বাঁধিব তোমায় বিরহ ডোরে পর্ব-০৩

0
530

#বাঁধিব_তোমায়_বিরহ_ডোরে
#রিয়া_জান্নাত
#পর্ব_০৩

“ ইশমাম আমি মনে হয় মারা যাব। আমি আর এই যন্ত্রণা কুলাইতে পারছিনা। তোমার সঙ্গে পথচলা বোধহয় আজকেই শেষ ইশমাম। সারাজীবন তোমার সঙ্গে থাকার অঙ্গীকার করেছিলাম। কিন্তু আজকে আমার শেষদিন চলে এসেছে। আমাকে ক্ষমা করিও ইশমাম, মনের অজান্তেই কোনো আ’ঘা’ত করে থাকলে। ”

“ প্রিয়া তুমি ছটফট করিও না, এইতো হসপিটালের কাছাকাছি চলে এসেছি। আমাদের বাবু ও তুমি সুস্থ থাকবে। মরার কথা ভূলেও বলবে না। আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না। আমাদের বাবুর তোমার দরকার প্রিয়া। কথা ছিলো একটা ফুটফুটে মেয়ে আমার কোলে দিবে। মেয়েটির নাম রাখবো রাহা। অযথা এসব ভেবো না, আমার ভয় করছে খুব। ধৈর্য ধরো আরেকটুখানি। ”

“ ইশমাম তুমিতো বাবু চেয়েছিলে, আমি তোমাকে বাবু দিচ্ছি। ইশমাম আমার অনুপস্থিতে আমাদের বাবুর কোনো অবজ্ঞা করবে না। তাকে নতুন মা এনে দিবে! তার অযত্ন করবে না। কথা দাও ইশমাম। ”

প্রিয়ার কথা শুনে ইশমাম কেঁদে ফেলে। প্রিয়াকে এই অবস্থায় দেখতে পারছিলো না। চোখের কোনায় পানি জমে যায়। দুফোঁটা চোখের পানি প্রিয়ার মুখে ফেলে। প্রিয়া হাত উঁচু করে ইশমামের চোখের পানি মুছে দেয়। এরপরে ইশমাম কে বলে প্রসব বেদনা এতো কষ্টের আগে যদি জানিতাম। যতন করা ভালোবাসাগুলো আগে আগেই প্রকাশ করতাম। আমাকে ক্ষমা করো, ক্যানো জানি মনে হচ্ছে আজকে আমি হেরে যাব। ইশমাম নিজের মনকে শক্ত করে আল্লাহকে বলে,,

❝ ভালোবাসিলাম দুজন দুজনে প্রসব যন্ত্রণা দিলেন কেনো প্রিয়াকে। কিছু যন্ত্রণা আমাকে দিন। মরিলে একসঙ্গে মরিবো বাচিলে জয় করবো দুজনে এই যন্ত্রণাকে ❞

ইশমাম ড্রাইভারকে বলে, ড্রাইভার গাড়িটা দ্রুত চালান। প্রিয়ার কষ্ট দেখতে পারছিনা।
“ জ্বি! স্যার টানের উপর রাখছি। ”

এমন সময় ইশমামের কানে ইনিয়ার গোঙানির আওয়াজ আসে। ইশমাম ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বলে। ড্রাইভার গাড়ি থামায়। তা দেখে প্রিয়া বলে গাড়ি থামাতে বললে ক্যানো?

প্রিয়া আমি কোনো মেয়ের গোঙানির আওয়াজ পেলাম। তুমি একটু স্থির থাকো আমি শুধু বাইরে যাব আর আসবো। প্রিয়া বলে যাও। ড্রাইভারকে সঙ্গে করে নিয়ে গোঙানির আওয়াজের দিকে যায় ইশমাম।দেখতে পায় ইনিয়াকে। রাস্তাজুড়ে রক্ত দিয়ে ভেসে যাচ্ছে। ইশমাম দ্রুত ইনিয়ার নাকে দুই আঙুল রাখে। দেখতে পায় নিঃশ্বাস চলছে। ইশমামের বুঝতে বাকি রইলো না ইনিয়ার সঙ্গে কি হয়েছে? একদিকে নিজ স্ত্রী প্রসব যন্ত্রণায় ছটফট করছে, অন্যদিকে এই মহিলা প্রসব যন্ত্রণায় লুটোপুটি খেয়ে পড়ে আছে।

“ ড্রাইভার বললো স্যার ম্যাডাম আর এই ভদ্রমহিলার সেইম কেইস কি করবেন? ”
“ এনার স্বামীর কি কোনো আক্কেল নাই? ”
“স্যার আমার মনে হচ্ছে এই মহিলার স্বামী হয়তো এই মহিলাকে এই অবস্থায় রাস্তায় ফেলে রেখেছে। আমাদের কেটে পড়া উচিত ”
“ তুমি কি মানুষ? কথা না বলে এই মহিলাকে ধরো। গাড়িতে তুলে নিয়ে যাই। যা হবার হবে। সবার আগে আমাদের কাছে মানবধর্ম। পরে দেখবো এর পিছনের কাহিনী কি? ”

ড্রাইভার বাধ্য হয়ে ইনিয়ার দুহাত ধরে। ইশমাম দু পা ধরে ঝুলিয়ে নিয়ে গাড়িতে তোলে? যেয়ে দেখতে পায় প্রিয়া সেন্স হারিয়ে ফেলছে। ইশমাম প্রিয়া প্রিয়া বলে ডাকা শুরু করে, কিন্তু প্রিয়ার কোনো সাড়া পায়না। ড্রাইভার দ্রুত গাড়ি চালিয়ে হসপিটাল আসে। হসপিটালে ঢুকে ডক্টর ডক্টর বলে চিৎকার করে। নার্সরা দৌড়ে এসে বলে কি হয়েছে স্যার? ইশমাম বলে আমার স্ত্রী প্রিয়া প্রসব যন্ত্রণায় সেন্স হারিয়ে ফেলছে? নার্স বলে আপনার দুই বউ স্যার। দুজনের একইদিনে বাচ্চা হবে? ইশমাম রেগে যায় নার্সের উপর। চিৎকার করে বলে আপনাকে কে বলেছে আমার দুইবউ? আপনারা বড্ড কথা বলে সময় নষ্ট করেন। গাইনী ডক্টর কই? স্যার ডেলিভারি চলছে? এতো বড় হসপিটালে ডক্টর কি একজন? না স্যার ব্যবস্থা করছি। ইমারজেন্সিতে পাটাচ্ছি। কথা শেষ করে নার্স ইনিয়া ও প্রিয়াকে ইমারজেন্সিতে নিয়ে যায়। ইশমাম ফ্লোরে বসে মাথায় হাত দিয়ে প্রিয়া প্রিয়া বলে চিৎকার করে। ইশমামের চিৎকারে একজন নার্স এসে বলে স্যার এখানে চিৎকার চেঁচামেচি করবেন না। পেসেন্ট কে এডমিট করাবো নামগুলো বলেন?

“ আমার স্ত্রী নাম প্রিয়া মির্জা ”
“ আপনার কি নাম? ”
“ ইশমাম মির্জা! ”
“ আপনার দ্বিতীয় স্ত্রীর নাম কি? ”

নার্সের এই কথা শুনে ইশমাম ভ্যাবাচ্যাকা খায়। ইশমাম বলে এক্সকিউজ মি।
“ জ্বি স্যার নামটা দ্রুত বলেন। পরবর্তী কাজ দ্রুত করতে হবে আমাদের। ”

ড্রাইভার হুট করেই পাখি নাম বলে। নাম শুনে নার্স বলে কি দারুণ মিল নাম দুইটার মধ্যে। এই প্রথম এরকম কোনো কেইস পেলাম আমরা। যেখানে দুইবউ একইদিনে ডেলিভারি হচ্ছে। নামের দারুণ মিল। আজকাল কার যুগে সতীন নিয়ে এভাবে সংসার করা সত্যিই প্রসংশনীয়। স্যার আপনি সম্ভবত তাদের অনেক ভালোবাসেন।

নার্সের কথা শুনে ইশমামের মাথায় বাজ পড়ে। মনেমনে বলে কি হচ্ছে এসব। এরা না জেনে অযথাই এসব বলছে। এদের এখন আমার কি বলা উচিত? ড্রাইভারের দিকে তাকায় ইশমাম। ড্রাইভার ইশারা করে হাতজোড় করে চুপ থাকতে।

ইশমাম রাগ করে নার্সকে বলে বড্ড ভাট বকেন আপনারা। আপনাদের কাজ হয়ে গেলে এখান থেকে যেতে পারেন। আমার স্ত্রীর কি অবস্থা দ্রুত জানান।

নার্সটি বলে উঠে দেখলাম পাখি ম্যামের ব্লেডিং হচ্ছে? আচ্ছা ওনি কি পড়ে গেছিলো?
” ইশমাম চোখ বড়বড় করে চিৎকার করে বলে আমি কিভাবে জানবো? ”

এমন সময় ইমারজেন্সি থেকে ডক্টর বের হয়। নার্সকে ডাক দেয়। নার্স ডক্টরের কাছে যায়। ডক্টর নার্সকে জিজ্ঞেস করে এই মূহুর্তে ডেলেভারি রুমে দুজন পেসেন্ট এসেছিলো ওনাদের নাম কি?
“ প্রিয়া মির্জা, পাখি মির্জা! “
“ যেই পেসেন্টের ব্লেডিং হচ্ছিলো না তার নাম কি? ”

ইশমাম এই কথা শুনে দ্রুত ছুটে এসে বলে আমার স্ত্রী নাম প্রিয়া? আমার স্ত্রী সুস্থ আছে ত ম্যাডাম?
“ ডক্টর মুখটা করুণ করে বলে স্যরি স্যার ওনাকে এখানে আনার আগেই মৃত্যুবরণ করেছে। সি ইস ডেড। আপনাদের বাচ্চা টা পেটে মরে গেছিলো। ”

ইশমাম এই কথা শুনে মুখের ভাব সিরিয়াস করে বলে আপনারা ফান করছেন কেনো? আমার স্ত্রী তো গাড়িতেই কথা বলছে আমার সঙ্গে। বলুন না প্রিয়া ও আমার বাচ্চা সুস্থ আছে।
” স্যরি মিস্টার এসব বিষয় নিয়ে ডক্টর কখনো ফান করেনা। একটুপর লাশকে বের করে দিচ্ছি নিয়ে যাইয়েন। এই কথা শেষ করে নার্সকে জিজ্ঞেস করে পাখির বাড়ির কেউ আছো? ”

নার্স বলে এনারাই ত এনেছে ম্যাম। স্যারের দ্বিতীয় স্ত্রী পাখি মির্জা।
” ও আচ্ছা অভিনন্দন স্যার । আপনার একটি মেয়ে বাচ্চা হয়েছে নর্মালে ডেলিভারিতে । কিন্তু পেসেন্টের অবস্থা সিরিয়াস। প্রচুর ব্লেডিং হওয়ার কারণে মিসেস পাখি এখন রক্ত শূন্যতায় ভুগছে। এই মূহূর্তে ও পজেটিভ রক্ত না পেলে আপনার দ্বিতীয় স্ত্রীও মারা যেতে পারে। দ্রুত ও পজেটিভ ব্লাড তিন ব্যাগ ম্যানেজ করেন। ”

ইশমাম চিৎকার করে বলে ও আমার স্ত্রী নয়। আমার তো একটা মাত্র বউ। প্রিয়া শুধু আমার বউ। কোনো পাখি টাকি আমার বউ নয়। বলেন না ডক্টর প্রিয়া বেঁচে আছে! আমার বাচ্চা সুস্থ আছে।
“ আপনার বউ মিসেস মির্জা বাচ্চা নিলে লাইফ রিস্ক ছিলো। কিন্তু ওনি বোধহয় আপনাকে খুশি করার জন্য বাচ্চা নিয়েছিলো। কিন্তু লাইফ রিস্ক তো ঘটে গেলো? আমাদের ক্ষমা করবেন। আমাদের হাতে কিছু ছিলোনা স্যার। আমরা শুধুমাত্র পেসেন্টকে সেবা দিই। সুস্থতা,মৃত্যু, নতুন জীবন সবইতো আল্লাহর হাতে। ”

“ ইশমাম ফ্লোরে হাঁটু ভাজ করে বসে রইলো। এরপরে চিৎকার করে বললো আমি ত তোমাকে ভালোবাসি প্রিয়া। আমাকে খুশি করার জন্য নিজের সঙ্গে এমন করলে কেনো? আমিতো জানতাম না বাচ্চা নিলে তোমার লাইফ রিস্ক হবে। তুমিতো একাই একাই ডক্টরের কাছে আসতে! আমাকে এরজন্য তুমি সঙ্গে করে নিয়ে আসতা না! বাবা হওয়ার থেকে তুমি যে আমার কাছে কতোটা প্রিয় তুমি জানতে না? এখন আমি তোমাকে ছাড়া থাকবো কি করে? এই নিষ্টুর পৃথিবীতে তুমি আমাকে একা করে চলে গেলে কেনো? ”
“ ড্রাইভার এসে ইশমামের কাঁধে হাত রাখে। স্যার শান্ত হোন। ”

“ ইশমাম ড্রাইভারের কথা কানে না নিয়ে ছুটে যায় ইমার্জেন্সিতে। ইমারজেন্সিতে এসেই এক বাচ্চার কান্নার আওয়াজ আসে কানে। ইশমাম ছুটে যায় এইতো আমার বাচ্চা। বাচ্চাটিকে কোলে তুলে নেয়। এরপরে বাচ্চাটিকে বলে ডক্টর মিথ্যা বলছে তাইনা বাবু। এইতো পাপা চলে এসেছে কান্না করিও না বাবু। বাচ্চাটি কোল পেয়ে চুপ করে যায়। ইশমাম ধীরে ধীরে প্রিয়ার দিকে এগিয়ে যায়। মুখের উপর থেকে কাপড়ের ঢাকনা সরিয়ে বামহাত দিয়ে প্রিয়ার মুখ নাড়ে। এরপরে বলে এই প্রিয়া তুমি ঘুমাচ্ছো? তুমি ক্লান্ত তাইনা। ডক্টর মিথ্যা বলছে তাইনা। এইতো আমাদের মেয়ে রাহা। কত মিষ্টি দেখতে হয়েছে তাইনা। ”

এমন সময় ডক্টর ইমারজেন্সিতে প্রবেশ করে চিৎকার করে নার্সদের। নার্সদের একজন ছুটে এসে বলে,,
“ জ্বি ম্যাম বলুন! ”
“ আপনারা ঠিকঠাক মতো ডিউটি করেন না? ইনি এখানে প্রবেশ করলো কিভাবে? এনাকে বের করুন। ”

ইশমাম ডক্টরের চিৎকার শুনে মুখ ঘুড়িয়ে বলে চুপ করুন ম্যাম। আমার প্রিয়া ঘুমাচ্ছে। প্রিয়ার ঘুম খুবই পাতলা। আপনারা এভাবে চিৎকার করলে প্রিয়ার ঘুম ভেঙ্গে যাবে।
“ ডক্টর বলে উঠে, হাজার চিৎকার করলেও আপনার বউ আর ঘুম থেকে উঠবে না। বিকজ্স সি ইস ডেড। ”

“ চুপ! আপনি ডক্টর হয়ে কিভাবে মিথ্যা কথা বলেন? এইতো আমার মেয়েবাবু হয়েছে। আমাদের রাহা আমার কোলে রয়েছে! ”

“ সদ্য স্ত্রী হারানোর শোকে পা’গ’ল হয়ে গেছেন? এইটা প্রিয়ার বাচ্চা নয়, পাখির বাচ্চা। আর পাখি মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে। দ্রুত তিনব্যাগ রক্ত ডোনেট না করলে আপনার দ্বিতীয় স্ত্রীও রক্তশূন্যতায় ভূগে মারা যাবে। ”

#চলবে,,,

আসসালামু আলাইকুম। ভূল ত্রুটি মার্জনীয়।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে