#বাঁধিব_তোমায়_বিরহ_ডোরে
#রিয়া_জান্নাত
#পর্ব_০২
❝ নিমুর ঠোঁ’টে চুমু দেয় জুনায়েদ। ঠান্ডা হাতদিয়ে নিমুর তুলতুলে নরম গালে আলতো ভাবে ধরলো জুনায়েদ। এরপরে বললো আমি তোমাকে হৃদয়ের রাণী করে রাখবো নিমু। নিমু তপ্তশ্বাস ছেড়ে বলে কিন্তু ইনিয়া আফার কি হবে? ❞
” ছাড়ো ত ওর কথা। আমি তোমাকে ভালোবাসি নিমু। মানুষ কি দুইবউ নিয়ে সংসার করেনা! আমিও দুইবউ নিয়ে সংসার করবো। ”
” নিমু মুখটা ভারী করে বলে, বিয়ে করার সময় এমন কথা ছিলো না জুনায়েদ। আমাকে আলাদা একটা সংসার দিতে চেয়েছিলে বলেই বিয়েতে রাজি হয়েছি আমি। ”
” এসব নিয়ে ভেবোনা নিমু। জুনায়েদ তার কথা রাখে। নিমু বেডে থাকা জুনায়েদের শার্টটা এনে দিলো। এরপরে জুনায়েদকে পড়তে বললো। জুনায়েদ মৃদু হেসে বললো তাড়িয়ে দিতে চাইছো? আমার কিন্তু এখনো বাসর বাকি রয়েছে। ”
” নিমু বিরক্ত প্রকাশ করে বললো আর কত করবে বাসর? প্রাক্তনের খোঁজ নিতে হবেনা? ”
এমন সময় দরজায় কড়া নারলো আলম দারোয়ান। স্যার আসতে পারি? আলমের গলার শব্দ শুনে জুনায়েদ রুমের বাইরে এসে বললো,,
” কি হয়েছে আলম? আজকে সোজা উপরে চলে এলে যে! ”
” স্যার, আমারতো ডিউটি শেষ। সাঝ নেমে এসেছে। ইনিয়া ম্যাডাম বাইরে বের হওয়ার সময় আমাকে একখানা চিঠি দিয়ে গিয়েছিলো। এই চিঠি দেওয়ার জন্যই উপরে চলে এসেছি। ক্ষমা করবেন নিজের সীমা লঙ্ঘন করে অনুমতি না পেয়েই উপরে আসার জন্য ”
” ইনিয়া বাইরে গিয়েছে! কিন্তু ক্যান গিয়েছে? এই সময়টা বাইরে যাওয়া উচিত নয়, তুমি জানো না। আমাকে তো ডাকতে পারতা আলম। ”
” ক্ষমা করবেন। আমি মনে করেছিলাম আপনি ম্যাডামকে দেখতে না পেয়ে একাই নিচে আসবেন। কিন্তু,আপনি তো নিচে আসলেন না। আর আপনাকে ডাকার দুঃসাহস ও আমার নাই। ”
” আচ্ছা ঠিক আছে। তুমি চলে যাও । ”
আলম চলে যায়। নিমু নিজের কাপড় ঠিক করে বাইরে আসে। জুনায়েদ কে বললো আলম ক্যান উপড়ে এসেছিলো জুনায়েদ? আর তোমার হাতে এইটা কিসের কাগজ?
” ইনিয়ার চিঠি। ”
” চিঠি ক্যান? আফা কই গেছে ”
” জানিনা। ”
” চিঠিটা খুলো তো। ”
” জুনায়েদ চিঠিটা খুললো। ”
প্রিয় শখের পুরুষ,
চিঠিটা যখন হাতে পেয়েছো, তখন আমি তোমার থেকে অনেক দূরে চলে গেয়েছি । নিজের চোখজোড়াকে আজ বড়ই ন’ষ্ট করতে ইচ্ছে করতেছিলো। যখন দেখলাম তুমি আমার সামনে নিমুকে বিয়ে করে বুকে টেনে নিয়েছো? মানুষ এতো নোংরা কিভাবে হয় জুনায়েদ? কিভাবে এতো তাড়াতাড়ি ভূলে গেলা আমাদের তিনবছরের সম্পর্ক? কিভাবে পারলা আমার দুধের বাচ্চার সঙ্গে প্রতারণা করতে। অবশ্য আমি সেদিন আভাস পেয়েছিলাম। যেদিন নিমু শর্ট ড্রেস পড়ে তোমার গায়ে ঢলেঢলে পড়তেছিলো। মানা করতে যেয়েও করতে পারিনি । কারণ আমার মনে এতো নোংরা চিন্তা ভাবনা আসছিলো না। ভেবেছিলাম কাজের মাধ্যমে মজার ঢলে বোধহয় এসব হচ্ছে। বোন হয়ে কিভাবে এতো ছোট্ট নজরে তোমাদের দিকে তাকাই বলোতো? কারন হলো আমি ভাবতেই পারিনি নিমু আমার সংসার ভাঙ্গনের কারণ হবে। ইসলামি শরীয়তে বড় বোন জীবিত থাকা অবস্থায়, যদি আমার হাসবেন্ড ;আমার ছোটবোনের সঙ্গে অবৈধ মেলামেশা বা বিয়ে করে তাহলে প্রথম স্ত্রী অটোমেটিক তালাক হয়ে যায়। আমি তোমার তালাক প্রাপ্ত স্ত্রী এখন। আমার সাজানো সংসার আমার বোনের হাতে তুলে দিলাম। আমার অনাগত দুধের বাচ্চাকে নিয়ে দূরে কোথাও চলে গেলাম। কারণ আমার বাচ্চা যখন বড় হয়ে জানতে পারবে তার বাবা একজন দুঃচরিত্রবান। তখন পারবে সন্তানের কাছে নিজের কুকীর্তি লুকাতে,নিজের মুখ দেখাতে । আমি চাইনা তুমি ছোট্ট হও আমাদের বাচ্চার কাছে। ভালোবেসেছিলাম তোমাকে বুকভরা ঘৃণা নিয়ে চলে গেলাম তোমার সংসার থেকে।
ইতি তোমার
❝ ইনিয়া ❞
চিঠির কথাগুলো পড়ে জুনায়েদ ভেঙ্গে পড়ে। সোফায় বসে নিমুকে বলে ইনিয়া চলে গিয়েছে নিমু।
নিমু মনেমনে বলে এইতো চেয়েছিলাম আমি। অবশেষে এই সংসার পারম্যান্টেলি আমার হবে জুনায়েদ শেখের সমস্ত সম্পত্তির মালকিন এখন নিমু রহমান।
জুনায়েদ মনেমনে বলে ইনিয়া আমি চেয়েছিলাম তুমি আমাকে ঘৃণা করো। অবশেষে আমি সাকসেসফুল। কিন্তু এতো জ্বলদি যে সবকিছু সাকসেসফুলি হবে ভাবতেও পারেনি। তবে কি আমার বাচ্চাকে আমি ভূমিষ্ট হতে দেখতে পারবো না। কোলে নিতে পারবো না? আদর করতে পারবো না।
____
আমাকে দিয়ে কি করবেন আপনারা ? দেখেন আমি একজন অসহায় গর্ভবতী মহিলা। কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। আমাকে ছেড়ে দিন। আমার দুধের বাচ্চা ও আমাকে নতুন ভাবে বাঁচতে দিন। ইনিয়ার এসব কথা শুনে লোক তিনজন অট্টহাসি দিয়ে উঠে। একজন বলে দেখ ম্যাডাম কি বলছে? ওনাকে ছেড়ে দিতে। বল ওনাকে কি ছেড়ে দেওয়া যায়? তাদের মধ্যে একজন উত্তর দিয়ে ফেললো। বললো, ম্যাডামকে আমাদের লাগবে না। ম্যাডামকে বল ভালোই ভালো যেনো ম্যাডামের সমস্ত শরীরে গহনা আমাদের হাতে তুলে দেয়। গহনা হাতে তুলে দিলে ম্যাডামকে আমরা কিছু করবো না। কারণ এই গর্ভবতী মহিলার সঙ্গে আর বা কি করা যায়।
” ইনিয়া আমতাআমতা স্বরে বলে ভাই আমাকে ছেড়ে দিন। আমার বাচ্চাকে জগতের আলো দেখাতে চাই। এর বিনিময়ে আপনাদের যা লাগে নিয়ে নেন! দয়া করুন আমাকে। ”
” তাহলে আপনার শরীরের সমস্ত গহনা খুলে ভালোই ভালো আমাদের হাতে দিয়ে দেন। ”
ইনিয়া অসহায়ের মতো ছটফট করে নিজের শরীরে যা যা গহনা ছিলো খুলে লোক তিনজনকে দিয়ে দিলো। শুধু অনামিকা আঙুলে একটি স্বর্ণের রিং আর গলায় একটি স্বর্ণের চেইন রেখে দিলো। তা দেখে লোক তিনজন বললো,,
“ ম্যাডাম আংটি আর চেইনটা রাখলেন কেনো? ”
“ দেখুন ভাই এই দুইটা জিনিস আমি দিতে পারবো না ”
” ক্যান দিতে পারবেন না? দেখুন নিজের বাচ্চা ও নিজেকে বাঁচাতে চাইলে ওই জিনিস দুখানা দিয়ে দেন ”
“ দেখুন ভাই চেইনটা আমার মৃত্যু মায়ের শেষ চিহ্ন। মরার সময় মা আমাকে হাতে দিয়ে বলেছিলো যখন আমাকে মনে পড়বে এই চেইন টা হাতে নিয়ে দেখবি, আমি তোর সামনে চলে আসবো। এই চেইনটাতে আমার মায়ের গন্ধ মেখে আছে। ছয়বছর বয়সে আমি আমার আম্মাকে হারিয়েছে। দয়া করুন আমার আম্মার শেষ স্মৃতি আমার থেকে বিচ্ছিন্ন করবেন না। ”
“ আর আংটি টা দিতে পারবেন না কেনো? ”
“ এইটা, এই.. এই.. টা হলো আমার ভালোবাসার চিহ্ন। প্রথম যখন জুনায়েদের সঙ্গে আমার বিয়ে হয় তখন এই উপহার টা প্রথমরাতে তার থেকে পেয়েছিলাম। সে তো আমার কাছে নেই এখন। তার শেষ স্মৃতি টা বিচ্ছিন্ন করতে চাইনা ”
“ তা ম্যাডাম আপনার পেটটা তো ফুলিয়ে দিছে আপনার সেই নাগর। ওইটা নিয়ে হ্যাপি থাকেন না। আংটি লাগে ক্যান? ”
“ দেখুন ভাই যা চাইলেন সবতো দিলাম। নিজের বোন মনে করে আমায় নাহয় এই দুটি জিনিস দিয়ে দিলেন। ”
“ এই ভালো কথায় কাজ হবেনা। ধর ম্যাডাম কে। ”
ইনিয়ার সঙ্গে ধস্তাধস্তি করে তিনজন মিলে। ইনিয়া হাফিয়ে যায় তিনজনের সঙ্গে না পেরে। চিৎকার করে কেউ আছেন? হেল্প! হেল্প!
লোক তিনজন বলে এই চিৎকার করছে রে তাড়াতাড়ি জিনিস দুটি নে নাহলে লোকজন আসলে ক্যাচাল হয়ে যাবে। ধস্থাধস্তিতে ইনিয়ার পেটে আঘাত লাগে। ইনিয়া পড়ে যায় রাস্তায় ব্লেডিং হতে থাকে। লোক তিনজন ঘাবড়ে যায় ইনিয়াকে এইভাবে দেখে। এরপরে লোক তিনজন বলে চল পালাই। মহিলা মারা গেলে কেলেঙ্কারি কান্ড ঘটবে। এই বলে লোক তিনজন পালায়।
ইনিয়ার পেটে প্রচন্ড ব্যাথা হয়। ইনিয়া চিৎকার করে আল্লাহ আমাকে বাঁচান। আমার বাচ্চাকে বাঁচান। কেউ আছেন হেল্প! হেল্প! কারো কোনো সাড়া পায়না রাস্তায়। কারণ মেইন রাস্তা থেকে এই রাস্তা অনেক দূরে। তাইতো লোকজনের চলাচল কম এই রাস্তায়। ইনিয়া পেটের ব্যাথায় রাস্তা থেকে উঠার চেষ্টা করে। কিন্তু উঠতে পারেনা রাস্তা থেকে। প্রচুর ব্লেডিং এ রাস্তা ভিজে যাচ্ছে রক্ত দিয়ে। ইনিয়া এই বেদনা সহ্য করতে পারছিলো না। চোখের কোণের পানিগুলো গাল বেয়ে টপাটপ পড়ছিলো। ইনিয়া দুহাত দিয়ে মাটি খোঁজার চেষ্টা করছিলো। কিন্তু কোনো মাটি পাচ্ছে না, কারণ রাস্তাটা পাকা। কিছুতেই ভর করে শক্তি দিতে পারছিলো না। এমতাবস্থায় ইনিয়া মনে করলো আজ বোধহয় এই পৃথিবী থেকে তার শেষ হওয়ার দিন। এসব ভাবছে আর চোখ দিয়ে অনবরত পানি ফেলছে। রাস্তা রক্ত দিয়ে ভেসে যাচ্ছিলো। ইনিয়া আল্লাহকে ডাকতে শুরু করলো, হে আল্লাহ কি পাপ করেছি আমি? কিসের জন্য আমাকে এতো শাস্তি দিচ্ছেন। একটু বুঝ হওয়ার বয়সে আমার থেকে আমার আম্মাকে কেড়ে নিয়েছেন! চৌদ্দটা বছর সৎ মায়ের জ্বালা যন্ত্রণা সহ্য করেছি। যেই আমার কপালে একটু সুখ আসলো আপনি কেড়ে নিলেন। আমার বাচ্চাকে আমি পৃথিবীর আলো দেখাতে চাই। এক পযার্য়ে ইনিয়ার শক্তি একদম নুইয়ে যায়। প্রসব বেদনার কষ্ট নিতে পারছিলো না ইনিয়া। ইনিয়া আর শক্তি দিতে পারছিলো না। শুধু মুখ দিয়ে গোঙানির আওয়াজ করতে লাগলো।
ইনিয়ার চোখে পৃথিবীকে নিষ্ঠুর লাগলো। চোখে ভেসে উঠলো ইনিয়া ও জুনায়েদের প্রথম রাতের কথা। জুনায়েদ ইনিয়ার মুখ থেকে ঘোমটা তুলে বললো আমার ঘরে চাঁদ এসেছে। আর এই চাঁদের মালিকটা আজ থেকে আমি। দেখি প্রেয়সী তোমার হাতখানা। ইনিয়া দুহাত এগিয়ে দিলে, জুনায়েদ বামহাতের অনামিকা আঙুলে আংটিখানা পড়িয়ে দিয়ে চুমু দেয় হাতে। ইনিয়া লজ্জা পেয়ে কেঁপে উঠে। জুনায়েদ বুঝতে পেরে ইনিয়ার নরম তুলতুলে দুই গালে হাত দিয়ে চেপে ধরে বলে লজ্জা ক্যান প্রেয়সী? হাসবেন্ড হই তোমার আমি, আমার ভালোবাসার অধিকার আছে। ইনিয়া এই কথা শুনে চোখ নামিয়ে ফেললে। জুনায়েদ ইনিয়াকে বুকে টেনে নিয়ে বলে, আজকের পর কোনো লজ্জা নয় প্রেয়সী। তোমার সকল অপ্রাপ্তি এই জুনায়েদ প্রাপ্তি দিয়ে ভরিয়ে ফেলবে।
ইনিয়া প্রসব বেদনায় সময়ে এই কথাগুলো ভেবে যন্ত্রণার হাসি দিয়ে চোখমুখ বন্ধ করে ফেলে। আস্তেআস্তে বলে ভালো থেকো নিষ্ঠুর ভালোবাসা। বিরহ ডোরের শেষদিনটা বোধহয় এভাবেই লেখা। ইনিয়া চোখ বন্ধ করে ফেলে। মূহুর্তের মধ্যেই ইনিয়ার চোখে পৃথিবীর আধার ঘনিয়ে আসে। তবে কি ইনিয়া মারা যাচ্ছে?
#চলবে