বাঁধিব তোমায় বিরহ ডোরে পর্ব-০১

0
808

#বাঁধিব_তোমায়_বিরহ_ডোরে
#রিয়া_জান্নাত
#সূচনাপর্ব

❝ নিজের চোখের সামনে আমার হাসবেন্ড আমার ছোট বোনকে বিয়ে করে এনেছে । শুনেছি, ইসলাম ধর্মে নিজের আপন বোনকে বিয়ে করলে প্রথম স্ত্রী তালাক হয়ে যায়। তাহলে আমার এই অনাগত দুধের বাচ্চার কি হবে? নিজের বোনকে বাসায় রাখা যে আমার জন্য কাল হবে, তা আমি কস্মিনকালেও কল্পনা করেনি! ❞

” জুনায়েদ নিমুকে বুকে টেনে নিয়ে দুম করে দরজা লাগিয়ে দিলো, আমার চোখের সামনে। চোখ দিয়ে টপাটপ দু’ফোটা চেখের পানি গড়িয়ে পড়লো গাল বেয়ে । স্বামীর বুকে নিজের বোনকে এই অবস্থায় দেখে চোখ মানছিলো না। জুনায়েদকে কিছু জিজ্ঞেস করার শ্রবণ শক্তি হারিয়ে গেছে ইনিয়ার। মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের করতে পারছিলো না। মনে হচ্ছে বুকে কেউ পাথর চা’পা দিয়ে রেখেছে। পিটপিট করছে চোখের পাতা। পানি পড়ছে টুসটুস করে। বেশিকিছুক্ষণ এভাবে কেটে গেলো। অনেকক্ষণ পর ইনিয়া নিজেকে স্বাভাবিক করে ফেললো। ”

” আমার পেটে আমার বরের বাচ্চা একটু একটু করে বেড়ে উঠছিলো। নয় মাসের অন্তসর্তা স্ত্রী তার। এই সময়ে এসব কিছু দেখবো কল্পনাও করিনি। বাবা – মা আমার ভালোর কথা ভেবে আমার বোনকে আমার বাড়িতে পাঠিয়েছিলো। কিন্তু ফলাফল যে এরকম হবে ভাবতেও পারেনি। কিছুদিন যাবত জুনায়েদকে মাঝরাতে আমার পাশে পাচ্ছিলাম না। হয়তো এই সময়ে তারা আমার অনোগোচরে অ’বৈ’ধ সম্পর্কে লিপ্ত হতো । মাথা কাজ করছে না কি করবো এখন আমি? আমার অনাগত সন্তানকে নিয়ে দূরে কোথাও যাব নাকি এসব দেখেও না দেখার ভান নিয়ে বসে থাকবো! কিন্তু আমার বাচ্চা পৃথিবীতে আসলে তাকে কি জবাব দিব? তার প্রশ্নের উত্তর কিভাবে দিবো,তাঁকে কিভাবে বলবো তোমার বাবা একটি ল’ম্প’ট। আমার দূরে যাওয়াই উচিত। আমি চাইনা আমার অনাগত সন্তান দুঃচরিত্রবানের ছত্রছায়ায় মানুষ হোক। যেইভাবা সেই কাজ, ইনিয়া আস্তে আস্তে উঠে এক কাপড়ে নিচে নেমে আসে। দারোয়ান ইনিয়াকে এই অবস্থায় নিচে আসতে দেখে জিজ্ঞেস করে কোথায় যাচ্ছেন ম্যাডাম? এই অবস্থায় এভাবে নিচে আসছেন স্যার জানে তো! আপনার কিছু লাগবে ম্যাডাম, দেন আমি নিয়ে আসি।

” আলম ভাই যার সংসার টাই ন’ষ্ট হয়ে গেছে তার কি লাগবে, না লাগবে এসব না ভাবলেও চলবে। আলম ভাই এই নেন একটা চিঠি, আপনি খুলবেন না। আপনার স্যার যখন আমায় খুঁজবে তখন তার হাতে দিয়েন। আমি মার্কেট যাচ্ছি, আল্লাহ হাফেজ! ”

” আলম ইনিয়ার কথাগুলো ঠিকমতো বুঝতে পারলো না। তাই দায়িত্বশীল হয়ে বললো ম্যাডাম এই অবস্থায় এভাবে নিচে আসা ঠিক হয়নি। কিছু লাগলে আমাকে ডাকতে পারতেন, আমি এনে দিতাম। কিন্তু নিচে যেহেতু চলে এসেছেন স্যারের গাড়িটা নিয়ে যান। দাড়ান আমি ড্রাইভারকে কল করি। ”

” ইনিয়া মুচকি হেসে বললো আপনার স্যারের কোনোকিছু ব্যবহার করতে পারবো না। আমি চাইনা আমার অনাগতের জীবনে তার ছোঁয়া লাগুক। আমি রিকশা নিয়ে চলে যেতে পারবো। ”

” এই অবস্থায় রিকশায় উঠতে পারবেন? রিকশায় উঠতে হলে অনেক উঁচুতে পা উঠাতে হবে। তারচেয়ে গাড়ি নিয়ে যান। ”

” ইনিয়া ক’র্ক’শ স্বরে আলমকে বলে,, আপনি আপনার স্যারের কর্মচারী আপনার কাজ আপনার স্যারকে নিয়ে ভাবা আমাকে নিয়ে নয়। ”

“ আলম চুপসে যায়। মাথা নেতিয়ে থাকে। ইনিয়া গেইট থেকে বের হয়, এরপরে আলমকে বলে গেইট টা লাগাতে। আলম বাধ্য কর্মচারীর মতো গেইট লাগিয়ে দেয়। ইনিয়া একটা রিকশা ডাক দেয়। খুবই সাবধানতার সহিত রিকশাতে উঠে বলে মামা আমাকে জা’হা’ন্না’ম থেকে নিয়ে চলুন যেদিকে দু চোখ যায়। ”

“ রিকশাওয়ালা মামা ইনিয়ার কথা ঠিক বুঝতে পারলো না। তাই ইনিয়াকে প্রশ্ন করলো কোথায় যাবেন ম্যাডাম? হসপিটালে চেক-আপ করাতে যাবেন নাকি? কিন্তু এই অবস্থায় এভাবে যাওয়া ঠিক নয় ম্যাডাম। আপনাকে দেখে যথেষ্ট বড়লোকের স্ত্রী মনে হচ্ছে , তাহলে ডক্টর কল করে ডাকলেই তো পারতেন? ”

” মামা আপনাকে এভাবে ভাবতে বলছে কে? অন্য নারীর কেয়ার নিয়ে না ভাবলেও চলবে। আপনি আপনার স্ত্রীর দিকে এসব কেয়ারিং দৃষ্টিপাত রাখুন। ”

” কিন্তু আপনি কোথায় যাবেন? কোথায় নিয়ে যাব আপনাকে? ”

” কিছুক্ষণ স্থির থাকলো ইনিয়া। এরপরে ইনিয়া ভেবেচিন্তে দেখলো ইনিয়ার তো আসলেই কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। ইনিয়া আসলে কোথায় যাবে? এই অবস্থায় বাবার বাড়িতে যেতেও লজ্জা করছে ইনিয়ার। তাই ইনিয়া ভেবেচিন্তে ঠিক করলো সারাদিন রিকশা করে ঘোরবে। তারপরে ভেবে দেখবে আসলেই কোথায় যাওয়া উচিত ইনিয়ার। ইনিয়া রিকশাওয়ালা মামার হাতে হাজার টাকার একটি নোট দিয়ে বললো সাঝ নামার আগ পযর্ন্ত আমাকে নিয়ে এই শহরের অলি গলি ঘোড়বেন। ”

” ইনিয়ার এমন উত্তরে রিকশাওয়ালা খানিকটা ঘাবড়ে গেলো। তবুও কিছু না বলে রিকশা নিয়ে শহরের অলিগলি ঘোরা শুরু করলো। রিকশাওয়ালা মনেমনে আন্দাজ করে নিয়েছিলো হয়তো হাসবেন্ডের সঙ্গে ঝ’গ’ড়া করে এই মহিলা এভাবে বের হয়েছে। সাঝ নামলে রাগ কমবে তখন নিশ্চিত ঘরে ফিরবে। ”

❝ শহর জুড়ে উষ্ণতা। বিন্দুবিন্দু ঘাম ইনিয়ার ললাটে জমছিলো। একটুপর পর টিস্যু নিয়ে ঘামগুলো মুছছিলো। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ মৃদু বাতাসে চোখ লেগে যায় ইনিয়ার। ঘুমের ঘোরে ভাবনার জগতে হারিয়ে গেলো ইনিয়া। ❞

” বিয়ের প্রথমদিনে কিচেনরুমে সবজি কাটতে যায় ইনিয়া। সবজি কাটার বেখেয়ালে হাত কেটে ফেলে ইনিয়া। ইনিয়া আউচ বলে চিৎকার করে। ইনিয়ার চিৎকারে জুনায়েদ দৌড়ে আসে কিচেনরুমে। ইনিয়ার আঙুল কেটে রক্ত পড়তে দেখে পা’গ’ল প্রায় হয়ে যায় জুনায়েদ । জুনায়েদ ইনিয়াকে পাঁজাকোলে করে নিয়ে দ্রুত নিচে আসে। গাড়ির সিটে বসায় ইনিয়াকে। ইনিয়া ভ্যবাচ্যাকা খেয়ে প্রশ্ন করে…

” কি করছো জুনায়েদ ? ”
” তোমাকে কত করে বললাম কিচেনরুমে যেতে হবেনা। আমরা অর্ডার করে খেয়ে ফেলবো? কিন্তু তোমার জে’দে’র কারণে আজকে এই সিচুয়েশনের মুখোমুখি হতে হচ্ছে ? ”
” ইনিয়া মৃদু হেসে বলে পা’গ’ল হয়েছো তুমি। কতদিন অর্ডার করে খাবে? আমাকে বিয়ে করছো কেনো তাহলে? আমি যদি তোমাকে একটু রান্না করে না খাওয়াতে পারলাম? ”
” এই তোমার রান্নার চক্করে পড়ে আমার হৃদয় থেকে রক্তপাত হচ্ছে ! ”

” সামান্য কেটেছে। কিছুনা হবেনা ড্রেসিং করলে হয়ে যাবে। এরজন্য গাড়ি করে কোথায় নিয়ে যাচ্ছো? ”
” ডক্টরের কাছে। ”
” জুনায়েদ তুমি পাগল হয়েছো? এই সামান্য কাটার জন্য কেউ ডক্টরের কাছে যায়। ”
” কোনটা সামান্য কাটা? আমার হৃদয়ের রক্তপাত হচ্ছে। এটাকে সামান্য কাটা বলে উড়িয়ে দিবেনা। ”
” ইনিয়া জুনায়েদের চোখে ভালোবাসার ছটফট দেখে মূহুর্তেই নিজেকে নিয়ে নিজেই মনে মনে হাসে। ”

❝ ডক্টর! ডক্টর! ডক্টর! কোথায় আপনারা? আমার হৃদয়ের রক্তক্ষরণ হচ্ছে চিকিৎসা দরকার! ❞

নার্স এইভাবে জুনায়েদের ছটফট দেখে জিজ্ঞেস করে, কি হয়েছে স্যার?
” জুনায়েদ কপাল ভাজ করে বলে ডক্টর কোথায় নার্স? আমার ডক্টরকে প্রয়োজন! ”
” জুনায়েদের চিৎকারে নার্স কানচেপে ধরে বলে ডক্টর ওইদিকে স্যার? ”
” জুনায়েদ ইনিয়ার হাত ধরে দ্রুত ডক্টরের কাছে যায়। ইনিয়া হাফিয়ে যায় জুনায়েদের এতো কেয়ারিং আচরণে। ”
” ইনিয়া জুনায়েদকে বলে কি হচ্ছে জুনায়েদ? এরকম করছো ক্যানো? আমার সেরকম কিছু হয়নি তো! ”
” তুমি চুপ থাকো। ”

❝ ডক্টর ফোনে কথা বলছে। সুমন ডক্টরের কাছে যেয়ে বলে আমার স্ত্রীর হাত কেটে গেছে ডক্টর। আমার হৃদয়ের রক্তপাত বন্ধ করুন দ্রুত। ❞

ডক্টর বিরক্তি প্রকাশ করে বলে, কি সমস্যা আপনার দেখছেন না ফোনে কথা বলছি। সমস্যা হলে ইমার্জেন্সিতে যান। ডক্টর আবার ফোনে কথা বলা শুরু করে।

ডক্টরের এইরকম ব্যবহারে জুনায়েদ ডক্টরের কলার চেপে ধরে বলে, আপনি ডক্টর না আপনার কাজ হচ্ছে পেসেন্টকে সার্ভিস দেওয়া। পেসেন্ট আপনার দোরগোড়ায় আপনি ফোনে কথা বলছেন কোন আক্কেলে?
ইনিয়া পিছন থেকে জুনায়েদকে বলে জুনায়েদ ( করুণাময়ী স্বরে )
” জুনায়েদ ইনিয়াকে বলে তুমি চুপ থাকো। ”
” ডক্টর ফোন কেটে দেয়। এরপরে জুনায়েদকে বলে আসুন ইমার্জেন্সিতে।”

হঠাৎ রিকশাওয়ালার ডাকে ইনিয়ার ঘোড় কেটে যায়। ইনিয়া রিকশাওয়ালাকে বলে কি হয়েছে?
” ম্যাডাম সেই দুপুর থেকে আপনাকে নিয়ে শহরের প্রত্যক অলিগলি ঘোরলাম। সাঝ নেমে এসেছে প্রায়। এখনতো বলুন কোথায় যাবেন আপনি? ”
” ইনিয়া রিকশাওয়ালা মামাকে বলে আমারতো কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই? কই যাব আমি। ”
” ধুর ম্যাডাম আপনি একজন মহিলা দেখে সম্মানের সহিত এতক্ষণ ছিলাম। তারমধ্য এরকম অসুস্থ দেখে ভেবেছিলাম স্যারের সঙ্গে অভিমান করে বের হয়েছেন বাসা থেকে। অভিমান কমলেই বাসা ফিরবেন। এখন আপনি এসব বললে আমি আপনাকে কোথায় নিয়ে যাব? দয়া করুন ম্যাডাম আমাকে। এইবার আপনি নেমে পড়ুন আমার রিকশা থেকে। আমাকে মুক্তি দেন। আমি কোনো ভেজাল কাঁধে নিতে চাইনা। ”
” ইনিয়া রিকশা থেকে নেমে রিকশাওয়ালাকে স্যরি বললো। এরপরে রিকশাওয়ালাকে বললো আপনি চলে যান মামা। ”
” রিকশাওয়ালা খানিকটা অবাক হলো। কিন্তু মনেমনে রিলিফ ফিল করে রিকশা টান দিয়ে নিজের বাড়ির দিকে পথ বাড়ালো। ”

” ইনিয়া ল্যাম্পপোস্টের নিচে বসে পড়লো। মাথায় হাত রেখে কাঁদতে লাগলো। কিছুক্ষণের মধ্যে সারা শহরজুড়ে অন্ধকার নেমে পড়লো। ”

অনেকক্ষণ যাবত ইনিয়া একজায়গায় বসে আছে। একদল লোক ইনিয়াকে ফলো করছে। ইনিয়া বুঝতে পারলো। ইনিয়া বুঝতে পেরে উঠে পড়লো সেখান থেকে। এরপরে হাটা শুরু করলো সামনের দিকে। পিছন থেকে কিছু তিনজন লোক ইনিয়াকে ধাওয়া শুরু করলো। ইনিয়া অসুস্থ অবস্থায় দৌড়াতে শুরু করলো। পা চলছে না ইনিয়ার। লোকগুলো ইনিয়ার কাছে এসে ইনিয়াকে ঘীড়ে ধরলো।
” ইনিয়া আমতাআমতা স্বরে বললো, কি চাই আপনাদের? ”
“লোকগুলোর মধ্যে একজন বলে উঠলো আপনাকে! ”

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে