বাঁধনহারা পর্ব-০২ এবং শেষ পর্ব

0
408

#ছোটগল্প
বাঁধনহারা (অন্তিম পর্ব)
~আরিফুর রহমান মিনহাজ

– ভাত বরফ হয়ে গেছে। একটু বসেন। ইশটোভে বসাইলে দেরি লাগবো না।
আমি মৃদু আপত্তি করলাম। টিকল না। চটপট ভাত বসিয়ে দিল সে। বিদ্যুৎ চলে গেল। চার্জলাইট জ্বলল। আমার হাতে একটা হাতপাখা ধরিয়ে দিল। নিজে একটি নিয়ে ঘুমন্ত ছোটভাইকে বাতাস করতে করতে কপালের চুল সরিয়ে পা ভাঁজ করে বসল। চিন্তামগ্ন হয়ে বলল,
– ও ছাড়া পাবে তো?
আমি এবার কিছুটা বিরক্ত হলাম,
– তোমার নিজের শরীরে ওর আঘাতের অসংখ্য দাগ আছে না মরিয়ম? তুমি যদি চাও,ও শোধরাক তাহলে তার ছাড়া পাওয়া নিয়ে এতো পাগলামি করিও না। একটা শিক্ষা ওর হওয়া দরকার।
মরিয়ম বিষণ্ণ হয়ে চুপ মেরে গেল। কিছুক্ষণ পর গরম গরম ভাত পরিবেশন করল ও। সঙ্গে শুটকির তরকারি আর তেলাপিয়া মাছ। বললাম,
– তোমরা খেয়েছ?
– খাইয়া শুইছিলাম৷ এমনসময় পুলিশ…।
আমি আরকিছু না বলে খাওয়া শুরু করলাম। খেতে খেতে ভাবলাম নিয়তির কথা। মানুষের নিয়তি বড় অদ্ভুত বটে! কস্মিনকালেও কি ভেবেছিলাম ফ্লাইওভারের নিচে খাবার বিক্রি করা গম্ভীর মেয়েটির ঘরে এসে গরম গরম ভাত গিলব? আবার মনে হলো,আমি এখানে কেন? মরিয়ম আমার কে হয়? সে কেনই বা আমাকে এতো রাতে নির্মল মমতা মিশিয়ে ভাত রেঁধে খাওয়াচ্ছে? শুধু ভাইয়ের স্বার্থের জন্য? নাকি এই জনাকীর্ণ শহরে ওর ভরসার কেউ নেই বলে? এই একবছর ঘুরতেই আমি ওর কী এমন আপন হয়ে গেলাম? আমি আড়চোখে তাকালাম ওর দিকে; যেন আমার মস্তিষ্কজুড়ে উৎপাতরত এসব অযাচিত প্রশ্নের সন্ধানে…। মরিয়ম একহাতে নিরলসভাবে হাতপাখা ঘুরিয়ে যাচ্ছে। অন্যহাত মাথায় ঠেকিয়ে সর্বহারা ভঙ্গিতে বসে আছে। ওর তন্বী দেহ উন্নত ধনুকের মতো বেঁকে আছে। যদি চিত্রকর হতাম রংতুলির আঁচড়ে সাদা ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলতে পারতাম ওর এই নয়নরঞ্জন ভঙ্গিটি।
– ভাত দেব?
আমি ভেতরে ভেতরে চমকে উঠলেও বাইরে কাঠ হয়ে রইলাম। মাথা ঝাঁকিয়ে বললাম,
– দাও।
ভাত বেড়ে দিতে দিতে ও বলল,
– আপনে তো দুপুরে ভাত খান্না। বাইরে এটাসেটা খান প্রইত্তেকদিন। অসুখ একটা বাঁধলে?
আমি বিতৃষ্ণা নিয়ে বললাম,
– বাঁধলে বেঁচে যাই৷ এই একলা জীবনের ঘানি আর টানা লাগল না৷
অসন্তুষ্ট হয়ে ঠোঁটজোড়া সংকুচিত করে ফেলল মরিয়ম। পদ্মের মতো আয়ত চোখজোড়ায় ভেসে উঠল প্রচ্ছন্ন রাগ। মরিয়ম আহামরি সুন্দরী না। কিন্তু এই অভিব্যক্তিতে ওকে সুন্দর দেখাল। আচমকা ওর বৈশিষ্ট্যহীন চেহারার মায়াবী একটি দিক উন্মোচিত হলো যেন। আমি হেসে বললাম,
– আমার জন্য তোমার চিন্তার প্রয়োজন নাই মরিয়ম। আমার মতো মানুষদের জীবনে চিন্তার মানুষ থাকলেই বিপদ।– দাও, আরেকটু শুটকির তরকারি দাও। তোমার রান্নায় ঘরোয়া ঘরোয়া একটা ব্যাপার আছে। অনেকদিন পর—

৩.
নানা চেষ্টা তদবিরের পর মাসকয়েক পরেই মরিয়মের ভাই মাজেদ ছাড়া পেয়ে গিয়েছিল। অবশ্য, এযাত্রায় আমার জমানো টাকা থেকে বেশ বড় একটি অংক খরচ করতে হয়েছিল। মরিয়ম যখন পরিচিত মানুষদের কাছ থেকে ঋণের চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে অশ্রুপ্লাবিত মুখে আমার দুয়ারে এসে দাঁড়িয়েছিল তখন ওকে ফিরিয়ে দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভবপর ছিল? নির্দ্বিধায় এবং বিনাবাক্যব্যয়ে ওকে সাহায্য করবার কথা জানিয়েছিলাম। কৃতজ্ঞতায় নুয়ে পড়ে সে বলেছিল,
– যেভাবে হোক,আপনের টেকা আমি দিয়া দিব, ইসহাক ভাই।
আমি জানি মরিয়মের খরচ অনেক। এই টাকা শোধ করা ওর পক্ষে অসম্ভব প্রায়। আশ্বাস দিয়ে বললাম,
– তাড়া নেই মরিয়ম। তোমার যখন বড় রেস্তোরাঁ হবে? তখন না-হয় দিও। যদি না-ও হয় তবুও আমি দাবি রাখব না। চাপ নিও না।

জেল থেকে ছাড়া পাবার পর মরিয়মের অনুরোধে আর মাজেদকে চোখাচোখে রাখার জন্য আমার কনস্ট্রাকশন সাইটের কন্ট্রাক্টরকে বলে জোগালির কাজ ধরিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু এতে হলো আরেক বিপত্তি। আমার প্রতি কৃতজ্ঞতার প্রদর্শনীসরূপ হোক কিংবা পরিবার-পরিজনহীন বলে প্রচ্ছন্ন মায়ায় হোক— মরিয়ম প্রায়শই ভাইয়ের মাধ্যমে হটবক্সে করে দুপুরের খাবার পাঠিয়ে দিতে শুরু করল আমার জন্য। শুরুতে শুরুতে ব্যাপারটায় ভীষণ বিব্রত বোধ করলেও দিনে দিনে আমি যেন লোভী হয়ে উঠলাম। তক্কেতক্কে থাকতে শুরু করলাম কখন মরিয়মের ভালোবাসাময় খাবার আসবে। সপ্তাহে একটি দিন অন্তত মরিয়ম খাবার পাঠাবেই। মনে মনে খুশি হলেও প্রতিবারই আমার একটি কথা,
– মাজেদ, তোমার আপাকে বলবা এসব না করতে। এগুলা আমার পছন্দ না।
মাজেদ হাসে। ওর হাসি দুর্বোধ্য। মাদকের নেশা যেন ভয়ংকরভাবে ওর আত্মার সব নির্যাস সিঞ্চন করে ফেলেছে।
তবে দিন যত গেল,আমার লাজলজ্জা উবে গেল। বিপরীতে আমাদের মধ্যকার নামহীন সম্পর্কটা আরো সহজ-সাবলীল হতে শুরু করল। এতে অবশ্য কিছুটা সংকটও দেখা দিল। কারণ, খাবারের মানের কারণে হোক বা অন্যকারণে; মরিয়মের কাস্টমার হুহু করে বাড়তে শুরু করেছিল। যারফলে আশেপাশের ভ্রাম্যমাণ দোকানদাররা বিষয়টা হজম করতে পারছিল না। তারা মরিয়মকে নানাভাবে ধরাশায়ী করার তালে ছিল। এবং এরই ধারাবাহিকতায় আমার অবারিত উপস্থিতি এবং আমার সঙ্গে মরিয়মের সদাহাস্য ভাবের কারণে তারা মরিয়মের নামে প্রকাশ্যে অপবাদ রটাতে শুরু করল। যা কানেও শোনা যায় না,কলমেও লেখা যায় না। খবর পেয়েছি,এই নিয়ে মরিয়ম ইতোমধ্যেই ওদের সঙ্গে কয়েকদফা বচসায় লিপ্ত হয়েছে। শুনে মরিয়মকে বললাম,
– ওদের সঙ্গে ঝগড়া করা মানে পাগলামো,মরিয়ম। ওরা অশিক্ষিত। তুমি কিছুটা হলেও পড়াশোনা জানো। এখন তোমার আর ওদের মধ্যে তফাত কি থাকলো?
– তাইলে চুপ করে থাকমু?
মরিয়মের স্বর ছাইচাপা আগুনের মতো। দেখতে শীতল মনে হলেও আদতে গনগনে।
– কিছু সময় চুপ করে থাকাটাও সমাধান হতে পারে। এখন ওরা যে অপবাদ দিচ্ছিল সেটা ওরা বিশ্বাস করতে শুরু করবে। আরো জোরেশোরে প্রচার করবে।
মরিয়ম তেমনি চাপা গনগনে গলায় বলল,
– আমি চুপ থাকতে পারমু না। এগুলা আপনার শুনতে ভাল্লাগতে পারে। আমার লাগে না।
আমি আর কিছু না বলে তৎক্ষনাৎ বিদায় নিলাম৷ বুঝলাম, আজ মরিয়মের মাথা ঠিক নেই। থাকার কথাও না।
এরপর দিনসাতেক আমি ওমুখো হইনি। অষ্টমদিন সকাল সাতটায় মরিয়মের স্কুলপড়ুয়া ছোট ভাইটি একটা স্টিলের টিফিন-ক্যারিয়ার নিয়ে হাজির আমার মেসে। আমি চোখ কচলাতে কচলাতে সেটি গ্রহণ করলাম। ঘরে এসে সোৎসাহে খুলে দেখলাম, আমার পছন্দের ডিমওয়ালা পুঁটিমাছের ঝোল আর ভাত। একটি পাত্র খালি। সেখানে একটা পলিমোড়ানো ছোট্ট চিরকুট। চিরকুট খুলে দেখলাম গোটাগোটা অক্ষরে লেখা,

“ইসহাক ভাই, আপনারে কল করতে সাহস হইতেছে না। আপনি রাগ করছেন। আমি সেইদিন ওমনে বলতে চাইনাই। আমাকে মাপ করবেন। আপনি একবার একহাজার টাকা দিয়ে বলছিলেন ডিমঅলা পুঁটিমাছ খাবেন। ওইটা দিলাম। অনেক কষ্ট করে জোগাড় করছি। ”

৪.
এভাবেই আমার নিস্তরঙ্গ, একঘেয়ে জীবনতরী ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঊর্মি ভেঙে এগোচ্ছিল। কিন্তু কে বলেছে সমুদ্র সবসময় শান্ত থাকে? কে বলেছে কালান্তক জলোচ্ছ্বাস হানা দেয় না জীবনতটে? এরমধ্যেই একদিন খবর পেলাম চট্টগ্রামের বেশ নামকরা একটি কোম্পানিতে আমার চাকরি হয়েছে। বেতন যথেষ্ট ভালো। আগামী মাসেই জয়েনিং। সবকিছু হারিয়ে ফেলার হতাশায় নিজেকে আমি লক্ষহীন মানুষ বলে ভাবতে ভালোবাসলেও এই খবরে আমার অন্তর-পরিতোষের কারণে বুঝতে পারলাম মানুষ লক্ষহীন বাঁচতে পারে না৷ নিজের অবচেতনই প্রত্যেক মানুষ একটি লক্ষে এগিয়ে চলেছে। আমিও তেমনই৷ খুশির খবরে মিষ্টি খাওয়ানো দরকার। মেসের রুমমেইট, মরিয়ম আর তর্কসাপেক্ষে মাইশা ছাড়া আর কে আছে আমার কাছের মানুষ? রুমমেইটদের খাওয়ালাম। আমার মতো অমিশুক, অহংকারী বিদায় হবে বলে ওরা বোধহয় খুশিই হয়েছে৷ মরিয়মের কাছে গেলাম মিষ্টি নিয়ে। দারুণ ব্যস্ত সে। গরম তেলে বেগুনি ভাজছে, উলটে দিচ্ছে। কখনো আবার কাস্টমারের হাত থেকে টাকা নিয়ে ক্যাশে পুরছে। পাক্কা আধাঘন্টা পর অবসর মিললে অবাক হয়ে বলল,
– মিষ্টি ক্যান, ইসহাক ভাই?
– নতুন চাকরি হইছে। খাও।
মরিয়ম একটা মিষ্টির অর্ধেকটা মুখে পুরল হাসিমুখে। আমি ধীরে ধীরে বললাম,
– আগামী সপ্তাহেই চট্টগ্রাম চলে যেতে হবে।
ভুরু কুচকে ফেলল মরিয়ম,
– ক্যান?
– চাকরি তো ওখানেই।
– অহঃ
হঠাৎ যেন দপ করে নিভে গেল সে। ওর হাস্যময় চোখে আচমকা যেন মেদুর ছায়া নেমে এলো। প্রথমবারের মতো আমিও একটা অদৃশ্য টান অনুভব করতে লাগলাম এই শহরের প্রতি,এই জায়গাটির প্রতি,মরিয়মের প্রতি। সর্বোপরি আমার নিরানন্দ নিয়মতান্ত্রিক জীবনে মরিয়ম শরত-শিউলির শিশিরভেজা স্নিগ্ধতা নিয়ে এসেছিল। নিস্তরঙ্গ জীবনসমুদ্রকে তরঙ্গায়িত করেছিল। একবার ভাবলাম, থাক বড় চাকরি প্রয়োজন নেই,জীবনে সুখশান্তিই তো আসল। এই শহরে না চাইতেও নির্মল শান্তির যে উপলক্ষ পেয়েছি এমন আর কোথায় পাব? কিন্তু,মানুষ তো! উর্ধ্বে উঠার সোপান ছেড়ে কেইবা নিম্নগামী হতে চায়? আমিও চাইনি৷ মরিয়মকে বললাম,
– আমি মাঝেমধ্যেই আসব। তোমাদের দেখে যাব।
মরিয়ম নিঃশব্দে মাথা ঝাঁকায়। কয়েকজন কাস্টমার এসেছিল,ওদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সে। আমি কাঠগড়ার আসমানীর মতো ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে দেখতে লাগলাম ওর কার্যকলাপ৷ চিরাচরিত ভঙ্গিমায় কাজ করছে বটে ; কিন্তু ওর ঘাম চিটচিটে শ্যামল মুখে যেন কীসের ছায়া নাচছে! আমার ভেতরটা দুলে উঠল। নাহ,এই অসম মায়াডোর ত্যাগ করাই আমার জন্য উত্তম। কোনোরকম বন্ধন আমার জন্য নয়। আমি আর দাঁড়ালাম না। ফেরার পথ ধরলাম। এখান থেকে মেস অনেক দূর। হাঁটতে লাগলাম। আজ হাঁটব,যতক্ষণ না ক্লান্ত হই।

আমি আমার সিদ্ধান্তে চিরকালই অটল থেকেছি,এবারও তাই। অবশ্যম্ভাবী সবকিছু চিন্তা করেই চট্টগ্রামের কোম্পানি ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম,সুতরাং আর পিছু হটা অসম্ভব। যেদিন বাক্সপেটরা গুছিয়ে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম সেদিন বারবার বারণ করা সত্বেও মরিয়ম বাসকাউন্টার পর্যন্ত আমাকে এগিয়ে দিতে এসেছিল। ঘনায়মান দুঃখের পরিবেশটা হালকা করার জন্য বলেছিলাম,
– মন খারাপ করছ নাকি মরিয়ম? আমার জন্য রাঁধতে পারবে না বলে?
মরিয়ম বলল,
– না। আপনের ভালা চাকরি হইছে। এখন বিয়েশাদি করবেন। আমার আর চিন্তা নাই।
আমি ভেতরের ভাঙনটা লুকায়িত করার জন্য স্বভাববিরুদ্ধভাবে গলা ফাটিয়ে হেসে উঠেছিলাম,
– যা বললে মরিয়ম। আমাকে কে বিয়ে করবে? আমার মতো বাঁধনহারাকে?
এই প্রশ্নের জবাবের নিরুত্তর মরিয়ম। বাসে চড়লাম। কিছুক্ষণ পরেই বাস ছেড়ে দিল। বুকের ভেতরে যেন কালবোশেখী মেঘ গর্জাতে লাগল। পেছনে আনাগোনারত অসংখ্য মানুষের ভিড়ে মরিয়ম বজ্রাহতের মতো দাঁড়িয়ে রইল। আমি জানালার ফাঁক গলে হাত বের করে বিদায় জানালাম। চোখে পড়ল ওর পরনের বহুলব্যবহৃত জীর্ণ সেলোয়ার-কামিজের দিকে। মনটা বেজার হলো। যাওয়ার আগে একটা কাপড় তো ওকে উপহার দেওয়া যেত! ভাবলাম,পরেরবার এলে দেওয়া যাবে। কিন্তু হায়,কে জানতো এই দেখাই ছিল শেষ দেখা! কে জানতো, ওর এই শেষ বিচ্ছেদ-বিধুর চাউনি বাকিটা জীবন আমার বুকে তীরের মতো বিদ্ধ হয়ে থাকবে?

চট্টগ্রামে চাকরিতে যোগ দেওয়ার পর নিয়মিত বিরতিতে মরিয়মের সঙ্গে বেশ কয়েকবার ফোনালাপ হয়েছিল। এরপর হঠাৎ করে আমি টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মাসখানেক শয্যাশায়ী ছিলাম। দুর্ভাগ্য কাকে বলে— ফোনটাও এই-ফাঁকে চুরি গেল। সুস্থ হয়ে উঠার পরও মাসখানেক বিভিন্ন ব্যস্ততায় ওর সঙ্গে কোনো যোগাযোগ হয়ে উঠেনি। কিন্তু এরপর যোগাযোগ করতে গেলে ওকে পাওয়া গেল না। দিনকয়েক অনেক চেষ্টা করেও যখন কোনো মাধ্যমেই মরিয়মকে পাওয়া গেল না তখন আমার চটক ভাঙল। কুচিন্তাপ্রবণ মনকে প্রবোধ দেওয়ার জন্য আমি সরাসরি দেখা করতে চলে এলাম ঢাকায়,সেই ফ্লাইওভারের নিচে। কিন্তু কোথায় মরিয়ম? কোথাও নেই সে। মাজেদও নেই। কেউ জানে না তাদের খবর। যেন কর্পূরের মতো উবে গেছে তারা। মরিয়ম যে বাসায় থাকতো সেখানে গিয়ে জানা গেল অপ্রত্যাশিত মর্মন্তুদ সংবাদ। গতমাসে মরিয়মের স্কুলপড়ুয়া ছোটভাইটি কুকুরের কামড়ে জলাতঙ্কে আক্রান্ত হয়ে ভয়ানকভাবে মৃত্যুবরণ করেছিল। আকস্মিক সেই মৃত্যুর ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে না পেরে পাগলপ্রায় হয়ে গিয়েছিল মরিয়ম। এরিমধ্যে বোনকে অকূলপাথারে ভাসিয়ে মাজেদ তার পুরনো পথে ফিরে গেছে। সবমিলিয়ে মরিয়মের মানসিক অবস্থা খুব একটা স্থিতিশীল ছিল না৷ গুম হয়ে বসে থাকতো সারাদিন। মাঝেমধ্যেই ভাইয়ের শোকে কেঁদে উঠত। গভীর রাতে কবরস্থানে গিয়ে বসে থাকতো। একদিন প্রতিবেশীরা সকালে জেগে উঠে দেখে, ঘরের দরজা হাট করে খোলা, ঘরে কেউ নেই। সবকিছু পড়ে আছে তেমনি। মরিয়ম নেই। এরপর আরো একমাস পেরিয়ে গেলেও সে আর ঘরে ফেরেনি।

পরিশিষ্ট-

অনেকগুলো বছর পেরিয়ে গেছে। এতবছরে আমার জীবনেও কম অদলবদল হয়নি। যে সাফল্যের সোপান বেয়ে উপরে উঠার আকাঙ্খায় আমি চোখবুঁজে ছুটেছিলাম অনিবার্য বিপর্যয়ের দিকে সেই সাফল্য আমাকে ধরা দিয়েছিল। সরকারি চাকরির মতো সোনার হরিণ আমি পেয়েছিলাম। সংসারীও হয়েছিলাম। মাইশা আমার জন্য অপেক্ষা করেনি। বিয়ে করেছিলাম অন্য কাউকে,যার কোনো ব্যাখ্যা এখানে নিষ্প্রয়োজন। তাকে হয়তো ভালোওবেসেছিলাম নিজের সবটুকু উজার করে দিয়ে। কিন্তু বন্য পাখিকে কি আদর-সোহাগ দিয়ে পোষ মানানো যায়? যায় না। সে ঠিকই তার বুনো চেহারা দেখিয়ে দিয়ে আপন নীড়ে ফিরে যাবে। আমার বউও তাই গেছে। আমার সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে,আইনের মারপ্যাঁচে আমাকে বিদ্ধ করে দুই বছরের ফুটফুটে পুত্রসন্তানসহ নিজের কাছে নিয়ে গেছে। আমাকে করে দিয়ে গেছে আগের মতো, একা,নিঃসঙ্গ। আমার প্রতি পর্বতপ্রমাণ অভিযোগ দাঁড় করালেও আমি বিলক্ষণ জানতাম, ওর হৃদয় অন্য কারোর জন্য ব্যথিত ছিল। ডিভোর্স হতে-না-হতেই চাচাতো ভাইকে বিয়ে করেছিল সে। কষ্ট পেয়েছি, অবাক হয়নি। কারণ, আমার যা কিছু সুখকর, প্রশান্তিয় সবকিছু একদিন-না-একদিন খোদাতায়ালা কেড়ে নিবেন এটাকেই আমি নিয়তি বলে বিশ্বাস করে নিয়েছি। সংসার-জীবন থেকে পৃথক হতেই একান্ত নির্জনে পুরনো ক্ষতগুলো তাজা হয়ে উঠতে শুরু করল। মরিয়মের মর্মন্তুদ প্রস্থান আমার জন্য এক মহাজাগতিক বিপর্যয়ের চেয়েও কম ছিল না। সংসারী জীবনে মরিয়মকে বেমালুম ভুলে থাকলেও নিঃসঙ্গ জীবনে ওর প্রস্থান-ব্যাথা পুনরায় ফিরে ফিরে আসে। নিজেকেই বারবার দোষী মনে হয়। চাকরির লোভে চট্টগ্রাম চলে না গেলে গল্পটা হয়তো ভিন্নও হতে পারত! ওর ভাইকে হয়তো বাঁচাতে পারতাম না,কিন্তু ওকে যে হারাতাম না এটাই আমার বিশ্বাস। আর এই বিশ্বাসই আমার নিঃসঙ্গ দিবসরজনীতে অহর্নিশ পীড়া দিয়ে যায়। সর্বোপরি বাবা-মায়ের মৃত্যুর পরে আমার ধূ-ধূ বিরানভূমিতে সে-ই নির্মোহ মমতার বারিধারা বর্ষণ করেছিল। হোক না সেটা অল্প সময়ের জন্য।

কিন্তু এখন কোথায় সে? আমি তো জানি সে বেঁচে আছে,সুস্থ আছে। কিন্তু কি এক বোবা অভিমানে আমার সঙ্গে লুকোচুরি খেলছে বছরের পর বছর–। যেসব শহর,জনপদ আমি মাড়িয়েছি সেসব শহরে আমার চোখজোড়া অগোচরেই খুঁজে ফিরেছে একটি তন্বী, শ্যামল অবয়বকে। তেমন কাউকে দেখলেই জ্বালানি-পাওয়া সলতের মতো দপ করে জ্বলে উঠে চোখজোড়া,পরক্ষণেই আবার নিরাশ হয়ে নিভে যায়। আমার দৃঢ়তর বিশ্বাস, জীবনের কোনো এক ক্রান্তিলগ্নে আবার সে ত্রাণকর্তা রূপে আবির্ভূত হবে;খরা-দীর্ণ এই বিরানভূমিতে আবারো বর্ষণ করবে শীতল বারিধারা। সেইদিন খুব দূরে নয়। আমি জানি।

—– সমাপ্ত—–

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে