বসের সাথে প্রেম
পর্ব-৩০
লেখা- অনামিকা ইসলাম।
মায়া চুপচাপ।
ভিষণ চুপচাপ।
সিয়াম মায়ার ঘাড়ে আবারো সুরসুরি দিলে ইষৎ কেঁপে উঠে। কাঁপা কাঁপা গলায় সিয়ামকে জিজ্ঞেস করে-
” কি হচ্ছে এসব?”
দৃঢ় গলায় সিয়ামের জবাব-
” সবে তো শুরু…”
যদি কথা না বলে এভাবে মরার মত শুয়ে থাকো তবে আরো অনেক কিছু’ই হবে।
– সিয়ামের কথা শুনে মায়া সোফা থেকে উঠে খাটে চলে যায়। সিয়ামও মায়ার পিছুপিছু খাটে গিয়ে বসে।
__ আপনি?!!!
এখানে এসেছেন কেন??(মায়া)
__ তুমি যে কারনে এসেছ…??(সিয়াম)
__ আমি ঘুমাবো। আপনি সোফায় যান।ঐখানে গিয়ে ঘুমান।??(মায়া)
_ আমিও ঘুমাবো। বলে’ই সিয়াম দুটো বালিশ একসাথে করে শুয়ে পরল।
__ এই আপনি এখানে…(…)….
আর দুই বালিশ কেন নিয়েছেন???(মায়া)
_ হ্যাঁ, আমি এখানে’ই শুইব আর বালিশের কথা বলছ না???
দুই বালিশ আমার লাগবে।(সিয়াম)
__ দু’বালিশ ছাড়া আমার ঘুম হয় না। একদম না। আর সেই জায়গায় একবালিশও নেই। আমি ঘুমাবো কোথায়?????(মায়া)
_ কেন? আমার বুকে…
আমার বুক’টা থাকতে এত টেনশন কিসের??????(সিয়াম)
_ স্যরি, তার আর দরকার হবে না। আমি বালিশ ছাড়া’ই ঘুমোতে পারব। বাই….?(মায়া)
মায়া ওর দু’হাত মাথার নিচে দিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে শুয়ে পরল। এদিকে সিয়াম মায়াকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে গেল বুঝতে পারেনি। ঘুম ভাঙে ভোর ৫টায়। কেমন গরম গরম অনুভূত হচ্ছে। কম্বলটা গায়ের উপর থেকে সরিয়ে হাত পা মেলে ধরতে’ই দেখে মায়া। হুম, মায়া শুয়ে আছে সিয়ামের বুকে। বালিশ ছাড়া ঘুমাতে পারে না মায়া। তাই তো ঘুমের ভান করে শুয়ে থাকলেও সত্যি বলতে ঘুমায়’নি। সিয়াম ঘুমিয়ে গেলে চুপিচুপি ওর নিচ থেকে বালিশ আনবে ভাবছিল কিন্তু আনতে পারেনি। কেন যেন মনে হচ্ছিল, বালিশ টান দিলে যদি ঘুম ভেঙে যায়। আর ঘুম ভেঙে গেলে যদি কষ্ট হয় লোকটার???
মায়া ডাক দেওয়ার সাহস পায়নি আবার বালিশ ছাড়া ঘুমানোও ওর পক্ষে পসিবল না।তাইতো রাত্রে সিয়ামের বুকে’ই মাথা রাখে। ভাবছে সিয়াম জাগার আগে সরে যাবে কিন্তু তা আর হলো কই???
বহুদিন পর নিশ্চিন্তে শান্তির ঘুম দেয় মায়া।
পরদিন সকালে বিজয়ের ডাকে ঘুম ভাঙে সিয়ামের। সিয়াম ঘুম ঘুম চোখে বিজয়ের দিকে তাকালে বিজয় মুচকি হেসে বলে-
” Sorry,For disturb.”
বসলে যে কথাটি বলতে এসেছিলাম সেটা হলো__এভাবে কেউ দরজা খোলা রেখে ঘুমায়? যদি চোর আসত???”
সিয়াম তাড়াহুড়ো করে শুয়া থেকে উঠে বসে।
একি?!!!
এই মেয়ে কখন ঘুমালো এভাবে?
ওহ এবার বুঝতে পারছি বিজয় ভাইয়া কেন মুচকি হাসছিল এতক্ষণ।
_ কি হলো? বিড়বিড় করে কি বলছ সিয়াম???(বিজয়)
_ নাহ,কিছু না ভাইয়া…(সিয়াম)
__ ঠিক আছে। আমি ড্রয়িংরুমে যাচ্ছি মণিকে নিয়ে ব্রেকফাস্ট করতে। তোমরা দু’জন এসো…(বিজয়)
বিজয় চলে গেলে সিয়াম মায়াকে বালিশে শুইয়ে দিয়ে উঠতে যাবে তখন’ই দেখে মায়া ওর হাতটা আঁকড়ে ধরে আছে। সিয়াম আর বিছানা থেকে উঠেনি। চুপ করে মায়ার মাথার পাশে বসে থাকে। সেই কখন থেকে মায়ার দিকে ঢ্যাবঢ্যাব করে তাকিয়ে আছে সিয়াম। সেই যে কখন দেখে’ই চলছে এখনো দেখার স্বাদ মিটছে না। অনেকক্ষণ এভাবে তাকিয়ে থেকে একটা সময় কল্পনায় হারিয়ে যায় সিয়াম ওর মায়াপরিকে নিয়ে।
হঠাৎ’ই মায়া নড়ে উঠে। ঘোর কেটে যায় সিয়ামের। তাকিয়ে দেখে মায়া ওর দিকে’ই তাকিয়ে আছে আধো ঘুম, আধো জাগরিত চোখে। সিয়াম শুভ সকাল জানাতে’ই বিছানা ছেড়ে উঠে বসে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে সকাল ০৯টা বেজে ০৫মিনিট।
– হায় আল্লাহ!
এতক্ষণ ধরে ঘুমাইলাম? মনে মনে কথাগুলো বলে বিছানা ছেড়ে উঠে বাহিরে চলে যায় মায়া।
__ ফ্রেশ হয়ে নিচে বিজয়-মণির কাছে চলে যায় সে। এদিকে সিয়াম ফোন হাতে নিয়ে দেখে 74 Missed call ভেসে আছে ওর ফোনে। সিয়াম তো হতবাক।
এত কল কি দিয়েছিল?!!!
নিশ্চয় বাসা থেকে???
– সিমটা ফোনটা হাতে নেওয়ার সাথে সাথে আবারো কল। হুম, যা ভেবেছিল তাই। সাইমা-আবির, সাইমার শ্বশুর-শাশুড়ি, আর সিয়ামের বাবা-মা মিলে ৭৪টা কল দিয়েছে। সেই যে সিয়ামের বাবা একটা খবর দিয়েছে সবাইকে যে মায়াকে পাওয়া গেছে, আর মণি ওদের মেয়ে তারপর থেকে ওদের উৎকন্ঠার শেষ নেই।
কখন ছেলে তার বউ মেয়েকে নিয়ে বাসায় যাবে সেই প্রতিক্ষায় আছে সবাই।
যায় হোক!
সাত-পাঁচ না ভেবে সিয়াম কলটা রিসিভ করেই ফেলল। সিয়াম শুধু হ্যালো বলছে তারপর’ই ওপাশ থেকে_
” বাবা! মায়াকে কখন আসবি? সেই কতক্ষণ ধরে কল দিচ্ছি! কলও ধরছিস না। হ্যারে, আমার ছোট্ট গিন্নিটা কেমন আছে? ও ব্রেকফাস্ট করেছে? আর আমার মায়া মা’টা কেমন আছে??? ও কখন আসবে বলছে? জানিস, তোর মা তো বউ-নাতনী বরণ করার জন্য কত কি রেডি করে রেখেছে। সাইমা আমায় পাগল করে দিয়েছে, ওখানে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আবিরের বাবা-মাও ওনাদের মেয়েকে দেখতে চাচ্ছে। আবির তো পাগল হয়ে গেছে কখন ভাগ্নিকে কোলে নিবে, ওর মুখ থেকে মামা ডাক শুনবে। আচ্ছা, শুন না তুই এখনি রওয়ানা হয়ে যা। হ্যালো বাবা শুনতে পাচ্ছিস???
এরকম হাজারো প্রশ্ন একসাথে জিজ্ঞেস করছিল সিয়ামের বাবা সিয়ামকে।
সিয়াম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল__
” বাবা! আমি ফ্রেশ হতে যাচ্ছি। ব্রেকফাস্ট করেই রওয়ানা দিব। রাখি এখন।”
সেদিন ব্রেকফাস্ট করে বাসায় যাওয়ার আগে মণির কাছে গেল সিয়াম।
” আমি তাহলে যায় মা!
বিকেলে আসব। তোমাদের নিতে।”
কথা’টা মায়াকে শুনিয়ে মণিকে বলতে’ই মণি বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলে সত্যি বলছ তো আব্বু???
আমায় ছেড়ে যাবে না তো কোথাও???
– হ্যারে মা!
আমি সত্যি বলছি।
আমি আসব তোমাদের নিতে।ঠিক বিকেল ৫টায়। অফিস থেকে ফেরার সময়। এসে একদম দাঁড়াব না। তোমরা প্রস্তুত থেকো কিন্তু। সিয়াম কথা’টা বলে বিজয়ের থেকে বিদায় নিয়ে মায়ার কাছে গিয়ে ‘আসি’ বলে চলে গেল অফিসে।
সেদিন অফিস থেকে ফেরার পথে বিজয়দের বাসার গেইটের ভিতরে ঢুকতেই মায়া বের হয়ে আসে বাসার ভেতর থেকে। সিয়ামকে দেখে’ই বলল__
” এসেছেন? চলেন এদিক’টাই ঘুরে আসি একটু।”
__ মায়াকে দেখে মনে হচ্ছে এতক্ষণ ধরে মায়া ওর’ই প্রতিক্ষায় ছিল কিন্তু সিয়াম কেন যেন নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছে না।
বিশ্বাস করতে পারছে না মায়া ওর’ই প্রতিক্ষায় ছিল।
যায় হোক!
সিয়াম মায়ার পিছু পিছু হাঁটতে শুরু করে। হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে যায় ওদের বাগানের ভেতরে। সেখানকার বাগান দেখাশুনাকারী গাছগুলোতে পানি ছিটিয়ে দিচ্ছিল, মায়া কাছে গিয়ে বলল__
” চাচা! আপনি একটু বাসায় যান। মণির সাথে কথা বলেন গিয়ে।”
__ লোকটি চলে গেল। মায়া বাগানের একপাশটায় গিয়ে চুপটি করে অন্যদিকে মুখ করে দাঁড়ালো। সিয়ামও গিয়ে চুপচাপ পাশে দাঁড়ালো। বেশকিছু ক্ষণ এভাবে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল সিয়াম-মায়া দু’জনেই। নিরবতা ভাঙে সিয়াম।
~~ কিছু বলবে???(সিয়াম)
__ হুম। (মায়া)
~~ বলো…
আমাদের যে সন্ধ্যার আগে’ই রওয়ানা দিতে হবে।(সিয়াম)
__ আমাদের নয়, বলেন আমার।(মায়া)
~~ মানে?(সিয়াম)
__ মানে অতি সহজ। আমি কিংবা মণি কেউ যাচ্ছি না আপনার সাথে।(মায়া)
~~ কি বলছ তুমি এসব?!যাবে না মানে???(সিয়াম)
__ মিথ্যে কিছু তো বলিনি! যাব না মানে যাব না।(মায়া)
~~ঠিক আছে। আজ না যাও যাবে তো একসময়।
তাহলে কখন যাবে সেটা বলো।(সিয়াম)
_ যদি বলি এ জীবন থাকতে আর নয়।(মায়া)
~~ কি???(সিয়াম)
__ জি….(মায়া)
~~ Are you creazy?
কি বলছ তুমি বুঝতে পারছ?(সিয়াম)
__ আমি সত্যি’ই বলছি। আর যা বলছি ভেবে চিন্তে সুস্থ মস্তিষ্কে বলছি। আমি যাব না। আর যাওয়াটা সম্ভব নয়।(মায়া)
~~ আমায় ক্ষমা করা যায় না?(সিয়াম)
_ ক্ষমা???
হা, হা হাসাইলেন। কিসের ক্ষমা করতে বলছেন আপনি? আপনি জানেন না ক্ষমা তাকে’ই করে মানুষ যে অপরাধ করে। আপনি তো ভুল বা অপরাধ করেন নি। তাহলে আপনাকে কেন ক্ষমা করব???(মায়া)
সিয়াম মায়ার দুটি হাত চেপে ধরল। প্লিজ মায়া।
আমায় ক্ষমা করে দাও। আমি জানি আমি যা করছি, তার কোনো ক্ষমা হয় না। তবুও বলছি আমাদের সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে আমায় একটু দয়া করো। সব ভুলে ফিরে চলো না আমার সাথে….
মায়া ছাড়িয়ে নিল সিয়ামের হাতের মুঠো থেকে ওর হাত দুটো। তারপর সিয়ামের দিকে তাকিয়ে বলল_
” জনাব সিয়াম সাহেব!
আপনার প্রতি আমার কোনো রাগ কিংবা অভিযোগ নেই। আমি অদৃষ্টে বিশ্বাসী। আমার বিশ্বাস-
যা হয়েছে তা সব’ই আমার কপাল।
এতে আপনার প্রতি আমার কোনো ক্ষোভ নেই।
আর ফিরে যাওয়ার কথা বলছিলেন না???
সেটা সম্ভব নয়।
আপনার কাছে আমি ফিরে যাব সেটা আপনি কল্পনাতেও ভাববেন না সিয়াম সাহেব।
আপনি ফিরে যান।
আর আমাদের মুক্তি দিয়ে যান। একটু প্রাণভরে নিশ্বাস নিতে চাই আমি আমার মেয়েকে নিয়ে। প্লিজ, আমার ভালো থাকাটাকে নষ্ট করবেন না। কথাগুলো একনিশ্বাসে মায়া বলল।
সিয়াম মায়ার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল জল ছলছল চোখে। অনেককিছু বলতে চেয়েও কেন যেন সে পারছে না বলতে।আটকে আসছে গলা। তবুও বলার জন্য মুখ খুলল সিয়াম।
মায়ার কাছে গিয়ে হাটুগেড়ে বসে পরল সিয়াম।
তারপর_
” মায়া প্লিজ এমন করো না।
আমার ভুল হয়ে গেছে। তোমার প্রতি আমার ঘোর অন্যায় করেছি। যার কোনো ক্ষমা হয় না। কিন্তু আজ আমি সত্যি’ই অনুতপ্ত।প্লিজ, আমায় একটাবার, শুধু একটা বার তোমায় ভিক্ষা দাও। কথা দিচ্ছি-
তোমার অমর্যাদা হবে না কোনো দিন। প্লিজ, মাফ করে দাও আমায়। এই শেষ বারের মত মাফ করে দাও।
__……… (মায়া চুপ)
__ প্লিজ, তুমি আমায় মাফ করে দাও মায়া। আমার কথা বাদ’ই দিলাম, অন্তত পক্ষে তোমার মেয়েটার কথা ভাবো। ওকে এভাবে বাবার আদর থেকে বঞ্চিত করো না। প্লিজ, মায়া।
প্লিজ। আমায় মাফ করো।
মায়া তখনো চুপ।
– মায়া! কথা বলো…
এভাবে চুপ করে থেকো না।
আমি তোমার দুটি পায়ে পরি প্লিজ তুমি আমায় ক্ষমা করে দাও। আমায় একটু ভালো ভাবে বাঁচতে দাও।
– আপনি উঠুন।
আর এসব নাটক বন্ধ করুন। আমি জাস্ট সহ্য করতে পারছি না এসব। সন্ধ্যা হয়ে আসছে বাসায় ফিরে যান। আর প্লিজ কখনো আমার আর মেয়ের সামনে এসে দাঁড়াবেন না। নিতে আসবেন না মেয়েকে পিতৃত্বের দাবী নিয়ে। যদি আসেন কখনো তাহলে সেদিন আমার মরন হবে। আপনি আমার মরা মুখ দেখবেন।(মায়া)
– মাাাাাায়াাাাা…
তুমি….(সিয়াম)
– চুপ!
একদম চুপ।
কোনো কথা আমি শুনতে চাই না। এই মুহূর্তে আপনি এখান থেকে বেরিয়ে যান যদি আমার মরা মুখ না দেখতে চান।(মায়া)
কথাটা বলে’ই মায়া বাসার দিকে চলে যায়।
– সিয়াম স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পরে।
সেদিন মণির কান্না শুনেও ওর কাছে যেতে পারেনি। বাহির থেকে যেতে হয় সিয়ামকে।
সেদিনের পর প্রায় ২মাস অতিবাহিত হয়ে যায়। এর ভিতরে যে সিয়ামের পরিবার আসে নি তা নয়।
সিয়ামের বাবা-মা, সাইমা-আবির এসেছে অসংখ্য বার। আবার ফিরেও যেতে হয়ে ব্যর্থ হয়ে। মায়াকে বুঝাতে বুঝাতে আজ তারা ক্লান্ত। তাই একসপ্তাহ ধরে তারাও আসছে না। এদিকে বিজয়ও যেন আর পেরে উঠছে না। উপায় না পেয়ে বন্ধ করে দেয় মায়ার সাথে কথা বলা। এতে যদি একটু ভালো কিছু হয় সে আশায়। কিন্তু ঘাড়ত্যাড়া মেয়েদের ঘাড় সোজা করা বোধ হয় সম্ভব নয় যতক্ষণ অবধি ওরা নিজ থেকে তা সোজা করার চেষ্টা না করে।
মায়ার ক্ষেত্রেও তাই হলো।
সেদিন পড়ন্ত বিকেল বেলায় মায়া ছাদে গিয়েছিল। ঠিক তখনি মণি মণি করে করে চেম্বার থেকে ফিরে বাসায় ঢুকে বিজয়। প্রায় মিনিট পাঁচেকের মত মণিকে ঢেকেও মণির কোনো সাড়া পাইনি বিজয়। ব্যাপার কী?
গেল কই মেয়েটা???
কথাগুলো বলতে বলতে বিজয় ওর রুমে ঢুকে। দরজার কাছে যেতে’ই থমকে যায় বিজয়। ওর হাত-পা রীতিমত কাঁপতে শুরু করে। মনে হচ্ছে এই বুঝি বিজয় পরে যাচ্ছে। একটা বিকট চিৎকার দিয়ে বিজয় ছুটে যায় ওর খাটের কাছে যেখানে মণি নিথর হয়ে পরে আছে।
বিজয়ের চিৎকার শুনে ছাঁদ থেকে ছুটে আসে মায়া। এসে দেখে মণি খাটে শুয়ে আছে অচেতন হয়ে আর বিজয় তার’ই পাশে বসে কান্না করছে। মায়ার বুকের ভেতরটা মুচড় দিয়ে উঠে। মণির কি হয়েছে বলে ছুটে আসে মণির দিকে। মণির খুব কাছে এসে ওকে ছুঁতে যাওয়ার আগে’ই বিজয় হাত বাড়িয়ে বাধা দেয় মায়াকে।
__ কাছে আসবি না।
একদম কাছে আসবি না।
আজ ওর এই অবস্থার জন্য শুধু তুই দায়ী। দিনের পর দিন বাবা বাবা করে যখন ও অস্থির, তখন তুই মনে জেদ পুষে রেখে মেয়েকে মারধোর করেছিস। না খেয়ে-দেয়ে, অবহেলায়-অনাদরে মেয়েটা আজ মৃত্যু পথযাত্রী। ছুঁইবি না ওকে।একদম ছুঁইবি না।(বিজয়)
__ ভাইয়া….(মায়া)
__ বিজয় মণিকে কোলে উঠিয়ে নিয়ে, আরেকহাতে মায়ার হাত ধরে টেনে ওকে ওর রুমে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে দরজায় তালা লাগিয়ে দেয়। তারপর মণিকে নিয়ে গাড়িতে বসিয়ে ছুটে চলে হসপিটালের উদ্দেশ্যে। হসপিটালে নিয়ে গেলে মণির জ্ঞান ফিরে আসলে, মণি অস্ফুট স্বরে আব্বু-আব্বু করতে থাকে। বলতে থাকে আমি আব্বুর কাছে যাব, আমি আব্বুর কাছে যাব। বিজয় মণির শরীরে স্যালাইন দিয়ে সিয়ামের বাসায় ফোন করে। খবর পেয়ে ছুঁটে আসে সিয়াম ও তার পরিবার।
তখনও মণির স্যালাইন চলছে। রাত ৮টায় সিয়ামের ডাকে চোখ মেলে তাকালো মণি। সিয়ামকে দেখতে পেয়ে মণি যেন প্রাণহীন দেহে প্রাণ ফিরে পেল। জাপটে ধরে মণি ওর বাবাকে। তারপর বাপ-মেয়ে দুজনে’ই কান্না শুরু করে।
পরদিন বিকেলে মণিকে নিয়ে সিয়াম ও তার পরিবার বাসায় ফিরে। অন্যদিন বিজয়কে জিজ্ঞেস করলেও আজ আর কিছু জিজ্ঞেস করেনি সিয়াম। বিজয়ও বাধা দেয়নি সিয়ামকে।
কিভাবে বাধা দিবে???
কার ভরসায় আটকে রাখবে মণিকে? যার ভরসায় এতদিন রেখেছিল সেই মা’ই যে মেয়ের আজকের এই অবস্থার জন্য দায়ী।
যায় হোক।
সিয়াম মণিকে নিয়ে বাসায় চলে যায়। এদিকে মায়া?!!!
কান্না করে করে সেঞ্চ হারায় রুমে। জ্ঞান ফিরে আবারো দরজার গিয়ে আঘাত করতে থাকে। কিন্তু কেউ আর দরজা খুলে দেয় না। সেদিন অনেক রাত করে বাসায় ফিরে বিজয়। দরজা খুলে বোনকে মেঝেতে পরে থাকতে দেখে বুকের ভেতরটা কেমন যেন ভিতরটা মুচড় দিয়ে উঠে বিজয়ের। বোনের পাশে গিয়ে বসে বিজয়। তারপর বোনকে কোলে উঠিয়ে খাটে শুইয়ে দিয়ে একটা ইনজেকশন পুষ করে দেয় বিজয়। কিছুক্ষণ পরে’ই জ্ঞান ফিরে মায়ার। কাজের মেয়েকে ডেকে খাবার আনিয়ে জোর করে খাইয়ে দেয় বোনকে। তারপর জোর করে ঔষধ খাইয়ে দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় বিজয়। মায়ার শরীরটা যেন অনেকটা দুর্বল হয়ে গিয়েছে। ক্ষাণিকবাদেই ঘুমিয়ে পরে মায়া। দরজা’টা বাইরে থেকে আটকে দিয়ে চলে যায় বিজয় ওর রুমে।
একটা কলের আওয়াজে ভোরে ঘুম ভেঙে যায় বিজয়ের। কলটা রিসিভ করতে’ই ওপাশ থেকে ভেসে আসে বিজয়ের চাচার সহকর্মীর কন্ঠ। কক্সবাজার থেকে ফোন দিয়েছেন ওনি।
__ বিজয়! তোমার চাচার অবস্থা খুব খারাপ। এক্সিডেন্ট করেছেন ওনি। ওনি তোমাকে দেখতে চাচ্ছেন। তুমি আসতে পারবে আজকে???
বিজয় স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল এমন দুর্সংবাদ শুনে।
হ্যাঁ আংকেল আমি আসছি বলে বিজয় তখনি ভোরের ট্রেনে বেরিয়ে পরে কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে। যাওয়ার আগে একটা চিঠি লিখে দিয়ে যায় কাজের মেয়ের হাতে। বলে যায় চিঠি’টা মায়া জাগলে ওকে দিয়ে দিতে। সকাল ৮টায় ঘুম ভাঙে মায়ার। কাজের মেয়ে মায়ার হাতে একটা চিঠি ধরিয়ে দেয়। যাতে লিখা__
” মায়া বোন আমার!
অভিমান করা ভালো তবে রাগ নয়। অতিরিক্ত রাগ অনেক সময় মানুষের জীবন থেকে অনেক কিছু কেঁড়ে নেয়। তাই বলছি-
সিয়ামের কাছে ক্ষমা চেয়ে ফিরে যা ওর কাছে। মণি সেখানে’ই আছে। বিশেষ কাজে আমাকে একটু ঢাকার বাহিরে যেতে হচ্ছে। কবে আসব তা জানি না। তবে এসে যাতে তোকে দেখি সিয়ামের সাথে সিয়ামের বাসায়। ভালো থাকিস।
ভাইয়া….”
চিঠি’টা পরে মায়া বিজয়কে কল দেওয়ার চেষ্টা করে কিন্তু ফোন অফ দেখাচ্ছে। মায়া ভেবে পাচ্ছে না ও কি করবে?
আচ্ছা, ভাইয়া আমার সাথে রাগ করে কিংবা আমার কৃতকর্মের জন্য রাগে ঘৃণায় দুরে সরে গেল না তো?
হতেও পারে…
না হলে ফোন অফ করবে কেন???
এমন হাজারো প্রশ্ন মায়া মনে মনে করে।
সেদিনের পর একটানা তিনদিন মায়া বিজয়ের ফোনে ট্রাই করে যায় কিন্তু ওকে আর ফোনে পায় না। মায়া বুঝতে পারে__
বিজয় এবার বুঝতে পারল মিথ্যে অজুহাতে ওর থেকে দুরে সরে গেছে। ভাইয়ার প্রতি ভিষণ রাগ হলো। একে তো মেয়ে চলে গেছে, আর এমন জায়গায় চলে গেছে যেখানে ও কখনো নিজ থেকে যেতে পারবে না আর। কারন- বেশকিছু ক্ষণ আগে একবার সিয়ামের বাসায় কল দিলে সিয়াম কলটা রিসিভ করে। রিসিভ করে সালাম দিতে’ই বলে স্যরি, ম্যাম। রং নাম্বার….
মায়া নামের কাউকে আমি চিনি না।
কি করে আমি তার বাসায় যাব???
যে কি না আমায় চিনে’ই না!!!
কাঁদতে কাঁদতে মায়া দাঁড়ানো থেকে বসে পরে। আর এই সময় ভাইটাও চলে গেছে। কি করবে মায়া???
কিছুই যেন বুঝতে পারছে না।
মায়া জানে ও যা করছে তার জন্য’ই হয়ত সিয়াম এমন করতেছে। রেগে আছে ওর উপর। কিন্তু আমি কিভাবে থাকব মণিকে ছাড়া?!!!
__ না, না! আমি পারব না মণিকে ছাড়া থাকতে। বিজয় ভাইয়াকে কল দিয়ে মাফ চেয়ে নিব।তারপর বলব নিয়ে যেতে ঐ বাসায়। আর কেউ আমায় না মানুক মা ঠিক আমায় মেনে নিবে। কথাটা বলে’ই ডায়াল করে বিজয়ের নাম্বার। কিন্তু এখনো নাম্বার’টা বন্ধ। আচ্ছা, তবে কি ভাইয়া আর চালু করবে না সিমটা???
__ হাল ছাড়ে না মায়া।
নাওয়া-খাওয়া বাদ দিয়ে একের পর এক কল দিয়েই যায় মায়া বিজয়কে।দেখতে দেখতে ৩মাস অতিবাহিত হয়ে যায়।
৩মাস পর_
বিজয় চাচার চিকিৎসা করে ফিরে আসে ঢাকায়। ঢাকায় এসে সর্বপ্রথম সিয়ামের বাসায় ঢুকে। বোন-ভাগ্নিকে দেখার জন্য। রুমে ঢুকেই__
মণি…মণি….
সিয়াম মণিকে কোলে নিয়ে সিড়ি বেয়ে নিচে নামে। মণি মামাকে দেখে বাবার কোল থেকে নেমে যায়। ছুটে যায় বিজয়ের দিকে…
__ মামা! মামা! (মণি)
__ বিজয় মণিকে কোলে নিয়ে চুমু দিতে থাকে। ওরে আমার মামণি’টা। কেমন আছ?(বিজয়)
__ ভালো।
তুমি কেমন আছ?(মণি)
__ আমি ভালো আছি।
তোমরা কেমন আছে মামণি???(বিজয়)
~~ আমি ভালো আছি। আব্বুও ভালো আছে। দাদাভাইয়ার একটু জ্বর। দাদিমা ভালো আছে। সাইমা ফুপ্পি পরে গিয়ে হাঁটুতে একটু ব্যাথা পাইছে, আবির মামাও ভালো আছে….(মণি)
_ আর….(…)…???(বিজয়)
__ আর কি???
সবার কথায় তো বলছি।(মণি)
_ মণি’মা দাদিমা কি করে একটু দেখে আসো তো।(সিয়াম)
_ আচ্ছা, আব্বু…(মণি)
__ মণি দৌঁড়ে চলে যায় উপরে।
– ভাইয়া বসেন।(সিয়াম)
বিজয় বসতে বসতে সিয়ামকে প্রশ্ন করে__
” পাগলী’টা কোথায়???”
_ পাগলী???
কার কথা বলছেন ভাইয়া?(সিয়াম)
– মায়া কোথায়?
মায়াকে যে দেখছি না।(বিজয়)
_ মায়া কোথায় মানে? মায়া আপনার বাসায় না???(সিয়াম)
_ ওহ, ওখানে গেছে বুঝি? কবে গেছে? আসবে কখন?(বিজয়)
_ ভাইয়া!
কি বলছেন আপনি এসব? ও তো এই বাসায় আসে নি কখনো। ও আপনার বাসায় না???(সিয়াম)
__ সিয়াম!
মায়া আসে নি। একদিনও আসে নি???(বিজয়)
_ না, ভাইয়া!
কি হয়েছে বলেন তো!!!(সিয়াম)
মানে? ও তাহলে তিনমাস ধরে কোথায়,কি খাচ্ছে??? আমি তো কক্সবাজারে যাওয়ার আগে চাচার চিকিৎসার জন্য সব টাকা নিয়ে গেছিলাম। আর সেখান থেকে মাত্র ফিরলাম।ও তাহলে কি খাচ্ছে???(বিজয়)
– মানে????
কি বলছেন এসব ভাইয়া?(সিয়াম)
– বিজয় সিয়ামের কথার উত্তর না দিয়ে কল করে ওর বাসার বাগানের কেয়ারটেকারের কাছে। কল দিয়ে ওনার কাছে যা জানতে পারে তা হলো__
” আজ দু’মাস হলো মায়া ওকে টাকা পয়সা বুঝিয়ে শুনিয়ে বলে দেয় অন্য কোথাও গিয়ে চাকরি করতে।”
_ বিজয় কাজের লোকদের কাছে কল দিলে ওরা জানালো ওরাও দু’মাস হলো বেরিয়ে আসছে বাড়ি থেকে। ড্রাইভারকে কল দিলে ড্রাইভার এক’ই কথা বলে। মোট কথা কেউ জানে না মায়া কেন বা কি কারনে এমন করছে। বিজয় স্তব্ধ হয়ে যায়। কি করবে বুঝতে পারছে না। তবে এটা বুঝতে পারছে ড্রাইভার, বাগান কেয়ারটেকার, কাজের লোকদের কাজ থেকে বের করে দেওয়ার একটাই কারন আর সেটা হলো টাকা। সিয়াম বিজয়ে পাশে এসে বসে। তারপর জিজ্ঞেস করে_
” কি হয়েছে ভাইয়া?!!!”
বিজয় সিয়ামের হাত দুটো চেপে ধরে। তারপর কান্না করে বলে__
” আমায় ক্ষমা করে দাও সিয়াম। আমায়া ক্ষমা করে দাও।”
অতঃপর সবটা খুলে বলে বিজয় সিয়ামকে। সবটা শুনে সিয়াম শুধু বিজয়কে একটাই কথা বলে_
” ভাইয়া আপনি মণির পাশে বসুন, আমি আসছি।”
গাড়ি নিয়ে ছুটে যায় সিয়াম বিজয়ের বাসার উদ্দেশ্যে। বিজয়ের বাসার সামনে গিয়ে কলিংবেল চাপতে’ই একজন দরজা’টা খুলে দেয়। সিয়াম তাড়াহুড়ো করে রুমে ঢুকে মায়ার রুমের দিকে চলে যায়। এ রুম, ও রুম সব রুম খুঁজে খুঁজে হয়রান। মায়াকে আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সিয়ামের কেন জানি মনে হলো ওর পাশে’ই একজন দাঁড়িয়ে আছে। কাজের মহিলা ভেবে বলল__
” মায়া কোথায়?”
এটুকু বলে পাশে দাঁড়ানো মহিলাটির দিকে তাকাতেই স্তম্ভিত হয়ে যায় সিয়াম।
এ যে কাজের মেয়ে নয়।
স্বয়ং মায়া দাঁড়িয়ে। কিন্তু ওর পরনে এমন জীর্ণ-শীর্ণ,ছেঁড়া-পুরনো শাড়ি কেন???
আর ওর একি হাল???
চোখের নীচে কালো দাগ পরে গেছে।
__ এদিকে সিয়ামকে এভাবে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মায়া লজ্জায় পরে যায়। নিচের দিকে তাকিয়ে গায়ে মুড়ানো চাদর’টা দিয়ে শরীরটা ঢাকার বৃথা চেষ্টা করছে মায়া।
একি অবস্থা করছ তুমি তোমার??? মায়া কোনো কথা না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।
সিয়াম মায়ার দিকে এগিয়ে যায়। তারপর মায়ার মুখটা দু’কাধে ধরে ঝাকিয়ে জিজ্ঞেস করে__
” চুপ করে আছ কেন? জবাব দাও”।
__ মায়া তখনো চুপ।
সিয়াম এবার মায়ার দু’কাধ ছেড়ে মায়ার মুখ’খানি উঁচু করে ধরে। মায়া করুণ চোখে সিয়ামের দিকে তাকিয়ে থাকে।
কিছুক্ষণ পর মায়াকে ধরে ওর রুমে নিয়ে যায়।ওকে খাটে বসিয়ে দরজা’টা বন্ধ করে দেয় সিয়াম।তারপর আলমারির চাবি খুঁজতে থাকে। চাবিটা পেয়ে আলমারি খুলে সিয়াম।
কিন্তু একি?!!!
এর ভেতর যে পুরনো জীর্ণ কাপড় ছাড়া একটা কাপড়ও নেই।
সিয়াম হতভম্ব হয়ে মায়ার দিকে তাকালো। মায়া সিয়ামের চোখটা থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে নিচে তাকালো। তারপর__
” ওগুলো বিক্রি করে দিয়েছি ফেরিওয়ালার কাছে।”
__ বেঁচে দিয়েছ? কেন???(সিয়াম)
__ ভাইয়া আমার সাথে রাগ করে চলে গেছে বাসা থেকে। আমার হাতে একটা টাকাও ছিল না। আর আমিও কোনো চাকরি পাচ্ছিলাম না। তাই ভাবলাম…(….)….(মায়া)
সিয়ামের চোখ দুটো জলে ছলছল করে উঠে।
চোখে জল নিয়েই জিজ্ঞেস করে__
তিনমাস কি খেয়েছ???
~~ দুইটা টিউশনি করি সকালে-বিকালে। তা দিয়েই চলে যায়…(মায়া)
সিয়ামের চোখের জল যেন বাধ মানছে না। বহুকষ্টে নিজেকে সামলে বলল__
আমায় কল দিয়েছিলে একসপ্তাহ আগে রাত্রে, তাই না???(বিজয়)
__ মায়া মাথা নাড়িয়ে বলে হুম।
~~ কেন দিয়েছিলে?(সিয়াম)
__ কন্ঠ’টা শুনতে খুব ইচ্ছে হচ্ছিল।(মায়া)
__ তারপর রাগ হয়ছিল আমার উপর, তাই না?(সিয়াম)
_ কেন?(মায়া)
__ এই যে ফোন রিসিভ না করে বন্ধ করে দিয়েছিলাম।(সিয়াম)
– মায়া চুপচাপ বসে আছে। নিচের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ বসে আছে, আর চোখ থেকে গড়িয়ে জল পরছে। সিয়াম মায়ার চোখের জলটুকু মুছতে যাবে তখন’ই বিজয়ের কল।
সিয়াম কলটা রিসিভ করে।
– হ্যাঁ, ভাইয়া বলেন।(সিয়াম)
~~ মায়া ঠিক আছে তো? কাঁদো কাঁদো গলায় বিজয়ের প্রশ্ন।
__ ভাইয়া!
ও ঠিক আছে। আপনি একদম চিন্তা করবেন না।(সিয়াম)
__ কাজের লোক, বাগান কেয়ারটেকার, ড্রাইভার সবাইকে বলে দিয়েছি। সবাই আসছে। আমিও আসছি মণিকে নিয়ে।(বিজয়)
__ সর্বনাশ!
মণিকে নিয়ে আসবেন না ভাইয়া। আর আপনিও প্লিজ আসবেন না আজকে। কাজের লোকদের ফোন করে বলে দিন ওরা যাতে এখনি এসে রাত হওয়ার আগেই রান্না করে দিয়ে চলে যায়। আজকে রাত্রে যাতে ওরা এই বাসায় না থাকে সেটা বলে দিন। (সিয়াম)
__ কেন? কেন?
রাত্রে থাকলে কি হবে???(বিজয়)
__ অনেক কিছু।
ওরা কেউ রাত্রে থাকবে না।থাকলে আমাদের সমস্যা হবে। (সিয়াম)
__ কি??
কাদের বলছ???(বিজয়)
__ ভাইয়া!
মজা নিবেন না তো।??
যা বলছি সেটাই করেন। মণিকে বলবেন কালকে ওর আম্মুকে নিয়ে আসছি, আজকে যাতে কোনোরকম ডিস্টার্ব না করে+ দুষ্টুমি না করে।(সিয়াম)
— ওকে, ওকে!
ডিস্টার্ব নো করলাম।
রাখি তাহলে।(বিজয়)
বিজয় হেসে কলটা রেখে দিল। ফোনটা পাশে রেখে সিয়াম মায়ার দিকে এগিয়ে যায়। মায়া তখনো নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। মায়ার চোখের জলটুকু মুছে দিয়ে সিয়াম চুপটি করে বসে থাকে মায়ার পাশে। খুব কষ্ট হচ্ছে মায়ার পরণের জীর্ণ শীর্ণ পুরনো শাড়ি দেখে। এতটা কষ্ট যা বলে বুঝানোর মত নয়।
হঠাৎ’ই কলিং বেল বাজার শব্দ হলো। সিয়াম মায়াকে চুপটি করে বসে থাকতে বলে দরজাটা খুলতে গেল।দরজা খুলে কাজের লোকদের দু’জন রুমে আসতে বলে একজন পুরুষ কাজের লোককে দরজার সামনে দাঁড় করিয়ে হাতে কিছু টাকা ধরিয়ে দেয়। অতঃপর কতগুলো খাবার কিনে আনার কথা বলে দরজাটা বন্ধ করে দেয়। কাজের মহিলা দুজনকে বলে যে তাড়াতাড়ি করে রুমগুলো গুছিয়ে চলে যেতে। সন্ধ্যার আগে’ই ওরা রুমগুলো গুছিয়ে, বাসাটা পরিষ্কার করে চলে যায়। আর সন্ধ্যার পর’ই রাতের খাবার চলে আসে। খাবারের প্যাকগুলো হাতে নিয়ে দরজা লাগিয়ে দেয় সিয়াম।খাবারগুলো ফ্রিজে রেখে রুমে চলে যায় সিয়াম। অতঃপর দু’জনে মিলে নামাজ আদায় করে নেয়।
রাত্রে সিয়াম নিজ হাতে মায়াকে মুখে তুলে খাইয়ে দেয়। খাওয়া-দাওয়ার পর্ব শেষে দু’জনেই বিছানার দু’প্রান্তে শুয়ে রেস্ট নিচ্ছে। হঠাৎ’ই সিয়াম শুয়া থেকে উঠে বসে। হাসোজ্জ্বল মুখে আলমারির দিকে এগিয়ে যায়। বের করে আনা লাল টুকটুকে বিয়ের বেনারসি। এই শাড়ি পরে’ই মায়া একদিন ওর ঘরে গিয়েছিল বধূবেশে। আজ এই শাড়ি পরিয়ে দিবে নিজ হাতে সিয়াম তার মায়াপরিকে। খুশিতে মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল সিয়ামের। শাড়ি নিয়ে মায়ার দিকে এগিয়ে যায়। মায়া তো শুয়া থেকে উঠে হা করে তাকিয়ে থাকে সিয়ামের দিকে।
– এই নাও…(সিয়াম)
~~ এটা কি??? (মায়া)
– বিয়ের লাল বেনারসি।(সিয়াম)
__ এটা দিয়ে কি করব আমি???(মায়া)
~~ পরবে।(সিয়াম)
— এখন….(…)…??(মায়া)
~~ জি, এখন…(সিয়াম)
_ কিন্তু…..(মায়া)
~~ একদম কথা বলবা না। চুপচাপ পরে নাও। আর কোনো কথা হবে না। চলবে না কোনো অজুহাত। মনে রেখো__
শাড়ি কিন্তু আমিও পরাতে পারি। কিন্তু আমি আবার ভদ্র ছেলে। তাই কিছু করলাম না।??(সিয়াম)
_ আমি এতবড় শাড়ি পরতে পারব না তো???
আর তাছাড়া শাড়ি পরতে গেলে অন্যান্য যা লাগে সেগুলোর একটি নেই।??(মায়া)
__ কি নেই??(সিয়াম)
__ ইয়ে মানে ব্লা…ব্লাউজ…?? (মায়া)
_ হা, হা, হা, হা…??(সিয়াম)
__ হাসেন কেন???(মায়া)
__ তোমার কথা শুনে।
ব্লাউজ নেই তাতে কি হয়ছে? তার বিকল্প জিনিসও তো আছে। ঐটা পরে কাজ চালিয়ে নাও।???(সিয়াম)
_ কি সেটা???(মায়া)
~~ বলব?!!!??(সিয়াম)
__ না, থাক…(মায়া)
__ না বললে শাড়ি পরবা কিভাবে? বলেই দেই….???(সিয়াম)
__ ??(মায়া)
__ চুপ মানে বলতে হবে।এইতো??? ওয়েট দেখাচ্ছি ব্লাউজের বিকল্প জিনিসটা….
এই বলে সিয়াম আলমারি থেকে ব্রা বের করে এনে মায়ার চোখের সামনে মেলে ধরে। এই হলো সেই বিকল্প। মায়া লজ্জায় নিচের দিকে চোখ ফিরিয়ে নিল।
– নাও।
এটা পরে শাড়ি’টা পরে নাও। তারপর অনেক কাজ বাকি আছে….??
সেগুলো করতে হবে।?(সিয়াম)
— এটা পরে শাড়ি পরা যাবে না।??(মায়া)
_ কেন???(সিয়াম)
__ এটা পরলে শরীর দেখা যাবে। ফিতা চিকন।(মায়া)
~ সমস্যা কি???
এখানে তো বাইরের কেউ নেই। পরে নাও। (সিয়াম)
_ আমার লজ্জা করে।(মায়া)
__ ওহ, তাই বলো।
শাড়ি আমাকে দিয়ে পরাতে চাও সেটা মুখে বললেই হতো। দাও, পরিয়ে দিচ্ছি। (আঁচলে টান দিয়ে সিয়াম)
__ মায়া লজ্জায় মাথা নিচু করে বলল,
না….
~ মায়া!
কথা বাড়াইবা না একদম। তাড়াতাড়ি শাড়ি পরতে হবে। সময় খুব কম।(সিয়াম)
_ আপনি ছাড়েন!
আমি পরছি…??(মায়া)
আঁচল টেনে একটু একটু খুলতে খুলতে_
শাড়িটা কিন্তু আমি’ই পরাবো।(সিয়াম)
চলবে……