বসের সাথে প্রেম
পর্ব-২০
লেখা- অনামিকা ইসলাম।
শুভদৃষ্টির মাঝখানে এহেম বলে কাশি দিল আবির।
__ভাইয়া!সময় তো অনেক পাবেন, আপাতত আমাদের সাথে আড্ডায় যোগ দেন। কি বলো সাইমা?
–জি, সেটাই তো….(সাইমা)
ইয়ে মানে আমি আসলে…..
বলে আমতা আমতা শুরু করে দিল সিয়াম। আর মায়া ফিরিয়ে নিল চোখ সিয়ামের থেকে। সবাই খাচ্ছে আর খুব হাসাহাসি করছে। মায়া চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছে কোনো কথা না বলে। পাশেই যে বিয়ে নিয়ে এত আনন্দ, এত কথা হচ্ছে সেদিকে বিন্দু মাত্র ক্রুক্ষেপ নেই মায়ার। খেয়ে-দেয়ে চুপটি করে সে স্থান ত্যাগ করে মায়া। সবাই হা করে মায়ার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকলে মাঝখান দিয়ে সাইমার শ্বশুর বলে উঠে-
” বেচারী! লজ্জা পেয়েছে…”
সবাই হি হা হা করে হেসে দিল। মায়ার শাশুড়ি গম্ভীর গলায় হাজবেন্ডকে শাসিয়ে বললেন,
দিন দিন তুমি না ছোট হয়ে যাচ্ছ। বলি ছেলে-মেয়ের সামনে মুখে কিছু আটকায় না?এখনও তোমার এসব করার সময় রয়েছে? ??
হাসোজ্জল মুখে সাইমার শ্বশুরের জবাব,
কি যে বলো না আবিরের মা! এখন না করলে কখন করব…???
কবরে গিয়ে…..?!?
বাজে কথা বলবা না বাবা, রাগান্বিত স্বরে সাইমার উত্তর। সাইমার সাথে তাল মিলিয়ে আবিরও বলছে, একদম বাজে কথা বলবা না। আর মা তোমাকেও বলছি। বাবা যা ইচ্ছে তাই বলবে, তুমি একদম বাধা দিবেনা বা কিছু বলবে না। যদি বলো তাহলে চলে যাব যেদিকে চোখ যায়।
– আফরোজা! এই দেখো, তোমার ছেলে-মেয়েরা গাল ফুলিয়ে বসে আছে…..(সাইমার শ্বশুর)
__যাক! আমি আর কখনো তোমাকে কিছু বলব না। তোমার যা ইচ্ছে তাই করো। অভিমানের স্বরে সাইমার শাশুড়ি বলল।
_ বেয়াই! বিয়ের কথা তো বলে ফেললাম। কিন্তু মায়ার পরিবারের ব্যাপারে কিছু তো ভাবলাম না। ওদের পরিবারের মানুষকে কি জানানোটা উচিৎ না? চিন্তিত গলায় সাইমার বাবার প্রশ্ন…
_হুম, সেটাই তো! ওর তো পরিবার আছে একটা….(সাইমার শ্বশুর)
– তোমরা কালকে মায়াকে নিয়ে গিয়ে ওদের কাছে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাও…(মা)
– বাবা! পরিবার ছাড়া কি বিয়ে হয় না? হতে পারে না?
– কি বলছ তুমি বউমা? পরিবার ছাড়া আবার বিয়ে হয় কিভাবে?(সাইমার শাশুড়ি)
– আর তাছাড়া বিয়ে বলে কথা….(সাইমার মা)
– সেটাই তো। ওরা হলেন মায়ার অভিভাবক।ওদের ছাড়া বিয়ে কিভাবে সম্ভব?(সাইমার শ্বশুর)
– বাবা! ওর কোনো পরিবার নেই। নেই কোনো আপনজন। ধীর গলায় সাইমা কথাটা বলল।
__মানে কিরে?!!!(সিয়াম)
– বউমা! খুলে বলো তো…(সাইমার শ্বশুর)
– আসলে ওর বাবা-মা নেই। রোড এক্সিডেন্টে মারা গেছে সে অনেক বছর আগে। সেই থেকে ও মামা বাড়িতে থাকে। কিন্তু মামা’টা স্ট্রোক করে মারা যায় এর কয়েক বছর পর’ই। এরপর থেকে ওর উপর নেমে আসে মামির অকথ্য নির্যাতন। পরিবারটা ওর মামি ওর মামার পেনশনের টাকা দিয়ে চালালেও, মায়ার শান্তি ছিল না। ওকে শারিরীক নয় মানসিক নির্যাতন করা হতো প্রতিনিয়ত। ও কাজের মেয়ের মতো থেকেছে ঐ বাড়িতে। সারাদিন কাজ করে রাত্রে যখন পড়তে যেত তখন ওর মামি লাইট নিভিয়ে দিত। ও বহুকষ্টে, লুকিয়ে-চুরিয়ে বই পড়ত। ওকে পড়া-শোনার খরচ কিংবা পরনের কোনো পোষাক বছরে একবারও দেওয়া হতো না। টিউশনি করে ও পড়াশোনা+নিজের খরচ চালাত। খুব সাধারণ একটা মেয়ে ও।
কলেজে ওর কোনো বন্ধু-বান্ধব ছিল না। ও চুপটি করে সবসময় বকুলতলায় বসে কিংবা বারান্দার এককোণে দাঁড়িয়ে বই পড়ত। ও ভিষণ চুপচাপ এবং শান্তশিষ্ট স্বভাবের মেয়ে। আর এই স্বভাবের জন্য’ই হয়ত প্রথম দেখায় বাবা ওকে মা ডেকে ফেলেছিলেন, দিয়ে দিয়েছিলেন কোম্পানিরর চাকুরী। বাবা! ওরা ওর জীবনের অভিশাপ। ও সেদিন মামার কুচক্রী ও বদ ভাইয়ের হাত থেকে থেকে বাঁচার জন্য ওনাকে ছুড়ি দিয়ে আঘাত করে রাতের অন্ধকারে পালিয়ে আছে বাড়ি থেকে। পাশের বাসার আন্টির বাসায় ও থাকত। আমি’ই দিয়ে এসেছিলাম ঐখানে। এরপরের ঘটনা তো বাবা জানেন….
চোখের জল মুছে সাইমা বাবার দিকে তাকাই। প্লিজ, বাবা! ওর পরিবারের খুঁজ করতে যেও না। মনে করিয়ে দিও না ওর জীবনের ভয়ংকর অতীতকে। ও কষ্ট পাবে। ও সইতে পারবে না বাবা….সইতে পারবে না….
সবাই স্তব্ধ হয়ে আছে সাইমার কথাগুলো শুনে। সিয়ামের চোখ জলে ভরে গেছে। অশ্রুভেঁজা নয়নে সেখান থেকে উঠে চলে যায় সিয়াম। হয়ত রুমে গিয়ে কাঁদবে। বালিশ জড়িয়ে কিংবা ছাদে গিয়ে দাতে দাত চেপে কাঁদবে। সিয়াম আজ কাঁদবেই। কারন, ওর মায়াপরিটার জন্য যে ওর ভিষণ মায়া….
সিয়াম চলে যাওয়ার পর হঠাৎ করে’ই সাইমার শ্বশুর একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল। মায়া কোথাও নয়, ওনার সাথে ওনার বাসায় ওনার মেয়ে হয়ে যাবে। আর এ পরিবার থেকে বরযাত্রী নিয়ে মানুষজন যাবে মায়াকে ঐ বাপের বাড়ি থেকে বধূবেশে নিয়ে আসতে। সবার চোখেই আনন্দ জল টলমল করে উঠল। সাইমা তো শ্বশুরকে জড়িয়ে ধরে বলল,
” You are great,baba”…
সেদিন রাত্রের মতো আলোচনা পর্ব সমাপ্তি ঘোষনা করা হলো। বলা হলো পরদিন সকালে মায়াকে সাথে নিয়েই সাইমা-আবিরসহ ঐ পরিবারের সবাই শ্বশুর বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিবে….
ঘড়ির কাটা তখন রাত দেড়টা ছুঁই ছুঁই। বুকের মধ্যিখান থেকে মৃত বাবা-মায়ের ছবিটা সরিয়ে বিছানা থেকে উঠে রুম থেকে বেরিয়ে যায় মায়া। উদ্দেশ্য দুপুরের কৃতকার্যের জন্য ক্ষমা চেয়ে নেওয়া সিয়ামের কাছে। কারন, দেরীতে হলেও মায়া বুঝতে ও একটু বেশীই খারাপ ব্যবহার করে ফেলেছে সিয়ামের সাথে। যে করে’ই হোক ক্ষমা আমায় চাইতেই হবে বলে ধীর পায়ে পিল পিল করে হাঁটতে থাকে মায়া। সিয়ামের রুমের সামনে গিয়ে’ই লাফ দিয়ে উঠে মায়া। সিয়ামও এদিকেই আসছিল। আচমকা ওকে এখানে দেখতে পেয়ে ভয় পেয়ে যায় মায়া। ক্ষাণিকটা শিউরে উঠে সে…
এদিকে সিয়ামও দাঁড়িয়ে পরে মায়া’কে দেখে। দু’জনই চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে একে অপরের দিকে তাকিয়ে। কারো মুখেই কোনো কথা নেই। হঠাৎ’ই সিনেমাটিক স্টাইলে দুজন’ই একসাথে বলে উঠে__
” আমার একটা কথা ছিল”
দু’জনই দু’জনের মুখের দিকে তাকিয়ে পরে আবার।
__হ্যাঁ, বলো! কি বলবা?(সিয়াম)
__না, স্যার! আপনি বলেন…(মায়া)
__তুমি আগে আসছ, তুমি বলো….(সিয়াম)
_আসলে স্যার আমি আপনার….
পুরোটা বলার আগেই মায়ার মুখ থেকে কথা ছুঁ মেরে ছিনিয়ে নেই সিয়াম।
— আসলে ফাইলগুলো দেখা হয়নি, এইতো?
মায়া কিছু না বুঝেই শুধু মাথা নাড়ে বোকার মত…
তুমিও না মায়া…এই কথা বলার জন্য এত রাত্রে ছুটে আসতে হলো তোমার? তোমাকে কাজের জন্য জোর করছি আমি? যাও, রুমে গিয়ে চুপটি করে ঘুমাও…(সিয়াম)
_কিন্তু আমি তো…(মায়া)
—-কোনো কিন্তু টিন্তু শুনব না। তুমি যাও ঘুমুতে। মায়া চুপটি করে ফিরে যায় রুমে। সিয়ামও কিছু বলতে চেয়েও না বলেই ফিরে গেল রুমে।
পরদিন দুপুরবেলা_
এই সাইমা! আর কত? তাড়াতাড়ি বের হো নারে বোন….(সিয়াম)
_ভাইয়া আর ৫মিনিট প্লিজ…(সাইমা)
_৫মিনিট বলে বলে এক ঘন্টা বানিয়ে দিয়েছিস। বের হো তাড়াতাড়ি।(সিয়াম)
_সাইমা মনে মনে ভাবল মায়ার নিশ্চয় এতক্ষণে গোসল করা শেষ। আপদটাকে বরং ঐ বাথরুমেই ঢুকিয়ে দেওয়া যাক। যেই ভাবনা সেই কাজ।সাইমা চেঁচিয়ে বলে উঠে, ভাইয়া! আমার বাথরুমটা খালি পরে আছে।ঐখানে ঢুকে যা প্লিজ…..
_ফাজিল মেয়ে!১ঘন্টা দাঁড় করিয়ে এখন বলে ঐটা খালি, আগে বললেই হতো বিড়বিড় করে কথাগুলো বলে বাথরুমে ঢুকে ছিটকিনি লাগিয়ে ঘুরে তাকাই সিয়াম।
– You এখানে বলে সিয়াম চোখ দুটো ঢেকে নেয় হাত দিয়ে। মায়া তখন গোসল করছিল ঐ রুমে সেটা সিয়াম লক্ষ করেনি। আর যখন লক্ষ করল তখন দেরী হয়ে গেছে অনেক। ওপাশে ঘুরে ভেঁজা শরীর নিয়ে মায়া মুখের সাবান ধূইতেছিল। তখন’ই কাজ হয়ে যায়…..
মায়া ওর ভিঁজা শরীরের দিকে তাকিয়ে সিয়ামের দিকে লজ্জানত চোখে তাকাই…
চলবে….