বসের সাথে প্রেম পর্ব- ১৭

1
6443

বসের সাথে প্রেম
পর্ব- ১৭

লেখা- অনামিকা ইসলাম।

মায়া চক্ষু দুইটা বন্ধ করলে সিয়াম মায়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে। মায়া চক্ষু বন্ধ করে’ই সিয়ামকে সরানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। শেষে না পেরে সিয়ামের বুকে এলোপাথাড়ি ভাবে কিলঘুসি দিতে থাকে আর আস্তে আস্তে কিসব বলে বকতে থাকে সিয়ামকে। সিয়াম মায়ার উপর থেকে সরে যায়। এই মুহূর্তে মায়ার মনে হচ্ছে ওর শরীর থেকে কয়েকশ মণ ওজনের বস্তা সরাতে পেরেছে। মায়া একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে ক্ষাণিকবাদেই চোখ খুলে। চোখ খুলে দেখে তার ঠিক পাশেই বিপরীতমুখী হয়ে সিয়াম শুয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ সরিয়ে নেয় মায়া। কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে মুখ খুলে সিয়াম….
~ভয় পেয়েছিলা?!!!
-‘ অস্ফুট স্বরে মায়া উহু বলে উঠে। সিয়াম অবাক চোখে মায়ার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘বলো কি? এমন একটা ঘটনার পরও বলছ তুমি একটুও ভয় পাওনি?’
মায়া এবার বলে__
” না, ভয় পাই নি।”
সিয়াম:- বাব্বাহ! আমার মায়াপরিটার এত্ত সাহস?এতকিছুর পরও ভয় পেল না?!!?
মায়া:- সাহস নয় বিশ্বাস….
আমার বিশ্বাস ছিল আপনি আমার কোনো ক্ষতি করবেন না, করতে পারেন না….♥♥♥
সিয়াম:- ???
মায়া:- কি হলো আবার?
সিয়াম:- একদিনেই পর করে দিলে আমায়? আমি আপনি হয়ে গেলাম?
মায়া:- স্যারকে আপনি ডাকব না তো কি ডাকব? আর তাছাড়া আপনি আমার বস। সেই হিসেবে আপনার প্রতি আমার শ্রদ্ধা প্রর্দশন করা উচিৎ, আর সেটাই আমি করছি….✌
সিয়াম:- আমি তোমার বস! তাই নাহ?!!!?
মায়া:- জি, বস…
আপনি আমার বস….
সিয়াম:- আর কিছু’ই না?!!!
মায়া:- না….
সিয়াম:- সত্যি’ই আর কিছু’ই না। এর বাহিরে আর কিছুই না?!!!
মায়ার ভিতরে কথা আটকে যাচ্ছিল, তবুও ঢোক গিলে স্বাভাবিক ভঙিতে বলার চেষ্টা করল__
” না, এর বাহিরে আপনি আমার কেউ না স্যার।”
কথাটা শুনে সিয়াম নিশ্চুপ…
-মায়া আবারো দৃঢ় গলায় বলল, “লিজা ম্যাম ভালো মেয়ে। আপনি লিজাকে বিয়ে করেন। সুখী হবেন, বাবা-মাও খুশি হবেন….”
সিয়াম এবার রেগে গিয়ে মুখ খুলল__
” লিজা নয়, আমি তোকে বিয়ে করব। তোকে, তোকে, তোকে।শুনতে পাচ্ছিস?!!! আমি তোকে বিয়ে করব। বিয়ে করলে আমি তোকে’ই করব…”
মায়া:- স্যার, আপনি লিজাকে বিয়ে করেন….
সিয়াম এবার আরো বেশী রেগে গেল।

~কেন? লিজাকে কেন? তুই থাকতে আমার লিজাকে বিয়ে করতে হবে কেন?

-মায়া ভীরু গলায় বলল,
আপনার বাবা-মা সেটাই চান….

~কিন্তু আমি তো চাই না। আমি শুধু তোকে’ই চাই। আর বিয়ে করলে তোকে’ই করব….

-‘ কিন্তু আপনার বাবা-মা আমাকে নয়, লিজা ম্যামকে চান। সন্তান হিসেবে আপনার উচিৎ ওনাদের চাওয়া-পাওয়ার মূল্য দেওয়া…(মায়া)

~’ আর সন্তান হয়ে আমি কি দোষ করলাম? ওনাদের কি উচিৎ নয়- বাবা-মা হিসেবে সন্তানের ইচ্ছে-অনিচ্ছের প্রাধান্য দেওয়া….???’

-‘সব ইচ্ছের প্রশ্রয় দিতে নেই। সন্তানের সব ইচ্ছের প্রশ্রয় দিতে নেই,স্যার….
আর মানুষের সব চাওয়াও পূর্ণ হয় না। আপনি ওনাদের কথা মেনে নেন, সুখী হবেন…
অনেক সুখী হবেন…
কান্নাভেঁজা কন্ঠে কথাগুলো মায়া বলেছিল….’

~`আমি পারব না। পারব না আমি বাবা-মায়ের এই কথাটা শুনতে…মানতে…
এর জন্য যদি বাবা-মায়ের অবাধ্য সন্তান বলেও গন্য হই, তাহলেও পারব না মানতে, পারব না তোমায় ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করতে….’

-‘ আপনি আমায় ভালোবাসেন না, স্যার?!!!(মায়া)

~হুম,বাসি।(সিয়াম)
-কতটুকু বাসেন?!!!(মায়া)

~অনেক ভালোবাসি, অনেক।অনেক….(সিয়াম)

-‘সেই ভালোবাসার কসম রইল, আপনি আপনার বাবা-মায়ের কথার অবাধ্য হবেন না। ওরা যা বলে যায় করবেন, শুনবেন। যদি এর ব্যতিক্রম করেন, তাহলে যেন আমাদের ভালোবাসাকেই অসম্মান করলেন….
মনে রাখবেন, আমাদের ভালোবাসার কসম দিয়েছি। আমি জানি, আপনি আমাদের ভালোবাসার অসম্মান কখনো করবেন না। যদি কখনো করেন, তাহলে সেদিন থেকে মায়া আপনার জন্য মৃত ভেবে নিবেন….(মায়া)

~’সিয়াম শুয়া থেকে উঠে বসে পরল মায়ার কথা শুনে।তারপর মায়ার দিকে তাকিয়ে বলল, একি শুনালে তুমি?!!!

-মায়াও শুয়া থেকে উঠে বসল। তারপর আচমকা সিয়ামের পা ধরে বসল। সিয়াম তো হতবাক। সিয়াম বার বার মায়াকে বলছে__
‘কি করছ? ছাড়ো মায়া। ছাড়ো…..’
মায়া পা জড়িয়েই বলল,
প্লিজ, আপনি আমাদের ভালোবাসার অসম্মান করবেন না। প্লিজ, আমার কথাটা রাখেন। আপনার কাছে আমার শেষ অনুরোধ এটা….
সিয়াম মায়ার হাতটা ওর পা থেকে সরিয়ে কাঁপা গলায় বলল, “ঠিক আছে, আমি তোমার কথায় রাখব। তোমার কথায় রাখব…আমি বাবা-মায়ের সব কথা শুনব, মেনে নিব। আমি বাবা-মায়ের পছন্দের যেকোনো পাত্রীকেই চোখ বোজে বিয়ে করব, তুমি কোনো চিন্তা করো না। আমি হতে দিব না আমাদের ভালোবাসার কোনো অসম্মান….

-‘ মায়ার চোখে জল, ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটে উঠে। চোখের জল মুছে কাঁপা গলায় মায়া বলে উঠে__
‘আপনি সুখী হবেন। দেখে নিয়েন আপনি সুখী হবেন। স্বয়ং আল্লাহ আপনার সাথে আছেন। আপনি খুব সুখী হবেন…’
কথাগুলো বলেই মায়া দৌঁড়ে সেখান থেকে রুমে চলে যায়, আর সিয়াম?!!!
চোখের জল মুছে বলে,
হুম, আমি সুখী হবো…
তুমি বলছ না মায়া?!!!
আমি না সুখী হয়ে যাব কোথায়?!!!
আমার যে সুখী হতেই হবে। জোর করে হলেও সুখী হতে হবে….আমায় সুখী হতে হবে। আমার মায়াপরি বলছে….
আমি কি সুখী না হয়ে পারি? অবশ্যই আমি সুখী হব। সুখ আমার ঘরে উপচে পরবে….যেন এক সুখের সাগরে আমি বসত করব…. কথাগুলো বলে সিয়াম উঠে দাঁড়ায়। ছাদের রেলিং ধরে চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছে, আর চোখ থেকে গড়িয়ে গড়িয়ে জল পরছে….
সিয়াম আনমনেই বলে চলছে,
‘লিজা তো আতিককে ভালোবাসে, আর আতিকও লিজাকে ছাড়া বাঁচবে না। একজন প্রেমিক হয়ে কি করে আমি ওদের ভালোবাসাকে ব্যর্থ করে দেই? তার চেয়ে বরং ওদের ভালোবাসা সফল হোক, আর আমি?!!! বাবা-মায়ের অন্য কোনো এক বন্ধুর মেয়ে কিংবা ব্যবসায়ের পার্টনারের মেয়ে কিংবা বাবা-মায়ের নির্বাচিতা পাত্রীকে বিয়ে করে নিব। তুমি চিন্তা করো না মায়া। আমি তোমার কথা রাখব।বাবা-মায়ের অবাধ্য আমি হবো না।আমি আর কখনো তোমাকে চাইব না…..
কথাগুলো বলে সিয়াম হু হু করে কাঁদতে শুরু করে।

পরদিন পরিস্থিতি আগের চেয়েও বেশী স্বাভাবিক হয়ে আসে। ব্রেকফাস্ট করে সিয়াম-মায়া দু’জনেই বিদায় নেই সাইমার শ্বশুরবাড়ি থেকে….

কর্মচক্র আগের মতই নিজ গতিতে চলতে থাকে। মায়া সিয়ামের পি.এ হয়েই থেকে যায়। এমডি এবং পি.এর মধ্যকার কথাগুলো ও কাজগুলোই ওদের মধ্যে হতো। এর থেকে বেশী কিছু ওদের মধ্যে ছিল না। বেশী কথাও হতো না। দেখতে দেখতে ৬মাস কেটে যায়। সিয়াম অবাক হলো এখনো ওর বাবা ওর বিয়ের ব্যাপারে কিছু বলছে না দেখে। সেদিন সিয়ামদের বাসায় সাইমার শ্বশুরবাড়ির সবাই ছিল। সেদিন সবাই একসাথে খেতে বসলে ওর বাবা সাইমার শ্বশুরকে বলে__
” বেয়াই সাহেব!!!
লিজার তো বিয়ে হয়েই গেল আতিকের সাথে। এখন আমার ছেলের কি হবে? ওরা তো রিলেশন করে বিয়ে করেছে, আমার ছেলের তো মনে হয় কোথাও রিলেশনও নেই। থাকলে তো অবশ্যই বলত। এখন যা করার আমাদের’ই করতে হবে। কি বলছি বুঝতে পারছেন তো?!!!

-‘ হুম, বুঝতে পারছি বেয়াই….(সিয়ামের দিকে তাকিয়ে হেসে সাইমার শ্বশুর জবাব দিল)

সিয়ামের বাবা আবার বলল,
-‘ আপনি ঐদিন যে মেয়ের কথা বলছিলেন, সে মেয়েকে আমার ভিষন পছন্দ হয়েছে। বিয়ে করালে ঐ লক্ষ্মী মেয়েকেই করাব। ঐ লক্ষ্মী মেয়েই হবে আমার পুত্রবধূ। কি বলেন?'(বাবা)

~’ আপনার উক্তি ঠিক আছে, কিন্তু সিয়ামের মতামতের মূল্য দেওয়ারও তো দরকার। মেয়েকে একবার দেখানো দরকার….(সাইমার শ্বশুর)

-‘ হুম….
সিয়াম…..
আজকে অফিসে যাবি না।তোরা একবার সামনাসামনি কথা বলে দেখ।(বাবা)

-‘ বাবা….
তোমাদের পছন্দ’ই আমার পছন্দ। আমি আলাদা করে আর কথা বলতে কিংবা দেখতে চাই না। তোমরা সব ঠিক করো। আর বিয়ের দিন শুধু মনে করিয়ে দিও যে আমার বিয়ে ঐদিন….(সিয়াম)

-‘ সেকি?!!! বিয়ের দিন মনে করিয়ে দিতে হবে মানে? আমার একমাত্র ছেলের বিয়ে, তুই কি ভাবছিস? কোনো অনুষ্ঠান হবে না? পুরো বাংলাদেশের সবাইকে তাক লাগিয়ে দিব। আমার ছেলের বিয়ে বলে কথা…(মা)

-‘ ঠিক বলছেন, মা….(আবির)

-‘ ইস! কি যে মজা হচ্ছে। ইচ্ছে হচ্ছে ডান্স দেই…. (সাইমা)

-‘ বৌমা। এখানে কিন্তু মুরুব্বিরাও আছে….??(সাইমার শাশুড়ি)

-‘ স্যরি, মা….??
বিয়ের কথা শুনে ভুলেই গেছিলাম আপনারা আছেন….?(সাইমা)

সবাই হা,হা,হা করে হেসে দিল…..
সবাই বেশ খোশ মেজাজে আছে, শুধু মায়া ছাড়া….
মায়ায় বেশ চুপচাপ বসে খাচ্ছে….
একটা কথাও বলে নি….
সিয়াম মনে মনে বলছে_
” মায়া!তোমায় আমি সেদিন বলেছিলাম কিন্তু তুমি আটকে দিলে। আমাদের ভালোবাসার দোহাই দিয়ে আটকে দিলে। সেদিন’ই প্রতিজ্ঞা করেছি, আর নয়..
আমি বাবা-মায়ের পছন্দের মেয়েকেই বিয়ে করব। আর ক্ষমার কথা বলছিলা না?!!!
ক্ষমা আমি তোমাকে কখনো করব না। তুমি শেষ হবে। আমার মত করে একটু একটু জ্বলে পুড়ে শেষ হবে…
তুমি কাঁদবে, আমার মতই কাঁদবে, নিরবে কাঁদবে। সে কান্নার আওয়াজ কেউ শুনবে না…..
আমিও দেখতে চাই,
আর কত…
আর কতদিন তুমি এভাবে চুপ থাকতে পারো…..

সিয়াম-মায়া দু’জনেই চুপচাপ খাওয়া সেরে উঠে গেল।

এদিকে বাকি মানুষগুলো যারা খাবার টেবিলে বসে খাচ্ছিল তারা হি হা হা হা করে হেসে দিল…..
সাইমা তো বলেই দিয়েছে_
” আহারে বেচারা-বেচারি…”

[সম্মানীত পাঠক/পাঠিকা আপু ও ভাইয়ারা…..
আপনারা হতাশ হবেন না। সিয়ামের পরিবার মায়ার কথায় এতক্ষণ ধরে বলছে। সেদিন রাত্রে ছাদে যা হয়েছে পুরো ঘটনা অন্তরালে থেকে একজন খেয়াল করেছিলেন, তিনি ছিলেন সাইমার শ্বশুর। গভীর রাত্রে ছাদে কারো কথার আওয়াজ শুনে ধীরপায়ে এগিয়ে এসে তিনি একজোড়া কপোত-কপোতীর প্রেমের শেষ দৃশ্যপটের সাক্ষী হয়েছিলেন। সেদিন তিনি আবিভূত হয়ে গিয়েছিলেন ছোট্ট একজোড়া কপোত-কপোতীর নিরব ভালোবাসা আর পরিবারের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাবোধ দেখে। শেষ কথাগুলো একদম মেনে নিতে পারেন নি। চোখের পানি ছেড়ে দিলেন সাইমার শ্বশুর। তবে ব্যর্থ হতে দিলেন না ওদের ভালোবাসাকে। ঝরে যেতে দেননি স্বর্গীয় এক প্রেমের বন্ধনকে। এ বন্ধন আরো অটুট এবং চিরস্থায়ী করার জন্য সেদিন’ই পুরো ঘটনা সাইমার বাবাকে খুলে বলেন। আনন্দে সে দিন সাইমার বাবার চোখ থেকে দু’ফোঁটা অশ্রু ঝরে পরে। ছোট্ট অবুঝ দুটি প্রাণের থেকে সেদিন তিনি ত্যাগের এক দারুণ শিক্ষা পায়। যা মুহূর্তেই কঠোর হৃদয়ের শিল্পপতিকে কোমল হৃদয়ের অধিকারী একজন বাবা, আদর্শ বাবা তৈরি করে দেয়। এর কয়েকদিন পর’ই বন্ধু আশরাফের মেয়েকে সিয়ামের বন্ধু আতিকের সাথে বিয়ে দিয়ে দেই…..
আর মায়ার জন্য প্রাণভরে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে। প্রার্থনা করে এমন মেয়ে যেন ঘরে ঘরে জন্মায়। আজ সত্যি’ই শিল্পপতি আশিকুর রহমান জীবন ধন্য। এমন এক আদর্শ মেয়ের আশ্রয়দাতা হতে পেরে তিনি সত্যি’ই ধন্য…..]

চলবে……

1 মন্তব্য

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে