বসন্ত এসে গেছে পর্ব-৬+৭+৮

0
1360

গল্পঃবসন্ত এসে গেছে
লেখাঃনুশরাত জেরিন
৬.৭.৮
পর্বঃ৬
,

শুক্রবারের দিনটা অপুর জন্য ব্যস্ততম একটা দিন।অন্যসব দিনে বাড়ির কাজ,ভার্সিটি, টিউশনি করতে করতে অন্যসব কাজ করার সময় পায়না।কিন্তু শুক্রবার আসলেই একসপ্তাহের পুরো কাজ একসাথে করে অপু।
মায়ের ঘরদোর পরিষ্কার করে,জামা কাপড়,বিছানার চাদর সব একসাথে ধুয়ে দেয়।মাকে শ্যাম্পু করিয়ে গোছলও করায় অপু।

,
সকাল সকাল উঠে কাজে লেগে পরে অপু।
মাকে তুলে বারান্দায় নিয়ে হাতল ওয়ালা একটা চেয়ারে বসায়।গায়ে মিষ্টি বাতাসের ছোয়া লাগে।শরীর মন দু’টোই ফুরফুরে হয়।
মাকে রেখে ঘরে যেতে গিয়ে আবার ফিরে আসে।
মায়ের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে কোলে মাথা রাখে।
আলেয়া বেগম চেয়ারে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বুজে ছিলেন।
কোলে কারও স্পর্শ পেয়ে সেদিকে তাকান।মুচকি হেসে অপুর মাথায় হাত বোলান।
বলেন,

—কিরে অপু?কি হয়েছে আমার মা টার?

—কিছুনা মা।

—কিছুই না?

—উঁহু। একটা কথা ভাবছি জানো মা।

—কি কথা?

—আমাদের সাথে যদি অলৌকিক কিছু ঘটতো,মানে যদি অলৌকিক ভাবে অনেক টাকা পেতাম তাহলে আমাদের সব দুঃখ ঘুচে যেতো তাইনা মা?তোমার চিকিৎসা করাতাম,আমরা দুজন আলাদা একটা বাড়ি বানাতাম।
খুব বেশি না,একটা টিনের ছোট্ট বাড়ি হলেই চলতো।
আর দুবেলা দুমুঠো ভাত।এই হলেই আমাদের দুজনের দিন চলে যেতো বলো মা?

আলেয়া বেগম মেয়ের মুখে এমন বাচ্চামো কথা শুনে হাসেন।বলেন,

—তুই বলছিস টাকা হলেই আমাদের সব দুঃখ ঘুচে যেতো? টাকা থাকলেই সুখ আসে?

অপু বললো,

—হ্যা তো।টাকা থাকলে তো আমাদের এতো কষ্ট করা লাগতো না।

—আমি মানছি জিবনে টাকার দরকার আছে কিন্তু টাকা থাকলেই সুখ পাওয়া যায়না।

অপু মাথা তুলে তাকালো।আলেয়া বেগম বললেন,

—যেমন ধর কারো কারো প্রচুর টাকা আছে, তারা বড় বড় উচু অট্টালিকায় থাকে,দুহাতে অজস্র টাকা উড়ায় কিন্তু তার মনে কোন কারনে শান্তি নেই,সে ঠিকমতো ঘুমাতে পারেনা,খেতে পারেনা।এতো এতো টাকা তার কোন কাজে আসলোনা।
তাহলে কি সে সুখি?
আবার ধর কেউ রিকশা চালায়।দিন আনে দিন খায়,তার ভেতরে কোন চিন্তা নেই,ভাবনা নেই।মনে তার শান্তি।
বাড়িতে বউ বাচ্চা নিয়ে খুশিতে থাকে।যেটুকু আয় করে সেটুকুতেই সন্তুষ্ট।
তাহলে বল তো সে কি সুখি না?

অপু ঘার নাড়ে।বলে,
—তাহলে মনে শান্তি থাকলেই সে সুখি মা?

—অবশ্যই।
প্রত্যেকেই
নিজের নিজের অবস্থানে সুখি আছে।

—সেটা কেমন?

—মনে কর যে রাস্তায় ভিক্ষা করে,অনাথ ছেলে,বাবা মা নেই,ঘর বাড়ি নেই,ঠিকমতো একবেলাও খাবার পায়না।
তার থেকে কি তুই সুখি না?

—হ্যা।

—তাহলে?

অপু উঠে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে।বলে

—তুমি কতো কিছু জানো মা।

অপু আরও কিছু বলতে যায় তার আগেই অপুর ভাবি হাসি হাসি মুখ করে বলে,

—এখানে কি করছো অপু?তোমার ভাইয়া তোমায় কখন থেকে ডাকছে?যাও দেখা করে এসো।

,

,

অপু অবাক হয়।জিবনে কোনদিন ভাবি তার সাথে এতো ভালোভাবে কথা বলেছে কিনা অপুর মনে পরেনা।
চোখ পিটপিট করে তাকায় ভাবির দিকে।আবার মায়ের দিকে তাকায়।
আলেয়া বেগম চোখে ইশারা করে যাওয়ার জন্য।অপু সেদিকে দেখে হেটে ভাইয়ের রুমে এগোয়।
,

,

,

,

অনিকের রুমে ঢুকে একপাশে দাড়ায়,অপু।কতোদিন হলো এ ঘরে আসা হয়না তার।আগেতো প্রায়ই ভাইয়ের জন্য এটাওটা নিয়ে আসতো,রুম গুছিয়ে দিতো।সকালে চা হাতে ভাইয়ের ঘুম ভাঙাতো।
সকালে অপুর হাতের চা আর তার মিষ্টি মুখ না দেখলে নাকি অনিকের দিন ভালো যেতো না।কতো খুনশুটি করতো দু’জনে।
কিন্তু এখন?
সময় বদলেছে,সেই সাথে বদলেছে আপন মানুষগুলোও।

অনিক অপুকে দেখে বলে,

—কি অপু,ওতো দুরে দাঁড়িয়ে আছিস কেনো?আয়,আমার পাশে এসে বস।

অপু এগিয়ে আসে।অনিক বিছানার পাশে বসার জন্য জায়গা করে দেয়।মুখে মিষ্টি হাসি তার।
অপু অবাক চোখে তাকিয়ে দেখে।আজ ভাইকে আগের মতো লাগছে,আগের মতো কথা বলছে ভাই তার সাথে।
ইদানীং তো ভাইয়ের সাথে কথাই হয়না।

অনিক বলে,

—ওভাবে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে কি দেখিস বোন?

অপু অবাক কন্ঠে বলে,

—এটা কি তুই ভাই?সত্যি তুই?

অনিক হাসে।অপুর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

—সত্যি আমি রে বোন।
আসলে আমি অনেক ভাবলাম বুঝলি,অনেক ভাবলাম।
দেখলাম আমি তোদের সাথে অন্যায় করে ফেলছি।মায়ের এতো বড় অসুখ আর আমি কিনা নিষ্ঠুরের মতো টাকার জন্য মায়ের চিকিৎসা করাচ্ছি না?মায়ের থেকে কি আমার টাকা বড় বল?টাকা তো অনেক কামাই করতে পারবো,কিন্তু মা গেলে আর মা কোথায় পাবো?
তাছাড়া তোর পড়াশোনার ব্যাপারেও আমি তোকে সাহায্য করিনি।খুব খারাপ কাজ করেছি আমি,খুবই খারাপ কাজ করেছি।

—তুই তোর ভুল বুঝতে পেরেছিস?

অনিক এবার কাঁদোকাঁদো স্বরে বললো,

—হ্যা রে।আমি বুঝতে পেরেছি আমি কতো বড় ভুল করেছি।তাইতো ভুলগুলো শুধরাতে চাই।মায়ের এ মাসের ভেতর আমি হার্টের অপারেশন করাবো দেখিস তুই।

অপুর চোখ ছলছল করে উঠলো।
তার ভাই ভুল বুঝতে পেরেছে?আবার আগের মতো হয়ে যাবে সে?মায়ের অপারেশন করাবে?মা ও সুস্থ হয়ে যাবে।অপুর জিবনে আবার শান্তি আসবে?

দুহাত দিয়ে অনিকের হাত আকড়ে ধরে অপু।বলে,

—সত্যি মায়ের অপারেশন করাবি ভাই?সত্যি?

খুশিতে কথাগুলো জড়িয়ে আসে অপুর।

অনিক বলে,

—হুমমম করাবো তো।মায়ের অপারেশন করাবো,তোর বিয়ে দেবো।
খুব ভালো ঘরে তোর বিয়ে দেবো।

—আমার বিয়ের কথা পরে ভাবিস।তাছাড়া এখন আমি পড়াশোনা করছিতো।আগে মায়ের অপারেশন করা।

অনিক অপুর হাত ছাড়িয়ে নেয়।বলে,
—তোর বিয়ে না দিলে মায়ের অপারেশন হবে কি করে?

অপু অবাক হয়।
—আমার বিয়ের সাথে মায়ের অপারেশনের কি সম্পর্ক ভাই?

—আরে তোর বিয়ে দিলেই তো তোর শশুড় আমাদের অনেক টাকা দেবে।সেই টাকা দিয়েই তো মায়ের অপারেশন হবে।সাথে আমরাও কিছু পাবো আর কি?

—মানে?আমি তো কিছুই বুঝতে পারছিনা।

অনিক এবার ধৈর্যহারা হয়।এতো মানে মানে করে মেয়েটা,মেজাজ ঠিক করে আবার বলে,

—এতোকিছু তোকে বুঝতে হবেনা।শুধু জেনে রাখ সামনের শুক্রবার তোর বিয়ে।

—বিয়ের তারিখও ঠিক করে ফেলেছিস?

—তো কি করবো?যতো তাড়াতাড়ি বিয়েটা হবে ততো তাড়াতাড়ি টাকাগুলো পাবো,না মানে ততো তাড়াতাড়ি মায়ের অপারেশন হবে।
তুই কি চাস না মায়ের অপারেশন হোক?

অপু কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে থাকে।
এতোক্ষণে ভাই ভাবির এতো ভালো ব্যবহারের কারন বোঝে।
মাথাটা ভনভন করে।তার ভাই,আপন ভাই টাকার জন্য বোনকে খোজখবর না নিয়ে যারতার সাথে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে?
এটা কি সত্যি অপুর ভাই?
তারমানে ভাইয়ের এতোক্ষণের ব্যবহার,কথা সব নাটক ছিলো?
অপুর মাথা কাজ করেনা।ভাবে সে কি বিয়েটা করবে?এভাবে কি বিয়ে হয়?কিন্তু মা?মায়ের অপারেশনটা যে হবে তাহলে।
মাকে বাঁচানোর জন্য এটুকু কি অপু করতে পারেনা?

অনিক ধাক্কায়।বলে,

—কিরে কি এতো ভাবছিস?এতো তো মা মা করিস আর এখন আসল জায়গায় এসে চুপ মেরে গেলি?মায়ের অপারেশন হোক তুই চাস না?

অপু ঘোর লাগা গলায় বলে,

—-চাই।

—তাহলে বিয়ের আয়োজন শুরু করে দেই?

—হুম।

,

,

,গল্পঃবসন্ত এসে গেছে
লেখাঃনুশরাত জেরিন
পর্বঃ৭

,

,

,
চারপাশে হইচই,চিৎকার, চেচামেচি কোলাহল।
অনেক মানুষের আনাগোনায় মুখরিত চারিদিক।মানুষে গিজগিজ করছে অপুদের বাড়ি।বাচ্চারা এদিক ওদিক ছোটাছুটি করছে।
উৎসব উৎসব আমেজ সবখানে।
সবার মুখে হাসি ফুটে আছে।হাস্যোজ্জল পরিবেশে মধ্যমনি হয়ে বসে থেকেও বিন্দুমাত্র আনন্দ ছুতে পারছেনা অপুকে।ভেতরে ভেতরে গুমরে মরছে সে।মনে বয়ে চলেছে অজানা ভয়ের স্রোতধারা।
কি হতে চলেছে তার জিবনে?জিবন নামক এ নদী কোন দিকে মোড় নেবে এবার?অপু কি সেখানে ভালো থাকবে?

অপু মাথা চেপে ধরে।অতিরিক্ত চিন্তায় মাথা ব্যথা করছে তার।তারউপর এতো চিৎকার চেচামেচি। কিচ্ছু সহ্য হচ্ছে না অপুর।মনে হচ্ছে একছুটে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়।
চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে,

আমি এ বিয়ে করবোনা,করবোনা আমি এমন বিয়ে।

কিন্তু বলতে পারেনা অপু।মায়ের হার্টের অপারেশনটা না করালে মা বাঁচবে না।ভাই কোনদিনও নিজের পকেটের টাকা খরচ করে মায়ের অপারেশন করাবেনা।অপুরও আয়ের এমন কোন উৎস নেই যা দিয়ে অপারেশনের টাকা জোগাড় করা যায়।
অপুর কাছে মাকে বাঁচানোর জন্য বিয়েটা করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই।

এরকম ত্যাগ সে করতেই পারে।

কিছু মেয়েরা দৌড়ে রুমে ঢোকে।খিলখিল করে হাসতে হাসতে বলে,

—অপুরে তুইতো লটারি জিতেছিস রে লটারি।তোর জামাই তো পুরো রাজপুত্র রে।

কথাটা বলেই আবার হাসিতে মেতে ওঠে তারা।
রাজপুত্র কথাটা মাথায় বারবার ঘোরে অপুর।
রাজপুত্র? যে কিনা রাক্ষসদের হাত থেকে যুদ্ধ করে রাজকন্যা কে উদ্ধার করে?রাজকন্যার সকল বিপদে ঢাল হয়ে যে সামনে দাড়ায়?
অপুর বরও কি সেরকম হবে?অপুর বিপদে আপদে তার পাশে ভরসার হাত হবে?নাকি শুধু দেখতেই রাজপুত্রর মতো?

অহেতুক চিন্তাগুলো অপু মাথা থেকে ঝেরে ফেলে।তার কিচ্ছু ভাবতে ইচ্ছে করছেনা এই মুহুর্তে। মাথাটা খুব ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।

একটু পরেই কাজি আসে ঘরে।
একটা কাগজ এগিয়ে দেয় সই করার জন্য।
অপুর হাত কাপে।এই মুহুর্তে তার মাকে পাশে দরকার।
কিন্তু মা তার ঘরে ঘুমিয়ে আছে।অপুর এরকম ভাবে বিয়ের কথা শুনে মা কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছিলো তাই ভাই ভাবি তাকে ঘুমের ঔষধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে।
অপু চোখ বুজে কয়েক সেকেন্ড দম নেয়।জোরে জোরে শ্বাস ফেলে।মায়ের মুখ মনে করে।মায়ের সুস্থ হওয়ার কথা ভাবে।
নিজেই নিজেকে সাহস দেয়।
এদিকে অনিক তাড়া দেয়,

—কিরে সই কর।এতোক্ষণ সময় নিলে হয় নাকি?

অপু চোখ মেলে তাকায়,গটগট করে সই করে দেয়

অপুকে কাবিননামার কাগজ পড়ে শোনায় কাজি।কবুল বলতে বলে।
অপু এবার আর সময় নেয়না।
বলে ওঠে,

—কবুল,কবুল,কবুল।

অনিকের মুখে দেখা যায় লম্বা হাসির রেখা।চোখ চকচক করে লোভে।অন্যদিকে বোনের চোখে যে অশ্রুর ধারা নামে সেদিকে তার কোন হুশ নেই।

,

,

বিদায় বেলাতেও অপু মায়ের সাক্ষাৎ পায়না।গাড়িতে উঠার সময় এদিক ওদিক বারবার তাকায়।কোন আপনজনের অপেক্ষা করে।কিন্তু কেউ আসেনা।অচেনা এতো মানুষের ভিড়ে চেনা মুখগুলো খুজে পায়না।
আশেপাশে গুঞ্জন শোনে,

—জামাই কি বিয়েতে রাজি না নাকি?দেখলি না কেমন গম্ভীর মুখ করে বসে ছিলো পুরোটা সময়।

আরেকজন বলে,

—হ্যা দেখেছিতো,তাছাড়া কবুল বলার পর পরই কেমন বেরিয়ে গেলো।বিয়ে করা বউকে একনজর দেখলো না পর্যন্ত।

—সত্যি তো।

অপুর বিষাদময় হ্রদয় আরো বিষাদে পরিনত হয়।চোখ বেয়ে টপাটপ জল পরে।ভবিষ্যতে কি হবে কথাটা ভাবতেই শিউরে ওঠে।
এমনসময় আরমান খান এগিয়ে আসেন।
অপুর মাথায় হাত বুলিয়ে চোখের জল মুছে দেন।
চোখ দিয়ে আশ্বস্ত করেন।
সে চোখে অপু ভরসা খুজে পায়।মনে হয় এইতো এখানে একজন আছে আমার আপনজন।
আছে একটা ভরসার হাত।
একটু পাশে তাকিয়ে ভাইকে নজরে পরে। দৌড়ে ভাইয়ের কাছে যায় অপু।
অনিক তখন একজন লোকের সাথে দাড়িয়ে কথা বলছিলো।
অপুকে আসতে দেখে বিরক্ততে কপাল কুঁচকায়।
বলে,

—এখনো যাসনি?

এমন সময় এমন কথা শুনে অপু থমকে যায়।এতো এতো কথা বলার ছিলো ভাইকে তার।বুকে মাথা রেখে কাঁদা বাকি ছিলো তার।কিন্তু ভাইয়ের রুক্ষ, বিরক্তিমাখা মুখের দিকে তাকিয়ে সবকথা যেনো হারিয়ে গেলো অপুর।
মুখে শুধু বললো,

—মাকে দেখে রাখিস।

কথাটা বলেই একমুহূর্ত দাড়ালো না অপু।ছুটে এসে গাড়িতে উঠে বসলো।
ভাইয়ের বদলে যাওয়া নিষ্ঠুর রুপ আর দেখতে চায়না অপু।আর না।
দুহাতে মুখ ঢেকে হু হু করে কেঁদে উঠলো সে।

,

,

,
——————-

,

,

আলিসান এক রুমে বসে আছে অপু।এতোবড় রুম,এতো দামী আসবাবপত্র জিবনে দেখেনি অপু।
খাটটাও সাজানো হয়েছে পুরো গোলাপ দিয়ে।যেনো দেশের সব গোলাপ এখানে নিয়ে আসা হয়েছে।
অপু এতোক্ষণ ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে দেখছিলো এসব,এখন মুলত তার ঘুমে চোখ ভেঙে আসছে।
রিতীমত ঘুমে ঢুলছে সে।বেশ কিছুদিন ধরে টেনশনে ঘুমাতে পারেনা অপু।আজ আবার বিয়ে বাড়িতে প্রচুর ধকল গেছে শরীরের ওপর দিয়ে।
সেই সব ক্লান্তি যেন একসাথে ভর করেছে আজ তার ওপর।

ঘড়ির কাটা এখন তিনটার ঘরে আটকে আছে।
অপু সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে স্মীত হাসলো।
সে প্রথমেই বুঝতে পেরেছে ছেলে এ বিয়েতে রাজি ছিলোনা।রাজি থাকলেও অপুকে কখনো মেনে নেবেনা।
মেনে নেবেই বা কিভাবে? কোথায় নামীদামী বড়লোক বাবার ছেলে,আর কোথায় অপু।
এভাবে কি মেনে নেওয়া যায়?
তাছাড়া লোকমুখে শুনেছে ছেলে নাকি রাজপুত্রের মতো দেখতে,আর অপু?সে সাধারন একটা মেয়ে।সাভাবিক দেখতে তাকে,সচরাচর যেমনটা দেখা যায় তেমন।আহামরি সুন্দরী তো নয়।
তাহলে?
কেন মেনে নেবে ছেলেটা?
অপুর কান্না পায় আবার পরক্ষনে নিজেই নিজের প্রতি অবাক হয়।
সে কাঁদছে কেনো?
কোনকিছু না পাওয়ার কষ্টে মানুষ কাঁদে? কিন্তু অপুর কান্না পাচ্ছে কেনো?সে কি পায়নি?
সুখ?
সুখের আশা কি করেছিলো সে?অপু তো জানতো এভাবে টাকা দিয়ে কিনে আনা মেয়েকে এতো বড়লোক ছেলে মেনে নেবেনা বা সংসার করবেনা।তাহলে?

নিজের ভাবনা চিন্তাকে জলাঞ্জলী দিয়ে উঠে দাড়ায় সে।মৃদু আলোয় চোখ ছোটছোট করে দেখে সাবধানে পা ফেলে হাটে।
ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে দাড়ায়।গলার কানের গহনার ধারগুলো গায়ে লেগে কুটকুট করছে।
অপুর অসস্থি হচ্ছে।
সে একে একে সব গহনা খুলে ড্রয়ারে তুলে রাখে।

তারপর ওয়াশরুমে গিয়ে চোখে মুখে পানির ঝাপটা দেয়।
তোয়ালে দিয়ে মুখ মোছে।
এই মুহুর্তে বিয়ের এই ভারী শাড়িটা বদলাতে পারলে ভাল হতো খুব।
খুবই জাঁকজমক এই শাড়িটা।
শাড়ি পরার অভ্যাস থাকলেও এতো ভারী শাড়ি পরার অভ্যাস অপুর নেই।
কিন্তু শাড়িটা বদলালে অপু কি পরবে সেটাই তো জানেনা।
বাড়ি থেকে কেউ তার সাথে জামাকাপড় দিয়ে দেয়নি।অপুও এতো টেনশনের মাঝে এসব নিয়ে ভাবেনি।কিন্তু এখন পরেছে সে মহাযন্ত্রনায়।বিয়ের পরদিন সকালেই কার কাছে বলবে যে আমার জামা এনে দাও?

অপুর এতো ভাবনার মাঝে দরজায় খট করে শব্দ হয়।অপু ফিরে তাকায়।
ঘরে ড্রিম লাইটের হালকা আলো জ্বলছে।
সামনে থাকা মানুষটার চেহারা দেখা সম্ভব হয়না।চোখ ছোট করে দেখার চেষ্টা চালায় অপু কিন্তু লোকটা সে সুযোগ দেয়না।গটগট করে এসে কাবার্ড খুলে টাউজার টিশার্ট নেয়।ওয়াশরুমে ঢুকে ঠাস করে দরজা লাগায়।
এতো জোরে শব্দে অপু দুহাত দিয়ে কান চেপে ধরে।
মিনিটখানেক যেতে না যেতে নোমান বেরিয়ে পরে।
অপু বিরবির করে,
—কি ফাস্ট রে বাবা।

অপুকে পাশ কাটিয়ে খাটে ধপ করে শুয়ে পরে নোমান।
অপু হা করে দাড়িয়ে থাকে।
নিজের দিকে একবার তাকায়,ভাবে সে কি অদৃশ্য হয়ে গেলো নাকি?
নাহ হয়নি তো?তাহলে?
লোকটা এমন ভাব করলো যেনো অপু এ রুমে নেই।তাকে দেখা যায়নি।
আরে মেনে না নিলি তবুও সৌজন্যমূলক কিছু তো বলতে পারতো।
অপু দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে খাটের কাছে এগোয়,তারও ঘুম পাচ্ছে।
খাটে বসার আগেই নিচে কিছু একটা পরে।অপু সেদিকে তাকায়,দেখে একটা বালিশ।
বালিশ কুড়িয়ে নিয়ে আবার খাটের কাছে আসে অপু।

নোমান বলে ওঠে,

—খাটে আমার সাথে একই বিছানায় শোয়ার স্পর্ধাও করোনা।
বালিশটা নিয়ে বিদেয় হও।

অপু অবাক হয়না।এরকম কিছু সে অনেক আগেই ভেবেছিলো।
বালিশ নিয়ে সোফায় যায়।
গুটিশুটি মেরে শুয়ে পরে।ঘুমে চোখ লেগে আসে তার।

,

,

গল্পঃবসন্ত এসে গেছে
লেখাঃনুশরাত জেরিন
পর্বঃ৮
,

,

,

সকাল সাতটায়,অপুর ঘুম ভাঙলো। আচমকা নতুন পরিবেশে, নতুন জায়গায় ঘুমানোর ফলে হয়তো বেশি বেলা হয়ে গেছে।তাছাড়া ঘুমাতেও গিয়েছিলো তো শেষ রাতে।
কিছুক্ষণ বসে আড়মোড়া ভেঙে উঠে দাড়ায় অপু।
পরমুহূর্তে তড়িঘড়ি করে।এ বাড়ির নিয়মকানুন তো অপু কিছুই জানেনা।যদি এ বাড়িতে সকাল সকাল ওঠার নিয়ম হয়?তখন তো অপুকে কথা শুনতে হবে।
অপু চটজলদি উঠে ওয়াশরুমে যায়।ফেশ হয়ে রুম থেকে বাইরে বেরোয়।
নোমান তখন ঘুমে বেঘোর।

অপু সিড়ি দিয়ে নিচে নামে।ড্রয়িং রুমে নেমে আসেপাশে তাকিয়ে দেখে।
চোখ বড় হয়ে যায় তার।এতো দামী আসবাব জিবনেও দেখেনি অপু,ব্যবহার করা তো দুরে থাক।
আশেপাশে দেখতে দেখতে সামনে এগোয়।
ড্রয়িং এর পাশে ডাইনিং রুম।
তারপাশে কিচেন।
কিচেনে টুংটাং শব্দ শুনে অপু কিচেনে যায়।দেখে দুজন মহিলা কাজ করছে আর গল্প করছে।
অপুকে দেখে তারা এগিয়ে আসে।
বলে,

—আপনে এইখানে কি করেন ছোট ম্যাডাম?

আরেকজন বলে,

—কিছু দরকার হইলে আমাগো ডাকতেন,আমরা চইলা আইতাম।

অপু তাদের থামিয়ে বলে,

— আরে আপনারা এতো ব্যতিব্যস্ত হবেননা।আমি এমনি ঘুরে দেখছিলাম।

—ওহ।আচ্ছা ছোট ম্যাডাম দেখেন।

অপু কপট রাগ দেখিয়ে বললো,
—কিন্তু আপনাদের ব্যবহারে আমি খুব মাইন্ড করেছি।

দুজনেই ভয় পাওয়া ভঙ্গিতে বললো,

—আমরা কি করলাম?

—আপনারা আমাকে ছোট ম্যাডাম বলে কেন ডাকলেন?

—তাইলে কি ডাকুম?

— নাম ধরে ডাকবেন,আমি আপনাদের মেয়ের বয়সী,আমাকে নাম ধরে ডাকতেই পারেন।আর হ্যা তুমি করে বলবেন।আপনি আপনি বলা চলবেনা।

—নাম ধইরা ডাকমু?

—হ্যা,আর আমি আপনাদের…

একটু চিন্তা করে বলে,

—খালা বলে ডাকবো।
আচ্ছা খালা বলে ডাকলে কি আপনারা রাগ করবেন?

রুজি বেগম আর নয়না বেগম দুজনের মুখ চাওয়াচাওয়ি করেন।দুজনে যেন বিশ্বাসই করতে পারছেননা এসব।
এ বাড়িতে কেউ তাদের সাথে ঠিকমতো কথাই বলেন না সেখানে ছোট স্যারের বউ এসে তাদের খালা সম্মোধন করে ফেললো?
দুজনে ছলছল চোখ নিয়ে হ্যা সূচক মাথা নাড়ে।

অপু মুচকি হাসে।এগিয়ে চুলার কাছে উঁকি দেয়।বলে,

— কি রান্না করছেন আপনারা ।

—চা বানাই।

—আর ওটা কি?

—কফি,ছোট স্যারের লাইগা।
আসলে আমি চা বানাইতাছি আর রুজি নাস্তা বানাইতাছে তাই এখনো কফিটা ঘরে দিয়া আসতে পারিনাই।

অপু বলে,

—দিন তো আমি দিয়ে আসছি।

রুজি বেগম ইতস্তত করেন।
অপু হাত এগিয়ে দেয়।কিন্তু দুর্ঘটনাবশত রুজির হাত থেকে কফির কাপ পরে যায়।
নয়না মাথায় হাত দেয়।
চা কাপে ঢালতে ঢালতে বলে,

—বড় স্যার আর মেডামরে চা দিয়া আমি আইসা আবার কফি বানাইতাছি।তুই নাস্তা বানা রুজি।

কথা বলতে বলতে সে চার ট্রে নিয়ে বেরিয়ে যায়।

অপু রুজি বেগমকে বলে,
—কফিটা আমি বানাই খালা?

—আপনে?মানে তুমি বানাইবা?

—বানাইনা খালা,প্লিজ।

রুজি অপুর এমন চেহারা দেখে হেসে ওঠে,অপুও হাসে।
নিজ হাতে কফি বানিয়ে বাইরে বেরোতে যায় আবার ফিরে আসে।
বলে,

—একটা কথা বলবো খালা?

—হ কও।

—না মানে একটা শাড়ির ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন?আমার কাছে এইটা ছাড়া আর কোন শাড়ি নেই।

রুজি বেগম অপুর দিকে তাকিয়ে দাঁতে জিভ কাটে। মেয়েটা এখনো বিয়ের শাড়ি পরে আছে।
সে বলে,

—বড় স্যার তোমার লাইগা এক গাদা শাড়ি আইনা রাখছে।
আমারে কইছিলো তোমারে দিতে,আমি এক্কেরে ভুইলা গেছি।
দাঁড়াও তোমারে আইনা দেই।

—না না আপনাকে এনে দিতে হবেনা, আপনি বলুন কোথায় রাখা আছে,আমি নিয়ে নিচ্ছি।

—তোমার রুমের পাশে আরেকটা রুমে রাখা আছে,সেইখানে।

—ঠিক আছে,ধন্যবাদ খালা।

রুজি বেগম অপুর কথা শুনে হাসেন।

অপু কফির কাপটা হাতে নিয়ে উপরে ওঠে।পাশের রুমে ঢুকে শাড়ির ব্যাগ দেখতে পায়।সেখান থেকে গোলাপি রংয়ের একটা শাড়ি তুলে নেয়।
নিজের রুমে ঢুকে খাটের পাশে সেন্টার টেবিলে কফির কাপটা রেখে শাড়ি নিয়ে ওয়াশরুমে ঢোকে।

ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে দেখে নোমান উঠে বসেছে।হাতে তার কফির কাপ।
সকালে ঘুম থেকে উঠেই তার কফি খাওয়ার অভ্যাস।

অপু বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ায়।বেলকনিটাকে তার কাছে কেমন ন্যাড়া ন্যাড়া মনে হয়।কেন দোলনা,ফুলের টব কিচ্ছু নেই।কেমন যেনো নির্জীব লাগে দেখতে।
অপু সোজা হয়ে দাড়িয়ে গ্রিলের ফাঁকে হাত রাখে। সকালের মিষ্টি রোদ গায়ে মাখে।চারদিক থেকে ঝিরিঝিরি বাতাস দোলা খায়।অপু চোখ বুজে বাতাস উপভোগ করে।
হঠাৎ বিকট কোন শব্দে চকিত দৃষ্টিতে পেছন ফেরে।
শব্দটা অনুসরণ করে রুমে ঢোকে।
দেখে ফ্লোরে কফিসহ ভাঙা মগের কাচ এদিকওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
নোমানের দিকে তাকিয়ে দেখে তার চোখ লাল,মুখটা অসম্ভব রাগী।
অপু এগিয়ে গিয়ে বলে,

—কি হয়েছে?

নোমান রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে অপুর উপর।
অপু ভয় পায়,দু কদম পিছিয়ে যায়।
নোমান চিৎকার করে ডাকে,

—নয়নাআআ,রুজিইইই,,কোথায় সবাই।

অপু ঢোক গেলে।এতো সুন্দর রাজপুত্রের মতো দেখতে মানুষটার এমন ভয়ংকর রুপ দেখে সে ঘাবড়ে যায়।
মিনমিন করে বলে,

—আমাকে বলুন।

নোমান বলে,
—তোমার নাম রুজি?নয়না?

—না।

—তাহলে তোমাকে কেনো বলবো।

রুজি বেগম,নয়না দরজায় দাঁড়ায়। তাদের মুখটা ভয়ার্ত দেখায়।
কাঁপা কাপা কন্ঠে বলে,

—কি হয়ছে ছোট স্যার?

নোমান গর্জে উঠে,

—কি হয়েছে?সকাল সকাল আমার মুড খারাপ করে বলছো কি হয়েছে?

—-কি করছি আমরা স্যার?

—কি করছো?কফিতে চিনি কেনো দিয়েছো?কেনো?জানোনা আমি কফিতে চিনি খাইনা?

রুজি আর নয়না বেগম কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে।চোখাচোখি করে কথা বিনিময় করে।একটু পর বলে,

—ভুল হয়ে গেছে স্যার,আর হবেনা।এবারের মতো ক্ষমা করে দেন।

অপু অবাক হয়।কফিটা সে বানিয়েছিলো।তাহলে রুজি খালা সে কথা বলছেনা কেনো?কেনো নিজের ঘারে দোষ নিচ্ছে? অপুকে বাঁচাতে?
কৃতজ্ঞতায় ভাষাহীন হয়ে পরে অপু।

নোমান রুজিকে কিছু বলতে যাওয়ার আগেই সামনে দাড়ায় অপু।
নোমান জিজ্ঞাসু সূচক চোখে তাকায়।
অপু বলে,

—কফি রুজি খালা বানায়নি,আমি বানিয়েছি।

চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে