বসন্তের একদিন পর্ব-০১

0
1800

#বসন্তের_একদিন
#পর্বঃ০১
#লেখিকাঃঅনন্যা_অসমি

” কোথাই যাচ্ছো বউমা?কোন পার্টি যাচ্ছো নাকি?”

শাশুড়ীর কথা শুনে ওখানেই থেমে যায় তৃধা।মাত্রই অফিস যাওয়ার জন্য বের হচ্ছিল তৃধা তখনই তাকে এই কথাটা বলে তার শাশুড়ী।

” মা এখন তো সকাল,সকালে তো কোন ধরণের পার্টি হয়না।”

” না থ্রি-পিস পড়লে তো তাই জিজ্ঞেস করলাম।”

” না মা অফিসে যাচ্ছি আমি।””

” তাহলে থ্রি-পিস পড়েছো কেন?”

” আসলে মা শাড়ি আমি সামলাতে পারিনা।শাড়ি পড়লে কাজের অসুবিধা হয়,তাই…”

তৃধাকে থামিয়ে তার শাশুড়ী গভীর কন্ঠে বললেন,

” সামলাতে না পারলেও শাড়ি পড়তে হবে।তুমি এখন এই বাড়ির বউ সেটা ভুলে যেওনা।আর আমাদের বাড়ির বউয়েরা কখনো শাড়ী ছাড়া অন্য কোন কাপড় পড়েনা।যাও এটা বদলে এসো।”

তৃধা আর কোন কথা না বলে রুমে চলে আসে।তৃধাকে পুনরায় রুমে আসতে দেখে তার স্বামী তেজবীন তাকে প্রশ্ন করে —

” কি হলো?আবার ফিরে এলে কেন?”

” তোমার মা বলেছে থ্রি-পিস পড়ে বাইরে যাওয়া যাবেনা।তাই পাল্টে এসেছি।”

” আমি তোমাকে আগেই বলেছিলাম,মা এসব মানবেন না।দেখো এখন শুধু শুধু টাকা গুলো নষ্ট হলো।”

তেজবীনের কথা শুনে তৃধার মনের কষ্টটা আরো বেড়ে গেলো।সে ভেবেছিল তেজবীন হয়তো তার সঙ্গ দেবে।কিন্তু বরাবরের মতো এবারো তেজবীন তার মায়ের সঙ্গই দিলো।তৃধা মন খারাপ সাইডে রেখে শাড়ী নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো।

শাড়ি পড়ে বাইরে এসে তৃধা দেখে তার অফিস শুরু হতে মাত্র ১০ মিনিট বাকি আছে।তাড়াতাড়ি করে বের হতে গেলে শাড়ির সাথে লেগে নিচে পড়ে যায় তৃধা।তৃধাকে পড়ে যেতে দেখেও তেজবীন নিজের মতো তৈরি হতে থাকে।এর মধ্যেই পান চিবোতে চিবোতে তৃধার শাশুড়ী ফাতেমা বেগম সেখানে আসে।

” হায় হায় সকাল সকাল ঘটালো আরেকটা বিপদ।এই মেয়ে একটা কাজও ঠিক মতো করতে পারেনা।প্রতিদিন একটা না একটা কান্ড তার ঘটনানো লাগবেই।এবার এখানে বসে না থেকে অফিসে গিয়ে আমাকে উদ্ধার করো দেখি বাপু।”

তৃধা একটা নিঃশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ায়।বাইরে এসে দ্রুত একটা রিকশায় উঠে বসে তৃধা।তৃধা আনিশা,একটা ম্যাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে কাজ করে।যদিও বা তার পদ বড় না তাও সে তার চাকরি নিয়ে খুশি।তেজবীন আহসান,তৃধার স্বামী।মাত্র ৭ মাস হলো তাদের বিয়ে হয়েছে।বিয়ের প্রথম দিন থেকেই তৃধার শাশুড়ী তার প্রতি অসন্তুষ্ট কারণ তার চাকরি।তিনি মোটেও চাননি যে বাড়ির বউ চাকরি করুক কিন্তু তৃধা সবার বিরুদ্ধে গিয়ে নিজের চাকরি করে যাচ্ছে।এসব কিছু ভাবতে ভাবতেই তৃধা তার অফিসে পৌঁছে যায়।

অফিসে আসতে দেড়ি হয়েছে বিধায় ম্যানেজার তৃধা অনেক বকা ঝকা করেন।কিন্তু তৃধা কিছু না বলে চুপচাপ মাথা পেতে তা মেনে নেয়।কারণ কিছু বললেই তার চাকরি চলে যাবে।আর একবার চাকরি চলে গেলে তাকে আর তার শশুড়বাড়ীর লোকেরা চাকরি করতে দেবেনা।

বকা খেয়ে তৃধা নিজের ডেস্কে এসে বসে।সকাল থেকে ঘরের সব কাজ করে,তারপর এতসব কিছু আর তৃধা নিতে পারছেনা।সে ব্যাগ থেকে বোতল বের করে পানি খেয়ে নেয়।পানি খাওয়া পর তৃধার নিজেকে একটু হালকা লাগছে।

” কি তৃধা ম্যাডাম,আজ এতো ক্লান্ত লাগছে যে?”

তৃধা মাথা উঁচু করে দেখে তার ডেস্কের সামনে তার কলিগ রোহান দাঁড়িয়ে আছে।রোহানকে দেখে তৃধা হালকা হাসে।

” তেমন কিছু না রোহান সাহবে।আসলে সকাল থেকে এতো ছোটাছুটি করে অফিস এসে একটু ক্লান্ত বোধ করছি।”

” তোমার এতো সমস্যা হলে তুমি চাকরিটা ছেড়ে দিচ্ছো না কেন?চাকরি ছেড়ে দিলে তো তোমার আর দৌড়াদৌড়ি করতে হচ্ছে না।শান্তিমতো আরামে বাড়ির কাজ সামলাতে পারবে।”

” আমার বাবা-মা তো আমাকে এতো কত কষ্ট করে পড়াশোনা বসিয়ে রাখার জন্য করাইনি।আমি যাতে একটা ভালো চাকরি করতে পারি,তার জন্যই ওনারা আমাকে পড়াশোনা করিয়েছেন।এখন যদি আমি চাকরি ছেড়ে দিয় তাহলে তো আমার বাবা-মায়ের কষ্ট বিফলে যাবে।”

” বুঝতে পেরেছি তোমার সাথে এখন কথা বললে তুমি একজন জ্ঞানী হয়ে যাবে।তার থেকে বরং আমি যায়,তুমিও তোমার কাজ করো।”

রোহান চলে যায়।তৃধা সবকিছু মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে নিজের কাজে মন দেয়।

অফিস শেষ করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে তৃধার সন্ধ্যা পর হয়ে যায়।তৃধা বাড়িতে ঢুকে যেই নিজের রুমের দিকে যাবে তখনই ফাতেমা বেগম তার সামনে এসে দাঁড়ায়।

” আজ আসতে এতো দেরি হলো কেন?”

” ৫ মিনিটই তো দেরি হয়েছে মা।” মাথা নিচু করে উত্তর দেয় তৃধা।

” তোমার সাহস তো দেখছি দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে,তুমি আমার মুখে মুখে কথা বলছো।”

” আসলে মা রিকশা পেতে দেরি হয়ে গিয়েছিল তাই….”

” হয়েছে হয়েছে আর সাফাই গাইতে হবেনা।এতো দেরি করে যে এলে রাতের রান্না করবে কে শুনি?রাত ৮ বাজে এখনো রাতের খাবার রান্না হয়নি।আমার ছেলেটা কিছুক্ষণ পর এলো বলে।বেচারা ছেলেটা সারাদিন অফিস করে আসবে,এসে যদি খাবার না পাই।এখনো আমার চেহারের দিকে কি দেখছো?যাও গিয়ে তাড়াতাড়ি চুলায় ভাত বসাও।”

তৃধা চুপচাপ রুমে এসে গোসল করতে চলে যায়।সকালে পড়ে গিয়ে হাতে ব্যথা পেয়েছিল তৃধা।পানি লাগার সাথে সাথে সে জায়গায় জ্বলতে শুরু করে।তবে তৃধা সেদিকে মনোযোগ না দিয়ে তাড়াতাড়ি গোসল শেষ করে বেরিয়ে আসে।দেরি হলে তা শাশুড়ী আর তার স্বামী তার গায়ে হাত তুলতেও দ্বিধাবোধ করবেনা।

চুলায় ভাত বসিয়ে দিয়ে শুটকি ভর্তার জন্য শুটকি ধুতে শুরু করে দেয় তৃধা।তার শাশুড়ী নাকি রাতে শুটকি ভর্তা খাবে।এরই মধ্যে বেল বেজে উঠে।তৃধা শুটকি সেখানেই ফেলে দৌড়ে দরজা খুলতে ছুটে যায়।কারণ সে জানে এখন তেজবীন এসেছে আর দরজা খুলতে দেরি হলে তার রক্ষে নেই।এইতো কিছুদিন আগে তৃধা বাথরুমে গিয়েছিল আর তখনই তেজবীন আছে।দরজা খুলে ২/৩ মিনিট দেরি হয়েছি বলে দরজা খোলার সাথে সাথে তৃধার গায়ে তেজবীন চড় মেড়ে দেয়।

” কোথাই মরতে গিয়েছিলি যে দরজা খুলতে এতো দেরি হলো?তোকে না বলেছিলাম আমি বেল দেওয়ার সাথে সাথে যেন দরজা খুলে যায়।”

” আমি ওয়াশরুমে গিয়েছিলাম তাই…..” তৃধার কথা শেষ হওয়ার আগেই তেজবীন আবারো চড় মারে তৃধার গালে।তারপর হনহন করে নিজের রুমে চলে যায়।তৃধা চোখ বন্ধ করে নিজের রাগ সংযত করে রান্নাঘরে চলে যায়।

কফি করে তেজবীনের জন্য নিয়ে আসে তৃধা।তেজবীন তখন মোবাইলে কিছু একটা করছিল।

” তোমার কফি।”

তেজবীনকে কফিটা দিয়ে চলে যেতে নিলে তেজবীন তৃধার হাত ধরে তাকে যাওয়া থেকে আটকিয়ে দেয়।তৃধা তেজবীনের দিকে তাকিয়ে দেখে সে ভ্রু-কুচকে তৃধার দিকে তাকিয়ে আছে।হুট করেই তেজবীন তৃধার চুল ধরে।

” আহ….তেজবীন কি করছো?ছাড়ো,লাগছে আমার।”

” লাগুগ।এই তোর চুল ভিজা কেন?তুই গোসল করেছিস নাকি?এই কার সাথে রাত কাটিয়ে বাড়ি ফিরেছিস হ্যাঁ?”

” তেজবীন তুমি এসব কিসব আজেবাজে কথা বলছো?”

” তাহলে তুই গোসল করলি কেন?”

” আজ খুব গরম পড়েছিল,ঘেমে গিয়েছিলাম প্রচুর তাই এসে গোসল করেছি।ঘামে ভিজা শরীর নিয়ে তো আর রান্না করা যায় না।প্লিজ ছাড়ো আমার চুল।”

তেজবীন তৃধাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়।তৃধা গিয়ে দেওয়ালের সাথে ধাক্কা খায়।একনজর তেজবীনের দিকে তাকিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায় তৃধা।

ফাতেমা বেগম বেগম কে রাতের খাবার বেড়ে দিচ্ছে তৃধা।

” এইযে নবাবের বেটি,এতো আস্তে আস্তে কচ্ছপের মতো খাবার বাড়ছো কেন?আমাকে কি আজ না খাইয়ে রাখার চিন্তা আছে নাকি?”

তৃধা একবার ফাতেমা বেগমের দিকে তাকিয়ে হাত চালিয়ে ওনাকে খাবার বেড়ে দেয়।ফাতেমা বেগম ডালের বাটি থেকে ডাল ঢেলে ভাতের সাথে মেখে খেতে থাকে।কিন্তু একলোমকা ভাত মুখে নেওয়ার পর উনার চোখ মুখ কুচকে যায়।

” রান্নার সময় মন কোথাই থাকে তোমার?ডালটা এতো পানি পানি কেন?বাপ-মা ঠিক মতো রান্নাটাও শিখিয়ে পাঠায়নি।”

তৃধাকে কথা শোনাতে শোনাতে ফাতেমা বেগম শুটকি ভর্তা নেন।কিন্তু এবারো খাবারটা মুখে দিয়ে উনার চোখমুখ কুচকে আসেন।

” এই মেয়ে আজ কি তোর আমাকে না খাইয়ে রাখার চিন্তা আছে নাকি?এটা কি শুটকি ভর্তা করেছিস?এতো ঝাল আর লবণ কেন?হুম বুঝতে পেরেছি,আমাকে না খাইয়ে রাখার জন্য তুই এসব করেছিস।কি দেখে যে তোকে নিজের ছেলের বউ করে এনেছিলাম।আমার ছেলেটাকে তো নিজের আঁচলে তোলে সেই কবেই নিয়ে নিলো এখন আমাকে না খাইয়ে রাখতে চাইছিস যাতে আমি মরে যায় নয়তো এই বাড়ি ছেড়ে চলে যায়।বুঝি,বুঝি সব বুঝি আমি।এমনি এমনি তো আর বয়স বাড়েনি আমার।”

এসব বলে বলে মরাকান্না জুড়ে দেয় ফাতেমা বেগম।তৃধা অবাক দৃষ্টিতে এখনো ফাতেমা বেগমের দিকে তাকিয়ে আছে।সে বুঝতে পারছেনা ফাতেমা বেগম আসলে কি করতে চাইছেন।

চলবে……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে