বর্ষাস্নাত রাত পর্ব-১০ এবং শেষ পর্ব

0
1299

#বর্ষাস্নাত_রাত
লেখা – জান্নাতুল ফেরদৌস মাটি
পর্ব – ১০ ( অন্তিম পর্ব)
.
.
সকাল ৯ টা। আরিফুল অফিসে বসে অন্যকেসের ফাইলপত্র ঘাটাঘাটি করছিল। সামনের চেয়ার টেবিল থেকে নীরব এসে বলল,
” স্যার, চা খাবেন?”
” চা দিবে, দাও। শরীরটা এমনিতে মেজমেজ করছিল দেখি চা খেয়ে খানিকটা চাঙা করতে পারি কি-না! ”
নীরব হাবিলদারকে দুটো চা আনতে পাঠিয়ে আরিফুলের সম্মুখ চেয়ারে বসল। এদিক ওদিক তাকিয়ে স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,
” আচ্ছা স্যার, রাকিবের কীরকম শাস্তি হতে পারে কিছু আন্দাজ করতে পারছেন?”
কাজের ফাঁকে আরিফুল ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
” তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে নতুন জয়েন করেছ এই লাইনে? কিছুই বুঝো না। পুলিশ লাইনে জয়েন করেছ কমদিন তো হয়নি। এর আগে কি দেখোনি এরকম অপরাধের শাস্তি কী হয় বা কী হতে পারে?”
” আসলে স্যার আমি যতদূর দেখেছি একই অপরাধের শাস্তি একেকবার একেকজনকে একেকরকম দেয়া হয়। কাউকে মৃত্যুদন্ড তো কাউকে আবার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। কেউ তো আবার বেলও পেয়ে যায়। তাই আর কি জিজ্ঞেস করলাম এই কেসের ক্ষেত্রে ঠিক কী হতে পারে।”
” বেশিরভাগ যাবজ্জীবন কারাদণ্ড কিংবা বেল হয় যাদের উপরে হাত আছে তাদের। কিন্তু সাধারণ জনগণের ক্ষেত্রে তা সম্ভব হয় না। সেই হিসেবে রাকিবের ফাঁসি হওয়াটাই স্বাভাবিক। ”
” ওহ্!”
” হঠাৎ তোমার মাথায় এ ধরনের কথা এলো যে?কোনো সমস্যা?”
” না স্যার, আসলে সামান্য আগ্রহের বসেই জিজ্ঞেস করা। এর বাইরে তেমন কিছুই না।”
“ও….তো সকালের দিকে ওকে দেখতে গিয়েছিলে কি?”
” জি স্যার, ঘন্টা দেড়েক আগেই ওই পাশটা ঘুরে এসেছি। ”
” কী করছে সে?”
” তেমন কিছু না, উল্টো দিক মুখ করে বসে ছিল। আর ছোট একটা ইটের চারা দিয়ে দেয়ালে ঘঁষছিল।”
” ইটের চারা! ও লকাপের ভেতর ইটের চারা কোথায় পেল?কে দিয়েছে ওকে ইটের চারা?”
” না স্যার কেউ দেয়নি। ওটা আগে থেকেই ওখানে ছিল। শুধু ওই একটি চারাই না, আরও বেশ কয়েকটি চারা ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। ডান পাশের যেই দেয়ালটি রয়েছে সেটির আস্তর খসে পড়েছে স্যার। আর সেখান থেকেই সিমেন্ট আর ইট মিশ্রিত কিছু চারা মেঝেতে পড়ে আছে। হয়তো সেখান থেকেই ও তুলে নিয়েছে। ”
“ও…… ”
হাবিলদার দু কাপ চা টেবিলে রেখে যেতেই আরিফুল তার হাতে থাকা ফাইলটি বন্ধ করে চায়ের কাপ হাতে তুলে নিল। গরম কাপে আলতো করে ঠোঁট ছুঁয়ে ছোট্ট করে চুমুক দিতেই নীরব বলে উঠল,
” স্যার, ওকে কোটে চালানের জন্য থানা থেকে ছাড়বেন কখন? সাড়ে ন’টা তো প্রায় বেজে যাচ্ছে। দেরি হয়ে যাচ্ছে না? যেতেও তো সময় লাগবে।”
” পাঠাবো, সাড়ে দশটা নাগাদই পাঠিয়ে দিব। ও নিয়ে তুমি ভেবো না।”
” জি স্যার। ”
আরিফুল ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
” আমার না এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না রাকিব এ কাজ করেছে। যদিও ওর জবানবন্দি সমেত সকল প্রমাণ আমাদের হাতে আছে কিন্তু তারপরও কেন যেন মনে হয় ও এ কাজ করতে পারে না। কোনো একটা ঘোরে আছি আমরা।”
” আপনার ভাবনায় কোনো ভুল নেই স্যার। তবে এটাও ঠিক যে আমরা কোনো ঘোরে নেই। আসলে কাজটা নিজের প্রিয় ভাই করেছে তো তাই আর-কি আপনার বিশ্বাস করতে সমস্যা হচ্ছে। বাইরের কেউ কাজটা করলে হয়তো আপনার এরকম লাগত না। কিন্তু কথায় আছে না স্যার, ঘরের শত্রু বিভীষণ! সেরকমটাই ঘটেছে এ ক্ষেত্রে। ”
” কীভাবে পারল এরকম একটি জঘন্য কাজ করতে? আমার ভাবতেই কেমন লাগছে। আর সে নিজের হাতে করেছে। ভাবতেই তো গা শিউরে উঠছে।”
” স্যার, রাকিবের কর্মকাণ্ড ভেবে আমার কিন্তু গা শিউরে উঠার মতো সেরকম কিছুই অনুভূত হচ্ছে না। কেননা রাকিব তো ছিল মহিউদ্দিন সাহেবের চাচাতো ভাই আর মারিয়া, মাহফুজের দূরসম্পর্কের চাচা। বর্তমান যুগে দূরসম্পর্কের আত্মীয়ের দ্বারা এরকম কাজ কোনো ব্যাপারই না। আমার তো অবাক লাগছে মহিউদ্দিন সাহেবের স্ত্রীর কথা ভেবে। দশ মাস দশদিনের মতো অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করে যে প্রাণ দুটোকে এ ভুবনে আনার জন্য প্রসবের মতো মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করেছে সেই দুটো প্রাণ নিজ হাতেই কেড়ে নিল! পরকীয়ার টানে নিজের সন্তানকে মেরে ফেলল! একটুও তার হাত কাঁপল না? চোখ জুড়ে নোনাজলের ধারা তো দূরের কথা, সামান্য জলের ছিঁটেফোঁটাও এলো না? তাহলে রাকিবের করতে সমস্যা কী? ওর তো এ সমস্ত কাজ নির্দ্বিধায় করার কথা। যেটা ও করেছেও। যে মা পৃথিবীর আলো দেখিয়েছে সেই মা যদি নিজ সন্তানের কথা না ভাবে, চাচা কেন ভাবতে যাবে স্যার? তাও যদি হয় দূরসম্পর্কের চাচা!”
” যদিও তোমার কথা ঠিক… যদি কেন, শতভাগ তোমার কথা ঠিক। কিন্তু তারপরও মনের ভেতর কেমন যেন হাসফাস লেগেই আছে। ”
“বিশ্বাস করবেন কি-না জানি না স্যার। রাকিবকে কিন্তু আমার প্রথম থেকেই ভীষণ সন্দেহ হচ্ছিল। ওকে যখন প্রথম আমরা ঘটনাস্থলে নিয়ে গেলাম ওর হাবভাব আপনি লক্ষ্য করেছিলেন কি-না জানি না, তবে আমি কিন্তু ওর আপাদমস্তক লক্ষ্য করেছি। কেমন যেন একটা চোর চোর ভাব ছিল ওর মাঝে। ওর চাহনিতেও কেমন যেন রহস্যের খেলা ছিল। কিন্তু তারপরও মনের সুপ্ত স্থানে ভরসা রেখেছিলাম যে, হয়তো আমার ভাবনা ভুল। তাই ওকে জেরা করার বিষয়টা মাথায় আনিনি। কিন্তু ফলাফল কী বের হলো, ওই রাকিবই সর্বদোষের দোষী।”
” হ্যাঁ, সেটাই তো দেখছি।”
আরিফুল ও নীরব দু’জনই গুমোট মুখ করে ফেলল। কারো মুখেই কোনো কথা নেই। কেবল একের পর এক চায়ের কাপে চুমুক বসাচ্ছে।চায়ের কাপে শেষ চুমুক টুকু দিয়েই আরিফুল বলল,
” আচ্ছা নীরব,তোমাদের এলাকার যে মেয়েটিকে কিছুদিন আগে ধর্ষণ করা হলো ওই ধর্ষণের মামলার কী অবস্থা? কোন খবর টবর নিয়েছ?”
” হ্যাঁ স্যার নিয়েছি তো। মামলা এখন টোটালি ক্লোজ হয়ে গিয়েছে। যেটা আমি আপনাকে আগেই বলেছিলাম। আসলে মেজিস্ট্রেটের ছেলে এ মামলার আসামি তো তাই আর কি কোটে বেশিদিন গড়াতে পারেনি কেসটা। টাকা, সবই টাকার খেলা স্যার।”
” এরই নাম বাংলাদেশ। বুঝলে নীরব? টাকা আছে তো ক্ষমতা আছে। আর ক্ষমতা আছে তো সেই ক্ষমতার অপব্যবহার করতেই হবে। এরকম খবর শুনলে মাঝে মাঝে তো ইচ্ছে করে এরকম বাপ ছেলেকে একসঙ্গে দাঁড় করিয়ে সমানে ব্রাশফায়ার করে মাথার খুলি উড়িয়ে দেই। যত্তসব ফালতু লোকজন! ”
বলেই চেয়ারে গা এলিয়ে বসল আরিফুল। মিনিট দুয়েক পেরোতেই টেবিল উপর হাত চেপে উঠে দাঁড়ালো আরিফুল। বলল,
” চলো নীরব রাকিবকে দেখে আসি আর চালানের ব্যবস্থাও করে আসি।”
” ওকে স্যার।”
আরিফুল সামনে আর নীরব পেছনে। বড় বড় পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে রাকিবের লকাপ রুমটির দিকে। তালা খুলে মাথা নিচু করে লকাপের ভেতর যেতেই আরিফুল ও নীরব দু’জনেই ‘থ’ মেরে গেল।
লকাপের ভেতরের একেবারে পেছনের দেয়ালের উপরিভাগে যে ছোট জানালাটি রয়েছে তাতে দড়ি দিয়ে গিট বেঁধে ফাঁস দিয়ে ঝুলে আছে রাকিব। মেঝে থেকে পা সামান্য উপরে। সর্বোচ্চ ৫ ইঞ্চি। হাত পা ছেড়ে একেবারে শক্ত হয়ে আছে। গলা থেকে মাথা অবধি ইতিমধ্যে ফুলে ভার হয়ে গিয়েছে।আরিফুল একবার সামনের দিকে তাকাচ্ছে তো আরেকবার নীরবের দিকে। নীরবেরও একই হাল।
আরিফুল ও নীরব দু’জন সমান তালে দু’পা সামনে এগিয়ে রাকিবের ঝুকে থাকা দেহকে ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল। নীরব ভ্রু কুচকে বলল,
” স্যার, এভাবে জানালায় ফাঁস দিয়ে কি মানুষ আদৌ মারা যায়? তারউপর পা তো প্রায় মেঝে ছুঁই ছুঁই। তাহলে কীভাবে কী?”
আরিফুল কোমরে দু-হাত চেপে রাকিবকে দেখতে দেখতে বলল,
” আত্মহত্যা করার জন্য প্রয়োজন নেই যে ফ্যান কিংবা গাছেই ঝুলতে হবে। মেডিকেল সাইন্স বলে, গলায় ফাঁস বসে থেকেও দেয়া যায়। আর তা কার্যকরীও হয়। তাই এই ফাঁসে কোনো সন্দেহ নেই।”
বলেই আরিফুল রাকিবের কাছে গিয়ে গলার উপর মোবাইল টর্চ জ্বালিয়ে ধরল। লাল দাগ হয়ে গিয়েছে পুরো গলা জুড়ে। জায়গায় জায়গায় রক্ত জমাটও বেঁধে গিয়েছে। চোখ দুটো আধখোলা। জিহবা প্রায় চার আঙুল সমান বেড়িয়ে বা পাশে বেঁকে আছে।
রাকিবকে ঘুরে ঘুরে দেখার মাঝে নীরব আরিফুলকে ডাক দিল,
” স্যার!”
” হুম, বলো।”
” একটু এদিকটায় আসুন।”
আরিফুল চার কদম এগিয়ে নীরবের কাছে যেতেই নীরব আঙুল দিয়ে সামনে ইশারা করল। আরিফুল তার সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকা দেয়ালের মাঝামাঝি অংশে তাকাতেই লাল ইট ঘঁষে লেখা বড় বড় অক্ষরের কয়েকটি শব্দ দেখতে পেল, ‘ পাপ যখন করেছি শাস্তি তো পেতে হবেই। হোক সে শাস্তি নিজ হাতেই!”
নীরব বলল,
” স্যার আমি যখন ওকে দেখতে এসেছিলাম ও এখানে বসেই ইটের চারা ঘঁষছিল। কিন্তু আমি তখন বুঝতে পারিনি যে ও শুধু ঘঁষছিলই না, সাথে কিছু লিখছিলও।”
” লক্ষ্য করার দরকার ছিল নীরব। তাহলে হয়তো থানায় এরকম একটা ঘটনা ঘটত না।”
” সরি স্যার!”
আরিফুল আর কিছু বলল না। কেবল একবার ডানপাশ, একবার বামপাশ দিয়ে ঘুরেফিরে রাকিবের ঝুলন্ত দেহ দেখতে লাগল।
এরই মাঝে নীরব বলে উঠল,
” যে হাতে পাপ করলি সেই হাতেই আবার মাশুল দিলি। লাভ কী হলো এতকিছু করে?”
” পাপ কখনো বাপকেও ছাড়ে না। দুনিয়ার পাপের ফল দুনিয়াতেই ভোগ করে যেতে হয়। যা জন্ম লগ্ন থেকেই ঘটে আসছে। আর পরবর্তীতেও এর ব্যাতিক্রম ঘটবে না।”
বলেই আরিফুল দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে লকাপ থেকে বেড়িয়ে যেতে যেতে বলল,
” CSU দের খবর পাঠাও। নতুন করে ইনভেস্টিগেশন শুরু করতে হবে যে!”
.
.
(সমাপ্তি)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে