বর্ষাস্নাত রাত পর্ব-০৯

0
871

#বর্ষাস্নাত_রাত
লেখা – জান্নাতুল ফেরদৌস মাটি
পর্ব – ৯
.
.
উচ্চস্বরে কথাগুলো বলে উঠল হাফসা। আমি স্বাভাবিক ভাবেই বললাম,
” তুমি এতটা উত্তেজিত হচ্ছো কেন হাফসা? আমরা তো কথাগুলো ঠান্ডা মাথায় স্বাভাবিক ভাবেও বলতে পারি তাই না?”
” কিসের ঠান্ডা মাথা? কিসের স্বাভাবিক কথা? ঠান্ডা মাথায় কথা বলার রাস্তা রেখেছ তুমি? একের পর এক সময় দিয়ে যাচ্ছো কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। সেই আমাকে এই চার দেয়ালের মাঝেই গুমরে গুমরে মরতে হচ্ছে। তাহলে কেন তুমি? কেন তোমার সাথে এই সম্পর্ক? সেইবার যখন প্রেগন্যান্ট হলাম মিষ্টি মুখ করে বললে, আর পাঁচ মাস অপেক্ষা করতে। আমি তখনি জানতাম সেটাও ছিল তোমার জাস্ট মুখের কথা। কিন্তু তারপরও কিচ্ছুটি বলিনি শেষবারের মত তোমাকে বিশ্বাস করে অপেক্ষা করেছিলাম। কিন্তু রেজাল্ট কি হলো? পাঁচ মাস গিয়ে ছ’মাসে পড়ে গিয়েছে কিন্তু তোমার জবের ‘জ’ ও হয় নি। এরপরও বলছ ঠান্ডা মাথায় কথা বলতে?”
এতক্ষণ হাফসা অন্যদিক মুখ করে কথাগুলো বলছিল। তাই আমি বিছানায় একপা উঠিয়ে বসে হাফসাকে আমার দিক ঘুরে বসালাম। বললাম,
” রাগ হয়েছে? ”
হাফসা চুপ করেই বসে রইলো। আমি আরও বেশ ককয়েকবার নানান কথা বলে রাগ ভাঙানোর চেষ্টা করতেই হাফসা বলে উঠল,
” এসব কথায় আমি আর ভুলছি না বাবলু। হয়তো তুমি আমাকে নেয়ার একটা ব্যবস্থা করবে। নয়তো আমার জীবন থেকে একেবারে সরে যাবে। এরকম দোটানার জীবন আমি আর নিতে পারছি না। ”
” তুমি আমার সাথে সংসার করতে চাও? ”
” একবার না হাজারবার চাই। কিন্তু তুমিই তো দিচ্ছ না। ”
” দিব অবশ্যই দিব। কিন্তু……”
” কিন্তু কী?”
” তোমাকে যে আমার কথামতো কাজ করতে হবে। ”
” মানে? কিসের কাজ? কোন কাজের কথা বলছ তুমি?”
” দাঁড়াও।” বলেই আমি দরজাটা ভেতর থেকে লক করে বিছানায় এসে বসলাম।বললাম,
” এই মুহুর্তে আমার জব নেই। আর জীবনো হবে কি-না তাও শিউর না। কেননা জব করার মনমানসিকতা আমার মাঝে কখনো ছিল না আর হবেও না। তাই আমি বলছিলাম…”
হাফসা ভ্রু কুচকে বলল,
” কী বলছিলে?”
” না মানে ভাইয়ার অবর্তমানে যা কিছু আছে সব তো বাচ্চাদের। আর বাচ্চাদের অবর্তমানে সবকিছু আমার। অর্থাৎ ভাইয়ার তো আর ভাই বোন নাই যে,ভাইয়া বা তার বাচ্চারা না থাকলে তার সবকিছু মালিক তার ভাইবোন হবে। সে তো একা। সেই হিসেবে আমাদের দেশের আইন অনুযায়ী ভাইয়া ও তার ওয়ারিশ না থাকলে তার যা সম্পত্তি আছে সবই চাচাতো ভাইদের হবে। বিশেষ করে আমার হবে। যেহেতু ভাইয়ার খুব কাছের মানুষ আমি। আর তাছাড়াও ভাইয়ার কোথায় কী আছে সবই তো আমার জানা। তাই আমিই হব ভাইয়ার সবকিছুর মালিক।মোটামুটি একটা ব্যবসা দাঁড় করিয়ে পায়ের উপর পা তুলে জীবন চলে যাবে দু’জনের। তবে হ্যাঁ, যদি তুমি চাও।”
” বাবলু! তুমি এসব কী বলছ? তুমি তোমার ভাইকে মারার কথা বলছ? সেই সাথে ওই দুটি শিশুকেও? মাথা ঠিকাছে তোমার? যা হয়েছে আমাদের হয়েছে শুধু শুধু ওদের জীবন কেন এর মাঝে এনে দাঁড় করাচ্ছো? সম্পর্কের শুরুতে তো বলোনি এসব কথা! তাহলে আজ কেন নতুন সুরে গান গাইছ?”
” বরের জন্য এতো প্রেম থাকলে আমার কাছে ধরা দিয়েছিলে কেন? শোয়ার সময় হুশ ছিল না? জোর করেছিলাম না-কি শুতে?”
” বাবলু! কেমন ভাষায় কথা বলছ তুমি?”
” গলা নামিয়ে কথা বলো হাফসা। সবসময় যে তোমার চড়া গলা মেনে নেব তা কিন্তু নয়। গলার জোর আমারও আছে। অতএব সাবধান। ”
” তুমি আমাকে ধোঁকা দিচ্ছ?”
” না, মোটেও না। আমি তোমাকে নিয়ে সুখের ঘর বাঁধতে চেয়েছি। আমাদের একটা সংসার বাঁধতে চেয়েছি। কিন্তু তুমি তো…..”
এবার হাফসা নরম সুরে বলল,
” এসব করার কী দরকার বাবলু? চলো আমরা অনেক দূরে চলে যাই। ওরা ওদের মত থাকুক আর আমরা আমাদের মত করে। এর মাঝে এসব খুন খারাপির কী দরকার বলো! আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি, আমি তোমার কাছে বাড়ি, গাড়ি, ভালো কাপড়, ভালো খাবার এসব কিচ্ছু চাইব না। তুমি যেভাবে রাখবে, যা খেতে দিবে সেগুলোই হাসি মুখে গ্রহণ করে নিব। এসব ঝামেলায় যেয়েও না প্লিজ।”
” ঐশ্বর্যের প্রয়োজন তোমার না থাকলেও আমার আছে হাফসা। একবার যখন বলেছি আমার সবকিছু চাই মানে চাই। এখন তুমি সাথে থাকো বা না থাকো। তবে হ্যাঁ, এটা মাথায় রেখো ভাইয়া কিন্তু আর আগের মতো তোমায় ভালোবাসবে না। আর না তুমি তাকে ভালোবাসতে পারবে। তুমি তো এখন ভাইয়াকে চোখের দেখাও দেখতে পারো না। তাহলে থাকবে কী করে তুমি?”
” তোমার ভাইয়ার কথা এখানে আসছে কেন? আমি তো তার সাথে না, আমি তো তোমার সাথে আছি। সে ভালোবাসল কি না বাসল তাতে তো আমার কিছু যায় আসে না। ”
” যায় হাফসা আসে যায়। যখন আমি থাকব না তখন তুমি তার ভালোবাসা পেতেই মরিয়া হয়ে উঠবে। মানুষ যে ভালোবাসার কাঙ্গাল। আর এটাই যে মানব জাতির বিশেষত্ব। ”
” তুমি থাকবে না মানে? কী বলছ এগুলো? ”
” হুম থাকব না-ই তো… কেননা তুমি যদি আমার সঙ্গ না দাও আমি তো আর তোমার সাথে সম্পর্ক রাখব না। আর না তোমার ছায়া হয়ে থাকব। তখন বাদ্ধ হয়েই তোমাকে ভাইয়ার শরণাপন্ন হতে হবে। আর ভাইয়া যেই মানুষ সে একবার যার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় দ্বিতীয় বার সেদিক ঝুঁকে না। হ্যাঁ সন্তানের খাতিরে এখন যেরকম লোক দেখানো সম্পর্ক আছে সেরকম হয়তো থাকবে কিন্তু মনের দিক থেকে নয়। তখন তুমি কী করবে?”
” তোমার সঙ্গ না দিলে তুমি আমাকে ছেড়ে দিবে? এ কথা তুমি বলতে পারলে বাবলু? ”
” অস্বাভাবিক কিছু বলেছি? এটাই কি স্বাভাবিক নয়? ভালোবেসে তুমি যদি আমার জন্য কিছু করতে না পারো, আমি কেন সেই ভালোবাসায় জড়িয়ে থাকব বলতে পারো? এমন তো না যে এইসব কিছু আমি আমার একার জন্য করছি। যা করছি সবই তো দু’জনের ভবিষ্যতের কথা ভেবে করছি। তো সেই কাজে তুমি যদি আমার ছায়া না হও আমি কেন তোমার জীবন ছায়া হবো বলো।”
” তুমি কিসের সাথে কী মেলাচ্ছ বাবলু? ভালোবাসা একটা আর কোন ক্রাইমকে সাপোর্ট দেয়াই আরেকটা। তুমি এটা বাদে অন্য যেকোনো কথা বলো দেখো আমি মানি কি-না! কিন্তু এসব কী করে সম্ভব? ”
” আমার সাথে থাকতে হলে এই অসম্ভবকেই তোমার সম্ভব করতে হবে হাফসা। আর নয়তো আমার কথা ভুলে যাও।আমি আমার রাস্তা মেপে নেব তুমি তোমারটা মাপো। ”
” এটাই তোমার শেষ কথা?”
” হুম এটাই শেষ কথা।”
হাফসা দুই হাঁটু উঁচিয়ে তাতে মাথায় গুঁজে বেশ খানিকটা সময় বসে রইলো। আমিও উল্টো দিক মুখিয়ে বসে রইলাম। কারো মুখে কোন কথা নেই। দু’জন দু’জনের মত নীরবে সময় কাটাতে লাগলাম। একপর্যায়ে প্রায় মিনিট দশেক পড়ে হাফসা ভারী কন্ঠে বলে উঠল,
” কীভাবে কী করতে হবে বলো।”
হাফসার কথা শুনে আমার মুখে পূর্ণ হাসির রেখা ফুটে উঠল।বুকে টেনে বললাম,
” এই তো ভালো মেয়ে। আমি তো জানতাম তুমি রাজি হবে। রাজি না হয়ে উপায় আছে না-কি! আমাকে যে তুমি বড্ড ভালোবাসো তাই না!”
” হুম, বলো কীভাবে কী করবে?”
” আমি একটা বুদ্ধি বের করেছি বুঝলে? আমার মনে হয় আমার ভাবনা অনুযায়ী সামনে এগোলে সহজেই সবকিছু সামাল দেয়া যাবে।”
” কী বুদ্ধি?”
” কিছুদিন পর অর্থাৎ এই বৃহস্পতিবারের পরের বৃহস্পতিবার আমি বন্ধুদের সাথে ৫ দিনের ট্যুরে যাওয়ার কথা বলে ঘর থেকে বেড়িয়ে যাবো। তবে যেদিন যাবো তারপরের দিন অর্থাৎ শুক্রবারই আবার রাতে ফিরে আসব। কিন্তু সেটা ভাইয়া জানবে না, জানবে শুধু তুমি। আমি ঘুমের ঠিক আগ মুহুর্তে আসব। তুমি দরজা খুলে দিলে আমি লুকিয়ে যাবো। ভাইয়া কিছু জিজ্ঞেস করলে পাশের বাসার ভাবি বলে চালিয়ে দিবে। ব্যস হয়ে গেল। মাঝরাতে ভাইয়া যখন ঘুমে বিভোর থাকবে তখনই আমরা আমাদের কার্য সম্পন্ন করব। কোনোরকম ঝামেলাই হবে না। ”
” এসবে কিন্তু অনেক রিস্ক বাবলু। ধরা পড়লে ফাঁসি হওয়া থেকে কেউ আটকাতে পারবে না। তুমি আরেকবার ভেবে নাও প্লিজ।”
” ভাবাভাবির কিছু নেই। সব কাজেই রিস্ক থাকে। আর এই রিস্ক নিয়েই আমাদের চলতে হয়। তাই ওসব নিয়ে না ভাবাই ভালো। ”
” আমার ভীষণ ভয় লাগছে বাবলু। ”
” আহা! ভয়ের কী আছে? আমি আছি না? তুমি তো জাস্ট আমার সঙ্গ দিবে বাকি কাজ তো আমারই। তোমাকে তো আর খুনটুন করতে বলছি না।”
” কিন্তু…”
” কোন কিন্তু না, যা বলেছি যেভাবে বলেছি সেভাবেই হবে। বুঝতে পেরেছ?”
রাকিবের কথার মাঝেই আরিফুল বলে উঠল,
” যা বলেছিস, যেভাবে বলেছিস সেভাবেই সবকিছু হলো তাই তো?”
রাকিব চুপ হয়ে গেল। নীরব বলল,
” এখন তুই চুপ করেই থাক। তোকে আর আমাদের প্রয়োজন নেই। যা জানার সব জেনে গিয়েছি। বাকি কাজ আদালতে।”
আরিফুল বলল,
” এই যে একে একে চারটে খুন করলি পারলি বাঁচতে? যে ঐশ্বর্যের জন্য এতকিছু করলি পারলি সেই ঐশ্বর্য ভোগ করতে? সেই তো চার দেয়ালের মাঝে আসতে হলো। তাহলে লাভ কি হলো এই শান্তির জীবনে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়কে স্বাগতম জানিয়ে? তুই কি জানিস তোর এতো বড় অপরাধের শাস্তি কী হতে পারে? মৃত্যু…. মৃত্যুদন্ড হচ্ছে একমাত্র শাস্তি তোর এই জঘন্য অপরাধের। এর ব্যাতিত কোনো শাস্তি তুই পাওয়ার যোগ্য নস আর না তোকে দেবে। মৃত্যুই হচ্ছে তোর শেষ পরিণতি। ”
বলেই ফাইলপত্র হাতে নিয়ে রিমান্ড ঘর ছেড়ে বেড়োতে লাগল আরিফুল। দরজার কাছে গিয়ে বলল,
” সকালেই ওকে চালান করতে হবে সব কাগজপত্র রেডি করো নীরব। আর হ্যাঁ, আজ রাতটা কোনার যে খালি ঘরটা আছে সেখানেই তালাবদ্ধ করে রাখো।”
” ওকে স্যার।”
আরিফুল বেড়িয়ে যেতেই নীরব রাকিবকে নিয়ে রিমান্ড ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে পড়ল।
.
.
চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে