বর্ষাস্নাত রাত পর্ব-০৮

0
1002

#বর্ষাস্নাত_রাত
লেখা – জান্নাতুল ফেরদৌস মাটি
পর্ব – ৮
________________
নীরব আরিফুলকে থামিয়ে চেয়ারে বসালো। বলল,
” স্যার এভাবে উত্তেজিত হবেন না, আমাদের আগে ঠান্ডা মাথায় পুরো ঘটনা জানা দরকার।”
আরিফুল চোখ বুজে দাঁত কিড়মিড়িয়ে রাকিবের দিকে হিংস্রাত্মক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,
” বল……”
এদিকে ব্যাথায় রাকিব কাত হয়ে আছে। ব্যাথায় পিঠ যেন নাড়াতেই পারছে না। সারা শরীর সমানে কাঁপছে। গলা দিয়ে নূন্যতম শব্দ বের হচ্ছে না। সেই শক্তিই নেই তার। কিন্তু তারপরও মারের ভয়ে অস্পষ্ট স্বরে সে বলতে লাগল,
” লুকোচুরির মাঝ দিয়েই আমাদের সম্পর্কের ডানা দিন দিন মেলছিল। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস হাফসা আর আমার মাঝের শারীরিক সম্পর্ক চলছিল। প্রথম দিকে শারীরিক চাহিদার জন্যে হাফসা আমার কাছে এলেও পরবর্তীতে সেটা হাফসার দিক থেকে ভালোবাসায় রূপান্তরিত হয়। সম্পর্কের ৮ মাস হওয়ার কিছুদিন পর অর্থাৎ এই চলতি বছর ২০২০ এর জানুয়ারির একদুপুরে হঠাৎ করেই হাফসা আমার রুমে এসে বলে….
” আমি প্রেগন্যান্ট বাবলু!”
” কী! কী বলছ এসব? মাথা ঠিকাছে তোমার?”
হাফসা ঘরের দরজা ভেতর থেকে লক করে বলল,
” আমাকে তুমি শীঘ্রই এখানে থেকে নিয়ে চলো। আমি আর এখানে থাকতে পারব না। এখানে থাকা যে প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে। ”
” কী আবল তাবল বলছ তুমি? এখানে থাকা অসম্ভব মানে কী?”
” আমি তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা বাবলু। আর ক’দিন গেলে আমার শারীরিক পরিবর্তন ঘটে সবকিছু ফুটে উঠবে। বুঝে যাবে সবাই সবকিছু। তখন কী হবে ভাবতে পারছ? তার থেকে ভালো চলো আমরা এখন… আজকেই যাই। মহিউদ্দিনও বাসায় নেই, বাচ্চা রাও ঘুমাচ্ছে। এখন বেড়োতে একেবারেই সহজ হবে।”
” মাথা ঠিকাছে তোমার? এই অবস্থায় তোমায় নিয়ে আমি কোথায় যাবো? তারউপর জবও তো নেই আমার। থাকব কোথায়? খাবো কী? তাছাড়া আমার যদি নিজের টাকায় থাকার সামর্থ্যই থাকত তাহলে কী আমি এখানে দিনের পর দিন পড়ে থাকতাম?”
” তাহলে এখন? এখন আমি কী করব? আর এভাবেই বা কতদিন থাকব? কবে নিবে তুমি জব? এভাবে তো দিন যেতে পারে না? সংসার করব একজনের আর প্রহর গুনব আরেকজনের! এটা কী জীবন বাবলু? সম্পর্কের শুরুতে তো খুব বড় মুখ করে বলেছিলে খুব দ্রুতই এখান থেকে মুক্তি দেবে। এখানে তুমি থাকবে না। এই তোমার দ্রুত? যে হাল ধরে বসে আছো এভাবে তো বছর কেন যুগ পেরোলেও তোমার জব হবে না। যেখানে তোমারই কোন আশা নেই, সেখানে আমি কোন আশায় দিনের পর দিন এভাবে বসে থাকব?”
” এমন তো না যে আমি জব খুঁজছি না। আমি তো জব খুঁজছি। এখন ভালো একটা জব না পেলে আমার দোষটা কী বলোতো?”
” দোষ তোমার না, দোষ আমার কপালের। কেন যে এ ঝামেলায় জড়াতে গিয়েছিলাম! ”
” কী?”
” কিছু না।”
” ও….আচ্ছা শোনো একটা বুদ্ধি এসেছে মাথায়।”
” কিসের বুদ্ধি!”
” বলছি তো……আগে তুমি বিছানায় শান্ত হয়ে বসো। তারপর আমি সবটা খুলে বলছি তোমায়।”
হাফসা বিছানায় বসতেই আমি তার পাশে বসলাম। বললাম,
” রাতে ভাইয়া ফিরলে তুমি একটু নমনীয় ভাষায় ভাইয়ার সাথে কথা বলবে। আজকাল যা বাজে ব্যবহার করো! ”
” যাকে ভালো লাগে না তার সাথে মুখ নাড়তেও ভালো লাগে না, ভালো ব্যবহার তো দূরের কথা! ”
” কিন্তু সবসময় তো মনের ভালোমন্দ বিবেচনা করলে চলবে না বাবু। মাঝেমধ্যে নিজের লাভক্ষতির জন্য হলেও মনের বিরুদ্ধে যেতে হয়।”
” মানে?”
” ভাইয়া আসার আগেই একটু ভালো করে সাজুগুজু করে নেবে। তারপর ভাইয়ার আসলে হাসিমুখে কথা বলবে। একটু কাছাকাছি গিয়ে মনমাতাবে। তারপর একপর্যায় গিয়ে বলে দেবে তুমি প্রেগন্যান্ট। মানে ভাইয়ার সাথে এরকম ভাবে কথা বলবে যেন এ বাচ্চাটা তারই…”
কথা শেষ না হতেই হাফসা দাঁড়িয়ে পড়ল। অস্থিরতা ঘেরানো গলায় বলল,
” এটা অসম্ভব বাবলু। তুমি খুব ভালো করেই জানো লাস্ট সাড়ে তিন মাসের উপর হবে মহিউদ্দিনের সাথে আমার সেরকম কোনো স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক নেই। ও কাছে আসতে চাইলেও আমি নানা অজুহাতে বারংবার পিছিয়ে গিয়েছি। তাহলে যেখানে ওর সাথে আমার কোনো সম্পর্কই হয়ে উঠেনি সেখানে আজ হঠাৎ করেই বা কী করে বলব আমি ওর সন্তানের মা হতে যাচ্ছি? এটা কীভাবে সম্ভব? আর ও এরকম ধরনের কথা কেনই বা বিশ্বাস করবে? ও কি শিশু বাচ্চা? কিচ্ছু বুঝে না ও?”
” হুম তাও কথা! কিন্তু আমার পক্ষে তো এখন কোত্থাও যাওয়া সম্ভব না হাফসা। কম করে হলেও আরও মাস পাঁচেক সময় চাই আমার। চাকরির কথা আর টাকার কথা মুখে বললেই তো হয় না, ব্যবস্থা করতে হয়।”
” তাহলে কী এই পাঁচ মাস আমি এভাবেই থাকব? পাঁচ মাস পর আমার কী অবস্থা হবে তোমার ধারণা আছে? ”
” আহা….তোমাকে এভাবে থাকতে কে বলেছে? আমি বলেছি? বলিনি তো, তাহলে এত ভাবছ কেন?”
” মানে?”
” শোনো হাফসা, অন্তঃসত্ত্বা হয়েছ বলেই যে মা হতে হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। বছর চারেক আগেই তোমার দ্বিতীয় সন্তান মারিয়া এসেছে। তোমার শরীর তো বলতে গেলে এখনো কাচা। অন্তত নিজের শারীরিক সুস্থতার কথা ভেবে হলেও এই মুহুর্তে বাচ্চা নেয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। ”
” কী বলছ তুমি এসব? মাথা ঠিকাছে তোমার? আমার গর্ভে যে আছে সে আমাদের প্রথম সন্তান বাবলু। তুমি কী করে পারলে এরকম একটি কথা বলতে?”
” তুমি যেরকম করছ মনে তো হচ্ছে এই প্রথম মা হচ্ছো তুমি!”
” বাবলু!”
হাফসার অবাক চাহনি বুঝতে পেরেই আমি গলারস্বর পরিবর্তন করে নরম গলায় বললাম,
” তুমি একটু বুঝার চেষ্টা করো হাফসা। আমরা এখন সময়ের কাছে বাঁধা। আমাদের অনুভূতি গুলো এই মুহূর্তে সময়ের কাছে বেওয়ারিশ অনুভূতি। চাইলেও এগুলোকে নাম দেয়া আমাদের পক্ষে অসম্ভব। তুমি কি মনে করো এই বাচ্চাকে নিয়ে অনুভূতি শুধু তোমারই? আমার নেই? আরে তুমি তো মা আগেই হয়েছ।এ অনুভূতির সাথে পূর্ব থেকেই তোমার পরিচিতি। কিন্তু আমি….আমি তো এ অনুভূতির আষ্টেপৃষ্টে নতুন করে জড়িয়েছি। আমার ভেতরটা কেমন লাগছে জানো? ছেলেরা যখন শুনে সে বাবা হবে তখন তাদের মনের অবস্থা কেমন হয় তুমি ধারণাও করতে পারবে না হাফসা। সেদিক দিয়ে আজ এই মুহূর্তের পর থেকে এ অনুভূতির কাঙ্গাল আমি। এ বাচ্চাকে ঘিরে অনুভূতি তোমার থেকে শতগুণ বেশি আমার হাফসা। ”
বলেই কান্না করে দিলাম। হাফসা তখন বেমালুম হয়ে নিজের কথা ভুলে আমাকে সামাল দিতে বলল,
” আমি আর কিচ্ছু বলব না,তাও তুমি এভাবে কেঁদো না প্লিজ। তুমি যেভাবে যা বলবে তাই হবে আমি কোনো আরগুমেন্ট করব না। প্লিজ বাবলু কেঁদো না।”
হাফসা আমার চোখ মুছে দিতেই আমি বললাম,
” ভুল বুঝো না আমাকে। আমি যা করছি আমাদের ভালোর জন্যই করছি। আর ভবিষ্যতেও যা করব আমাদের ভালোর জন্যজ করব। ভরসা রেখো আমার উপর।”
” হুম।”
” টাকা হাতে কিছু আছে? ”
” হুম আছে তো।”
” তাহলে আজ এক্ষুনি চলো হসপিটালে চলে যাই। কাজটা যত তাড়াতাড়ি সাড়া যাবে তত তাড়াতাড়ি চিন্তামুক্ত হওয়া যাবে।”
” এক্ষুনি যাবে? কাল গেলে হয় না? বাচ্চারা তো ঘুমাচ্ছে এই সময় যাওয়াটা ঠিক হবে না।”
” ঘুমাচ্ছে বলেই তো এখন যাবো। সজাগ থাকলে কী যেতে পারব না-কি? আর হসপিটালও তো কাছেই কাজ সেড়ে আসতে যেতে সময় লাগবে না তেমন। ”
” কিন্তু…..”
” কোনো কিন্তু না, যাও দ্রুত রেডি হয়ে নাও। আমিও রেডি হচ্ছি। আর শোনো টাকা কিন্তু একটু বেশি করেই নিও। কত লাগে বলা তো যায় না। ”
” আচ্ছা।”
সেদিনই হসপিটাল গিয়ে বাচ্চাটার কাহিনী শেষ করে এলাম। যার ফলে হাফসার শারীরিক অবস্থা খারাপের দিকে ধাবিত হলেও দিন দশেক যেতেই আবার উন্নতিও হচ্ছিল। ভাইয়া সেইবার অনেক করে হাফসাকে জিজ্ঞেস করলেও হাফসা কিছু বলেনি। এটা সেটা বলে বারংবার বিষয়টা এড়িয়ে গিয়েছে। কিন্তু ভাইয়া হয়তো কিছু আঁচ করতে পেরেছিল। ভাইয়া কেন যেন আমার সাথে আগের মত কথা বলত না, আড্ডা দিত না। হাফসার কাছেও ভিড়তো না। নিজের মত নিজে থাকত আর বাচ্চাদের ঘিরে থাকত আর তাদের সঙ্গ দিত। অবশ্য এতে যে আমার আর হাফসার আহামরি কোনো সমস্যা হচ্ছিল তা না। আমরা আমাদের মতই চলছিলাম। দিনের পর দিন মাসের পর মাস এভাবেই কাটিয়ে দিচ্ছিলাম। যার দরুণ আমাদের বন্ডিং টাও বেশ মজবুত হয়ে গিয়েছিল।
তো দিন দশেক আগের কথা। শেষ বিকেলে মারিয়াকে কোলে নিয়ে মারিয়ার পছন্দের কার্টুন শিনচেন দেখছিলাম। মাহফুজ অন্যরুম থেকে এসে বলল,
” চাচ্চু চাচ্চু, আম্মু তোমাকে আম্মুর ঘরে ডাকছে।”
বলেই ও সোফায় বসে পড়ল। আমি মারিয়াকে কোল থেকে নামিয়ে মাহফুজের পাশে বসিয়ে হাফসার রুমে যেতেই হাফসা বিছানায় বসতে বলল। আর আমিও কোনো প্রশ্ন না করে বসে পড়লাম। কিছুক্ষণ বাদে হাফসা এটাসেটা হাতের কাজ করার ফাঁকে বলল,
” তোমার মতলব কী?”
” মতলব! কী আজেবাজে বলছ? মতলবের কথা আসছে কোথা থেকে? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।”
” কিছুই বুঝতে পারছ না? ”
” বুঝলে অবশ্যই জিজ্ঞেস করতাম না।”
” বেশ তাহলে তোমাকে বুঝিয়েই বলছি। এই যে তোমার আমার সম্পর্ক এর ভবিষ্যৎ কী? কিসের আশায় এভাবে হাত পা গুটিয়ে বসে আছো? কী চাইছ কী তুমি? দিনের পর দিন তুমি এভাবে আমার সাথে মজা লুটে যাবে আর আমি চুপটি করে থাকব? দায়ভার যখন নিতেই পারবে না, কেন এ খেলা জুড়েছ?”

.
.
চলবে……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে