বর্ষাস্নাত রাত পর্ব-০৭

0
816

#বর্ষাস্নাত_রাত
লেখা – জান্নাতুল ফেরদৌস মাটি
পর্ব – ৭
________________
হরদম মার খেয়ে ক্লান্ত মুখ নিয়ে চেয়ারে গা ছেড়ে বসে আছে রাকিব। শরীরে মিলছে না একটুখানি শক্তি। হাত পা যেন পুরো অবস হয়ে আছে। তবে এই ক্লান্ত শরীরেও পানির তৃষ্ণা যেন তার মিটছেই না। মার খাওয়ার পর গুনে গুনে ৫ টি পানির গ্লাস শেষ করেছে সে।
মাথার প্রতিটি চুলের আগা বেয়ে টপ টপ করে ঝড়ছে লবণাক্ত জলরাশি। এ যেন বর্ষা মৌসুমের ঝিম ঝিমানো বৃষ্টি।
আরিফুল চোখের দৃষ্টিতে ভয়ানক ভাব এনে রাকিবের সামনে থাকা মাইকের মাথাটি উঁচু করে বলল,
” ভিডিও ফুটেজে দেখা গেল মহিউদ্দিন সাহেবের স্ত্রী তোকে বাবলু বলে ডাকছে। কিন্তু তোর আর বাকি সবার ভাষ্যমতে তোর নাম রাকিব। তাহলে উনি কেন তোকে বাবলু নামে ডেকেছিল?”
” বাবলু আমার ডাক নাম স্যার। বাড়ির মানুষ আমাকে বাবলু বলেই ডাকে। আর বাহিরের মানুষ রাকিব বলে।”
“ও…. এবার বল, কী বলবি।”
রাকিব মাইকের দিকে তাকিয়ে ঢোক গিলে মুখ চুপসে ফেলল। আরিফুল ধমকের সুরে বলল,
” কী হলো? চুপ কেন? বল…..”
আরিফুলের এক ধমকে রাকিবের বন্ধ থাকা দুই ঠোঁটের ভাজ খুলে গেল……
” ২০১৭ সাল। অনার্স পাশ করে ঢাকায় এসেছিলাম চাকরির খোঁজে। একে তো বেকার তারউপর হাতেও তেমন টাকা পয়সা ছিল না যে, বাড়িভাড়া কিংবা মেসে থাকব। তখন বাধ্য হয়েই মহিউদ্দিন ভাইয়ার কাছে আসি কিছুদিনের জন্য মাথা গোঁজবার ঠাই চাইতে। ভাইয়ার সাথে আমার অত্যন্ত ভালো সম্পর্ক থাকার সুবাদে ভাইয়াও না করেনি। বরং বলেছিল, ” তুই কি পর কেউ? আমার মায়ের পেটের ভাইয়ের সমতূল্য তুই। তোর কোত্থাও যেতে হবে না, চাকরি পেলেও এখানেই থাকবি। আমার সাথেই থাকবি। এক্সট্রা রুম তো আমার আছেই।”
ভাইয়ার সেদিনকার কথাগুলো ছিল আমার কাছে ঈদের চাঁদ হাতে পাওয়ার মত আনন্দ। কতবড় বোঝা যে মাথার উপর থেকে নেমেছিল সে কেবল আমিই জানি। হাসিখুশিতেই যাচ্ছিল দিনগুলো। ভাইয়ার ঘরকে ধীরে ধীরে যেন আমি নিজের ঘরই ভাবতে শুরু করলাম। যখন যা ইচ্ছে হতো তাই করতাম। বাঁধা নিষেধ করার মত কেউই ছিল না। আরাম আয়েশে দিন কাটাতে কাটাতে জবের কথা যেন আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। ভাইয়া মাঝেমধ্যে জবের কথা জিজ্ঞেস করলেও নানান বাহানা দেখিয়ে এড়িয়ে যেতাম। ভাইয়া অবশ্য বুঝতো কিন্তু কখনোই তেমন শক্ত করে কিছু বলেনি।
দিন যেতে লাগল আর আমি যেন ভাইয়ার আরও ঘনিষ্ঠ হতে লাগলাম। ভাইয়ার যা কিছু ছিল সবকিছুই ভাইয়া আমার সাথে শেয়ার করতো। কোন একাউন্টে কত টাকা, কোথায় কতটুকু জমি সবই বলতো ভাইয়া। আর আমি শুধু অবাক হয়ে শুনতাম। কারণ ছোট থেকেই বাবার ঘরে অভাবে বড় হয়েছি। আর বর্তমান জীবনেও অভাবের দাস ছিলাম। আর অপরদিকে ভাইয়া ছোট থেকেই ঐশ্বর্যের ভেতর বড় হয়েছে আর নিজের জীবনেও সে ওই ধারা বজায় রেখেছে।
যার দরুণ একপ্রকার লোভ আর আক্রোশ জন্মে গিয়েছিল ভাইয়ার সবকিছুর উপর। কারণ আমাদের দেশের আইন অনুযায়ী সম্পত্তির মালিকের কোনো ছেলেমেয়ে না থাকলে ওই সম্পত্তির মালিক ভাইস্তারা হয়। তাই সবসময় আমার মাথায় একটা চিন্তাই ঘুরপাক খেত। ভাইয়া ও তার বংশ না থাকলে ভাইয়ার ক্লোজ যেহেতু আমি, তারউপর চাচাতো ভাই, সেহেতু ভাইয়ার ভাগের পৈত্রিক সম্পত্তি ও তার নিজের সমস্ত সম্পত্তি সবই আমার হবে। জীবনে কোনকিছু করার প্রয়োজন পড়বে না। পায়ের উপর পা তুলে সারাজীবন কাটিয়ে দিতে পারব।
বলতে গেলে সারাদিনই এই সমস্ত ব্যাপার নিয়ে ভাবতাম কিন্তু কীভাবে কী হবে বা কীভাবে কী করব তার কোনো সুরাহা খুঁজে পেতাম না। একদিন হঠাৎই মাথায় এলো হাফসা ভাবীর কথা। অর্থাৎ তাকে তুরুপের তাশ বানানোর কথা। কেননা কথায় আছে, প্রেমে পড়লে সবাই অন্ধ হয়ে যায়!”
বলেই থামল রাকিব। আরিফুল আর নীরব একে অপরের দিকে একপলক তাকিয়ে বলল,
” তারপর! ”
” এক গ্লাস পানি দেয়া যাবে?”
রাকিবের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশকে আরিফুল চোখের ইশারা দিতেই পানি ভর্তি গ্লাস হাজির হয়ে গেল। রাকিব ঝড়ের বেগে পানির গ্লাস ফাঁকা করতেই আরিফুল বলল,
” তারপরের অংশ বল…”
রাকিব মাথা নাড়িয়ে বলতে আরম্ভ করল…..
” ২০১৯ সালের মে মাসের কথা! ভাইয়ার অফিসের একটা কাজে ভাইয়াকে ১০ দিনের জন্য দিল্লি যেতে হয়েছিল। যদিও ভাইয়া যেতে চাইছিল না কিন্তু চাকরির খাতিরে যেতে হয়েছিল। আর সেই সুযোগটাই নিয়েছিলাম আমি…..
ভাইয়ার যাওয়ার পরেরদিন……
দুপুর ৩ টা। মাহফুজ আর মারিয়াকে ঘুম পারিয়ে খাবার টেবিলে খাবার বেড়ে ডাক দিয়েছিল ভাবি। আমি চেয়ার টেনে টেবিলে বসতেই ভাবি খাবারের প্লেট সামনে দিয়ে দিল। আর সে বসল আমার থেকে দুটো চেয়ার পরে। সেসময় আমাদের মাঝে বাড়তি কথা তেমন হয়নি। তবে সে বাড়তি কথাটা হয়েছে খাবারের পর ড্রয়িং রুমে টিভি দেখার অজুহাতে। টিভি চলছিল…. ভাবি একপাশের সোফায় আর আমি অন্যপাশের। টিভি দেখার মাঝেই আমি বললাম,
” ভাই নেই খারাপ লাগছে না ভাবি? বিয়ের পর তো এই প্রথমই মনে হয় এতদিনের জন্য ভাইয়া এতদূর গেল তাই না? ”
” হ্যাঁ, এই প্রথম। তাই তো বেশি খারাপ লাগছে।”
ভাবির এই কথাটির মাঝে কেমন যেন এক ধরনের ইশারা এবং সাহস দুটোই খুঁজে পেয়েছিলাম আমি। বললাম,
” একটা কথা বলব ভাবি?”
” হ্যাঁ বলো। ”
” আপনাকে দেখলে কিন্তু কেউ বলবে না আপনি দুই বাচ্চার মা। আপনার ফিগার এখনো মাশাল্লাহ সেই বিয়ের আগের মত। মনে হয় কলেজ পড়ুয়া মেয়ে। এক্ষুনি প্রেম করে ফেলি। ”
” কী যে বলো না!”
” আমি যে মিথ্যে বলি না সেটা কিন্তু আপনি ভালো করেই জানেন। তাছাড়া আপনি এরকম সত্যি একটা কথা শুনে অবাক হচ্ছেন কেন? এর আগে এরকম কথা ভাইয়া কি কখনো বলেনি বুঝি?”
” তোমার ভাইয়ার এসব বলার সময় সুযোগ আছে না-কি! তার কথানুযায়ী আমি এখন দুই বাচ্চার মা। বয়স হয়েছে আমার। অতিরিক্ত আদর আহ্লাদ আমায় মানায় না। ” কথাগুলো একটু মুখ বাঁকিয়েই বলেছিল ভাবি। যা আমাকে আরও গভীর সাহস জোগাতে সহযোগিতা করে। তাই আমি ভাবির পাশের সিটে বসে বললাম,
” এটা কেমন কথা? স্বামী স্ত্রীর ভালোবাসার আবার বয়স, ছেলেমেয়ে এসব আছে না-কি? এ ভালোবাসা তো সর্বকালের জন্য। হোক সে দু সন্তানের মা কিংবা পাক চুল ওয়ালী বুড়ি।”
” তোমার ভাইয়া যদি তোমার মত বুঝত তাহলে তো হতোই।”
” ভাইয়া না বুঝুক…. আমি তো বুঝি ভাবি। ”
” মানে!”
আমি ভাবির হাত ধরে ফেললাম। বললাম,
” আমি আপনাকে বড্ড ভালোবেসে ফেলেছি ভাবি। তাছাড়া ভাইয়ার সাথে আপনার বয়সও ম্যাচ হয় না, আর বয়স ম্যাচ না হওয়ার জন্যে শারীরিক, মানসিক কোনো চাহিদাই হয়তো ম্যাচ হয় না। হয়তো কেন অবশ্যই ম্যাচ হয় না। যেটা আপনার মুখ দেখলেই স্পষ্ট বুঝা যায় আপনি আপনার প্রাপ্য ভালোবাসা, চাহিদা থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত। ”
” তুমি কি বলতে চাচ্ছো বাবলু?”
” আমি আপনার সঙ্গ চাই ভাবি। আমি আপনাকে ভালোবাসতে চাই। আমি আপনাকে আপনার প্রাপ্য সুখের সাগরে ভাসাতে চাই। প্লিজ ভাবি আপনি আমাকে ফিরিয়ে দিবেন না। কথা দিচ্ছি আমি আপনাকে আমার জীবন থাকতে কষ্ট পেতে দেব না। আপনার সমস্ত কষ্ট আমি হাসিমুখে বুক পেতে নিব।”
” এটা হয় না বাবলু। তোমার সামনে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। তুমি চাইলে আরও সুন্দর মেয়ে পেতে পারো। শুধু শুধু নিজের জীবনে ঝামেলা ডেকে এনো না। ”
” আমার অন্য কাউকে না, তোমাকে চাই হাফসা। আমি তোমার ভালোবাসায় বিভোর হয়ে গিয়েছি। আমার মনের অলিতেগলিতে কেবল তোমারই বিচরণ। একটা সুযোগ দাও প্লিজ…… একটা সুযোগ! ”
” তুমি বুঝার চেষ্টা করো বাবলু……তোমার ভাই জেনে গেলে কেলেঙ্কারি বেঁধে যাবে। ”
” আমি আর তুমি যদি না জানাই ভাই জানবে কীভাবে? পাড়াপড়শি তো আর ঘরের খবর জানবে না যে ভাইয়াকে বলবে। তুমি শুধু আমাকে একটা সুযোগ দাও। যদি আমি তোমার মনমতো হতে না পারি আমার সাথে কোনো সম্পর্ক রেখো না। আমিও তোমাকে ফোর্স করব না। আর যদি আমি তোমাকে পূর্ণ সুখী করতে পারি তাহলে তুমি ভাইয়ার সংসার ছেড়ে আমার হাত ধরবে। আমাদের সংসার সাজানোর স্বপ্নে বিভোর হবে।প্লিজ হাফসা আমি তোমার পায়ে পড়ি আমার ভালোবাসার একটা পরীক্ষা নাও তুমি।”
” কিন্তু……”
” কোনো কিন্তু না, আমি একটা সুযোগ তোমার কাছে ভিক্ষে চাই হাফসা। একটা সুযোগ মাত্র।”
ভাবির মুখের আভায় সম্মতির লক্ষণ দেখতে পেতেই ভাবিকে আরও কাতর করতে আমি ভাবিকে জড়িয়ে ধরে তার ঠোঁটে নিজের ঠোঁট জোড়া চেপে ধরলাম। আর ভাবিও তা ধীরে ধীরে স্বাভাবিক ভাবেই নিতে লাগল।
এভাবেই কেটে গেল বাকি দিনগুলো। ভাইয়া আসতে আর বেশি দেরি ছিল না। মাঝের রাত টাই শুধু হাতে ছিল। দিনের আলো ফুটলেই ভাইয়া আগের ন্যায় আবার হাজির হয়ে যাবে আমাদের মাঝে। অবশ্য এতে আমার কোনো সমস্যা ছিল না। কারণ আমার যা করার ছিল আমি করে ফেলেছিলাম। হাফসা তখন আমাতে বিভোর ছিল। আর সেই বিভোরতাই ছিল আমার কার্য সম্পাদনের প্রথম ধাপ।
রাত ২ টা। কাপড় বিহীন দেহ মেলে হাফসা আমার উপর শুয়ে। চোখমুখে বিষাদের ছায়া। কন্ঠস্বরে আবেগময় শব্দভাণ্ডার। কালো মুখে বলল,
” আবার আমরা কবে এক হবো বাবলু? তোমার ভাই তো চলে আসবে। এইভাবে খোলামেলা তো আমরা আর থাকতে পারব না। সারাদিনের খুনসুটি আর করা হবে না। রান্নাঘরে কাজের ফাঁকে তোমার জড়িয়ে ধরা অনুভূতি আর পাওয়া হবে না। কীভাবে থাকব আমি? কেমন করে দিন পার করব? সাদামাটা জীবন যে আমার আর ভালো লাগবে না।”
” এতো ভাবছ কেন পাগলী? ভাইয়া আসছে তাতে কী হয়েছে? আমি তো আর চলে যাচ্ছি না। তাছাড়া ভাইয়া তো সারাদিন অফিসেই থাকবে কেবল রাতটাই ঘরে। আর আমি তো সারাদিন ঘরেই থাকব। রাতে না হোক পুরোদিনটা তো আমাকে ঘিরেই থাকবে। ”
” আমার যে রাতেও চাই তোমায়। তোমার ভাই তো অফিস থেকে এলে আর হুশ থাকে না কখন ঘুম দেবে। আমি যে পাশে আছি খবরই থাকে না। আর তুমি আমার কত খেয়াল রাখো। আমার প্রয়োজন অপ্রয়োজন সব তুমি আমার মতো করে বুঝো। গল্প করে আমাকে হাসাও, আবার রাগ করলে সেই রাগ সযত্নে ভাঙাও। এগুলিই তো আমিই চাই। এর থেকে বেশি কিছু তো আমার চাওয়া নেই। না না, আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারব না বাবলু। ”
” এবার বুঝলে তো আমার ভালোবাসা তোমার জন্য ঠিক কতটা খাঁটি? ”
” সে কী আর বলতে?” বলেই আমার খোলা বুকে চুমু খেল।
আমি তার খোলা চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে বললাম,
” আমি দ্রুতই তোমাকে এখান থেকে নিয়ে দূরে চলে যাবো। ততদিন ভাইয়ার সাথে আর তেমন মেলামেশা করো না। যেহেতু এখনো তার বউ হিসেবে এই ঘরে থাকতে হবে তাই যতটুকু না করলেই নয় ততটুকুই করবে। আর হ্যাঁ, যত দেরি করে মেলামেশা করবে ততই ভালো। আমার কিন্তু এসব সহ্য হবে না। ”
” তোমার কী আমারই তো ভালো লাগবে না। আমার সবকিছুর জন্যে তো তুমি আছোই। ”
বলেই আমার ঠোঁটে চুমু খেতেই আমি তার খোলা পিঠে চেপে ধরে কাত করে বিছানার উপর ফেলে দিলাম। আর আমার সমস্ত শরীরের ভর ছেড়ে দিলাম তারউপর।”
আরিফুল দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলল,
” যার বিড়াল তাকে বলিস মিয়াঁও? যার টাকায় খাচ্ছিস, দাচ্ছিস তার বউয়ের সাথে নষ্টামি করে আবার তাকে তার পরিবার সহ মারার প্ল্যান করছিলি? আবার শোয়াশুইয়ের কথা ব্যাখ্যাও করছিস! তুই তো ভয়ানক বড় ও উদার মনের মানুষ! ”
বলেই আরিফুল নিজেকে কন্ট্রোল না করতে পেরে বসা থেকে উঠে সজোরে বেতের বারি বসালো রাকিবের পিঠ জুড়ে।
.
.
চলবে……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে