#বর্ষাস্নাত_রাত
লেখা – জান্নাতুল ফেরদৌস মাটি
পর্ব – ৬
________________
আরিফুল কন্ঠস্বর লঘু করে বলল,
” আপাতত নেই। ”
শেখ সাহেব বললেন,
” ভবিষ্যতে প্রমাণ সাপেক্ষে হতে পারে তাই তো?”
” হ্যাঁ, সেটা হতেই পারে। বুঝতেই তো পারছেন মার্ডার কেস, সন্দেহ ব্যাপারটা সবার দিকেই ঘুরঘুর করছে। ”
” তা বেশ এতে আমার কোনো সমস্যা নেই। কারণ আমি বিশ্বাস করি সত্যের জয় সর্বদা হয়। আমার ভাই পাজি হতে পারে, কথার ভাজে আমার ক্ষমতার প্রভাব আমি না দেখালেও সে ভালোই দেখাতে পারে কিন্তু কারো জীবন নেয়ার মত কাজ আমার ভাই করবে না। এ ব্যাপারে আমি শতভাগ নিশ্চিত। তাই আপনারা একবার না হাজারো বার সন্দেহ করলেও আমার কোনো সমস্যা নেই। ”
” ধন্যবাদ। ”
” এখন কথা হচ্ছে আমি জামিনদার হয়ে যদি আমার ভাইকে নিয়ে যেতে চাই তা কী সম্ভব? আপনাদের যখনই প্রয়োজন পড়বে আমি নিজে নিয়ে আসব। আসলে ভাই টা এভাবে থেকে অভ্যস্ত না তো!”
” এই মুহুর্তে আমি দুঃখিত! যদিও আমাদের নিকট থাকা সকল প্রমাণ সাপেক্ষে তানভীর সাহেব সম্পূর্ণ নির্দোষ তারপরও আমরা তাকে ছাড়তে পারব না। আপনি নিজেই দেখতে পারেন হালিমা মঞ্জিলের কেয়ারটেকার আমাদের তত্ত্বাবধানে বর্তমানে আছে। সেও কিন্তু তানভীরসাহেবের মত নির্দোষ। তারপরও তাকে আমরা খালাস করছি না। করতে পারছি না। কারণ ঘটনা চক্র কোথা থেকে কোথায় যায় বলা তো যায় না। তাই যাদের উপর কিঞ্চিৎ সন্দেহ প্রথম থেকে হয়েছে সত্যটা সামনে আসার আগ পর্যন্ত তাকে আমরা ছাড়তে পারব না। ”
” আচ্ছা সমস্যা নেই। তাহলে আপনারা সব যাচাই বাছাই করুন তারপরই না’হয় তানভীরকে নিয়ে যাবো। ”
” জি ধন্যবাদ। ”
শেখ সাহেব চলে গেলেন।নীরবকে উদ্দেশ্য করে আরিফুল বলল,
” রাকিবের কথানুযায়ী যতটা খারাপ এদের ভেবেছিলাম ততটা খারাপ কিন্তু এনারা নন। তাছাড়াও শেখ সাহেবের সম্পর্কে আমি আগেও শুনেছিলাম, মানুষ হিসেবে তিনি অত্যন্ত সৎ এবং অমায়িক মনের অধিকারী। ”
” জি স্যার। উনি কিন্তু চাইলেই উপরে যোগাযোগ করে তার ভাইকে এখান থেকে নিয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু সে সেরকম কিছুই করেননি। এতেই বুঝা যায় তার মন-মানসিকতা কেমন প্রকৃতির।”
” হুম…..আচ্ছা মহিউদ্দিন সাহেবের গোপন ক্যামেরাটা ল্যাপটপে অন করো। দেখি কী আছে এর ভেতর। ”
” জি স্যার। ”
নীরব ক্যামেরাটির সাথে ল্যাপটপ কানেক্ট করে ভিডিওটি চালু করল। আর আরিফুল সামান্য টেবিলের দিকে ঝুঁকে গভীর মনোযোগের সাথে সেই ভিডিও দেখতে লাগল। শুরুর দিকে বাচ্চাদের খেলাধুলা, হাফসা ও মহিউদ্দিনের কর্মব্যস্ততার ভেতর দিয়ে যাচ্ছিল ভিডিওটি। আরিফুল বলল,
” সামনের অংশ খানিক কেটে দাও নীরব। এতঘন্টার ভিডিও দেখার সময় নেই এই মুহূর্তে আমাদের হাতে। মাঝের দিকে ধরো তাতেই সেদিনকার রাত টুকুর অংশ থাকতে পারে।”
” ওকে স্যার।”
নীরব মাঝের একটু আগের দিকেই ভিডিওটি চালু করে দিল। যেখানে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে বাড়ির গেইটের সিসি ক্যামেরায় যে ব্যাক্তিটিকে কালো কাপড় পড়া অবস্থায় সন্দেহ করা হয়েছিল সেই ব্যাক্তিটিই মহিউদ্দিন সাহেবের রুমে দাঁড়িয়ে। আর তার পেছনেই হাফসা। আরিফুল আর নীরবের চোখ যেন কপালে উঠে গেল। চাকু হাতে নিয়ে কালো কাপড় পড়া লোকটি মহিউদ্দিনের দিকে এগোতেই আরিফুল বলল,
” টেনে দাও নীরব। আমি ওসব দেখতে পারব না। মাথা যন্ত্রণা করে। ”
আরিফুলের কথামত নীরব মিনিট বিশেকের মত কেটে দিতে নিলেই আরিফুল আবার বলল,
” না থাক কেটো না, হয়তো এর মাঝেও অনেক প্রমাণ পাওয়া যেতে পারে।”
” জি স্যার।”
বিভৎস ভিডিওটি দেখার মিনিট বিশেক বাদে একপর্যায়ে দেখতে পেল সেই লোকটি হাফসার গলার পাশেও চাকু মেরে দিয়েছে। আরিফুল চোখ বুজে নিলেই নীরব বলে উঠল,
” হায়রে পরকীয়া! ”
ভ্রু কুচকে আরিফুল ফের ভিডিও ফুটেজে তাকাতেই দেখতে পেল পরক্ষণেই মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ব্যাক্তিটির তার আসল রূপ বের করল। আরিফুল আর নীরব একে অপরের দিকে বিষ্ময় চাহনিতে একবার তাকাচ্ছে তো আরেকবার ভিডিও ফুটেজের দিকে। তাদের চোখকে যেন তারা নিজেরাই বিশ্বাস করতে পারছে না। ভিডিও ফুটেজ কয়েকবার স্টপ করে খুনির মুখগহ্বর ভালো করে দেখে আরিফুল অস্পষ্ট গলায় বিষ্ময় ভাব ফুটিয়ে বলল,
” রাকিব!”
নীরব বলল,
” আমি আগেই বলেছিলাম স্যার এই রাকিবই খুনি। ওর জুতো দেখেই আমার যথেষ্ট সন্দেহ হয়েছিল। কিন্তু আপনি তো তখন বিশ্বাস করেননি। আর ওর সেদিনের কান্না….. সেটাও আমার কাছে স্বাভাবিক কান্নার মত লাগেনি। কুমিরের কান্নার মত লেগেছে। এটাও আমি আপনাকে বলেছিলাম।”
” কোথায় এখন সে?”
” হাবিলদারকে সঙ্গে রেখে ওদিকটায় বসিয়ে রেখেছি। ”
দু’জনের কথা বলার মাঝেই একটি ছেলে এসে নীরবের হাতে কিছু কাগজ ধরিয়ে দিল। নীরব সেগুলো চেক করে আরিফুলের হাতে দিতেই আরিফুল সমস্ত কাগজপত্র চেক করে নীরবের দিকে তাকিয়ে বলল,
” তানভীর আর কেয়ারটেকারকে ছেড়ে দিও। আর হ্যাঁ তার আগে রাকিবকে আমার কাছে নিয়ে এসো। ”
” লকাপে ঢুকাবো না স্যার?”
” সে আবার বলতে? আগে এখানে নিয়ে আসো তারপর হারামজাদাকে ভেতরে ঢুকাবো।
” ওকে স্যার।”
নীরব চলে যেতেই আরিফুল বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। একহাত পকেটে ঢুকিয়ে টেবিলের এপাশ থেকে ওপাশ বিষাক্ত চাহনি সমেত হাঁটতে লাগল। মিনিট দুয়েক যেতেই নীরব ছুটে এলো। হাঁপাতে হাঁপাতে অস্থিরতা ভরা কন্ঠে বলল,
” স্যার! রাকিব….রাকিব নেই। পালিয়ে গিয়েছে সে। ”
” পালিয়ে গিয়েছে? মানে কী? কী বলছ তুমি?”
” হ্যাঁ স্যার ও নেই থানায়। পুরো থানা হন্ন হয়ে খুঁজেছি কোত্থাও নেই রাকিব। এমনকি বাহিরেও দেখেছি ও নেই। আমার মনে হয় ওর থেকে জুতো নেয়ায় হয়তো ওর সন্দেহ হয়েছিল তাই পালিয়ে গিয়েছে। ”
” শিট! তুমি না বলেছিলে হাবিলদারকে পাহাড়ায় রেখেছ? সে কোথায়? সে দেখেনি পালাবার সময়? ”
” স্যার হাবিলদারও তো নেই। ”
” মানে কী এসবের?”
” বুঝতে পারছি না স্যার।”
” গাড়ি বের করো…..ফাস্ট! ”
” ওকে স্যার।”
এরই মাঝে হাবিলদার ছুটে এসে বলল,
” স্যার স্যার রাকিব তো পালিয়েছে।”
হাবিলদারকে দেখে আরিফুলের মাথায় রক্ত চড়ে যায়। দাঁত কিড়মিড়িয়ে শার্টের কলার চেপে বলল,
” এখন এসেছিস সুসংবাদ দিতে? তোকে না ওই হারামজাদার সাথে রেখে গিয়েছিল পাহাড়া দিতে? কোথায় গিয়েছিলি তুই? হাওয়া খেতে না-কি ওই খুনিকে পালাতে সাহায্য করতে কোনটা? ”
হাবিলদার কাপা গলায় বলল,
” স্যার…..আমার সকাল থেকেই পেট খারাপ। কম করে হলেও এই নিয়ে পাঁচ ছয়বার বাথরুমে গিয়েছি। তাই পেটে চাপ পড়তেই আর হুশ ছিল না, দৌড়ে বাথরুমে চলে গিয়েছিলাম।”
” ভালো করেছিস। খুব ভালো করেছিস।”
বলেই দাঁতে দাঁত চেপে বেরিয়ে যায় থানা ছেড়ে আরিফুল। আর তার পিছু নিল নীরব।
.
সন্ধ্যা ৭ টা। রিমান্ড রুমের ভেতর বসে আছে রাকিব। তার ঠিক পেছন ভাগে বন্দুক হাতে সমেত এক পুলিশ কর্মকর্তা দাঁড়িয়ে। আর সম্মুখ ভাগে আরিফুল আর নীরব বসে। মুখ জুড়ে তার শত শঙ্কার ছাপ। সেকেন্ডের ব্যবধানে একের পর এক ঘামের নোনা ফোঁটা ছুঁয়ে যাচ্ছে গলা বেয়ে। সামনে থাকা পানি ভর্তি গ্লাসটি একনিমিষে ফাঁকা করেও গলা যেন ভেজেনি তার। যার দরুণ সেই শুকনো গলা ভেজাতে এই মুহূর্তে তার আরও পানির প্রয়োজন। তবে পানির কথা মুখ ফুটে বলার নূন্যতম শক্তি পাচ্ছে না রাকিব। ভয়ে নেতিয়ে গিয়েছে সে সম্পূর্ণ ভাবে।
সামনে থেকে আরিফুল বলল,
” পালিয়ে কী বিশেষ কোনো লাভ হয়েছে? সেই তো রাস্তার মোড় থেকেই ধরে আনলাম। অকারণে পালিয়ে নিজেকে ও আমাদের এভাবে হেরেজ করার কোনো মানে ছিল?”
রাকিব মাথা নিচু করে চুপটি মেরে বসে আছে।
আরিফুল আবার বলল,
” যেদিন মহিউদ্দিন সাহেবের ফুল ফ্যামিলির খুন হয় সেদিন রাতে তুমি কোথায় ছিলে? ”
রাকিব কাপা গলায় বলল,
” স্যার আর কতবার বলব, আমি আমার বন্ধুর বাসায় ছিলাম।”
” মিথ্যে…..মিথ্যে বলছ তুমি। সত্যি করে বলো কোথায় ছিলে? ”
” স্যার আমি সত্যিই করেই…..”
” রাকিব! আবারও বলছি মিথ্যে বলো না। সমস্ত প্রমাণ কিন্তু আমাদের হাতে অলরেডি চলে এসেছে। কোনোভাবেই তুমি বাঁচতে পারবে না। তাই এখনও সময় আছে গায়ে হাত তোলার আগে সত্যিটা খুলে বলো আমাদের।” রাকিবের কথার মাঝে উঁচুস্বরে কথাগুলো বলল আরিফুল।
রাকিব আবারও চুপ হয়ে গেল। আরিফুল নিজেই আবার বলল,
” কী হলো চুপ করে আছো যে? যার জিজ্ঞেস করেছি তার উত্তর দাও ….”
কিন্তু এবারও রাকিব নিশ্চুপ। আরিফুল টেবিলে হাত দিয়ে সজোরে আঘাত করে বসা থেকে উঠে কোমরে হাত চেপে দাঁড়ালো।পেছনে ঘুরে রিমান্ড রুমের দেয়ালের সাথে সংযুক্ত থাকা বিশাল মাপের আয়নার দিকে ব্যর্থ দৃষ্টিতে তাকালো। এই আয়না দ্বারা বাহির থেকে ভেতরের কিছু দেখা না গেলেও, ভেতর থেকে বাহিরের সবই দেখা যায়। যেমনটা এই মুহূর্তে ভেতর থেকে দেখছেন ডিসি রাসেল।আর আরিফুল ডিসি রাসেলকে উদ্দেশ্য করে মাথা দুলিয়ে রিমান্ড রুম থেকে বেরিয়ে পেছন রুমে গেল। অর্থাৎ সেই আয়নার ভেতর রুমটিতে। যেখানে দাঁড়িয়ে আয়নার বহির্ভাগে ঘটা সমস্ত কিছু দেখে ও শুনে পর্যবেক্ষণ করছিলেন ডিসি রাসেল। আরিফুল যেতেই ডিস রাসেল রাকিবকে দেখিয়ে বললেন,
” এর জবানবন্দির জন্য অপেক্ষা করছ কেন? এমন তো না যে প্রমাণ আমাদের হাতে নেই, ওর সাক্ষীই সব। সবকিছু আমাদের ফেভারে আছে আরিফুল । ওর স্বীকারোক্তির কোনো প্রয়োজনই নেই। ”
” হাত চালাতে বলছেন স্যার?”
” অবশ্যই! কী কারণে এতকিছু ঘটিয়েছে জানতে হবে না!”
” জানব তো অবশ্যই স্যার। এতক্ষণ একটু সময় দিচ্ছিলাম ভালোয় ভালো যাতে বলে দেয়। এখন যেহেতু বললই না দ্বিতীয় রাস্তা তো অবলম্বন করতেই হয়।”
” যে রাস্তাই অবলম্বন করো না কেন, ঘটনার উদঘাটন দ্রুত হওয়া চাই। আর এই রাকিবের যেই ভয়াবহ অবস্থা দেখছি তাতে মনে হয় দুটো বারি দিলেই কথার ঝুড়ি বেরিয়ে যাবে। সময় নিবে না বেশি। ”
” জি স্যার।”
” তো যাও যা করার দ্রুত শুরু করো। হাতে সময় নেই আমাদের। ”
” ওকে স্যার। ”
আরিফুল আয়নার গোপন রুম থেকে বেরিয়ে হাতে দুটো মোটা বেতসহ রিমান্ড রুমে প্রবেশ করল। নীরবকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“বেটার হাত বাঁধো।”
নীরব মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিয়ে রশি এনে রাকিবকে হেঁচকা টানে মেঝেতে ফেলে হাত দুটো একটি আরেকটির সাথে বাঁধল। আরিফুল নিজের হাত একটি বেত রেখে অন্যটি নীরবের হাত ধরিয়ে দিল। রাকিবের সামনে দু পা এগিয়ে চুলের মুঠি ধরে বলল,
” এখনো বলবি না কোথায় ছিলি?”
” স্যার বিশ্বাস করেন…..”
রাকিবের কথা শেষ হবার আগেই আরিফুল সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রাকিবের পা বরাবর তার হাতে থাকা মোটা বেতের ছাপ বসিয়ে দিল। চোখের পলকে লাল রক্ত জমাট বেঁধে গিয়েছে জায়গাটি। রাকিব ব্যাথায় চিৎকার করতেই সেই জমাট বাঁধা জায়গাতে আবারও মারল আরিফুল।
রাকিব কান্নার মাঝে মা মা বলে চেঁচাতেই নীরব তার হাতের বেতটি দিয়ে রাকিবের হাতের উপরিভাগে সজোরে আঘাত করল। আরিফুল বলল,
” এই সামান্য আঘাত সহ্য হয় না? ব্যাথায় কুঁকড়ে গিয়ে মা বলে চেঁচাচ্ছিস? আর সেদিন যখন চার চারটে প্রাণ বিভৎস ভাবে কেড়ে নিলি তাদের বুঝি আঘাত লাগেনি? তোর তো সামান্য যন্ত্রণা হচ্ছেরে…..আর তাদের যে মরন যন্ত্রণা হয়েছে! ছোট্ট ছোট্ট দুটি নিষ্পাপ শিশু যাদের খেলার বয়স তারা যে মরন যন্ত্রণায় ছটফট করেছে সেটা বুঝি কিছু না? ”
বলেই আরিফুল আরও একটি আঘাত বসালো রাকিবের পিঠে। রাকিব ব্যাথায় কাতর হয়ে অস্পষ্ট গলায় বলল,
” বলব…আমি সব বলব।আমি সব বলে দিব আমাকে এভাবে মারবেন না। দোহাই লাগে আপনাদের আমাকে এভাবে মারবেন না।”
.
.
চলবে….