#বর্ষাস্নাত_রাত
লেখা – জান্নাতুল ফেরদৌস মাটি
পর্ব – ৫
.
” স্যার, খুনির সন্ধান হয়তো আমি পেয়ে গিয়েছি। ”
আচমকা ঝড়ের বেগে ছুটে এসে নীরবের এরকম একটি উদ্ভব কথা যেন রাসেল আর আরিফুলকে চমকে দিল! উৎকন্ঠা হয়ে আরিফুল বলল,
” কী বলছ নীরব! তুমি খুনির সন্ধান পেয়েছ! মানে কী? আর পেলেও কখন? কীভাবে? কেমন করে তুমি খুনির সন্ধান পেয়েছ?”
নীরব সামান্য ঝুঁকে তার হাতে থাকা মোবাইলটির গ্যালারি বের করে একটি জুতোর ছবি দেখালো। তবে এর প্রতিক্রিয়া বেশিদূর অবধি গেল না। ডিসি রাসেল চড়া মেজাজ করে বলেন,
” তোমার কাছে কী এই সবকিছু ফাইজলামি মনে হচ্ছে?আর আমরা এখানে ফাইজলামি দেখতে বসেছি? জুতোর ছবি দেখিয়ে বলছ খুনির সন্ধান পেয়ে গিয়েছ। মানে কী এসবের?ইতরামো করছ আমাদের সাথে? ”
নীরব সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে বলল,
” সরি স্যার! তবে আমি কিন্তু ভুল কিছু বলছি না স্যার। আপনারা চাইলে একবার চেক করে দেখতে পারেন। সিসি টিভি ফুটেজে রাত সাড়ে দশটায় কালো কাপড়ে আবৃত আমরা যে মানুষটাকে বাড়ির ভেতর ঢুকতে দেখতে পাই সেই মানুষটার পায়ে কিন্তু ঠিক এই সেইম জুতোই ছিল। যেটা কি-না আমি মনের অজান্তেই ভিডিও দেখার সময় লক্ষ্য করেছিলাম। আর আজ যখন সেই সেইম জুতো একজনের পায়ে দেখলাম সন্দেহের তীড় টা কেন যেন সঠিক মনে হচ্ছিল। তাই লুকিয়ে জুতো জোড়ার ছবি তুলে দ্রুত আপনাদের কাছে চলে আসি।”
ডিসি রাসেল আরিফুলের দিকে তাকিয়ে ভ্রু উঁচিয়ে বললেন,
” ভিডিওটি চালু করো ত…আমিও দেখি কী মিল আছে!”
আরিফুল ভিডিও টি চালু করতেই বেশ কয়েকবার পুষ করে করে দেখলেন রাসেল। একবার মোবাইল গ্যালারি তো একবার ভিডিও ফুটেজ। এভাবেই মিনিট দশেক যাবৎ ঘাড় দুলিয়ে যাচ্ছেন তিনি। একপর্যায়ে উদগ্রীব হয়ে বলে উঠলেন,
” জুতো দুটো তো একেবারেই সেইম! কোথায় পেলে তুমি এই জুতোকে? আর কার পায়েই বা ছিল এই জুতো জোড়া? ”
নীরব কন্ঠস্বর নিচু করে বলল,
” এই জুতোর মালিক বর্তমানে থানায় উপস্থিত আছে স্যার। ”
আরিফুল বলল,
” কে সে?”
নীরব বলল,
” রাকিব!”
রাসেল বললেন,
” রাকিব! মানে ভিক্টিমের চাচাতো ভাই? ”
নীরব বলল,
” জি স্যার। মহিউদ্দিন সাহেবের চাচাতো ভাইয়ের কথাই বলছি আমি। ”
আরিফুল বলল,
” আমার কেন যেন মনে হচ্ছে এই সামান্য মিলের জন্য কারো উপর সন্দেহ করা ঠিক হবে না। কেননা এই সেইম জুতো আরও হাজারো মানুষের পায়ে আছে। তাই বলে কী তারা সবাই খুনি? আমাদের আরও কিছু প্রুভের প্রয়োজন। জোড়ালো প্রুভ।”
নীরব বলল,
” স্যার, আমি তো বলছি না এই সামান্য সন্দেহের ভিত্তিতে কারো উপর জেরা করতে। তবে একটা চেষ্টা তো করতে পারি আমরা। বাই চান্স যদি লটারিটা লেগে যায়। বলা তো যায় না কার মনে কী থাকে! আর এই রাকিবের আচরণবিধির উপরও যথেষ্ট পরিমাণ সন্দেহ কাজ করে আমার। সে যাই হোক, এখন আপনারা যদি অনুমতি দেন তাহলে আমি রাকিবের জুতো জোড়া ডিএনএ করতে পাঠাবো। কেননা আমি আশা বাদী এই পরীক্ষার মাধ্যমেই সব সন্দেহের অবসান ঘটবে।”
আরিফুল বলল,
” সন্দেহ তো ক্ষানিকটা আমারও হয়। বিশেষ করে সেদিন রাতে ওর মিসিংটা নিয়ে। আচ্ছা এক কাজ করো রাকিবের থেকে জুতো জোড়া নিয়ে ল্যাবরেটরিতে পাঠিয়ে দাও। আর হ্যাঁ, রাকিবের উপর নজর রেখো কিন্তু।”
” ওকে স্যার।”
নীরব যেতেই রাসেল বললেন,
” ব্যাপারটা বড্ড ঘোলাটে লাগছে আরিফুল। ”
আরিফুল ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
” যদি সেরকম কিছু হয়… তাহলে তো নিজ পরিবারের উপর থেকে মানুষের বিশ্বাস উঠে যাবে স্যার। ”
মাথা নাড়িয়ে আরিফুলের মত রাসেলও নিঃশ্বাস ফেলল তবে….দীর্ঘশ্বাস!
চেয়ার ছেড়ে উঠে বললেন,
” এখন তাহলে আমি আসছি। জরুরি কিছু হাতের কাজ ফেলে রেখে এসেছিলাম। সেগুলো গিয়ে ঠিক করতে হবে। আর হ্যাঁ, ডিএনএ রিপোর্ট কী বেরোলো অবশ্যই আমাকে জানিও। তাছাড়াও প্রতি মুহূর্তের আপডেটও আমাকে সময়ে সময়ে জানাবে। ”
” ওকে স্যার।”
ডিসি রাসেল চলে যেতেই আরিফুল দাঁড়িয়ে সম্মান জানালো। পরমুহূর্তে আরিফুল যখন চেয়ারে বসে মুঠো হাতে মাথা ঠেকিয়ে নীরবতার মাঝে মত্ত ছিল ঠিক তখনই থানায় প্রবেশ করে সুদীপ। তার চলনে ফুটে উঠছিল অস্থিরতার ভাব। মুখভঙ্গি জানান দিচ্ছিল রহস্য উন্মোচনের আর্তনাদ।
আরিফুল বলল,
” কী ব্যাপার সুদীপ সাহেব? আপনি হঠাৎ এখানে যে?”
সুদীপ দ্রুত এসে বলল,
” স্যার… আসলে আমি একটা জরুরি কথা বলতে এখানে এসেছি। যদিও কথাটি আমার আরও আগে বলা দরকার ছিল কিন্তু ভোলামন আর ভয়ের জন্য বলে উঠতে পারিনি। ”
” তা কী কথা শুনি!”
” আসলে স্যার মহিউদ্দিনের ব্যাপারে কিছু কথা।”
” হ্যাঁ সেটা তো বুঝতেই পেরেছি। এখন কী কথা বলবেন বলুন। ”
” স্যার গত একমাস যাবৎ মহিউদ্দিন তার স্ত্রী অর্থাৎ হাফসা ভাবিকে সন্দেহ করছিল। শুধু সন্দেহ বললে ভুল হবে গুরুতর ভাবেই সন্দেহ করছিল। মহিউদ্দিনের কাছে মনে হচ্ছিল হাফসা ভাবি হয়তো অন্যকোন সম্পর্কে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছে। অবশ্য তার যথেষ্ট প্রমাণও মহিউদ্দিন পেয়েছিল। তবে সেই মানুষটি কে সেটা বুঝতে পারেনি। আর তাই বৃহস্পতিবার দিন অফিস শেষে মহিউদ্দিন আমাকে নিয়ে যায় একটি ক্যামেরা কিনতে। বলেছিল রাতেই ক্যামেরা ফিট করবে। কিন্তু ক্যামেরা ফিট করে তো বিশেষ কোনো লাভ হলো না, পরের দিন তো লাশই হয়ে গেল।”
বেশ গভীর মনোযোগে সুদীপের কথাগুলো শুনছিল আরিফুল।সুদীপের কথা শেষ হতেই আরিফুল বলল,
” মহিউদ্দিন সাহেবের স্ত্রীর যার সাথে পরকীয়া জড়িত সম্পর্ক ছিল তাকে তো মহিউদ্দিন সাহেব চিনতেন না আপনার কথানুযায়ী। কিন্তু সন্দেহ দৃষ্টি কী কারো উপর পড়েছিল? মানে কাকে সন্দেহ করে আপনাকে সেরকম কিছু বলেছিল?”
” না স্যার সেরকম কিছু তো বলেনি। ”
” ও…… আচ্ছা ক্যামেরা কোথায় ফিট করবে সেরকম কিছু কী আপনাকে জানিয়েছে? ”
” শিউর করে তো কিছু বলেনি তবে মনের দোটানা নিয়ে বলেছিল তার নিজের রুমে রাখতে পারে, আবার নাও রাখতে পারে। সুযোগ বুঝে ব্যবস্থা নিবে এরকমটা বলেছিল মহিউদ্দিন। ”
“ওকে! আর কিছু বলেছিল?”
” জি না স্যার। আর তো কিছু বলেনি।”
আরিফুল টেবিলের উপর রাখা দুহাত উচিঁয়ে কনুই তে ভর দিয়ে মুঠোবন্দি হাতের মাঝে থুতনি গেঁথে গম্ভীর মুখে কী যেন ভাবতে লাগল। মিনিট দুয়েক যেতে থুঁতনি থেকে দুহাত নামিয়ে টেবিলের উপর রেখে দাঁড়িয়ে পড়ল। বলল,
” ওকে তাহলে আপনি এবার আসুন। পরে আবার কথা হবে। আমরা মহিউদ্দিন সাহেবের বাড়ির উদ্দেশ্যে বের হবো তো সেজন্যই একটু তাড়া আছে।”
” কোনো সমস্যা নেই স্যার।”
” আর হ্যাঁ, ধন্যবাদ আমাদের সাথে এতটা কো-অপারেট করার জন্য। ”
বলেই আরিফুল বসা থেকে উঠে কয়েকজন দু’জন কনস্টেবল নিয়ে থানা থেকে বেড়িয়ে গেল।
.
হালিমা মঞ্জিলের ভেতর ঢুকতেই কয়েকজন পুলিশ আরিফুলকে স্যালুট দিয়ে সম্মান জানালো। আরিফুল তাতে সাড়া দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে মহিউদ্দিন সাহেবের ফ্ল্যাটে ঢুকে পড়ল। গন্ধে গা গুলিয়ে আসছে সকলের। আরিফুল তো পারলে এক্ষুনি বমি করে দেয়। বাসি জমাট বাঁধা ছন্নছাড়া রক্তের এরকম বিভৎস গন্ধের সুবাস তার ভীষণ পরিচিত। চাকরির খাতিরে প্রায় পেতে হয় আরিফুলকে এই সুবাস। বিরক্ত লাগে তারপরও মনকে বেঁধে এই কড়া নিঃশ্বাসগুলো তাকে বারংবার আমন্ত্রণ জানাতে হয়। বমি মুখ পুড়ে আসলেও নিজেকে সংযত রাখতে হয়। যেমনটা এই মুহূর্তে রাখছে। নাকে রুমাল চেপে সাথে থাকা দু’জন কনস্টেবলকে গোপন ক্যামেরা খুঁজতে বলল। আর সে নিজেও এদিক ওদিক চোখ ফিরিয়ে ক্যামেরা খোঁজার সন্ধানে নেমে পড়ল।
একবার এ-রুম তো একবার ও-রুম এভাবেই খুঁজে যাচ্ছে সবাই। তাও ক্যামেরার কোনো হদিস পেল না কেউ। ঘন্টা প্রায় খোঁজার পরও ক্যামেরা না পেয়ে সবাই যখন হতাশ ঠিক তখনই আশার আলোর মত আরিফুলের নজর গিয়ে পড়ল মহিউদ্দিনের রুমের আলমারির উপর। ছোট্ট একটি জিনিসের উপর কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা। যেন কিছু লুকোনোর প্রচেষ্টা মাত্র!
আরিফুল কোনোকিছু না ভেবে একটি চেয়ার টেনে তার উপর দাঁড়িয়ে পড়ল। আলমারি থেকে আরিফুলের উচ্চতা ক্ষনিকের জন্য হলেও বেড়ে গেল। যার দরুণ খুব স্পষ্ট ভাবেই আরিফুল দেখতে পাচ্ছে আলমারির উপরটি। আরিফুল হাত উঁচিয়ে কাপড়টি সরাতেই তার কাঙ্ক্ষিত গোপন ক্যামেরাটি পেয়ে যায়। তবে এতেই সে থেমে থাকেনি। তন্নতন্ন করে পুরো আলমারির উপরটা তল্লাশ চালিয়ে গিয়েছে। যদি আরও কিছু প্রমাণ পেয়ে যায় সেই আশায়। কিন্তু না, আর কিছুই পায়নি আরিফুল। তাই ক্যামেরা হাতে নিয়েই চেয়ার ছেড়ে নেমে পড়ল। কনস্টেবলদের ডাক দিয়ে বলল,
” তোমরা কী সন্দেহজনক কিছু পেয়েছ?”
” না স্যার। তেমন কিছুই পাইনি।”
” আচ্ছা থাক আর কিছু লাগবে না। আর আমি ক্যামেরা পেয়ে গিয়েছি। এখানে আর থাকার প্রয়োজন নেই। আমরা এক্ষুনি থানায় ফিরব। ”
” ওকে স্যার।”
কনস্টেবলরা সামনে থেকে সরে যেতেই আরিফুল সামনে পা বাড়িয়ে দরজার দিকে এগুতে লাগল। আর সেই পায়ে পা মিলিয়ে তার পিছু নিল কনস্টেবল দু’জন।
.
থানায় পৌছে হাতের ক্যামেরাটি টেবিলের উপর রেখে কপালের ঘাম মুছে টেবিলে বসতেই নীরব এলো। বলল,
” হুট করে কোথায় গিয়েছিলেন স্যার? কোনো সংবাদ পেয়েছেন বুঝি? ”
” হ্যাঁ ওরকম কিছুই। মহিউদ্দিন সাহেবের বন্ধু সুদীপ এসেছিলেন। বললেন মহিউদ্দিন সাহেব তার স্ত্রীকে সন্দেহ করে বাড়িতে না-কি ক্যামেরা লাগিয়েছিল। তাও আবার মার্ডার হবার আগের দিন৷ তাই ওই ক্যামেরাটা খুঁজতে গিয়েছিলাম। যদি খুনি সম্পর্কে কোনো ক্লু পাই সেজন্যে। ”
” ও…তো ক্যামেরাটা কি পেয়েছেন স্যার?”
” হ্যাঁ পেয়েছি তো। একটু জিরিয়ে ল্যাপটপে অন করব। ”
” ও…”
” তোমার কী খবর? ডিএনএ রেজাল্ট কী এসেছে? ”
” না স্যার, এখনো তো আসেনি। তবে যাকে পাঠিয়েছি তার সাথে কথা হয়েছে আধ ঘন্টার মত সময় লাগবে আসতে। ”
” ও…”
” জি স্যার। ”
আরিফুল আর নীরবের কথা বলার মাঝেই থানায় উপস্থিত হলো এমপি শেখ সাহেব।মোটা স্বরে বললেন,
” থানার ওসি কে? ”
আরিফুল এগিয়ে এলো। পকেটে হাত ঢুকিয়ে বলল,
” জি আমি।”
শেখ সাহেব চেয়ারের দিকে ইশারা করে স্মিত হেসে বললেন,
” বসে কথা বলি?”
” জি অবশ্যই।”
মুখোমুখি বসে আছে এমপি শেখ সাহেব ও আরিফুল। চায়ের কাপে হাত ঘোরাতে ঘোরাতে শেখ সাহেব বললেন,
” তানভীর আমার ছোট ভাই আশা করি এতক্ষণে আপনারা এই ব্যাপারে নিশ্চয়ই অবগত হয়েছেন। ”
” জি।”
” তো তানভীরকে এখানে নিয়ে আসার কারণটা কী জানতে পারি?”
” হ্যাঁ অবশ্যই।”
আরিফুল আগে পরের সমস্ত ঘটনা একে একেখুলে বলতে লাগল শেখ সাহেবকে। সবকিছু শুনে শেখ সাহেব বললেন,
” সবই তো শুনলাম। আমার কথা হচ্ছে সব প্রুভ তানভীরের বিপরীতে যাওয়া সত্ত্বেও এখনো কি আপনাদের তানভীরকে নিয়ে কোনো প্রকার সন্দেহ আছে? ”
.
.
চলবে…..