#বর্ষাস্নাত_রাত
লেখা – জান্নাতুল ফেরদৌস মাটি
পর্ব – ৪
.
.
ইংরেজিতে গোটা গোটা অক্ষরের শব্দগুলো দেখে রাকিব ভেতর ও বাহির দুদিক দিয়েই দুমড়ে মুচড়ে গেল। হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে দরজার কাছে যেতে নিলেই একদল পুলিশ তাকে ধরে ফেলে। সে চিৎকার চেঁচামেচি করে বলে,
” ছাড়ুন ছাড়ুন আমাকে আপনারা । আমি ঘরে যাবো। আমি আমার ভাইয়ার কাছে যাবো। আমার সোনামণিদের কাছে যাবো। ছাড়ুন, ছাড়ুন বলছি ।”
কনস্টেবল আলিফ রাকিবকে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল,
” এখানে এরকম কোন সিন করবেন না। আর না কিছু ছুঁতে যাবেন। এখানের প্রত্যেকটি জিনিস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই ভালো হবে এখান থেকে চলে গেলে।”
” আশ্চর্য তো! আমি আমাদের ঘরে যাবো আপনারা আমাকে কেন আটকাচ্ছেন? আমাদের নিজেদের ঘরে ঢোকার অধিকার আমার সম্পূর্ণ আছে। আপনারা আমাকে আটকাতে পারেন না।”
” আপনার অধিকার আপনি থানায় গিয়ে পেশ করেন। এখানে না। বর্তমানে আমরা নিজেদের ডিউটিতে আছি আর এ ফ্ল্যাট রয়েছে আমাদের জিম্মায়।এখানে আপনার অধিকার দেখার সময় নেই আমাদের হাতে।”
বলেই রাকিবকে সিঁড়ির দু ধাপ নিচে নামালো আলিফ। রাকিব কিছু বলতে নেয়ার আগেই নিচ থেকে পুরুষালী কন্ঠে বলে উঠল,
” আপনি কি রাকিব?”
রাকিব পেছনে ফিরে চোখ মুছতে মুছতে বলল,
” হ্যাঁ আমি…. কিন্তু আপনি?”
পেছন থেকে আলিফ বলে উঠল,
” উনি আমাদের থানার ওসি আরিফুল স্যার।”
রাকিব বলল,
” কাল তাহলে আপনিই কল দিয়েছিলেন স্যার?”
আরিফুল বলল,
” হ্যাঁ, আমিই দিয়েছিলাম। কিন্তু আপনি এখানে কী করছেন? আপনাকে তো সোজা থানায় যেতে বলা হয়েছিল। আপনি সেখানে না গিয়ে এখানে এলেন যে?”
” স্যার আমার বন্ধুর ন্যায় বড় ভাই, ভাবি, ভাইস্তা, ভাস্তি খুন হয়েছে….আর আমি এখানে আসব না? এটা কী সম্ভব স্যার?”
” আপনি কি ভেতরে যেতে চাইছেন?”
” জি স্যার।”
আরিফুল আর কথা বাড়ালো না।আলিফকে চোখের ইশারা দিয়ে বুঝিয়ে দিল হলুদ ফিতাটির একপাশ খুলে দিতে।
আলিফও মাথা নুইয়ে সঙ্গে সঙ্গে ফিতাটির একপাশ খুলে দিল। আর ওমনি ঘরের ভেতর হুমড়ি খেয়ে পড়ল রাকিব। পেছন পেছন ঘরের ভেতর এসেছে ওসি আরিফুল আর এস আই নীরব। আরিফুল চোখের ইশারায় নীরবকে বলল, রাকিবের চাল চলনের উপর নজর রাখতে।
নীরবও চোখের ইশারায় সম্মতি দিয়ে কড়া দৃষ্টি নিক্ষেপ করল রাকিবের উপর।
রাকিব একবার এ-রুম যাচ্ছে তো একবার ও-রুম। একবার ভাইয়ের কাপড় ধরে কাঁদছে তো একবার ভাস্তির। কাঁদার ফাঁকে একপর্যায়ে বলে উঠল,
” আমার নিষ্পাপ সোনার মানিকদের যে এই পরিণতি করেছে তাদের কাউকে আমি ছাড়ব না। কাউকে না।”
আরিফুল ভ্রু কুচকে বলল,
” আপনি কি কারো উপর সন্দেহের দাগ টানছেন? মানে কাউকে সন্দেহ হয় আপনার?”
রাকিব নাক টেনে প্রতিশোধপূর্ণ গলায় বলে উঠল,
” জি স্যার। আমার একজন না, পুরো একটি ফ্যামিলির উপর সন্দেহ হয়। আর আমি নিশ্চিত তারাই এই কাজটা করেছে। কেননা তারা ছাড়া আমার ভাইয়ের পরিবারের শত্রু এই পৃথিবীতে আর কেউ নেই।”
” কারা তারা? কোথায় থাকে? আপনি কাদের কথা বলছেন? আর কাদেরই বা সন্দেহ করছেন? খুলে বলুন আমাদের প্লিজ!”
” তানভীর, আরবী আর….সাদিয়া। ”
” তানভীর, আরবী, সাদিয়া! এই তিনজন কারা? আপনি চেনেন এদের?”
” চিনি মানে খুব ভালো করেই চিনি। ওদের মত দুষ্টু প্রকৃতির মানুষ এ ভুবনে আর দুটি নেই। ওরাই আমার ভাইয়ের পরিবারকে শেষ করেছে। হ্যাঁ, ওরাই করেছে। ”
” ওরা কারা রাকিব?”
রাকিব কিছুটা সময় নিয়ে বলল,
” পাশের ফ্ল্যাটের বাসিন্দা।”
আরিফুল আর নীরব একে অপরের দিকে বিষ্ফোরিত চোখে চাওয়া চাওয়ি করল। আরিফুল বলল,
” পাশের ফ্ল্যাটের বাসিন্দা! এদের সাথে আপনাদের কী এমন বাজে সম্পর্ক যার জন্য এরকম একটি জঘন্য কাজ করল।”
” কিছুদিন আগেই আরবী অর্থাৎ ওই ফ্ল্যাটের ভাবির সাথে হাফসা ভাবির ঝগড়া বিবাদ হয়। যার ফলে ঘরে থাকা তার ছোট বোন ও তার হাজবেন্ড দুজনই ঝগড়ায় সামিল হয়। আরবী আর আমার ভাবি কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে তো হাতাহাতিও করে ফেলে। তখনই আরবীর হাজবেন্ড তানভীর বলে উঠে, ‘তোরা এখানকার ভাসরা। ভাসতে ভাসতে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় এসেছিস। আবার কথা বলিস? তোর সাহস কী করে হয় আমার বউয়ের গায়ে হাত দেয়ার? তোর হাত যদি ভেঙে গুড়িয়ে না দিয়েছি বলিস। আরে তোদের মেরে ভাগা দিলেও তো আমাদের কেউ ধরার নেই। সাবধান হয়ে যা বলে দিলাম।’ এভাবে থ্রেট দিয়েছিল তানভীর। আর যে জনসম্মুখে এভাবে থ্রেট দিতে পারে সে সবকিছুই করতে পারে। বিশেষ করে আমি মনে করি। ”
আরিফুল বলল,
” সে এরকম দাপট গিরি দেখিয়ে কথা বলল কেন? মহিউদ্দিন যেরকম ভাড়াটিয়া তানভীরও তো ভাড়াটিয়া। তাহলে এভাবে থ্রেট টাইপ কথা বলার কারণ কী? এলাকার দু চারটে মাথা তার হাতে না-কি? ”
” জি স্যার ওরকমই। তবে হাতে না একেবারে ঘরের। এই এলাকার এমপি তানভীরের আপন বড় ভাই হয়। তাই সে সবসময় এরকম দাপট দেখিয়ে কথা বলে। কারণে অকারণে সবার সাথে মিস বিহেভ করে। এমনকি বাড়িওয়ালাকেও ছাড় দেয় না সে। ”
” এতই যখন বাজে এই পরিবার তাহলে বাড়িতে এখনো রেখেছে কেন? নোটিশ দিয়ে বের করে দিলেই পারে।”
” ভয়ে স্যার ভয়ে। বাড়িওয়ালা এদের ভীষণ ভয় পায়। তাই শত চাওয়া সত্ত্বেও বের করতে পারে না এদের।”
” ও…..আচ্ছা, আপনি যে কথাগুলো আমাকে বললেন সেগুলো কি সবার সামনে বলতে পারবেন?”
” অবশ্যই স্যার। আর হ্যাঁ, আপনার যদি আমার কথা সামান্য পরিমাণও অবিশ্বাস হয় আপনি এক কাজ করতে পারেন, এ বাড়ির প্রত্যেকটি ভাড়াটিয়া এমনকি বাড়িওয়ালাকেও এ ঝগড়া আর থ্রেটের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতে পারেন। সত্যতার প্রমাণ পেয়ে যাবেন।”
আরিফুল বা পকেটে হাত ঢুকিয়ে নীরবকে বলল,
” এ বাড়ির প্রত্যেকটি মানুষ অর্থাৎ ভাড়াটিয়া, বাড়িওয়ালা সবার থেকেই এ ঝগড়া সম্পর্কে সমস্ত তথ্য নিয়ে আসো। ততক্ষণে আমি ওই ফ্ল্যাট থেকে ঘুরে আসি।”
” ওকে স্যার।”
নীরব যেতেই আরিফুল রাকিবকে নিয়ে পাশের ফ্ল্যাটের বেল বাজালো।
আরবী ঘরের কাজে ব্যস্ত থাকায় তানভীরকে বলল দরজাটা খুলতে। তাই তানভীর একপ্রকার অনিহা নিয়েই দরজাটা খুলল। দরজার ওপারে পুলিশসহ রাকিবকে দেখে তানভীর বলল,
” আপনারা!”
আরিফুল বিনা অনুমতিতে ঘরে ঢুকে সোফায় বসে পড়ল। বলল,
” কথা ছিল কিছু।”
তানভীর দরজা লক করে আরবীকে ডেকে অপর পাশের সোফায় বসতে বসতে বলল,
” আমাদের সাথে কথা! কিসের কথা? ”
” কিসের কথা বুঝতে পারছেন না বুঝি?”
” বুঝলে অবশ্যই জিজ্ঞেস করতাম না।”
” ও…. তাহলে সরাসরি বলছি। মহিউদ্দিন সাহেবের পরিবারের সাথে আপনার পরিবারের সম্পর্ক কেমন? মানে বন্ধুত্বসুলভ না-কি শত্রুপরায়ণ….কোনটা?”
” হঠাৎ এ ধাঁচের প্রশ্ন যে?”
” কেন? জিজ্ঞেস করা বারণ কী? ”
” বারণ বলিনি… বলেছি আমাদেরই বা কেন প্রশ্ন করা হচ্ছে? ”
” চার চারটে খুন হয়েছে আপনাদের পাশের ফ্ল্যাটে। বুঝতে পারছেন বিষয়টা? আর আপনাকে বা আপনাদের জিজ্ঞেস করব না তা কি হয়? তারউপর যদি হয় সাপ বেজির সম্পর্ক। ”
” সাপ বেজির সম্পর্ক মানে?”
” মহিউদ্দিন সাহেবের পরিবারের সাথে আপনার পরিবারের সম্পর্ক বাজে ছিল কেন?”
তানভীরকে চোখের ইশারায় থামিয়ে আরবী বলে উঠল,
” এই বাজে কিংবা ভালোর সম্পর্কের ব্যাখ্যা বুঝি এই রাকিব দিয়েছে? ”
আরিফ ভারী কন্ঠে বলল,
” আমি কিন্তু আপনার সাথে কথা বলছি না মিসেস তানভীর। ”
” আমার সাথে না বললেও আমাদেরকেই তো ইশারা করে কথাগুলো বলছেন। সেই সূত্র ধরে আমি কথা বলতেই পারি স্যার।”
আরিফুল আরবীর থেকে মুখ ফিরিয়ে তানভীরকে বলল,
” যতদূর শুনেছি কিছুদিন আগেই মহিউদ্দিন সাহেবের পরিবারের সাতে আপনাদের মনমালিন্য হয়েছিল এমনকি একপর্যায়ে হাতাহাতিও হয়ে থাকে। আর সেখানে আপনি মিঃ তানভীর তাদেরকে মেরে ফেলার থ্রেটও দিয়েছিলেন। কথাটা কি সত্য? আর সত্য হলেও কেন এভাবে থ্রেট দিয়েছিলেন?”
” আপনি একজন শিক্ষিত মানুষ। পুলিশ বিভাগের বড় পদে আছেন আপনার মুখে কিন্তু এ কথাটি মানালো না। অন্তত আমি মেনে নিতে পারলাম না। কারণ ঝগড়াঝাটির মাঝে সেন্স হারিয়ে অনেকেই কিন্তু অনেক কথা বলে থাকে। তাই বলে কী সেগুলো কেউ বাস্তবায়ন করে? হ্যাঁ অনেক ক্ষেত্রে বাস্তবায়ন হয় যদি সেই ঝগড়ার কারণ মাত্রাতিরিক্ত গভীর হয় কিংবা স্বার্থ জড়িত কোনো ঘটনা থাকে তবে। কিন্তু আমাদের আর মহিউদ্দিন সাহেবের পরিবারের মাঝে কিন্তু সেসব কিছুই ছিল না। অতিক্ষুদ্র বিষয়ের জের ধরেই ঝগড়ার উৎপত্তি। তাও আবার মহিউদ্দিন সাহেবের স্ত্রীর জন্যই। সে একটু আগ বাড়িয়ে কথা বলতো যেটা আমার স্ত্রী পছন্দ করতো না। আর যার জন্যই সেদিন এতবড় ঝগড়া বিবাদের সৃষ্টি হয়।”
তানভীরের কথা শেষ হতেই কলিং বেল বেজে উঠল। আরবী দরজা খুলতেই নীরব ঘরে ঢুকে পড়ল। আরিফুলের পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে মাথা নাড়িয়ে তদন্তের রেজাল্ট পজিটিভ এসেছে বুঝাতেই আরিফুল বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়ল। সেই সাথে তানভীরও দাঁড়িয়ে পড়ল। বলল,
” আরও কিছু জানার থাকলে বলতে পারেন। আমি উত্তর দিতে প্রস্তুত। ”
” আলবাদ আছে তবে সব কথা তো সব জায়গায় বলা যায় না। আপনাকে আমাদের সাথে থানায় আসতে হবে তারপরই সব কথা হবে। ”
আরবী ভ্রু কুচকে বলল,
” না, ও কেন থানায় যাবে? ও তো থানায় যাবে না। ওর তো থানার সাথে কোনো সম্পর্ক থাকার কথা না। যে খুন করেছে তাকে খুঁজে থানায় নিয়ে যান। অকারণে শুধুমাত্র কিছু কথার ভিত্তিতে ও কেন আপনাদের সাথে থানায় যাবে।”
” কথার ভিত্তি থাকুক বা না থাকুক কিংবা কারণ হোক বা অকারণে আমরা যেহেতু তাকে থানায় যেতে বলেছি অবশ্যই প্রয়োজনে যেতে বলেছি। খোশ গল্প করতে না। ”
তানভীর আরবীর দিকে তাকিয়ে বলল,
” কথা বাড়িয়ে লাভ নেই আরবী। সত্য যেটা সেটা আজ না হোক কাল প্রমাণ হবে। তুমি চিন্তা করো না। তুমি বরং ভাইকে কল দিয়ে সবটা বলো।”
” কিন্তু!”
” কোনো কিন্তু না…… যেটা বলেছি সেটা করো।”
বলেই আরিফুলের দিকে চোখ ফিরয়ে বলল,
” চলুন।”
আরিফুল দু পা এগিয়ে রাকিবের দিকে ফিরে বলল,
” আপনিও চলুন আমাদের সাথে।”
.
সিসি ক্যামেরা ফুটেজ চালু করে একই সিন বারবার রিপিট করে বিভিন্ন এঙ্গেল থেকে দেখছে ডিসি রাসেল। তার ফাঁকে বলে উঠে,
” এমপির ভাইকে যে ধরে আনলে এর ফলাফল কী হতে পারে ভেবে দেখেছ আরিফুল? আর এমনও না যে কোনোকিছু জানতে পেরেছ। ঘন্টার উপর হয়েছে এর পেছনে সময় ব্যয় করেছ কিন্তু সমাধান কী….. জিরো! স্বীকারোক্তিমূলক কোনো জবানবন্দিই পেলে না। এমনকি শুকিয়ে যাওয়া ঘামের ডিএনএ-ও তো মিলল না এর সাথে। এখন এমপির কাছে কী জবাব দিবে? ”
আরিফুল চিন্তিত স্বরে বলল,
” এমপির কাছে কী জবাব দেব বা সে কী করবে সেসব নিয়ে এই মুহূর্তে আমি ভাবছি না স্যার। আসল দোষী কে সেটা বড় কথা। তানভীরের মৌখিক স্বীকারোক্তি তো পরের কথা, আমাদের হাতে থাকা সব প্রমাণই তো ওর বিরুদ্ধে যাচ্ছে। কোনভাবেই ওর সাথে প্রমাণাদি যাচ্ছে না। তাহলে মৌখিক স্বীকারোক্তি দিয়ে কী হবে? ”
” হুম সেটাই তো বলছি….সব প্রমাণ যেহেতু ওর বিরুদ্ধেই যাচ্ছে এখন এমপিকে কী জবাব দিবে? ”
” সে একটা কিছু বলে সামলে নেয়া যাবে স্যার। আর আমি যতদূর জানি, তানভীর তার ভাইয়ের পাওয়ার যতটা দেখায় এমপি নিজেও ততটা পাওয়ার দেখায় না।মোটামুটি সাদামাটা ভাবেই থাকে। তাই আমার মনে হয় তাকে বুঝিয়ে বললে সে হয়তো বুঝবে।”
” হ্যাঁ, সেরকম তো আমিও শুনেছি। বাকিটা দেখো কীভাবে সামলাবে।”
এরই মাঝে হন্তদন্ত হয়ে এস আই নীরব এলো। উদ্বিগ্ন গলায় বলল,
.
.
চলবে…..