বর্ষাস্নাত রাত পর্ব-০৩

0
904

#বর্ষাস্নাত_রাত
লেখা – জান্নাতুল ফেরদৌস মাটি
পর্ব – ৩
_______________________
থানার নিজ টেবিলে একগালে হাত দিয়ে বসে আছে ওসি আরিফুল। কুচকে থাকা ভ্রুর ভাজে ফুটে উঠছে অগণিত চিন্তার আভাস। সামনের চেয়ারে ভীত মুখ নিয়ে বসে আছে হালিমা মঞ্জিল বাড়ির কেয়ারটেকার সালাম। আর তার পাশের চেয়ারে বসে আছে রিপোর্ট দাতা সুদীপ। সালামের সন্দেহ ভাজন দু-তিন টি কথা শুনে আরিফুল গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
” তুমি পেছনের চেয়ার গুলোতে গিয়ে বসো। তোমার সাথে পড়ে কথা বলছি। ”
সালাম করুণ গলায় বলল,
” স্যার, আমি কিছু করি নাই। আমারে যাইতে দেন। সত্যিই কইতাসি আমি কিছু করি নাই স্যার।”
সালামের সাথে কথা না বাড়িয়ে আরিফুল হাবিলদারকে ইশারা দিয়ে সালামকে পেছনে নিয়ে বসালো। তারপর সুদীপের দিকে ফিরে বলল,
” রিপোর্ট দাতা তো আপনিই তাই না? ”
” জি স্যার।”
” তো আপনার পরিচয়! ”
” স্যার আমি সুদীপ। মহিউদ্দিনের কলিগ ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু।”
” ও…..তো আগে বন্ধুত্ব না-কি কলিগ?”
” আগে বন্ধুত্ব স্যার। ভার্সিটি লাইফ থেকেই আমাদের বন্ধুত্ব। তারপর একইসাথে জবের জন্য ইন্টারভিউ দেয়া এবং ভাগ্যক্রমে পেয়েও যাই আমরা।”
” ও….. আচ্ছা, আপনি আজ কী মনে করে মহিউদ্দিন সাহেবের বাসায় গিয়েছিলেন? আপনি কী আগে থেকেই জানতেন বা আন্দাজ করতে পেরেছিলেন যে এরকম কিছু ঘটতে পারে?”
” না স্যার, আমি কীভাবে জানব? আর আন্দাজ করার কথা তো প্রশ্নই আসে না। আমি তো গিয়েছিলাম দুদিন যাবৎ ও অফিসে আসে না বলে। আর আমাদের স্যারই আমাকে পাঠিয়েছেন। কলিগ সম্পর্কের বাইরে আমাদের মাঝে আরও একটি সম্পর্ক থাকায় স্যার নিজেই আমাকে এই দায়িত্বটি দেন। ”
” ও….তো যাওয়ার আগে ফোন দিয়েছিলেন না-কি ডিরেক্ট চলে গিয়েছেন? আর গিয়েও কী অবস্থায় পেয়েছেন সবকিছু? ”
” ফোন তো অনেকবারই দিয়েছি স্যার কিন্তু মহিউদ্দিন ধরেনি। তখন তো আর আমি জানতাম না যে, ও ততক্ষণে লাশে পরিণত হয়ে গিয়েছে। তো ফোন দিতে দিতে একপর্যায়ে যখন বিরক্ত হয়ে যাই তারপরই অফিস থেকে ছুটি নিয়ে ওর বাড়িতে আসি। আর তারপরই তো….. ”
” হুম তারপর? ”
সুদীপ কোন কিছু না বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
এদিকে আরিফুল বলে উঠল,
” সুদীপ, চুপ করে থাকবেন না। আপনি গিয়ে কী অবস্থায় পেয়েছিলেন খুলে বলুন আমাকে।”
“মহিউদ্দিনের ফ্ল্যাটের মেইন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ কলিং বেল বাজানোর পরও যখন দরজা কেউ খুলছিল না, আমি আবারও মহিউদ্দিনের ফোনে কল দেই। আর ফোনটিও রিং হতে থাকে। একপর্যায়ে হঠাৎ করেই আমার কানে মহিউদ্দিনের মোবাইলের রিংটোনের আওয়াজ ভেসে এলো। আমি দরজার সাথে কান লাগিয়ে সেই রিংটোনের আওয়াজ শোনার চেষ্টা করলেই আমার হাত দরজার হ্যান্ডেলের সাথে লেগে আমাকে অবাক করে দিয়ে দরজা খুলে যায়। আমি দরজার দিকে ভালো করে লক্ষ্য করতেই বুঝতে পারি এতক্ষণ যাবৎ দরজা ভিড়িয়ে রাখা ছিল। লক করা ছিল না। তারপর দু পা এগিয়ে মহিউদ্দিনের ঘরের দিকে যেতেই দেখতে পাই রক্তাক্ত ফ্লোর তবে তরল বা তাজা রক্ত না, জমাট বাঁধা কালো রক্ত। যেখানে বাসা বেঁধেছে শত মশা মাছি আড্ডা খানা। আর তার মাঝেই মুখ থুবড়ে পড়ে আছে হাফসা ভাবি। আর তার পাশে অর্থাৎ বিছানার উপর ঠিক একইভাবে পড়ে আছে মহিউদ্দিন।
বিশ্বাস করবেন কি-না জানি না স্যার, সেই মুহূর্তে আমার মনে হয়েছিল আর এক মিনিট দাঁড়ালে হয়তো আমি নিজেও এই পরিণতির স্বীকার হবো। তারপর মনে পড়ল বাচ্চা দুটোর কথা। ছুটে বাচ্চাদের ঘরে যেতেই বুক কেঁপে উঠলো আমার। বাবা মায়ের মত ঠিক একই অবস্থায় পড়ে ছিল নিষ্পাপ দুটো শিশু। বিছানার উপর মাহফুজ আর মেঝেতে মারিয়া। একটা মানুষের মনে কতটা হিংস্রতা কাজ করলে দুধের শিশুদের উপর এরকম অসহনীয় নির্যাতন করতে পারে সেই মুহূর্তে আমি হাড়ে হাড়ে বুঝতে পেরেছি।”
কথা বলার সময় সুদীপের চোখেমুখে ভয়ভীতির কোন ছায়া খুঁজে না পাওয়ায় আরিফুল বুঝতে পারল সন্দেহের তালিকার বহির্ভূত সুদীপ নামক ছেলেটি। তাই স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,
” আচ্ছা, আপনি তো বললেন যে মহিউদ্দিন সাহেবের বেশ ঘনিষ্ঠ বন্ধু আপনি তাই না? ”
” জি স্যার। ”
” তাহলে আপনি নিশ্চয়ই জানবেন মহিউদ্দিন সাহেবের কারো সাথে মনমালিন্য ধরনের সম্পর্ক আছে কি-না! কিংবা ঝগড়া বিবাদ জাতীয় কোনো সম্পর্ক আছে কি-না! ”
” না স্যার, ও ওরকম ধরনের ছেলেই না। আসলে ও বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান ছিল। নিজের ভাই বোন বলতে কেউই ওর নেই। কাজিনদেরই নিজের ভাই বোন বলে ভাবত। বিশেষ করে ওর ছোট চাচার ছেলে রাকিবকে। যার দরুণ ঝগড়াঝাটি ওর ডিকশনারিতে নেই বললেই চলে। এমনকি ভাবিও যদি কোনো কারণে ওকে গালমন্দ করত তারপরও ও ওসব ঝগড়া বিবাদে যেত না। হেসে উড়িয়ে দিত। আর বাহিরের মানুষের কথা তো প্রশ্নই আসে না। ”
” ও……তো আপনার বিবরণ অনুযায়ী রাকিব নামের ছেলেটি মহিউদ্দিন সাহেবের বেশ ঘনিষ্ঠ কেউ ছিল তাই তো?”
” জি স্যার। বয়সে পাঁচ ছয় বছরের ছোট হলেও বন্ধুর মতই চলত। ”
” যদি বন্ধুর মতই চলে তারউপর যদি হয় ভাই তাহলে মহিউদ্দিন সাহেবের পরিবারকে ঘিরে যে এতবড় একটি দূর্ঘটনা ঘটল কই, সেই ভাইকে তো একবারের জন্যও দেখলাম না।”
” আসলে স্যার রাকিব মহিউদ্দিনদের সাথেই থাকে। বিগত কয়েক বছর ধরেই ওদের সাথে থাকছে। মহিউদ্দিনের মুখে যতটুকু শুনেছি বৃহস্পতিবার অর্থাৎ দূর্ঘটনা ঘটার আগের দিন রাকিব তার ফ্রেন্ডদের সাথে ৫ দিনের জন্য অন্য একটি ফ্রেন্ডের গ্রামে বেড়াতে যায়। আর সেজন্যেই হয়তো রাকিব এরকম একটি সময়ে মিসিং। এমনো হতে পারে ও জানেও না এসবকিছু। ”
” রাকিবের নাম্বার আছে আপনার কাছে?”
” জি স্যার।”
” নাম্বারটি দিন।”
সুদীপ নাম্বারটি দিতেই আরিফুল বলল,
” আচ্ছা তাহলে এখন আপনি আসতে পারেন। তবে…. যদি বিশেষ কোনো কারণে আপনার প্রয়োজন আমাদের পড়ে অবশ্যই কিন্তু আসতে হবে।”
” নিশ্চয়ই স্যার।”
” ওকে আসুন।”
সুদীপ সালাম দিয়ে চলে যেতেই আরিফুল বেশ চিন্তিত স্বরে হাবিলদারলে ডাক দিয়ে বলল,
” সালামকে ভেতরে নিয়ে যাও।”
” জি স্যার। ”
.
একটি বিশাল খালি রুমে বসে আছে সালাম। মাথার উপর একটি ঝুলন্ত লাইট আর সম্মুখে টেবিল। যার উপর রয়েছে একটি পানির গ্লাস ও একটি মাইক। তার বসার চেয়ারটি বাদে আরও দুটো চেয়ার আছে টেবিলের কোণ ধরে। আর তার সামনেই দেয়াল জুড়ে একটা বিশাল আয়না। টেবিল থেকে সর্বোচ্চ ৬ কি ৭ কদম দূরেই হবে আয়না টি। আর পুরো রুম জুড়ে কিছুই নেই। পুরো ফাঁকা।
সালাম পুরো রুমটি চোখ ঘুরিয়ে দেখেও আয়নার উৎস খুঁজে পেল না। ফাঁকা একটি রুমে এতবড় আয়না কেন রাখা সালাম কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছে না।
এমন সময় রুমের দরজা ঠেলে বড় বড় পায়ে এগিয়ে এলো আরিফুল। পেছনে একজন হাবিলদার। চেয়ার টেনে সালামের মুখোমুখি বসতেই সালাম ঢোক গিলল। বলল,
” স্যার…… আমারে এনে আনছেন কেন? এটা কিয়ের রুম? আপনেরা কি আমারে মারবেন?”
আরিফুল একগাল হাসল। বলল,
” এটা রিমান্ড রুম।”
রিমান্ড নামটি শুনতেই সালাম ভয়ে কুঁকড়ে উঠল। ছলছলে চোখে বলল,
” স্যার গো, আমি গেরামের গরীব মানুষ। শহরে আইসি কাম কইরা ভাত খাইতে। এই ছোট্ট একটা চাকরি কইরা নিজের সংসার চালাই। দুই পোলা মাইয়া আমার স্কুলে পড়ে। গেরামে বউ দুই পোলা মাইয়া নিয়া খুব কষ্ট করে। আমি চাকরি না করলে ওগো না খাইয়া মরতে হইব। আমারে ছাইরা দেন স্যার। আমি এডির কিছু জানি না স্যার।”
” এতো অগ্রিম কথা বলছ কেন? তোমাকে এখনো আমি কিছু জিজ্ঞেস করেছি? না-কি মারধর করেছি? এটা রিমান্ড রুম বলেই যে সবসময় মারধর হয় তা কিন্তু নয়। ”
” তাইলে?”
” তুমি যদি সহজেই সবকিছু খুলে বলো তাহলে তোমাকে আমরা কিছুই করব না। আর যদি সময় নাও কথা পেঁচাও তখনই সমস্যা হবে।”
” কিন্তু স্যার…… ”
” এখন বাজে কথা বাদ দিয়ে আমি যা জিজ্ঞেস করছি সেগুলোর সোজা সরল উত্তর দাও।”
বলেই হাতের একটি ফাইল খুলল আরিফুল। বলল,
” শুক্রবার রাত ৯ টার পর বাড়ির ভেতর কে কে ঢুকেছিল?”
” স্যার এডা আমি কেমনে কমু? এত বড় বাড়ি আর এত ভাড়াটিয়া, এহন ভেতরে কত মানুষই তো ঢুকে। আমি তো কহনই কাউরে তেমন কিছু কই না আর দেখিও না। ”
” আশ্চর্য! তুমি বাড়ির কেয়ারটেকার আর তুমি লক্ষ্য করো না যে বাড়ির ভেতর কে কে ঢুকে? তাহলে তোমাকে রেখেছে কেন? ঘাস কাটতে?”
” আমি তো খালি পানির টাংকি ভরি, সিড়ি ঝাড়ু দেই আর রাতের বেলা কেচি গেইট তালা লাগাই আবার সকালে খুলি। এরমধ্যে কেডা আইল কেডা গেল সেসব তো আমি দেহি না স্যার।”
সালামের কথা শুনে আরিফুলের মেজাজ বিগড়ে গেলেও নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করে বলল,
” বুঝলাম তুমি কখনোই লক্ষ্য করো না, কে এলো আর কে বের হলো তাই তো?”
” হো স্যার।”
” কিন্তু তুমি বেখেয়ালি থাকা সত্ত্বেও অবশ্যই দেখেছ কে বাড়ির ভেতর এসেছে বা কে বাইরে গিয়েছে?মানে তোমার কথা অনুযায়ী যদিও তুমি লক্ষ্য করো কিন্তু দেখেছ তো। ”
” হো স্যার হেমনে তো দেখছিই।”
আরিফুল এবার যেন আশার আলো খুঁজে পেল। উদ্বিগ্ন গলায় বলল,
” কাকে দেখেছ?”
” সারাদিনই তো বাড়ির মানুষ আর বাইরের মানুষ বাড়ির ভেতর আয়ে যায়। বাইরের মানুষ বলতে ভাড়াটিয়া গো মেহমান আর কি। তয় রাত সাড়ে ১০ দিকে একটা বেডা আয়ে। সারা শরীলে কালা কাপড় পেঁচাইয়া। আমার কেমন জানি লাগলে হেরে দাঁড় করাইতে যাই। কিন্তু হে দাঁড়ায় নাই। কইছে, হে না-কি এই বাড়িরই ভাড়াটিয়া। বৃষ্টিতে হের শরীল ভিজ্জা গেছে এখন আর হে দাঁড়াইতে পারব না। কইয়াই তাড়াতাড়ি উপরে উইঠা গেছে। পরে আমিও ভাবলাম বাইরে যেই বৃষ্টি এইজন্যই মনে হয় কালা কাপড় শরীলে পেঁচাইছে। তাই আমিও আর হের পিছনে যাই নাই।”
” এটা কী সাড়ে দশটার ঘটনা?”
” হো স্যার।”
” আচ্ছা তোমাদের বাড়িতে কোনো সিসি ক্যামেরা লাগানো আছে? ”
” হো আছে তো স্যার। আমি যেনে বইয়া থাকি হেনেই আছে। ”
” গ্রেট! ”
বলেই আরিফুল বসা থেকে উঠে চলে যেতে নিলে সালাম বলে উঠল,
” স্যার, আমি কী এহন যাইতে পারমু?”
আরিফুল স্মিত হেসে বলল,
” সময় হোক আমি নিজেই বলব।”
বলেই রুম থেকে বেড়িয়ে যেতে যেতে হাবিলদারকে বলল,
” সালামকে কিছু খেতে দাও। আর হ্যাঁ, এখানে কিন্তু স্টিল দাঁড়িয়ে থাকবে তুমি।কোত্থাও যাবে না।”
” ওকে স্যার।”
আরিফুল দ্রুত পায়ে রিমান্ড রুম থেকে বেড়িয়ে নিজের টেবিলে এসে বসল। ফাইলপত্র গোছাতে গোছাতে এস আই নীরবকে ডেকে বলল,
” এক্ষুনি হালিমা মঞ্জিল গিয়ে বাড়ির মালিকের কাছ থেকে সিসি ক্যামেরার ফুটেজ নিয়ে আসবে। আমি ফুটেজ দেখেই কিন্তু বাড়ি ফিরব। অর্থাৎ ফাস্ট যাবে আর আসবে।”
” ওকে স্যার।”
.
দুপুর ৩ টা। হন্তদন্ত হয়ে হালিমা মঞ্জিলের মেইন গেইট পার হয়ে মহিউদ্দিনের ফ্ল্যাটের দিক এগোচ্ছিল রাকিব। দরজার কাছে যেতেই দেখতে পেল হলুদ রঙের একটি ফিতা দিয়ে দরজার সামনে বেড়িবাঁধ দেয়া। যাতে কালো রঙে লেখা Crime scene​ do not cross ……
.
.
চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে