#বর্ষার_প্রনয়ের_কথা
#পর্ব_০৩
#নুর_নবী_হাসান_অধির
আরাভী চৌধুরী মেয়েকে দুই বাহুর মাঝে আবদ্ধ করে বলেন,
–‘শেষ থাপ্পড়টা পড়েছে ভুল মানুষকে ভালোবাসার জন্য। যাকে পাওয়ার সম্ভাবনা ১০ শতাংশও নেই তাকে কেন ভালোবাসতে হবে? সে কি তার পরিবারকে একবারও ভালোবাসার কথা জানিয়েছে? নাকি তুমি আমাদের একবার ভালোবাসার কথা জানিয়েছো?’
–‘মা আমি অনার্স শেষ করার পর জানাতে চেয়েছিলাম৷ সে সময় আসার আগেই মাহবুবের রুপ বেরিয়ে আসল। মাহবুব একজন লোভী মানুষ৷ ইভাকে বিয়ে করেছে শুধু টাকার জন্য৷’
আরাভী চৌধুরীর চোখেও পানি৷ মেয়ের চেয়ে যেন নিজেই বেশি কষ্ট পেয়েছেন৷ সন্তানের কষ্ট হলে মায়ের বুক ফেটে যায়৷ মেয়ের গায়ে হাত তুলতে চাননি৷ রাগের মাথায় মেঘের গায়ে হাত তুলেছেন৷ মেয়ের চোখের জল মুছে দিয়ে বলেন,
–‘তুমি আমার মেঘ বালিকা৷ মেঘ যেমন সূর্যকে আড়াল করে ঠিক তুমিও দুঃখকে আড়াল করে জীবনের পথে এগিয়ে যাবে৷’
–মেঘ সাময়িক সময়ের জন্য আড়াল করে৷ আমি কি পারব সব সময়ের জন্য নিজের কষ্ট ভুলে থাকতে?’
–‘তোমাকে ভুলে থাকতে হবে৷ তোমার কথামতো মাহবুব একজন লোভী মানুষ৷ লোভ মানুষকে ধ্বংসের দিকে ধাবিত করে৷ আল্লাহ তার লোভের শাস্তি নিশ্চয় দিবেন৷ তুমি ধৈর্য ধারণ করে৷ আল্লাহ তায়ালা নিশ্চয়ই ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন৷’
আরাভী চৌধুরী মেঘের কপালে আলতো করে ভালোবাসার পরশ একে চলে যান৷ মেঘকে কিছু সময়ের জন্য একা ছেড়ে দেন৷ মেঘ এখন ছোট নয়৷ তার বিচার বুদ্ধি ক্ষমতা রয়েছে৷ ভালোবাসা মানব জীবনে মারাত্মকভাবে প্রভাব ফেলে৷ নেশার মতো কাজ করে৷ ভালোবাসা সবকিছুর উর্ধ্বে। যার জন্য সবকিছু করতে পারে৷ ভালোবাসা পাওয়ার জন্য নিজের জীবন তুচ্ছও করতে পারে৷
______________
মেঘ সবকিছু ভুলে পাড়ি জমায় রাজশাহীর বুকে৷ নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে কিভাবে পরিস্থিতির সাথে মোকাবেলা করে বেঁচে থাকতে হয়? আদোও রাতে ঘুম ভেঙে গেলে মাহবুবের স্মৃতি সাড়া ফেলে হৃদয়ের গহীন কোণে৷ আনমনে ক্যান্টিনে বসে আছে৷ ছোঁয়ার কথায় মেঘের ধ্যান ভাঙে৷ ছোঁয়া বিরক্তি স্বরে বলল,
–‘কোথায় হারিয়ে গেলি৷ চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে তো৷ মনে আছে, আজ ইলেক্ট্রিসিটি প্যাক্টিকেল আছে৷ জুয়েনা ম্যামের প্যাক্টিকেল না করলে এক নাম্বার দিবে না৷’
ছোঁয়া চায়ের কাপে চুমু দিয়ে দেখল সত্যি সত্যি ধোঁয়া ওঠা চা ঠান্ডা হয়ে গেছে৷ টাকা দিয়ে কেনা চা ফেলে দেওয়া যায়না৷ তাই এক নিশ্বাসে খেয়ে ফেলল৷ মূলত খাবার নষ্ট করা ভালো নয়৷ বাংলাদেশের কত মানুষ খাবারের সাথে যুদ্ধ করে বেঁচে আছে৷ এক বেলা খাবারের জন্য প্রাণপণে যুদ্ধ করে যাচ্ছে। আমরা সেখানে খাবার নষ্ট করি৷ খাবারগুলো নষ্ট না করে গরিব মানুষদের পাশে দাঁড়ালে আল্লাহর কাছে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দোয়া করবে৷ ছোঁয়া মলিন মিহি হাসি দিয়ে বলল,
–‘হ্যাঁ মনে আছে৷ কোন দুঃখে পদার্থ বিজ্ঞান নিয়ে অনার্স করতে গিয়েছিলাম৷ কত কষ্ট করে তিন বছর পার করে এসেছি৷ ফাইনাল ইয়ারের এসেও এতো চাপ৷ লাস্ট সেমিস্টার কবে আসবে? আর ভালো লাগছে না৷ অনার্স শেষ করে বিসিএস দিয়ে জব নিব৷”
তাদের কথার মধ্যে যোগ দিল সৌরভ৷ বড়লোক বাবার এক প্রকার বখাটে ছেলে৷ তার কাজ হলো জুনিয়র মেয়েদের বিরক্ত করা৷ মেঘকে উদ্দেশ্য করে বলল,
–‘মেঘ তোর মন খারাপ? তুই ঢাকা থেকে আসার পর আমাদের সাথে ঠিকমতো কথা বলস না৷ সারাদিন নিজেকে একা রাখার চেষ্টা করস৷’
মেঘ নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে বলল,
❝দূর তোদের ভাবনা ঠিক বুঝতে পারিনা৷ বাড়ি থেকে আসলে কিছুই ভালো লাগে না৷ মা বাবাকে ছেড়ে আসতে মন চাইনা৷ মন বলে ঢাকায় মা বাবার কাছে থেকে যাই৷❞
সৌরভ গিটার কাঁধে ঝুলাতে ঝুলাতে বলল,
❝তোরা এখানে সুখ দুঃখের গল্প কর৷ আমি গেলাম৷ জুয়েনা ম্যাম একটু পর ক্যান্টিনে এসে পিটানো শুরু করবে৷❞
সৌরভের কথায় ছোঁয়া, মেঘ দু’জনেই আট্ট হাসি দিয়ে উঠল৷ মেঘ হাসি থামিয়ে বলল,
❝তুই লেখাপড়া প্রতি গুরুত্ব দিলি কবে? এসাইনমেন্ট, প্যাক্টিকেল সব জুনিয়রদের দিয়ে করিয়ে নেস৷❞
সৌরভ ভেংচি কেটে বলল,
❝আজ থেকে লেখাপড়ার প্রতি গুরুত্ব দিলাম৷ কারণ একজনকে আমার খুব ভালো লাগে সেই প্রথম বর্ষ থেকে৷ তাকে নিজের মনের কথা জানানোর সময় এসে পড়েছে৷ সেজন্য নিজেকে একটু পরিবর্তন করতে হবে৷❞
সৌরভ কথা না বাড়িয়ে খাবারের বিল মিটিয়ে চলে যায়৷ এখানে থাকলে হাজারটা প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে৷ মেয়েদের পেটে পেটে অনেক প্রশ্ন এসে উঁকি দিবে৷ এদের কাছ থেকে সরে যেতে পারলেই ভালো৷
__________________
সৌরভ সন্ধ্যায় মেঘের বাসায় এসে হাজির হয়৷ মেঘকে ফোন দিয়ে বলল,
❝দোস্ত একটু নিচে আয়৷ তোর সাথে আমার কিছু কথা আছে৷❞
মেঘকে কিছু বলতে না দিয়ে ফোন রেখে দিল৷ মেঘ জানে সৌরভ এমনই। নিশ্চয় কোন অকাম করে এসেছে৷ রাত অব্দি ক্যাম্পাসে থাকবে আর নানা ভাবে সবাইকে র্যাগিং দিবে৷ রাজনীতি বিষয়ে কথা হলেই পালিয়ে আসবে৷ সেদিক থেকে সৌরভ খুব ভালো৷ বখাটে টাইপের ছেলে হলেও রাজনীতি তাকে টানেনি৷ সৌরভ বাইকের উপর হাত ভাঁজ করে বসে আছে৷ মেঘ হাসির ছলে বলল,
❝রাতের বেলাও কালো চশমা পড়তে হবে৷ তোকে একদম কানা লাগছে৷ ওই যে আমাদের গেইটের সামনে যে কানা বসে থাকে৷ ঠিক তোকে ওমন লাগছে।❞
❝তুই এসবের কি বুঝবি? স্টাইল এটা। কথা বাড়াতে চাচ্ছিনা৷ বাইকে উঠে বস৷ তোকে নিয়ে এক জায়গায় যাব৷❞
❝তোর সাথে কোথাও যাওয়ার ইচ্ছা নেই৷ তাছাড়া আমার বয়ফ্রেন্ড আছে৷ তোর বাইকে ঘুরতে যাব না৷ বয়ফ্রেন্ড জানতে পারলে হয়ে যাবে৷❞
❝তিন বছর থেকে তোর বয়ফ্রেন্ডকে দেখে যাচ্ছি৷ এখন কথা না বাড়িয়ে ওঠ৷ রঙ্গনের খুব বিপদ। তাড়াতাড়ি ওঠ৷❞
মেঘ কথা না বাড়িয়ে উঠে পড়ল। বন্ধু মহলে কারো বিপদ হলে কেউ বসে থাকতে পারে না৷ ধীরে ধীরে বন্ধুরা আত্মার সাথে মিশে যায়৷ পরিবার থেকে দূরে থাকা কষ্টকর হয়৷ যখন এই বন্ধুরা পাশে থাকে তখন ভালো লাগে৷ কষ্টটা ভুলে যায়৷ সৌরভ বাইক থামাল একটা হোটেলের সামনে৷ মেঘ সন্দিহান দৃষ্টিতে সৌরভের দিকে তাকাল৷ আবাসিক হোটেলে তারা কি করবে? সৌরভ খারাপ কোন মন্তব্য করেনি তো৷ মেঘ ভয়ে ভয়ে বলল,
❝তুই আমাকে এখানে কেন আনলি? তোর স্বাভাব চরিত্র আমার কাছে ভালো লাগছে না৷…❞
মেঘ আরও কিছু বলতে যাবে তখনই ছোঁয়া মেঘকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে৷ হাসিমুখে বলল,
❝তুই এতো লেট করলি কেন? ভিতরে চল৷ ভিতরে গেলে দেখতে পারবি রঙ্গন কি কাজ করছে?❞
মেঘ ভিতরের দিকে পা বাড়ালে সৌরভ মেঘকে পিছন থেকে ডেকে বলল,
❝যতটা খারাপ ভাবস ততটা খারাপ নয়৷ আমার মাঝেও সুন্দর একটা মন আছে৷ জানিনা তুই কোনদিন বুঝতে পারবি না৷ আমি জানি একদিন ঠিক দেখতে পারবি৷ সেদিন দেরি না হয়ে যায়৷❞
মেঘকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বাইক চালিয়ে সামান দিয়ে চলে যায়৷ হাবলার মতো মেঘ কিছু বুঝার চেষ্টা করল৷ ছোঁয়ার জন্য সেই চেষ্টা বৃথা গেল৷ মেঘ রুমে এসে অবাক৷ ঋষি বউ সেজে বসে আছে৷ ঋতুর পাশে পুতুলের মতো সুন্দর একটা মেয়ে। মেঘ চকিত কন্ঠে বলল,
❝ঋতু এসব কি? তুই বউ সেজে বসে আছোস কেন? আমার মাথায় কিছুই ঢুকছে না৷❞
ঋতু লজ্জমাখা মুখে বলল,
❝আমি আজ রঙ্গনকে বিয়ে করতে যাচ্ছি৷ আমার বিয়ে তোদের ছাড়া সম্পুর্ন হবে না৷ তোকে কিছু জানানো হয়নি৷ তোকে সারপ্রাইজ দিলাম৷❞
মেঘ আকাশ থেকে পড়ল৷ রঙ্গন আর ঋতু এক বছরের বেশি সময় ধরে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়েছে৷ ঋতুর পাশে বসা থাকা মেয়েটি মেঘকে এক পলক দেখে তার দিকে এগিয়ে আসে৷ মেঘকে জড়িয়ে ধরে বলল,
❝আপনিই কি স্বপ্নের মেঘ বালিকা?যে পাখির মতো মুক্ত আকাশে উঠে বেড়ায়৷❞
মেঘ নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
❝কে তুমি? তোমাকে ঠিক চিনতে পারলাম না৷❞
মিষ্টি কন্ঠে বলল,
❝আমি সৌরভ ভাইয়ার বোন সুভা৷ আপনার সাথে আমার অনেক কথা আছে৷ ভাইয়ার মুখে আপনার অনেক কথা শুনেছি৷❞
সুভা মেঘকে টানতে টানতে বারান্দায় নিয়ে গেল৷ মেঘ বুঝতে পারছে না এখানে কি হচ্ছে? সুভা কেন তাকে টানতে টানতে নিয়ে আসল? কি বলতে চায়? সুভা মুষ্টি হাসি দিয়ে বলল,
❝ভাইয়া সাথে আপনার প্রেম কিভাবে হয়েছে? আপনার কথা ভাইয়া বাড়িতে সবাইকে বলেছে৷ আপনাকে ভাইয়া ভীষণ ভালোবাসে৷❞
সুভার কথায় মেঘ আকাশ থেকে পড়ল৷ সুভা কি বলছে এসব আবোলতাবোল? মাথা ঠিক আছে তার। মেঘ সবকিছু জানার জন্য বিনয়ের সাথে বলল,
❝সৌরভ আর কি কি বলেছে? তুমি তো আমায় আগে কখনও দেখনি৷ আমাকে চিনতে পারলে কিভাবে?❞
❝ভাইয়ার রুম আপনার ছবি দিয়ে ভর্তি৷ ভাইয়ার রুমে গেলেই আপনাকে দেখতে পাই৷ দু’জনে কত সুন্দর রোমান্টিকভাবে তাকিয়ে আছেন৷ একদিন আমাদের বাড়িতে যাবেন৷ মা আপনাকে দেখতে চেয়েছে৷ ভাইয়া কিছুতেই আপনাকে নিয়ে যায়না৷ বলে “সময় হলে দেখতে পারবে৷” আপনি অনেক সুন্দর।❞
মেঘ নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না৷ একজন মানুষ তাকে এত ভালোবাসে সে জানে না৷ মেঘ চোখ বন্ধ করে মনে মনে বলে,
❝মেঘ তোর জন্য ভালোবাসা বিষাক্ত। তুই ভালোবাসার মোহে জড়াবি না৷ তুই এসব কিছু থেকে দূরে থাক৷ কিন্তু এখন মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে৷ সুভাকে কিছু বুঝতে দেওয়া যাবে না।❞
সুভা মেঘের হাত ঝাঁকি দিয়ে বলল,
❝কি হলো আপু? আপনি কি ভাবছেন? আপনাদের ভালোবাসার কথা তো বললেন না৷❞
মেঘ বিনয়ের সাথে বলল,
❝সেসব কিছু না৷ আজ তো রঙ্গন আর ঋতুর বিয়ে৷ আমরা বরং তাদের বিয়েতে আনন্দ করি৷ তাদের পাশে থাকি৷❞
________________
ঘরোয়া পদ্ধতিতে রঙ্গন ঋতুর বিয়ে হয়ে গেল৷ সৌরভ সবার জন্য বিরিয়ানি নিয়ে এসছে৷ সবাই আনন্দের সাথে ডিনার করে নিল৷ সবাই এক সাথে বসে অনেক কথা বলছে। সবার মাঝখান থেকে রঙ্গন বলল,
❝সৌরত তুই অনেক ভালো গান পারিস। আমাদের সবাইকে একটা গান শুনা৷❞
সৌরভ মেঘের দিকে তাকিয়ে কন্ঠে ধ্বনিত্ব করল,
♪
সেই হঠাৎ করেই যে চোখে পড়েছে৷
তাকে প্রথম দেখাতেই ভালো লেগেছে৷
ধীরে ধীরে মন প্রেমে পড়েছে..
♪
মেঘ চোখ বন্ধ করে মনে মনে ভাবতে থাকে,
❝সবার ভালোবাসা পূর্ণতা পেলেও আমার ভালোবাসার পূর্ণতা পেল না৷ আমার ভালোবাসায় কোন কমতি ছিল না৷ মন উজাড় করে মাহবুবকে ভালোবাসতাম৷ সে কেন আমার ভালোবাসার মূল্য দিল না? আমার ভালোবাসার সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা কেন করল? কেন মাহবুবকে ভুলতে পারছি না৷ কেন তার কথা বারবার মনে পড়ে৷❞
নিজের অজান্তেই চোখের কোণায় অশ্রু চলে আসে৷ মনে মনেই হাজার প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল৷
চলবে…..