#বর্ষার_প্রণয়ের_কথা
#পর্ব_০৫
#নুর_নবী_হাসান_অধির
“অতীত কখনও কারো পিছু ছাড়ে না৷ আমাদের সম্মুখে অতীত এসে নাড়া দিয়েছে৷ তুহিনের কথা মনে আছে তোদের৷ তুহিনের শেষ কথা তোদের মনে আছে।”
ঋতু কাঁপা কাঁপা গলায় সবাইকে উদ্দেশ্য করে আরও বলল,
“তুহিন সেদিন মৃত্যুর আগে বলেছিল আমি তোদের কাউকে ছাড়ব না৷ আমাদের জন্যই কিন্তু তুহিন মারা গেছিল৷”
ঋতু আর কিছু বলতে পারল না৷ ছোঁয়া তার আগেই ঋতুর মুখ চেপে ধরে৷ তুহিন ছিল একজন বাজে স্বভাবের লোক৷ প্রথম বর্ষে ভর্তি হবার পরই তুহিনের সাথে ঝামেলা হয়৷ তুহিন ছাত্র হিসেবে ভালো ছিল না৷ বার বার ফেল করত আর প্রথম বর্ষে রয়ে যেত৷ কিভাবে চান্স পেয়েছে আল্লাহ জানেন৷ তুহিন মেয়েদের বিরক্ত করত৷ বাজেভাবে তাদের স্পর্শ করত৷ একদিন ল্যাব শেষে তুহিন ঋতুর কোমরে স্পর্শ করে ঘাড়ে কিস করে৷ রাগে ঋতুর হাতে থাকা স্লাইড ক্যালিপ্রাস দিয়ে গলায় আঘাত করে৷ সেখানে থাকা রঙ্গন, সৌরভ তাকে অমানবিকভাবে মারতে থাকে৷ তুহিন এতটায় মারা যায় যে সে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি৷ শেষে রঙ্গন আর সৌরভ তুহিনকে বাসায় পৌঁয়ে দেয়৷ যাওয়ার পথে তুহিনের বলে,
“ঋতু আমি আবার আসব৷ এর পর তোর সাথে যা হবে তার জন্য প্রস্তুত থাক৷ তোকে আমি ছাড়ব না৷”
তুহিনকে আরও আঘাত করতে ইচ্ছা করছিল৷ কিন্তু মা রা যাওয়ার ভয়ে আর আঘাত করা হয়নি৷ কিছুদিন পর জানতে পারে তুহিন মা-রা গেছে৷ ছোঁয়া চোখ পাকিয়ে বলল,
“আমরা তুহিনকে কেন মারতে যাব? সেদিন তো তুহিন মা-রা যায়নি৷ এসব কথা কখনও বলবি না৷”
ঋতু কাঁপা কাঁপা গলায় আবারও বলল,
“তুহিনের শেষ কথা তোদের মনে নেই৷ একবার ভেবে দেখ যদি তার কথা সত্যি হয়৷ তাহলে আমাদের জন্য অনেক বিপদ৷”
সৌরভ বিরক্তি স্বরে বলল,
“একটা থাপ্পড় দিয়ে বাংলা সিনেমার মতো তোর স্মৃতি শক্তি মুছে দিব৷ এমন কিছুই হয়নি৷ আর কেউ মরে গেলে ফিরে আসে না৷ তুহিন ফিরে আসলে তখনই আসত৷ তিন বছর পর ফিরে আসত না৷ মানুষ মা-রা গেলে ভুত হয়না৷ রঙ্গন তোর বউকে আবুলদের মতো কথা বলতে মানা কর৷ দরকার পড়লে মানসিক হসপিটালে ভর্তি কর৷”
মেঘ আর চুপচাপ বসে থাকতে পারল না৷ সেও তাদের সাথে যোগ দিল৷ চিন্তিত কন্ঠে বলল,
“কিন্তু ভাবার বিষয় হলো ছয়টা কুকুরকে কে মারতে পারে৷ ল্যাবের চাবি পেল কিভাবে? আমার মন বলছে এখানে বড় কোন ষড়যন্ত্র চলছে৷ আজ ক্লাস হবে না৷ আমরা অন্য কোথাও যায়৷ সেখানে এসব নিয়ে কথা বলা যাবে৷”
পাঁচ বন্ধু মিলে সিএনজি ভাড়া করে পদ্মা গার্ডেনে চলে যায়৷ পদ্মা গার্ডেনে এসে ঋতু রঙ্গন প্রেম করতে অন্য জায়গায় চলে যায়৷ সৌরভ মেঘের মান ভাঙাতে চলে যায়৷ মাঝে ছোঁয়া একা পড়ে রই৷ সিঙ্গেল জীবনের মতো কষ্ট আর নেই৷ সৌরভ মেঘের সাথে কথা বলতে আসলে মেঘ এগিয়ে যায়৷ সৌরভ ক্ষোভ নিয়ে বলল,
“তোমার সাথে কথা বলতে সমস্যা কি? আমি তোর বিষয়ে সবকিছু জানি৷ মাহবুবের বিষয়েও জানি৷”
মাহবুবের নাম শুনে মেঘ স্থির হয়ে যায়৷ চকিত কন্ঠে বলল,
“তুই মাহবুবের সম্পর্কে কিভাবে জানলি? তোকে কে বলল?”
ছোঁয়ার দিকে তাকাতেই ছোঁয়া অন্যদিকে মুখ করে নেয়৷ বুঝতে বাকী রইল না কে বলেছে? ছোঁয়া অপরাধী কন্ঠে বলল,
“আমি কিছু বলিনি৷ তোরা কথা বল৷ আমি একটু ঘুরে আসি৷”
ছোঁয়া চলে যেতেই সৌরভ মেঘের হাত ধরে৷ মেঘ চারদিকে একবার প্রখর করে বলল,
“সৌরভ এটা পাবলিক জায়গায়। এমন কিছু করবি না যাতে আমার মান সম্মান চলে যায়৷”
“হাত ধরলে এমন কিছু হয়না৷ আমরা এক জায়গায় বসে কিছু কথা বলতে পারি৷ আমি তোর বিষয়ে অনেককিছু জানতে চাই৷ আমি জানি তুই আমাকে মাহবুবের জায়গা দিবি না৷ আমিও কোনদিন তোর ভালোবাসার জায়গা নিতে চাইব না৷ তবে তোর বন্ধু হয়ে পাশে থাকব৷”
মেঘ আর কিছু বলল না৷ দু’জন পাশাপাশি বসে আছে৷ কারো মুখে কোন কথা নেই৷ সৌরভ মেঘের হাতের উপর হাত রেখে বলল,
“জানি তুই আমাকে কোনদিন ভালোবাসার নজরে দেখিস না৷ আমি তোকে সেই প্রথম বর্ষ থেকে ভালোবাসি৷ তোর প্রতিটি মুহুর্ত আমার কাছে স্মৃতি হয়ে থাকবে৷ আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করবি না৷ তুই আমার সাথে কথা না বললে আমার খুব কষ্ট হয়৷ নিজেকে খুব ছোট মনে হয়৷ আমি তোর কাছে সব সময় ছোট হয়েই থাকতে চাই৷”
“সৌরভ পৃথিবীটাই খুব জটিলতায় ভরপুর। কখনও নিজে থেকে ছোট হবি না৷ আল্লাহর রহমতে তুই মোটামুটি ভালো ছাত্র। দেখতে মাশাল্লাহ অনেক সুন্দর। আমার পক্ষে কাউকে ভালোবাসা সম্ভব নয়৷ বাকী জীবন মাহবুবের স্মৃতি নিয়ে কাটিয়ে দিব৷”
“কেন দ্বিতীয় বার কাউকে ভালোবাসা যায়না৷ কাউকে বিশ্বাস করা যায় না৷”
“বিশ্বাস ভালোবাসা সবই উঠে গেছে৷ আমি কাউকে না পারব বিশ্বাস করতে না পারব ভালোবাসতে৷”
“বিশ্বাস ভালোবাসা আছে বলেই আজও পৃথিবীর এত সুন্দর। পৃথিবী থেকে যেদিন ভালোবাসা উঠে যাবে সেদিন ধ্বংস হয়ে যাবে ত্রি ভূবণ।”
“আমি ভালোবাসার কাছে হারতে পারব না৷ জীবন্ত লাশ হয়ে বেঁচে আছি৷ নিজেকে মৃত লাগে৷ আমার কাছে পৃথিবী রঙিনহীন। আমার জীবন থেকে সব রং চলে গেছে৷”
“মাহবুব তোর ভালোবাসা ছিল৷ আমি তোর বন্ধু হয়ে থাকব৷ সব সময় পাশে থাকব৷ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত পাশে থাকব৷ কখনও ছেড়ে যাব না৷ কখনও তোকে ঠকাব না৷ তোকে ঠকানোর কথা আমি কল্পনাতেও ভাবতে পারিনা৷”
“আমার এসব কথা ভালো লাগছে না৷ আমার মাথায় সকালের ঘটনা ঘুরছে৷ কে করতে পারে এসব কাজ? আমি জানি তুহিন এসব কাজ করেনি৷ নাকী রাজনীতি দলের কেউ করেছে৷”
“তারা এক সাথে ছয়টা কুকুর পেল কিভাবে? আমাদের ভার্সিটিতে তেমন কুকুর দেখা যায়না৷ আমার মন বলছে এখানে বড় কোন রাজনীতি চলছে৷ সবাইকে ভয়ে রাখতে চাচ্ছে৷ যেন আমরা সব সময় ভয়ে থাকে৷ চিন্তা করে দেখ আমাদের ডিপার্টমেন্টে ছাত্রছাত্রী বেশি৷ আর আমাদের ডিপার্টমেন্টেই এসব কিছু৷”
“হুম আমিও তাই ভাবছি৷ তবে আমাদের সাবধান থাকতে হবে৷ ছোঁয়া কোথায় গেল৷ তাকে একা ছাড়া যাবে না৷ তার খেয়াল রাখতে হবে৷ সে একবার আর্ট ক্লাবে কেওয়াজের সৃষ্টি করছিল৷ সে সুযোগ কাজে লাগাতে পারে৷”
________________
ঋতু রঙ্গনের কাঁধে মাথা রেখে শুয়ে আসে৷ পদ্মার সিগ্ধ বাতাস মনকে রোমান্টিক করে তুলেছে৷ শীতল হাওয়ায় ঋতুর খোলা কেশ দক্ষিণা বাতাসে দুলছে৷ হাতে থাকা নুড়ি পাথর দিয়ে পদ্মা নদীতে ঢিল ছুঁড়ছে৷ ঋতু মায়াবী কন্ঠে বলল,
“সময়টা যদি থেমে গেলে আমার কাছে সব থেকে বেশি ভালো লাগবে৷”
“আমাদের সেই ক্ষমতা নেই৷ সৃষ্টি কর্তা আমাদের সেই ক্ষমতা দিলে আমি ক্ষমতার ব্যবহার করে থামিয়ে দিতাম৷”
“আমাদের সেই ক্ষমতা না থাকলেও এখানে আসার ক্ষমতা আছে৷ মন খারাপ থাকলেই আমরা এখানে আসি৷ তুমি আমাকে এখানেই প্রথম প্রপোজ করেছিলে৷ সেদিন সব বাচ্চাদের চকলেট কিনে দিয়েছিলে৷”
“তোমার জন্যও অনেক চকলেট ছিল৷ ভালোবাসা ভালোবাসা এই পদ্মা গার্ডেন দিয়ে৷”
ঋতু ভয়ে ভয়ে ভীত গলায় বলল,
“আমার ভীষণ ভয় হয়৷ আমাদের সম্পর্ক পরিবার মেনে নিবে৷ তাদের না জানিয়ে আমরা বিয়ে করেছি৷ আমাদের সম্পর্ক না মেনে নিলে আমি মা-রা যাব।”
“মা-রা যাওয়ার কথা মুখেও আনবে না৷ কতদিন আমাদের দূরে রাখবে৷ একদিন কাছে টেনে নিবে৷ সবথেকে পবিত্র সম্পর্ক হলো বিয়ের বন্ধন৷ সেটা ভাঙার কারোর ক্ষমতা নেই৷ আমি তোমার পাশে সব সময় থাকব৷ আর পরিবারের মানুষ মেনে না নিলে আমরা নিজেরাই ছোট একটা সংসার বাঁধব৷ সেই ছোট সংসারের রানী হবে তুমি৷”
“কিন্তু পরিবারের দোয়া ছাড়া আমাদের জীবন চলবে৷ বড়দের দোয়া আমাদের জন্য খুবই প্রয়োজন৷”
“চিন্তা কর না৷ সব ঠিক হয়ে যাবে৷”
চলবে……