বর্ষণ সঙ্গিনী পর্ব-৩৬+৩৭

0
1511

#বর্ষণ_সঙ্গিনী
#হুমাশা_এহতেশাম
#পর্ব_৩৬

রেনুমার ডাকে সকালে ঘুম থেকে উঠলাম।রেনুমা বলেছিল ও সকাল ১০ টার আগে ঘুম থেকে ওঠে না।আমার এলার্মের আগেই ও আমায় ডেকে দিয়েছে।আমি বিছানায় বসে চোখ বন্ধ করেই বললাম,,,

–রাতের চাঁদ মনে হচ্ছে দিনেই দেখতে পাচ্ছি। তা ব্যাপারটা কি?ভোর বেলাই উঠে পরলে যে।

–আরে এখন বাজে ৪:৩৫।তুমি তো একটু পরেই নামাজের জন্য উঠতে।তাই আরকি। (রেনুমা)

আমি চোখটা খুলে ওর দিকে সন্দেহ ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে গলায় অবিশ্বাসের রেশ টেনে বললাম,,,

–আমাকে ওঠানোর জন্য?সত্যি তো?

–সস..সত্যি নাতো কি মিথ্যা নাকি?(রেনুমা)

আমি একটু অনুকরণ করার ভঙ্গিমায় বললাম,,,

–কেউ একজন বলেছিল “ইশ ওনাকে যদি রাত-দিন চব্বিশ ঘন্টাই বসে বসে দেখতে পারতাম।আপু কালকে কিন্তু আমাকে ভোরবেলাই ডেকে দিবে”।

আমি কথাটা শেষ করতেই দেখি রেনুমা দৃষ্টি লুকানোর জন্য এদিক ওদিক তাকাচ্ছে।আসলে কাল রাতেই একফাঁকে রেনুমা কথার তালে তালে এই কথাটা বলে ফেলেছিল।রেনুমার একটা স্বভাব হলো পেটে কথা হজম করতে পারে না।আর তার থেকে আরেক টা মজার স্বভাব হলো সজল ভাইয়াকে উনি ওনার বলে সম্মোধন করে। সামনাসামনি আপনি বলে কথা বলে। এপর্যন্ত ভাইয়া ডাক ওর মুখ থেকে শুনিনি। আমাকে বলেছিল ভোরবেলা যেন ওকে আমি ডেকে দেই।কিন্তু আমার আগে দেখি ওই উঠে গেছে। এখন তো আমারই ডাউট হচ্ছে ও সারারাত ঘুমিয়েছে কিনা?
আমি বসে বসে যখন কালকের কথা ভেবে যাচ্ছিলাম তখন রেনুমা বলে উঠলো,,,

–তুমি যা ভাবছো ঠিক তাই ই।এখন উঠেই যখন গিয়েছি তাহলে ফজর এর নামাজ টা পড়ে চলো তাড়াতাড়ি বাইরে যাই।

–ওহোওওও এতো তাড়া।ঠিক আছে চলো তাহলে।

দুজনে মিলে নামাজ পড়ে কিছু সময় পরে সাড়ে পাঁচ টার দিকে ভিলা থেকে বের হলাম।আমি আমার পড়নের থ্রি-পিছ টার ওড়না টা ভালো করে মাথায় দিয়ে নিলাম।আমরা বের হতেই দেখি নিয়াজ ভাইয়া আর ভাবি ও বের হয়েছে। নিয়াজ ভাইয়া আমাদের দুজনকে উদ্দেশ্য করে বলল,,,

–শোন রিসোর্টের শেষ মাথায় একটু ফাঁকা স্পেস আছে।বসার জায়গাও আছে।আমরা নাস্তা করে আপাতত ওখান টা ঘুরে দেখে আসবো। তোরা দুজন চাইলে সামনে এগোতে পারিস।আমি আলআবিদের কল করে ডেকে নিচ্ছি।

রেনুমা ফট করে বলে উঠলো,,,

–না না।আমরা আগে আগে যাবো কেন?চলেন একসাথে ই যাই।

আমি ওর কান্ডে মিটমিটিয়ে হাসলাম।নিয়াজ ভাইয়া আলআবি ভাইয়াদের কল করতেই দেখতে পেলাম তারা দুজন অলরেডি ভিলা থেকে বের হচ্ছে। আলআবি ভাইয়াকে দেখলাম সাদা টি-শার্ট এর সঙ্গে সাদা টাউজার পড়েছেন।তার চুল গুলো একহাত দিয়ে পিছনে চেপে দিয়ে আমাদের সামনে এসে হাজির হলেন।হঠাৎ করেই এক উদ্ভট ভাবনা মস্তিষ্কে হানা দিল। মনে মনে চিন্তা করছি যদি আলআবি ভাইয়ার চশমার কালো ফ্রেমটায় শুভ্র রঙ স্থান পেতো, কালো চুলগুলোয় যদি শুভ্র রঙ স্থান পেতো, চোখের ভ্রু থেকে শুরু করে চোখের পাপড়ি,গালের দাঁড়ি পর্যন্ত যদি শুভ্র রঙ ছেয়ে যেত তাহলে কেমন হতো?নিশ্চয়ই তাকে শুভ্র ভূত বলে ডাকতো সবাই।অথবা বলতো শুভ্র আলআবি। তাকে ভূত ভেবে বেজায় হাসি পেলো।মনে মনে যখন তাকে ভূত সাজাচ্ছিলাম তখন খেয়াল করলাম ফারাবী ভাইয়া আর মিথিলা আপুও এসে পরেছে।রিসোর্ট টা আমাদের ঘুরে দেখা হয়নি তেমন ভাবে।তাই কিছু সময় এখানে ঘুরে ফিরে আমরা রিসোর্টের ওপেনিং এ ৯ টার দিকে বের হবো।

সবাই মিলে ধীর পায়ে এগোতে এগোতে রিসোর্টে এর শেষ প্রান্তে এসে পরলাম।এখানে এসে দেখি অবাক কান্ড।খোলা আকাশে রঙবেরঙে এর ঘুড়ির মেলা বসেছে।লাল, নীল,হলুদ, সবুজ রঙের ঘুড়ি স্বচ্ছ নীল আকাশটাকে নিজেদের দখলে নিয়ে নিয়েছে।খোলা জায়গাটায় ঘুড়তে আশা নানান বয়সের পর্যটকরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নাটাই সামলাচ্ছে। দূরে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড় গুলো মনে হচ্ছে উকিঝুঁকি দিয়ে ঘুড়িবিলাস করে যাচ্ছে। পাহাড়ের গায়ে লেপ্টে থাকা সবুজ গাছ গুলো কাল শেষরাতে হওয়া বর্ষণে স্নান করে গায়ে স্নিগ্ধতা জড়িয়ে মুগ্ধ করেছে আগত পর্যটকদের।আকাশ একেবারে ঝকঝকে পরিষ্কার। মাঝে মাঝে তুলোর ন্যায় শুভ্র মেঘ এসে আমাদের দেখা দিয়ে যাচ্ছে।

আমাদের সামনে হাজির হলেন রিসোর্টের ম্যানেজার।তার হাতে থাকা ফাইলটা একটু নেড়ে আলআবি ভাইয়া কে উদ্দেশ্য করে বললেন,,,

–গুড মর্নিং স্যার!আমাদের এখানে আমরা “ঘুড়ি উৎসব” নামে একটা ছোটখাটো উৎসবের আয়োজন করেছি।আমাদের পক্ষ থেকে এখানে আসা পর্যটকদের জন্য আয়োজন করা হয়েছে এই উৎসব।স্যার আপনারা চাইলে ইনজয় করতে পারেন।

–সকালবেলা ঘুড়ি উৎসব! ব্যাপারটা কেমন হয়ে যায় না?(আলআবি ভাইয়া)

— স্যার আসলে বিকেলে দেখা যায় পর্যটকদের অনেকে ঘোরাফেরা করে ক্লান্ত হয়ে ফিরে আসে।সব দিক চিন্তা করে সেজন্য আমরা সকালের দিকে আয়োজন করেছি।(ম্যানেজার)

–ইন্টারেস্টিং তো!(ফারাবী ভাইয়া)

— ভাইসব চল তাহলে একবার প্রতিযোগিতা হয়ে যাক। (সজল ভাইয়া)

আলআবি ভাইয়া ম্যানেজারের উদ্দেশ্যে বললেন,,,

–ঠিক আছে আমরাও তাহলে পার্টিসিপেট করবো

শুরু হয়ে গেল তাদের চারজনের ঘুড়ি কাটাকাটির প্রতিযোগিতা। কিছু কিছু মানুষ নিজেদের ঘুড়ি ওড়ানো বাদ দিয়ে নিয়াজ ভাইয়া দের ঘুড়ি প্রতিযোগিতা উপভোগ করেছেন।আমি, রেনুমা,তাসফি ভাবি আর মিথিলা আপু বসার জন্য যে বেঞ্চ রয়েছে সেখানে বসে বসে তাদের দেখেছি।

সজল ভাইয়া আর নিয়াজ ভাইয়ার ঘুড়ি অনেক আগেই আকাশ থেকে বিদায় নিয়েছে।এখন আলআবি ভাইয়া আর ফারাবী ভাইয়া মানে দুই ভাইয়ের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলছে। টানটান উত্তেজনার ইতি ঘটিয়ে ফারাবী ভাইয়া প্রথম হলো।

আমরা যেখানে বসে আছি তার পাশেই আর একটা বেঞ্চ আছে। সজল ভাইয়া আর আলআবি ভাইয়া সেখানে বসে পড়লেন। আলআবি ভাইয়া কে লেগপুল করতে করতে ফারাবী ভাইয়াও এসে আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে পরলেন। ফারাবী ভাইয়া মিথিলা আপু কে উদ্দেশ্য করে বললেন,,,

— মিথু চলো আজকে তোমাকে ঘুড়ি ওড়ানো শিখিয়েই ছাড়বো।

–এখন?এখানে?(মিথিলা আপু)

ফারাবী ভাইয়া মিথিলা আপুর এক হাত ধরে বসা থেকে টেনে তুলে বললেন,,,

— হ্যাঁ এখন। এই মুহূর্তে ই চলো।

তারা যেতেই ভাবি নিয়াজ ভাইয়া কে বলল,,,

–প্লিজ চলনা আমরাও ঘুড়ি উড়াই?

–এই সময়ে একদমই না (নিয়াজ ভাইয়া)

–প্লিজ চলো না বেশি সময় না। প্লিজ! প্লিজ! প্লিজ!(ভাবি)

–বেশি নড়াচড়া করবে না।(নিয়াজ ভাইয়া)

–তুমি বললে সারা জীবনেও নড়াচড়া করবো না। এখন প্লিজ চলো।(ভাবি)

নিয়াজ ভাইয়া স্মিত হেসে বলল,,,

–ওকে চলো।

ওরা চলে যাওয়ার কিছুক্ষন পর সামনে তাকিয়ে দেখি নিয়াজ ভাইয়ার দুই বাহুর মধ্যে তাসফি ভাবি। দুজনই এক নাটাই দিয়ে ঘুড়ি ওড়াচ্ছে।ফারাবী ভাইয়া আর মিথিলা আপুরও একই অবস্থা। পাশ থেকে রেনুমা বলে উঠলো,,,

–হাউ রোমান্টিক!

আমাদের দুই বেঞ্চের দুরত্ব বেশি নয়।রেনুমার বলা কথাটা শুনে সজল ভাইয়া বলল,,,

— তুই এইটুকুন বয়সে রোমান্টিকের কি বুঝিস?

–আপনি তো বুড়ো বয়সেও রোমান্স কি বুঝলেন না।(রেনুমা)

–এক চড়ে দাঁত ফেলে দিব।বেয়াদব মেয়ে!তোর মাকে এখনই কল দিয়ে জানাচ্ছি। (সজল ভাইয়া)

–কি বলবেন?আপনি বুড়ো বয়সে ও রোমান্স শিখতে পারেননি বলবেন।(রেনুমা)

রেনুমার বলা কথায় আমি আর হাসি চেপে রাখতে পারলাম না। কিছু টা শব্দ করে ই হেঁসে ফেললাম। রেনুমা যে সজল ভাইয়া কে জব্দ করায় ওস্তাদ তা বুঝতে বাকি নেই।আলআবি ভাইয়া বলে উঠলেন,,,

–ভাই মানসম্মান আর ও প্লাস্টিক বানানোর ইচ্ছা থাকলে আরও কিছুক্ষণ বসতে পারিস।

তৎক্ষনাৎ সজল ভাইয়া হনহন করে চলে গেলেন।সজল ভাইয়ার প্রস্থানের সঙ্গে সঙ্গে খিলখিল করে আমি আর রেনুমা হাসতে শুরু করলাম। আমাদের হাসির মাঝেই আলআবি ভাইয়া রেনুমাকে বললেন,,,

–যা তো।গিয়ে দেখ তোদের ভিলায় গিফট পৌঁছেছে নাকি?

রেনুমা উত্তেজিত হয়ে বলল,,,

–কিসের গিফ্ট?

–গেলেই তো জানতে পারবি।যা গিয়ে দেখ।(আলআবি ভাইয়া)

রেনুমা আমার একহাত ধরে বলল,,,

–জুইঁ আপু চলো।

আমি রেনুমার সাথে যাওয়ার জন্য উঠতেই আলআবি ভাইয়া বলে উঠলেন,,,

–ওর যাওয়ার দরকার নেই।তুই গিয়ে দেখ।

কথাটা শুনে আমি বলে উঠলাম,,,

–আমি যাব না কেন?

–কারণ গিফ্ট ওর।ও যাবে।(আলআবি ভাইয়া)

আলআবি ভাইয়া আবার রেনুমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,,,

–কিরে তুই এখানে দাঁড়িয়ে যে?

তার কথায় রেনুমা একাই চলে গেলেন।রেনুমা চলে যেতেই আলআবি ভাইয়া হুট করে আমার সামনাসামনি দাঁড়িয়ে পরলেন। তার এভাবে দাঁড়ানোতে আমি দু পা পিছিয়ে গেলাম।আলআবি ভাইয়া আমাকে বললেন,,,

–তখন ম্যানেজার কি বলেছিল মনে আছে?

আমি একটু ভ্রুকুচকে বলে উঠলাম,,,

–কি বলেছিল?

–ইনজয় করতে বলেছিল। (আলআবি ভাইয়া)

–করেন ইনজয়।আমাকে বলছেন কেন?(আমি)

–ওকে লেট’স গো।(আলআবি ভাইয়া)

বলেই আমার হাত ধরে হাটা ধরলেন।২০ নাম্বার ভিলার পিছনে এসে আমার হাত ছেড়ে দিলেন। আমার মনে প্রশ্ন জাগলো উনি এখানে আনলেন কেন?তাও আবার একা।হায়!হায়!আমাকে এখান থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিবেন না তো?এখান থেকে ভূপৃষ্ঠ ভালোই নিচে। মানুষ পরলে ওঠার কোনো চান্স নেই।আমি ভয়ে ভয়ে তার দিকে তাকালাম।দেখি পাশে উনি নেই। পিছনে ফিরে তাকাতেই দেখি ওনার হাতে একটা খাঁচা। সেখানে তিনটা টিয়ে পাখি দেখা যাচ্ছে। আমি উৎফুল্লতার সহিত বললাম,,,

–টিয়াপাখি! কি করবেন এগুলো?

–পাখি খাঁচায় পুরে রাখার জিনিস নয়। আল্লাহ তো এদের ডানা এমনি এমনি দেয়নি।আসো এদিকে আসো।(আলআবি ভাইয়া)

আমি তার কাছে যেতেই একটা পাখি আমার হাতে তুলে দিলেন।পাখিটা হাতে নিতেই খুশি লাগছে অনেক।হাতের মধ্যে নিয়েই পাখি টাকে দেখতে লাগলাম। হুট করে আলআবি ভাইয়া আমার পিছনে দাঁড়িয়ে পরলেন। আমি দুই হাতে পাখি টাকে ধরে রেখেছি।আলআবি ভাইয়া পিছন থেকে আমার হাত ধরে পাখিটাকে আলগা করে নীল আকাশে মুক্ত করে দিলেন। পাখিটা উড়তে উড়তে চলে যাচ্ছে ।কানের কাছে ফিসফিসে আওয়াজে ভেসে আসলো,,,

–ইট ওয়াস ইউর গিফ্ট।

চলবে…………

#বর্ষণ_সঙ্গিনী
#হুমাশা_এহতেশাম
#পর্ব_৩৭

৩টা পাখিই ছেড়ে দেয়ার পর দুজন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে পাখিদের চলে যাওয়া দেখছি আলআবি ভাইয়া কে উদ্দেশ্য করে বললাম,,,

–একটা কথা বলি?

আলআবি ভাইয়া আকাশ পানে তাকিয়েই বললেন,,,

–বলে ফেলো

–সাদা রঙ ছাড়া আপনি অন্য রঙ এর জামা পড়েন না কেন?(আমি)

–সাদা জামায় দাগ ভরলে কিছু দাগ উঠবে কিছু দাগ উঠবে না।যে দাগগুলো উঠবে সেগুলো তাদের ছাপ রেখে যাবে সারাজীবন এর জন্য। আমি যখন সাদা পাঞ্জাবি পড়ি তখন সবসময় দাগ থেকে মুক্ত রাখার চেষ্টা করি।আমি যে পথে চলছি এ পথে সৎ থাকাটা কিছু টা কষ্টের।রাজনীতির মাঠে নামলে আমার এই সাদা পাঞ্জাবি ই আমাকে মনে করিয়ে দেয় চরিত্রে দাগ লাগানো যাবে না।সময়ের তালে তালে দাগ ফিকে হয়ে যাবে ঠিকই কিন্তু আজীবনের জন্য একটা ছাপ রেখে যাবে। (আলআবি ভাইয়া)

–আরেকটা কথা বলি?(আমি)

আলআবি ভাইয়া এবার আমার দিকে দৃষ্টি দিয়ে ঠোঁটের কোনে মুচকি হাসি বজায় রেখে নরম কন্ঠে বললেন,,,

–বলো।

তার এই “বলো” শব্দ টা অতি সামান্য হলেও কেন যেন আমার কাছে অন্য রকম লাগলো।এ মুহূর্তে খুব আবেদনময় লাগছে তাকে। মনে হচ্ছে কোনো ছোট বাচ্চার থেকে মুখের বুলি শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। তার দিকে তাকিয়ে বললাম,,,

–ধন্যবাদ এতো সুন্দর মুহূর্ত উপহার দেয়ার জন্য।

আলআবি ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে অমায়িক হাসি হাসলেন।মনে হলো হাসিটা হুট করেই আমাকে লজ্জায় ফেলে দিল। কাউকে ধন্যবাদ দিলেও কি লজ্জা লাগে নাকি?এ দিনও আমার দেখতে হচ্ছে। নাকি আমারই কোনো অসুখ হলো? কথাটা বলে আর একমুহূর্তও দেরি করলাম না। সোজা ঘুড়ি উড়ানোর স্পটে এসে পরলাম।

আজ বান্দরবান আমাদের ২য় দিন।পরশুরাতে আমরা এখান থেকে বিদায় নিব।একটু আগেই আমাদের প্ল্যান চেঞ্জ হলো।তাহলো,ভিলায় আমরা আর ব্যাক করবো না।পরশুদিন পর্যন্ত আমরা নতুন রিসোর্টে ই থাকবো। তার কারণ হলো রিসোর্ট থেকে ১৬ কিলোমিটার দূরেই চিম্বুক পাহাড় অবস্থিত। তাই ভিলায় ব্যাক না করেই আমরা ওখান থেকে ই চিম্বুক পরিদর্শন করতে পারি। এতে জার্নিটাও কম হবে।

সকাল এখন ৯ টা বেজে ১৫ মিনিট। আমরা সবাই আলআবি ভাইয়ার রিসোর্টের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পরেছি।অনেকটা সময় পথ অতিক্রম করে আমরা আমাদের সেই কাঙ্ক্ষিত রিসোর্টে পৌঁছালাম৷

রিসোর্টের প্রতিটা কটেজই দৃষ্টি কেঁড়ে নিবে প্রত্যেকের।এখানে মোট ১৩ টা কোটেজ আছে।সবচেয়ে দৃষ্টি আকর্ষনের দিক হলো প্রত্যেকটা কটেজই ছোটখাটো একটা গোলাপ বাগানে ঘেরা।সাথে বেলিফুলও রয়েছে।গোলাপ আর বেলি বাদে কিছু নাম না জানা অপরিচিত ফুলও রয়েছে।কটেজের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো প্রতিটা কটেজ কাঠের তৈরি যা মাটি থেকে একটু উঁচুতে।কটেজে ওঠার জন্য রয়েছে কাঠের সিঁড়ি। এই রিসোর্টের সীমানা গোলাকৃতির।এখানে যার নামে কটেজ বুক করা হয় তার নামের নেমপ্লেট টানিয়ে দেয়া হয় দরজায়।এখানে খাবার এর ও ব্যবস্থা আছে।তবে খাবারটা নাকি যার যার কটেজে এসে দিয়ে যাওয়া হয়।আরো ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হলো খাবার রান্না হয় মাটির চুলোয়।বাঙালি খাবার ছাড়া মেনুতে অন্য কোনো বাইরের ফুড নেই।এক কথায় বলতে গেলে রিসোর্ট প্ল্যান টা খুব ই দারুণ।

আজকে রিসোর্টে বাইরের কোনো পর্যটক নেই। অফিস স্টাফ, আর আমরাই পুরো রিসোর্টে।এখানে এসে দুপুরের খাবার খেয়ে রিসোর্টটা সবাই মিলে ঘুড়ে দেখলাম।এখানে আসার পরেই আলআবি ভাইয়া কোথায় যেন হাওয়া হয়ে গিয়েছেন।কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির মুখ দর্শন করতে না পেরে মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল।রিসোর্ট টা ভালো করে দেখা শেষ হলে আমার আর রেনুমার জন্য বরাদ্দকৃত কটেজে এসেই বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে ঘুমের দেশে পারি জমালাম।রাতে একটা ছোটখাটো পার্টি হবে। হয়তোবা অনেক সময় রাত জেগে থাকা হবে।

দরজায় কড়া আঘাতের শব্দে চোখ মেলে তাকালাম। দেখি রেনুমা পাশের সিঙ্গেল বেডে বেঘোরে অগোছালো ভাবে ঘুমাচ্ছে।আমার বেড থেকে উঠে গিয়ে ওকে একটু ঠিকঠাক করে দরজা খুলে দিলাম। দেখি রিসোর্টের একজন স্টাফ দাঁড়িয়ে আছে। আমার হাতে দুটো শপিং ব্যাগ ধড়িয়ে দিয়ে বলল,,,

–ম্যাম এটা স্যার এর পক্ষ থেকে আপনাদের দুজন এর জন্য।

–কোন স্যার?(আমি)

–আলআবি স্যার এর পক্ষ থেকে। (স্টাফ)

সে তার কথা শেষ হতেই চলে গেলেন। দরজা আটকে ভিতরে এসে দেখি টেবিল ঘড়িতে বিকেল পাঁচ টা বাজে। শপিং ব্যাগ দুটোয় খেয়াল করলাম একটার মধ্যে রেনুমা লেখা আর একটার মধ্যে জুইঁ লেখা। ওয়াশরুম থেকে একটু ফ্রেশ হয়ে এসে ভাবলাম এক সাথেই না হয় দুটো ব্যাগ খুলবো। তাই রেনুমা ডেকে তুললাম। ওকে ফ্রেস হয়ে আসতে বললাম কিন্তু ও আগেই ব্যাগ দুটো খুলে ফেলল। ব্যাগ থেকে দুটো বেগুনি রংয়ের শাড়ি পেলাম। আমাদের দুজনের শাড়ি একরকমের ই দেখতে। আমার ব্যাগ থেকে একটা কালো রঙের হিজাব স্কার্ফও পেলাম। রেনুমাকে আমি হিজাব পরতে দেখিনি।ওর ব্যাগ থেকে কোনপ্রকার হিজাব পেলাম না।রেনুমা আমাকে জিজ্ঞেস করে বসলো,,,

–এগুলো কি সন্ধ্যার ইভেন্টের জন্য? নাকি এমনি এমনি দিয়ে গেলো?

–দাঁড়াও ভাইয়াকে কল দিয়ে জেনে নেই। (আমি)

নিয়াজ ভাইয়া কে কল করতেই ভাইয়া জানালো এই শাড়ি পরে একেবারে রেডি হয়েই যেন আমরা কিছুক্ষণের মধ্যে বাইরে আসি। ভাইয়ার কথামতো শাড়ি পড়ে রেডি হয়ে নিলাম। আগে থেকেই প্ল্যান করে এসেছিলাম শাড়ি পড়বো। তাই সাথে দুটো শাড়ি আর তার সাথে দুটো ব্লাউজ নিয়ে এসেছিলাম। এখান থেকে একটা রেনুমাকে দিলাম।

কটেজের বাইরে খোলামেলা স্থানে এসে দেখি নিয়াজ ভাইয়া, ভাবি, ফারাবী ভাইয়া, মিথিলা আপু সহ অন্যান্য কলিগরাও একসাথে এক জায়গায় ভিড় জমিয়েছে। সকল মেয়েদের পড়নেই আমাদের মতো বেগুনি বর্ণের শাড়ি। ছেলেদের মধ্যে কেউ কেউ সাদা পাঞ্জাবি পড়েছে। পুরো রিসোর্টটা ও মরিচ বাতি দিয়ে হালকা পাতলা ডেকোরেশন করা হয়েছে। স্পিচ দেয়ার জন্য ছোটখাটো একটা স্টেজ সাজানো হয়েছে। স্টেজের সামনে সারি সারি চেয়ার আর গোল টেবিল বসানো হয়েছে তবে এখনো মরিচ বাতি গুলো জ্বালানো হয়নি। এক অংশে বারবিকিউ এর জন্য স্টোভ সাজানো হচ্ছে। চারপাশে কিছুটা রমরমা পরিবেশ হলেও আমার কাছে পুরো পরিবেশটাই নির্জীব মনে হচ্ছে সবকিছুই ফাঁকা ফাঁকা মনে হচ্ছে এখন পর্যন্ত আলআবি ভাইয়ার দেখা মেলেনি। কয়েকদিন ধরে আলআবি ভাইয়া আশেপাশে থাকলে সবকিছু পরিপূর্ণ লাগে। আজকে হঠাৎ তার অনুপস্থিতিতে মনে হচ্ছে আমার চারপাশ অপূর্ণতায় ঘিরে যাচ্ছে। আমরা যেখানটায় বসে রয়েছি সেখান থেকে রিসোর্টে ঢোকার প্রধান রাস্তা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। বারবার শুধু আশেপাশে পরখ করে যাচ্ছি। সজল ভাইয়া আর আলআবি ভাইয়ার দুজনের একজনকেও দেখতে পাচ্ছি না।কাউকে জিজ্ঞেস ও করতে পারছি না। আমার জায়গায় উল্টো দু-তিনবার রেনুমা আমাকে জিজ্ঞেস করে ফেলেছে সজল ভাইয়ার কোন খোঁজ জানি নাকি।

আমি বসে বারবার যখন চারপাশে চোখ বুলিয়ে যাচ্ছি তখন আমার চোখ এক জায়গায় আটকে যায়।দেখি আলআবি ভাইয়া রিসোর্টে ঢোকার রাস্তা দিয়ে এদিকে আসছেন।তার কোলে একটা ৫-৬ বছরের বাচ্চা।বাচ্চাটাকে এক হাতে আগলে কোলে নিয়ে অন্যহাতে একটা লাগেজ নিয়ে এদিকে এগোচ্ছেন।তার পাশেই হেটে হেটে একটা মেয়ে আসছে।মেয়েটার মুখমন্ডলে সাজসজ্জার কোনো কমতি নেই।তবে তার পোশাক-আশাকে শালীনতার ছাপ রয়েছে। তিনজনকেই খুশি খুশি দেখাচ্ছে। লক্ষ্য করলাম তাদের পিছনে ই সজল ভাইয়া আসছে।ওদের দেখে মনে কুচিন্তার পাহাড় জমা হয়ে যাচ্ছে। তিনজন কে দেখে মনে হচ্ছে একটা সুখি পরিবার হেঁসে খেলে এদিকেই আসছে।মনের মধ্যে এমন ভাবনা আসতেই বুকে মোচড় দিয়ে উঠলো।বাচ্চা ছেলেটা কি যেন বলতে বলতে আসছে আর আলআবি ভাইয়া হেঁসে হেঁসে তার জবাব দিচ্ছেন। তারা আমাদের কাছে আসতেই শুনতে পেলাম বাচ্চা টা মিষ্টি গলায় বলে উঠলো,,,

–আমার বাবাই বেস্ট বাবাই।

বলেই তার গলা জড়িয়ে ধরে তার সাথে আরো লেপ্টে গেলো।ওদের কে চোখে পরতেই মিথিলা আপু বলে উঠলো,,,

–আরে অনুরাধা!!!

মেয়ে টা আমাদের সামনে এসে ই সুন্দর করে গাল ভরা হাসি দিয়ে মিথিলা আপুর উদ্দেশ্যে বলল,,,

–কেমন আছো ভাবি?

এই কথাটা আমার পুরো শরীর অসাড় করে করে ফেলল।মস্তিষকে একটা কথা বারবার যন্ত্রণাদায়ক খোঁচা দিচ্ছে। “উনি বিবাহিত”।

চলবে…………

[বিঃদ্রঃ গল্পটি সম্পূর্ণরূপে কাল্পনিক। অনুগ্রহ করে বাস্তবিক অর্থ খুজতে গিয়ে বিভ্রান্ত হবেন না আর লেখিকা কে ও বিভ্রান্ত করবেন না]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে