বর্ষণ সঙ্গিনী পর্ব-৩২+৩৩+ বোনাস পর্ব

0
1597

#বর্ষণ_সঙ্গিনী
#হুমাশা_এহতেশাম
#পর্ব_৩২

–আপনি আমাকে বর্ষণ সঙ্গিনী হিসেবে মানবেন নাকি জুইঁ হিসেবে মানবেন তা আপনার ব্যাপার। কিন্তু ভুলেও এই মুহুর্তে বউ হিসেবে একদমই মানতে পারবেন না বলে দিলাম।

আলআবি ভাইয়া তার কথা শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে আমিও তাকে পাল্টা জবাব দিয়ে দিলাম। দেড় বছর সে আত্মগোপন করে আমার থেকে দূরে দূরে ছিলেন। এবার তাকেও বোঝাবো দূরে দূরে থাকার মজা। আমি তার দিকে তাকিয়ে আমার কথাটা শেষ করলাম। দেখি সে কটমট করে আমার দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকিয়ে আছেন। তার এমন চাহনিকে মনে মনে আমি একটু হলেও ভয় পাই। তাই তার দিকে আর না তাকিয়ে আশেপাশে পরখ করতে লাগলাম। তার থেকে চোখ ফিরানো মাত্রই তিনি হুট করে দাঁড়িয়ে ঝুঁকে পড়লেন আমার দিকে। তার এভাবে দাঁড়ানো দেখে আমি হকচকিয়ে তার দিকে তাকালাম। কিছু বুঝে উঠার আগে ই তিনি তার ওষ্ঠদ্বয় আমার কপালে ছোঁয়ালেন তারপর আবার নিজের স্থানে বসে পড়লেন।বসেই বলে উঠলেন,,,

–আর কিছু? কি যেন বলছিলে?

বলেই আমার দিকে তার সেই চিরচেনা ইবলিসি মার্কা হাসি ছুঁড়ে দিলেন। তার আকস্মিক এমন কাজে আর কথায় আমি একরাশ লজ্জা নিয়ে স্তম্ভিত হয়ে বসে রইলাম।তার যে হুটহাট মুড চেঞ্জ হওয়ার ব্যামো রয়েছে তা আমার অজানা নয়। তবে তার এমন আচার-আচরণ আমার ঠিক হজম হচ্ছে না। আমাদের কয়েক হাত দূরে ই পাশের টেবিলে একজোড়া মধ্য বয়স্ক দম্পতি দেখা যাচ্ছে। সাথে রয়েছে তাদের ছয় অথবা সাত বছরের একটা মেয়ে। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই আলআবি ভাইয়ার এমন এহেন কান্ড দেখে ফেলেছেন।তারা মিটমিট করে হাসছেন। যা আমাকে আরও অস্বস্তিতে ফেলে দিচ্ছে। আমি আলআবি ভাইয়া কে কোন জবাব দিলাম না মাথা নিচু করে বসে রইলাম। এর মধ্যে একজন ওয়েটার এসে আমাদের জিজ্ঞেস করলেন আমরা কি খাবো। এখানে মূলত এখন ভাত আর ইলিশ মাছের নানা রকম আইটেম পাওয়া যাবে। এছাড়া তাদের কাছে আর কিছু নেই।আলআবি ভাইয়া কি কি অর্ডার করলেন সেদিকে আমার কর্ণ পাত হলো না।আমি নিরব মনে আশেপাশের মানষ দেখতে ব্যস্ত ছিলাম।আশে পাশে দেখে যা বুঝলাম তাহলো এখানে আগতো প্রায় সব মানুষই হয়তোবা পদ্মা নদীর ওপারে যাবে আর নয়তো পদ্মা নদী পেরিয়ে এসেছে।পেট পূজো হলেই নিজের গন্তব্য মুখী হবে।

বই পুস্তকে পড়া এই পদ্মা নদী আজই প্রথম দর্শন করলাম। প্রিয় মানুষ টার সাথে অপরিচিত স্থানে ঘোরাঘুরি করায় অন্যরকম অনুভূতি জড়িয়ে থাকে। কতগুলো অচেনা মুখের ভিড়ে কেবল একটা চেনা মুখের উপরই থাকে সকল আশা ভরসা।

আমি আলআবি ভাইয়ার মুখোমুখি বসে আছি। একটু পর পর তাকে আড় চোখে দেখে নিচ্ছি। তাকে যে আমি বারবার পরখ করছি সে হয়তো তা বুঝতে পারছেন না। বুঝবেন কি করে, সে তো তার মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত আছেন।তার হাতে মোবাইল দেখে বাসার কথা ফের মনে পরলো।তাই তাকে ডাক দিয়ে বসলাম,,,

–আলআবি ভাইয়া?

আমার ডাকে তিনি আমার দিকে তাকিয়ে হালকা করে ভ্রুকুটি করলেন তারপর বললেন,,,

–আমি তোমার কোনো জন্মেরই ভাই হই না।তাই এরপর থেকে ভাইয়া ডাক যেন না শুনি।

–আপনি আমার এ জন্মের ই ভাই।এহ্ আসছে ভাইয়া ডাক যেন না শুনি।আপনি যদি আগেই আপনার পরিচয় দিতেন তাহলে হয়তো ভাইয়া ডাকতাম শুনতে হতো না।এখন তো একশো বার বলব ভাই। ভাই! ভাই! ভাই!(আমি)

–তখন তো কপালে ঠোঁটের ছোঁয়া পেয়েছ।এরপর আর একবার ভাইয়া বলে দেখ, ঠোঁটের ছোঁয়া এরপর যেখানে দিব তা তোমার ধারণার বাইরে হবে।(আলআবি ভাইয়া)

আমি নাক মুখ কুঁচকিয়ে বলে উঠলাম,,,

–নির্লজ্জ লোক! দিন দিন মুখটাকেও নষ্ট করে ফেলছেন।

উনি কিছু বলার আগেই একজন লোক এসে গরম গরম ধোঁয়া ওঠা ভাত ভর্তি দুটো প্লেট টেবিলের উপর রাখলেন।এরপর প্লেটে করে রাখলেন ভাজা ইলিশ মাছের সাথে নানান রকমের ভর্তা। আর কথা না বাড়িয়ে খাওয়া শুরু করলাম এভাবে কোন খোলামেলা রেস্তোরাঁয় বসে ভাত খাওয়াটাও আমার জীবনে প্রথম। তাঁর জন্যেই রাত থেকে সকাল পর্যন্ত কিছু নতুন নতুন অনুভূতিকে আলিঙ্গন করতে পারলাম। তেতুল বলতেই যেমন জিভে জল এসে পড়ে তেমন ইলিশ মাছ নাম শুনলেই আমার জিভে জল এসে পড়ে। তাই আশেপাশের কোন খবর না নিয়েই যখন নিজের পেট পূজোয় ব্যস্ত ছিলাম তখন হঠাৎ করে আলআবি ভাইয়ার প্লেটের দিকে চোখ পরল। দেখি উনি বিনা ইলিশ মাছেই কেবলমাত্র ভর্তা দিয়ে ভাত খেয়ে যাচ্ছেন। তাকে জিজ্ঞেস করলাম,,,

— আপনি মাছ নিবেন না?

আলআবি ভাইয়া আমার দিকে কিছুটা অসহায় চাহনি দিয়ে বললেন,,,

— এই মাছে প্রচুর কাঁটা তাই…..

এটুকু বলেই থেমে গেলেন।তারও আর বলার প্রয়োজন হলো না।আমার যা বোঝার তা বুঝে গিয়েছি।আমার জন্মদিনের দিন আমি লক্ষ্য করেছিলাম উনি ইলিশ মাছ নেন নি।সেদিন তার না খাওয়ার পিছনে যে এই কাহিনী ছিল তা আজ জানতে পারলাম।তার পানে একটা মুচকি হাসি দিয়ে সামনে থাকা মাছের প্লেট থেকে এক পিছ মাছ নিয়ে সন্তপর্ণে কাঁটা বেছে বেছে তার প্লেটে উঠিয়ে দিলাম।আমার থেকে এমন ব্যবহার হয়তো তার কাছে একেবারেই অপ্রত্যাশিত ছিল।তিনি আমার দিকে কিছু সময় তাকিয়ে থেকে খাওয়া শুরু করলেন।

ইলিশ মাছের কথা মনে পড়তেই সেদিন রাতের কথাও মনে পড়ে গেল।কথা টা অনেকদিন ধরেই আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। সেদিন আমাকে সিঁড়িতে ধাক্কাটা কে মেরেছিল? যদি আলআবি ভাইয়াই হয়ে থাকেন, তাহলে বলতে হয় সে হয়তোবা ছাঁদে থাকতেই তার বাবার মৃত্যু সংবাদ শুনেছেন।তাই তার হিতাহিত জ্ঞান হয়তোবা সাময়িকের জন্য লোপ পেয়েছিল। বাবার এমন একটা সংবাদ শুনে যেকোন সন্তানেরই দিশেহারা অবস্থা হয়ে যাবে।তার উপর আলআবি ভাইয়ার সাথে তার বাবার সম্পর্ক ছিল গভীর বন্ধুত্বের। ওই সময়ে তার ওইরকম আচরণ মেনে নেয়া গেলেও দেড় বছরের আত্মগোপন একেবারে ই মেনে নেয়া যায় না। কোন কারণের জন্য তার এমন করতে হলো? ভেবেই আমি কূল পাচ্ছিনা। আর যদি অন্য কেউই আমাকে ধাক্কা দিয়ে থাকে তাহলে, আমাকে ধাক্কা দেয়ার তার কি উদ্দেশ্য ছিল? মোটকথা সেদিন রাতের ঘটনার কিছুর সাথেই কিছুর যোগ সূত্র খুঁজে পাচ্ছিনা।মনে মনে ভেবে নিলাম তাকে এসম্পর্কে জিজ্ঞেস করব। কিন্তু এখন না। আরো কয়েকদিন পরে। কারন এখন তো আমি তার সাথে দূরে থাকার অভিনয় অভিনয় খেলা খেলবো।

আমার আকাশ কুসুম ভাবনার মধ্যে ই আমাদের খাওয় শেষ হলো। রেস্তোরাঁর বাইরে এসে সামনেই তার সাদা বর্ণের গাড়িটা দাঁড়ানো দেখলাম। গাড়ির বাইরে শাফিন নামের ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে। আমরা দুজনে গাড়ির কাছে যেতেই শাফিন বলে উঠলো,,,

— ভাই আপনার বাইক পাঠিয়ে দিয়েছি আর এই যে গাড়ির চাবি।

বলেই শাফিন আরেকটা ছেলের সাথে একটা বাইকে করেই চলে গেল।শাফিন চলে যেতেই আমি আলআবি ভাইয়া কে প্রশ্ন করলাম,,,

–গাড়ীতে কেন?বাইকেই তো ঠিক ছিলাম।ফুড়ফুড়ে বাতাস খেতে খেতে বাসায় যেতাম।

–হ্যাঁ আর আমি আমার বউয়ের চেহারাটা সবাইকে দেখাতে দেখাতে যেতাম তাই না? (আলআবি ভাইয়া)

–কে আপনার বউ? কীসের বউ? আর আমি তো মাস্ক পড়েই আছি।(আমি)

–আসো দেখাই কীসের বউ।(আলআবি ভাইয়া)

কথাটা বলা শেষেই তার মুখে দুষ্টুমি ভরা হাসির ছাপ দেখতে পেলাম।তিনি একপা একপা করে আমার দিকে এগিয়ে আসতেই আমি দ্রুতগতিতে গিয়ে গাড়ি তে উঠে বসলাম। গাড়ি কিছুদূর যাওয়ার পর আমি আলআবি ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করলাম,,,

— আচ্ছা আমাদের যেতে আর কত সময় লাগবে?

–দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা। জ্যামে পড়লে তিন ঘন্টার মতোও লাগতে পারে। (আলআবি ভাইয়া)

এখন প্রায় পৌনে আটটা বাজে। তার মানে বাসায় যেতে যেতে দশটা বা দশটার বেশি বেজে যাবে। আমি আলআবি ভাইয়াকে পুনরায় জিজ্ঞেস করলাম,,,

— বাবা আর ভাইয়া যখন জিজ্ঞেস করবে কোথায় ছিলাম? বাসায় গিয়ে তখন আমি কি বলবো? (আমি)

–সেটা তোমার ব্যাপার। (আলআবি ভাইয়া)

–কি!!! আমার ব্যাপার মানে? আপনি ই তো আমাকে নিয়ে এসেছেন।(আমি)

— আমি তোমাকে কোন জোরজবরদস্তি করেছি নাকি। বর্ষণ সঙ্গীর নাম শুনেই তো তুমি লাফিয়ে লাফিয়ে চলে আসলে।

এই মুহূর্তে তার উপর খুব রাগ হচ্ছে বলার মত কিছু মুখেও আসছে না। তার দিকে কটমট করে তাকালাম কিন্তু তাতে তার কোনো ভাবান্তর নেই। সে একমনে গাড়ি ড্রাইভ করে যাচ্ছে। কিছু সময় তার দিকে তাকিয়ে থেকে সিটে মাথা এলিয়ে দিলাম। ভাবতে লাগলাম বাসায় যেয়ে কি বলা যায়।

আমার ভাবনার রাজ্য থেকে কখন যে ঘুমের রাজ্যে চলে গিয়েছে তা টের পাইনি। ঘুম ভাঙতেই দেখি আমার জানালার পাশের গ্লাস টা খোলা সেই সাথে আমার চুলের খোঁপা টাও খোলা। জানালা দিয়ে মাঝারি গতির বাতাস এসে আমার চুলকে এলোমেলো করে দিচ্ছে। মূলত এলোমেলো চুল আমার মুখে আছড়ে পড়ার কারনেই ঘুমটা ভেঙে গিয়েছে। আমার পাশেই লক্ষ্য করলাম আলআবি ভাইয়া একমনে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছেন। গাড়ির স্টিয়ারিং এর সাথে ঝুলছে খোপায় লেপ্টে থাকা বেলি ফুলের মালাটা। মালাটা ওখানে দেখে একটু অবাক হলাম। কারণ আমার মনে হচ্ছে খোঁপাটা খুলে চুল এলোমেলো হয়েছে বাতাসের বেগে। সেই হিসেবে মালাটা আমার চুলে খোলা অবস্থায় থাকতো অথবা নিচে পড়ে যেত। মানে আমার আশেপাশে ই থাকতো। অত দূরে গেল কিভাবে? ওহ নিশ্চয়ই আলআবি ভাইয়া রেখেছেন।মালাটা থেকে এখন তীব্র সুবাস ছড়াচ্ছে না। কিন্তু তাও মৃদু একটা সুবাস ছড়িয়ে আছে পুরো গাড়ি জুড়ে।

প্রায় দশ টার দিকে গাড়ি আমাদের এলাকায় ঢুকলো। কিন্তু আমার বাসার রাস্তায় না ঢুকে সাদুদের বাসার রাস্তার দিকে ঢুকছে। ওদের বাসার রাস্তা দেখে আমি বলে উঠলাম,,,

–এই রাস্তায় কেন ঢুকছেন আপনি? আমাদের বাসার রাস্তা তো পেছনে বা দিকে ফেলে এসেছেন।

আমার কথা শেষ হতে না হতেই গাড়ি সাদুদের বাসার গেটের সামনে থেমে গেল। আলআবি ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,,,

–তোমার বান্ধবীর থেকে গিয়ে যেকোন একটা নোট নিয়ে আসো। এক মিনিটের মধ্যে যাবে আর আসবে। নো গসিপ। বাসায় গিয়ে বলবে তোমার বান্ধবীর বাসায় এসেছিলে নোট আনার জন্য। এতোটুকু বললেই হবে। বাকিটা নিয়াজ সামলে নিবে।

–মানে?নিয়াজ ভাইয়া কি করবে আবার?কি সামলাবে? (আমি)

— তাড়াতাড়ি যাও আমার সময় নেই হাতে।

আমি আর কথা না বাড়িয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম। সাদুকে এর আগে আমি আলআবি ভাইয়ার কথা বলেছিলাম। তাই ওকে সবকিছু বলা লাগেনি। শুধু আলআবি ভাইয়ার স্বীকারোক্তি মুখে বলে তারাহুরো করে একটা নোট নিয়ে আবার নেমে পড়লাম। বাসায় এসে আলআবি ভাইয়ার শেখানো বুলি গুলোই বললাম। আজও বর্ষণ সঙ্গীর চক্করে ভার্সিটি মিস হয়ে গেল। বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে বিশাল বড় একটা ঘুমের জন্য প্রস্তুতি নিয়ে শুয়ে পরলাম।

সন্ধ্যাবেলায় ভাইয়া অফিস থেকে এসেই দারুণ একটা খবর দিলো। নিয়াজ ভাইয়ার ভাষ্য মতে তাদের কনস্ট্রাকশন কম্পানি মানে আলআবি ভাইয়াদের কম্পানি বান্দরবানে তিন বছরের একটা রিসোর্ট প্রজেক্ট শেষ করেছে। এক সপ্তাহ বাদেই রিসোর্টের ওপেনিং সেলিব্রেশন।আমরা মাত্র ছয় দিন পরে ই চার দিনের জন্য পুরো পরিবার বান্দরবান যাচ্ছি। অফিস থেকেই তাকে সকল খরচাপাতি দেওয়া হবে। ভাইয়ার কথায় যেমন খুশি হয়েছি ঠিক তেমনই মনে একটা খটকা লাগছে। ওপেনিং সেরেমানিতে ভাইয়া একলা যেতে পারে বড়জোর সাথে করে ভাবিকে নিতে পারে কিন্তু পুরো পরিবার শুদ্ধ আমন্ত্রিত কেন? যাই হোক আমি এতকিছু দিয়ে আমি কি করব? ঘুরতে যাওয়ার সুযোগ যখন পেয়েছি তখন আমি শুধু ঘুরে বেড়াবো। রাতে খাবার টেবিলে বাবা জানিয়ে দিল সে যাবেনা। বাবা বলল আমরা তিনজন যেন যাই অনেক জোরাজুরির পরেও বাবাকে রাজি করতে পারলাম না। তাই সিদ্ধান্ত নেয়া হলো আমরা তিনজনেই যাব। ভাবির প্রেগনেন্সির দেড় মাসের একটু বেশি চলছে। তাই আপাতত এই মুহূর্তে ভাবির খুব একটা বেশি সমস্যা হওয়ার কথা না।

রাতে সাড়ে এগারোটার দিকে ঘুমাতে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম।সে সময় আমার ফোনটা বেজে উঠলো। ফোনের স্ক্রিনে সেই চিরচেনা নামটা জ্বলজ্বল করছে –“বর্ষণ সঙ্গী”।আজ দেড় বছরেরও বেশি সময় পর এই নাম্বার থেকে আবার কল আসলো। অজান্তেই ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটে উঠলো। কলটা তাড়াহুড়ো করে রিসিভ করতে গিয়েও থেমে গেলাম। ভাবলাম একটু মজা দেখাতে হবে তাকে। ফোনের সাইলেন্ট মুড অন করে রেখে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। ঘুম তো দূরের কথা চোখের পলকটাই ফেলতে ইচ্ছে করছেনা। একদৃষ্টিতে ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে আছি।প্রথমে কলটা রিসিভ করতে ইচ্ছে না করলেও এখন একটু প্রিয় মানুষটার গলার স্বর শুনতে খুব ইচ্ছে করছে। মন আর মস্তিষ্কের যুদ্ধে মস্তিষ্ককের পরাজয় করে ঘোষণা করে চারবারের সময় রিং হতেই কলটা রিসিভ করে বসলাম।

–আসসালামু আলাইকুম। (আমি)

–ওয়ালাইকুম আসসালাম। ফোন ধরতে এতে সময় লাগে কেন?(আলআবি ভাইয়া)

–আমার ফোন,আমার ইচ্ছে। (আমি)

–তোমার দেখছি ইদানীং মুখে খই ফুটছে।ব্যাপার কি?(আলআবি ভাইয়া)

— ব্যাপার হলো আমার এখন ঘুম পাচ্ছে। আপনার সঙ্গে খেজুরে আলাপ করার ইচ্ছে মোটেও নেই।(আমি)

— আমারও তোমার সঙ্গে খেজুরে আলাপ করার কোনো ইচ্ছা নেই। (আলআবি ভাইয়া)

–তাহলে আপনি ফোন দিয়েছেন কেন শুনি? (আমি)

–প্রেম আলাপ করার জন্য(আলআবি ভাইয়া)

— তাহলে বসে বসে আপনার ঘরের মশার সাথে প্রেমালাপ করুন আমি রাখলাম।(আমি)

কথাটা বলেই আর এক মুহুর্ত দেরি করলাম না। সঙ্গে সঙ্গে কলটা কেটে দিলাম। ফোনটা সাইলেন্ট মুডে রেখে দিলাম। তারপর দু চোখের পাতা বন্ধ করে নিলাম। এবার খুব শান্তির ঘুম হবে।

চলবে…………

#বর্ষণ_সঙ্গিনী
#হুমাশা_এহতেশাম
#পর্ব_৩৩

২২৩ টা মিসড কল দেখে যেটুকু ঘুম ঘুম ভাব ছিল তাও জানালা দিয়ে ফুড়ুৎ করে পলায়ন করল।এত গুলো কল কেউ কিভাবে দিতে পারে।সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই দেখি আলআবি ভাইয়ার এতগুলো কল। সারারাত ধরে কি আলআবি ভাইয়া না ঘুমিয়ে আমাকে কলই করে গিয়েছেন।তাতে আমার কি?যা হয়েছে, ভালো হয়েছে। একদম উচিৎ শিক্ষা হয়েছে। আমাকে কল করেছেন মাত্র একরাত।আর আমি যে কতগুলো রাত অপেক্ষা করেছি তা?

হালকা পাতলা নাস্তা বানিয়ে খেয়ে আলআবি ভাইয়ার দেওয়া সেদিনের সেই কালো বোরখা আর হিজাব টা গায়ে চাপিয়ে বেড়িয়ে পরলাম।সাদু আর ওর আম্মু কোন এক কারণে ওদের গ্রামের বাড়ি গিয়েছে। ভার্সিটি দুই দিন মিস যাওয়ায় একাই বেড়িয়ে পরলাম।

ভার্সিটিতে কিছু “হায়-হ্যালো”করার ফ্রেন্ড রয়েছে। ওদের সাথে বসেই ক্লাস করলাম।শেষের যে ক্লাস টা হওয়ার কথা ছিল সেটা ক্যানসেল হয়ে যাওয়ায় আমি মনে মনে ভেবে নিলাম নিশাদ ভাইয়ার কাছে যাব। গতদিনের একটা ইম্পর্টেন্ট লেকচার মিস হওয়াতে ই মূলত নিশাদ ভাইয়ার কাছে যাওয়ার পরিকল্পনা করলাম।নিশাদ ভাইয়া হলো আমাদের এক ব্যাচ সিনিয়র। সেই সাথে ডিপার্টমেন্টের টপারদের মধ্যে একজন।পড়াশোনা বুঝে নেয়া ছাড়া তার সাথে আর অন্য কোনো কারণে সাক্ষাৎ হয় না।ভার্সিটি লাইফেও কিছু শিক্ষার্থী পাওয়া যাবে, যারা পড়াশোনা ছাড়া কিছুই বোঝে না।তাদের সাথে বন্ধু মহলের পরিবর্তে পাওয়া যায় বইমহল।এই নিশাদ ভাইয়াও ওইসব শিক্ষার্থীদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত। ক্লাসে গিয়ে তাকে না পেয়ে লাইব্রেরিমুখী হলাম। কারণ এই বান্দার বিচরণ কেবল ক্লাস আর লাইব্রেরিতেই।

লাইব্রেরি তে প্রবেশ করেই দেখতে পেলাম নিশাদ ভাইয়া বইয়ে মুখ গুঁজে আছেন। আমি গিয়ে তার সামনাসামনি বসতেই ঝড়ের গতিতে কেউ একজন এসে আমার পাশে বসে পরলো।তাকাতেই দেখি আলআবি ভাইয়া আমার পাশে বসে বসে হাপাচ্ছেন।তাকে এখানে দেখেই তার ২২৩ টা কলের কথা মনে পরে গেল।হায়!হায়! এখন এখানে বসেই দু-চারটা টা লাগিয়ে দিবে নাকি? সামনে চোখ পড়তেই দেখে নিশাদ ভাইয়া আমাদের দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে। তার চাহনি বলে দিচ্ছি আমাদের দুজনকে তার সামনে বসে থাকতে দেখে তিনি কিছুটা বিরক্ত। আমি যখনই কিছু বলার জন্য উদ্যত হলাম তখন আলআবি ভাইয়া নিশাদ ভাইয়াকে উদ্দেশ্য করে বললেন,,,

— ও যেটা বুঝতে এসেছে তাড়াতাড়ি ওকে সেটা বুঝিয়ে দাও।

আলআবি ভাইয়ার কথা শুনে আমি তার দিকে তাকিয়ে তড়িৎ গতিতে বললাম,,,

–আপনি কি করে জানেন আমি এখানে কিসের জন্যে এসেছি?

— তুমি দিনে কয় কদম ফেলো সেই খবরও আমার কানে আসে।(আলআবি ভাইয়া)

আমাদের কথার মাঝেই নিশাদ ভাইয়া বলে উঠলেন,,,

— আমার মনে হয় আপনাদের দুজনের একটু ব্যক্তিগতভাবে কথা বলে আসা দরকার।

নিশাদ ভাইয়ার কথা শেষ হতেই আলআবি ভাইয়া আমার বাম হাত চেপে ধরে বললেন,,,

–আমি বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র বলে তোমাকে আজ অন্যের কাছ থেকে পড়া বুঝে নেয়ার সুযোগ টা দিচ্ছি।

কথাটা বলেই উনি নিশাদ ভাইয়ার উদ্দেশ্যে বললেন,,,

–ওর যেটাতে প্রবলেম আছে সেটা সলভ করে দাও।

নিশাদ ভাইয়ার কাছে যেহেতু আগেও প্রবলেম সলভ করতে এসেছিলাম সেহেতু ভাইয়া বুঝে গিয়েছেন আলআবি ভাইয়া কিসের কথা বলছেন।আমি যখন কিছু বলতে যাব তার আগেই নিশাদ ভাইয়া বলল,,,

–জুইঁ শুরু করি তাহলে?

আমি আর কোনো কথা বাড়ালাম না।আমার সমস্যা গুলো নিশাদ ভাইয়াকে দেখাতে লাগলাম। আলআবি ভাইয়া সেই যে আমার হাত ধরে রেখেছেন ছাড়ার নাম গন্ধ ও নেই।আমি হাত টা ছাড়ানোর জন্য মোচড়ামুচড়ি করতেই আলআবি ভাইয়া বলে উঠলেন,,,

–কি সমস্যা?

–আপনার কি সমস্যা? এভাবে হাত ধরে রেখেছেন কেন? আমি ভালো ভাবে মনোযোগ দিতে পারছি না আপনার জন্য।(আমি)

কথাগুলো বলতেই আলআবি ভাইয়া হাতটা ছেড়ে দিলেন। হাত ছাড়া পেতেই আমি বইয়ের ওপর পুনরায় চোখ রাখলাম। তৎক্ষণাৎ ই হাতে টান লাগতে আবার ও হাতের দিকে তাকালাম।হাতের দিকে তাকাতেই আমার চক্ষু চড়কগাছ। আলআবি ভাইয়া তার এক হাতে আর আমার আরেক হাতে হাতকড়া পরিয়ে রেখেছেন। আলআবি ভাইয়ার দিকে তাকাতেই একটা গা জালানো হাসি আমার দিকে ছুড়লেন। ঠোঁটের কোণে সেই হাসি বজায় রেখে বললেন,,,

— এটা কল না ধরার জন্য শাস্তি।

তার কথায় আমি থ হয়ে গেলাম।কি বলছেন উনি এগুলো?এমন শাস্তি তো আমি আমার দাদার জন্মেও দেখিনি। এখন কোন উপায়ও নেই। এভাবেই আমাকে থাকতে হবে। তাই আবার পড়ায় মনোযোগ দিলাম। কোনমতে পড়াটুকু বুঝে তাড়াতাড়ি করে আলআবি ভাইয়াকে নিয়ে লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে আসলাম। এতক্ষণ লাইব্রেরিতে আমরা নিচু স্বরে ই কথা বলছিলাম। বাইরে এসে আলআবি ভাইয়াকে স্বাভাবিক কন্ঠে বললাম,,,

–শাস্তি দিয়েছেন এবার খুশি তো? তাড়াতাড়ি এখন এটাকে খুলুন।আমি বাসায় যাব।

— আমার হাতকড়া, আমার ইচ্ছে। তাই যখন আমার মন চাইবে তখনই খুলবো(আলআবি ভাইয়া)

তার কথা শুনে আমি জোরে বলে উঠলাম,,,

–কি?কি বললেন?

–জানোই তো এক কথা আমি দুবার বলি না।

— ভার্সিটিতে না হয় ঢুকেই গিয়েছেন। কিন্তু আপনি লাইব্রেরি তে কি করে ঢুকলেন আগে সেটা বলুন।(আমি)

— তোমার হাজবেন্ডের পরিচয় দিয়েছি।বলেছি আমি আমার বউকে নিয়ে যেতে এসেছি। (আলআবি ভাইয়া)

–কি? কাকে কাকে বলে বেরিয়েছেন এ কথা?(আমি)

— কাউকে না শুধুমাত্র তোমাদের ভিসি স্যার কে বলেছি।(আলআবি ভাইয়া)

তার কথা শুনে আমার মাথায় বাজ পড়ল।তরতর করে রাগ বাড়তে লাগল। বেশ জোরালো কন্ঠেই তাকে বললাম,,,

–কি সব বলে বেড়াচ্ছেন আপনি?আর ভিসি স্যার কে কি করে বললেন এগুলো? লজ্জা শরমের ছিটেফোটাও তো দেখছি আপনার মধ্যে নেই। দেড় বছরে কি সব খেয়ে ফেলেছেন?

–আরে তার তো জানার অধিকার আছে তার বউমা কে হবে।(আলআবি ভাইয়া)

–মানে?(আমি)

— মানে হল আমরা দূর সম্পর্কের চাচা ভাতিজা।(আলআবি ভাইয়া)

তার কোথায় আমি একটু দমে গেলাম তারপর বললাম,,,

— আপনারা যা ইচ্ছা তাই হন।আপনি কেন বলবেন আমি আপনার বউ? এরপর আর আমাকে উল্টোপাল্টা কথা বলে দেখেন। আমি কিন্তু সোজা গিয়ে নারী উত্যক্তের কেস করব।

আমার কথার তিনি কোনো জবাব না দিয়ে সোজা হেঁটে যেতে লাগলেন। হাতে টান অনুভব করায় আমিও তার পিছু ছুটলাম। তার পিছু পিছু হাঁটছি আর বারবার হাতকড়াটা খুলে দিতে বলছি। কিন্তু তাকে দেখে মনে হচ্ছে আমার কোন কথাই তার শ্রবণন্দ্রিয় পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছাচ্ছে না। ভার্সিটি থেকে বের হয়ে একটা রিকশায় উঠে পড়লেন সাথে আমাকেও টেনে রিকশায় উঠালেন। রিক্সায় উঠে তাকে বললাম,,,

–বাসার সামনে গিয়ে ছেড়ে দিবেন তাইতো? এটা বললেই তো হয়।

এটুকু বলেই আমি আর কোন কথা না বলে চুপ করে বসে রইলাম। আমাদের রিকশার হুডি তুলে দেওয়া। বাইরে পরিবেশ স্বাভাবিক। না আছে রোদ আর না আছে আকাশে মেঘ। সেইসাথে আবহাওয়াটাও বলতে গেলে নাতিশীতোষ্ণ। আমার আর আলআবি ভাইয়ার মাঝখানে দেড়-দুই ইঞ্চির মতো ফাঁকা রয়েছে। তবে তার ডানহাত আর আমার বাম হাত একসাথে মিলানো।

রিক্সাটা আমাদের ভার্সিটি ক্যাম্পাস থেকে একটু এগিয়ে বাসার দিকে না গিয়ে উল্টো পথে চলতে লাগলো। আসলে আলআবি ভাইয়া যখন রিকশায় উঠেছেন তখন রিক্সাওয়ালা মামাকে কি বলেছেন সেটা স্পষ্ট শুনতে পাইনি। অচেনা পথ দেখে আমি বলে উঠলাম,,,

— আরে মামা এই রাস্তা না তো। আপনি তো অন্য রাস্তায় চলে এসেছেন।

তখন রিক্সাওয়ালা মামা পেছনে ফিরে আলআবি ভাইয়ার দিকে তাকালেন। তিনি রিক্সাওয়ালা মামাকে ইশারায় আশ্বস্ত করলেন এই রাস্তা দিয়েই যেতে। তখন আমি আলআবি ভাইয়াকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলাম,,,

— আপনার মতলবটা কি? কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে?

— এত কথা কেন বল তুমি? মুখ দিয়ে আর একটা শব্দ বের করলে এই রিক্সা সোজা কাজী অফিসে গিয়ে থামবে।জানোই তো কাজী অফিসে কি করা হয়। কি জানো না? (আলআবি ভাইয়া)

শেষের কথাটা বলে তার এক ভ্রু উঁচু করে আমার দিকে তাকালেন।তার কথার অর্থ বুঝতে আমার বেগ পেতে হলো না। তার দিকে দৃষ্টি দিয়ে বললাম,,,

–সারাদিন বউ বউ আর বিয়ে বিয়ে করা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই আপনার?

— কতগুলো কথা বলে ফেললে। এখনতো আমি নিজেও এই রিকশাকে কাজী অফিসে যাওয়া থেকে থামাতে পারবে না।(আলআবি ভাইয়া)

তার কথায় আমার মনের মধ্যে ভয় ঢুকে গেল। কারণ একবার সে যা বলে সেটা করে ছাড়ে। তাহলে কি সত্যি সত্যি উনি আজকেই আমাকে বিয়ে করে ফেলবেন? আমি এখন তাহলে কি করব? রিক্সা থেকে লাফ দিয়ে নেমে দৌড়ে চলে যাবো? হাতটা একটু উঁচু করতেই মনে পড়ল এই খবিশ লোকটা তো সেই রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছেন। এখন আমার কি হবে? এই মানুষরূপী খবিশ টাকে জব্দ করার আগেই কি বিয়ে হয়ে যাবে? রিক্সাটা হঠাৎ থামতেই আমার ভাবনার মধ্যে তালা ঝুলে যায়। রিক্সায় বসা থেকে সামনে দৃষ্টি পড়তেই আমার শ্বাস ক্রিয়া বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়ে যায়। সামনে একটা সাইনবোর্ড এ কালো রং এর মধ্যে সাদা রং দিয়ে খুব সুন্দর করে নিপুন হাতে লেখা আছে——–“কাজী অফিস”।

আমি ভয়ে ভয়ে একবার সাইনবোর্ড দিকে তাকাচ্ছি আর একবার আলআবি ভাইয়ার দিকে তাকাচ্ছি। তখন আমাকে আলআবি ভাইয়া বলে উঠলেন,,,

— কি হলো চলো দেরি হয়ে যাচ্ছে তো। শুভ কাজে নাকি দেরি করতে হয় না।

আলআবি ভাইয়া আমাকে টান দিয়ে রিক্সা থেকে নামিয়ে নিলেন। রিক্সার ভাড়া মিটিয়ে সোজা কাজী অফিসের দিকে হাঁটা ধরলেন। আমি যেতে না চাইলে এক প্রকার টেনেই সঙ্গে করে নিয়ে চললেন।

চলবে…………

#বর্ষণ_সঙ্গিনী
#হুমাশা_এহতেশাম
“বোনাস পর্ব”

আমার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আলআবি ভাইয়া হাসতে হাসতে গলে পরছেন।বহুদিন পর তার এমন দম ফাটা হাসি যেমন আমায় মুগ্ধ করছে তেমন কিছুটা রাগও হচ্ছে।রাগটা মূলত হচ্ছে নিজের উপর ই।নিজের বোকামিতে নিজেকে ই এখন মনে মনে বকে চলেছি।

কিছুক্ষণ আগে,,,

আলআবি ভাইয়া আমাকে নিয়ে সোজা কাজী অফিসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। আমি মনে মনে দোয়া দুরুদ যপে যাচ্ছি। ঠিক অফিসটার সামনে আসতেই চোখ বুজে কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলে উঠলাম,,,

–আমি বিয়ের জন্য এখনো রেডি নই।আমি বিয়ে করব না।

কথাটা বলে চোখ খুলেই দেখি আলআবি ভাইয়া আমাকে নিয়ে কাজী অফিস টা পেড়িয়ে পাশের ছোট গলিটা দিয়ে সুরসুর করে ঢুকে গেলেন।আমি তার দিকে তাকিয়ে তার পিছুপিছুই হেঁটে যাচ্ছি। গলিটার শেষ মাথায় এসে আলআবি ভাইয়া দাঁড়িয়ে পরলেন। তার দিকে হতবাক হয়ে আমাকে তাকিয়ে থাকতে দেখেই এখন এই ভাবে হাসছেন।তার দিকে তাকিয়ে তার হাসি দেখেই বুঝতে পারলাম উনি আমাকে কিভাবে বোকা বানিয়েছেন।

আলআবি ভাইয়া কোনো রকমে হাসি থামিয়ে ব্যঙ্গ করে বললেন,,,

–আমি বিয়ে করব না।

বলেই আবারও শরীর দুলিয়ে হো হো করে হাসতে লাগলেন।আমি রেগে তাকে বললাম,,,

–একদম দাঁত বের করে হাসবেন না।আস্তো খবিশ!!! কোথায় নিচ্ছেন আমাকে?

–খবিশ বলায় তোমার শাস্তির মেয়াদ আরও বাড়লো।ভেবেছিলাম এখনই হাতকড়া খুলে ফেলব কিন্তু মুডটাই তুমি নষ্ট করে দিলে।

তিনি কথা শেষ করে আমাকে আর কিছু বলার সুযোগ ই দিলেন না। পাশেই আর একটা সরু গলিতে ঢুকে পড়লাম আমরা। এই গলিটারও একেবারে শেষ মাথায় এসে একটা গেটের সামনে দাড়িয়ে পড়লাম আমরা।সামনেই একটা খোলামেলা জায়গায় দেখা যাচ্ছে। যার শেষ প্রান্তে সারি সারি ঘর দেখা যাচ্ছে। সবগুলোই সাদা রং এর সেমিপাকা ঘর।খোলামেলা জায়গায় কিছু বাচ্চারা খেলছে। এক প্রান্তে রয়েছে টিউবওয়েল। কেউ কেউ টিউবওয়েল থেকে পানি নিচ্ছে।কয়েকটা মুরগি এদিক ওদিক ছোটাছুটি করছে।এখানে না হলেও ২৫-৩০ টা ঘর রয়েছে। আমি যখন এসব দেখতে ব্যস্ত তখন আলআবি ভাইয়া বলে উঠলেন,,,

–যেটা দেখছ এটা আমার ২য় পরিবার।আমার জীবন ওতোপ্রোতো ভাবে ওদের সাথে জড়িত।

আলআবি ভাইয়ার কথায় আমি তার দিকে তাকালাম। দেখি আলআবি ভাইয়া একদৃষ্টিতে খেলতে থাকা বাচ্চা গুলোর দিকে তাকিয়ে আছেন।আলআবি ভাইয়া আবার বলতে লাগলেন,,,

–যে বাচ্চাটাকে দেখছ চোখ না বেঁধেই কানামাছি খেলছে ও চোখেই দেখতে পায় না।

আমি ভালো ভাবে লক্ষ্য করে দেখি সত্যি ই ৭-৮ বছর এর একটা মেয়ে নির্বিঘ্নে কানামাছি খেলে যাচ্ছে চোখ না বেধে ই।আলআবি ভাইয়ার কথায় আবার তার দিকে তাকালাম।

–চার দিন বাদেই বাচ্চা টার আই ট্রান্সপ্ল্যান্ট হবে। (আলআবি ভাইয়া)

আমাকে ইশারা করে একটা ছেলেকে দেখিয়ে বললেন,,,

–ওখানে খেলার দর্শক সেজে বসে থাকা ছেলেটার পায়ের একটা রগ শুঁকিয়ে গিয়েছে। ছেলেটা ভালো করে হাটতে পারে না।দুই দিন পরেই ওর অপারেশন। ওই যে ওখানে দেখ,যে বুড়ো মহিলা টা বসে আছে তার আপনজন বলতে আমি আর এখানে থাকা মানুষগুলো ছাড়া কেউ নেই।টিউবওয়েল এর ওখানে যে মেয়েটাকে দেখছ ওকে ওর ভালোবাসার মানুষটা ধোঁকা দিয়ে বিক্রি করে দিচ্ছিল।এখানে আজ মেয়েটা এসেছে ১৩ দিন হয়েছে। কাল ওকে ওর পরিবার এর কাছে হস্তান্তর করব।ওদিকটায় যে ৩ টা ঘর দেখছ তাতে কিছু পথ শিশু থাকে।ওদের প্রত্যেককেই ৫-৬ বছর বয়সে আমি পেয়েছি। তবে এখন ওরা পথশিশু নয়।

তার কথা আমি একমনে শুনে যাচ্ছিলাম। আলআবি ভাইয়া সামনের খোলামেলা জায়গাটা দেখিয়ে বললেন,,,

–এখানে প্রতিদিন ওদের পাঠশালা বসাই।স্কুলে যা যা শিখে আসে সেগুলো আমাকেও এসে শিখাতে শুরু করে দেয়।সজল আর নিয়াজও মাঝে মাঝে আসে ওদের সাথে আড্ডা দিতে। এই মানুষ গুলোও আমার বাবার আরেকটা পরিবার ছিল।কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো এই মানুষ গুলোকে আমার জীবনে আনতে অনেক দেরি করে ফলেছি।ওদের দেয়া পরিচয় টাই এখন আমার বড় পরিচয় –“বড় ভাই”।

আলআবি ভাইয়া কথাগুলো বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আমাকে নিয়ে ভিতরে ঢুকে গেলেন। আমার কানে এখনো তার বলা কথা গুলো বেজে যাচ্ছে।মুহূর্তে মুহূর্তে তাকে আমি নতুন রূপে আবিষ্কার করছি।আর কত রূপ আছে তার?সারাজীবন এমন একটা মানুষের সাথে থাকার সৌভাগ্য কি হবে আমার?

গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকতেই বাচ্চা গুলো একেবারে মৌমাছির মতো ধেয়ে আসলো আমাদের কাছে।আমাদের পিছনেই শাফিন ভাইয়ার কন্ঠ শুনতে পেলাম।দেখি শাফিন ভাইয়ার হাতে অনেকগুলো চিপসের প্যাকেট আর চকলেট। তার পিছনেই একটা ভ্যানে রান্নার সরঞ্জাম সাথে বাজারও রয়েছে। বাচ্চাগুলোর সাথে কথা বলে বেশ ভালো লাগলো।ওরা বসয়ের চেয়ে একটু বেশিই পাকা।একটা পিচ্চি মেয়ে তো বলেই বসলো,,,

–বড় ভাই এইডা আফনের বউ?

মেয়েটার কথায় আমি থতমত খেয়ে আলআবি ভাইয়ার দিকে দৃষ্টি দিতেই দেখি উনি হাসি হাসি মুখ করে বাচ্চা টাকে বললেন,,,

–সারাজীবনের #বর্ষণ_সঙ্গিনী।

পিচ্চি টার ছোট মাথায় আলআবি ভাইয়ার বলা কথাটার অর্থ বোধগম্য না হলেও আমার ঠিকই বোধগম্য হয়েছে।তার কথায় একটুও বিরক্তি বা রাগ আমার মধ্যে ধারণ করতে পারলাম না।কিছু সময় তার দিকে তাকিয়ে রইলাম।

হঠাৎ করেই মনে পরলো তাকে তো রাগ দেখাতে হবে।আমি তো তাকে শিক্ষা দিব।তৎক্ষনাৎ আমি একটু মিথ্যে রাগ এনে আলআবি ভাইয়ার দিকে রাগীদৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললাম,,,

–আমি কারো বর্ষণ সঙ্গিনী না।

–আমার জানা মতে তোমাকে তো কেউ কিছুই জিজ্ঞেস করে নি।তাহলে একা একা পাগলের মতো বিলাপ করে যাচ্ছ কেন?(আলআবি ভাইয়া)

আমাকে আলআবি ভাইয়া কোথায় যেন নিয়ে যাচ্ছেন। আমি তার পিছু পিছু হাঁটতে হাঁটতে বললাম,,,

–আপনি কিন্তু আমার কথা এড়িয়ে যাচ্ছেন।আমি পাগ…..

আর কিছু বলতে পারলাম না।আমাকে নিয়ে আলআবি ভাইয়া তার দেখানো সেই বুড়ো মহিলার ঘরের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পরলেন। আলআবি ভাইয়াকে উদ্দেশ্য করে মহিলাটি বললেন,,,

–এতো সময় লাগে তোর আহনে।

আমাকে দেখিয়ে আলআবি ভাইয়া বললেন,,,

–ওনার ভার্সিটি থেকে আসতে দেরি হয়েছে।

–কি কিহের থেইকা?(বুড়ো মহিলা)

–ভার্সিটি।(আলআবি ভাইয়া)

আলআবি ভাইয়া জোড়ে কথাটা বললেন। আমি আলআবি ভাইয়াকে আস্তে করে বললাম,,,

–আপনি এতো জোড়ে কথা বলছেন কেন?

–তার কানে একটু প্রবলেম আছে। (আলআবি ভাইয়া)

–ওওহ (আমি)

আমি তাকে হাত দিয়ে ইশারা করে সালাম দিলাম সাথে মুখেও বললাম,,,

–আসসালামু আলাইকুম।

–ওয়ালাইকুম আসসালাম।তুমিই তাইলে জুইঁ?(বুড়ো মহিলা)

আমি মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ জানালাম।তখন আলআবি ভাইয়া দুষ্টমির স্বরে বললেন,,,

–সিতারা বানু কেমন লাগলো?চলবে তো?

–আরে চলবো মানে ফালাইবো।আয় তুই এইহানে বয়।কহন থেইকা দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া কথা কইতাছোস। (সিতারা বানু)

সিতারা বানু আলআবি ভাইয়া কে চৌকি দেখিয়ে বসতে বলায় আলআবি ভাইয়া গিয়ে বসে পরলেন।হাতে হাতকড়া থাকাতে আমাকেও তার পাশাপাশি বসে পড়তে হলো।আমাকে উদ্দেশ্য করে সিতারা বানু বলে উঠলেন,,,

–কি গো মাইয়া তুমি দেহি আমার নাতিডারে ছাড়া একমুহূর্তও থাকতে পারো না।হাত ধইরাই রাহো দেহি।বুজবার পারছি বেশিই ভালোবাসা তোমগো মইধ্যে।তোমার কতা কইতে কইতেই তো আমার কানডারে ঝালাপালা কইরা একেবারে বয়রা বানাইয়া তুইছে আমারে। এহন থিকা তুমিই তোমার জনরে সামলাও।বহো তোমরা আমি একটু আইতাছি।

সিতারা বানুর কথায় আমি বকাবনে গেলাম।কি বলে গেলেন উনি।হাত পিছনে রাখায় আমাদের হাতকড়া এখনো কারো চোখে পরেনি।আমি আলআবি ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে দেখি উনি মিটমিটিয়ে হাসছেন।

চলবে…………

[বিঃদ্রঃ গল্পটি সম্পূর্ণরূপে কাল্পনিক। অনুগ্রহ করে বাস্তবিক অর্থ খুজতে গিয়ে বিভ্রান্ত হবেন না আর লেখিকা কে ও বিভ্রান্ত করবেন না]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে