#বর্ষণ_সঙ্গিনী
#হুমাশা_এহতেশাম
#পর্ব_৩০
এক মুহূর্তের জন্য মনে হচ্ছে আমি বুঝি দেড় বছর আগে চলে এসেছি। আমাদের ড্রয়িংরুমে নিয়াজ,আলআবি আর সজল নামের তিন যুবক ঠিক সেই দেড় বছর আগের মতো বসে বসে তাদের জমানো কথার ঝুড়ি খালি করছে।আমার এতো অবাক হওয়ার কারণ আলআবি ভাইয়া তার বাবা ইন্তেকালের পর একবারের জন্যেও আমাদের বাসায় আসেন নি।কালকে রাতে ১ম এসেছিলেন।আর সজল ভাইয়া ও আসেন নি।নিয়াজ ভাইয়ার সাথে সজল ভাইয়ার শুধু ফোনেই কথা হতো।তাকে বাসায় আসতে বলা হয়েছে অনেকবার কিন্তু সে নাকচ করে দিয়েছিলেন।আজ অনেক গুলো দিন বাদে সেই পুরনো বন্ধু গুলো এক হয়েছে। কাল রাতের তুলনায় আজ আলআবি ভাইয়ার মুখশ্রী বেশ স্পষ্ট আমার কাছে।দেড় বছর আগের সেই আলআবি ফিরে এসেছে মনে হচ্ছে। আমি পা বাড়িয়ে তাদের নিকটে গিয়ে দাড়ালাম। আমাকে দেখা মাত্রই সজল ভাইয়া বলল,,,
–আরে জুইঁ কই ছিলি এতো সময়?আর আছিস কেমন?
আমি একগাল হাসি এনে বললাম,,,
–আলহামদুলিল্লাহ ভাইয়া।ভালো আছি অনেক।তুমি কেমন আছো? আর এতো দিন কি আমাদের বাসার রাস্তা ভুলে গিয়েছিলে নাকি?
–তেমন না।আসলে আলআবি ছিল না তাই আমারও আসা হয়নি।(সজল ভাইয়া)
আমি একটু টের চোখে আলআবি ভাইয়ার দিকে তাকালাম। তার চোখে চোখ পরতেই তিনি আমাকে চমকে দিয়ে আমার উদ্দেশ্যে চোখ টিপ মারলেন।এরূপ কাজে আমি আহাম্মক বনে গেলাম। তার থেকে চোখ সড়িয়ে অন্য দিকে দৃষ্টি রাখলাম।যতটুকু সময় ড্রয়িংরুমে ছিলাম তার দিকে তাকানোর সাহস করলাম না।
আলআবি ভাইয়ারা দুপুরের খাবার খেয়ে চলে গেলেন। তারা চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।যতটুকু সময় তারা ছিলেন তাতে আলআবি ভাইয়ার কর্মকান্ডে বেশ অবাক হয়েছি।তার এরূপ কর্মকান্ড আমি আমার জন্মে এই প্রথম দেখলাম। যেমন, দুপুরে খাওয়ার টেবিলে—–
আমি চেয়ার টেনে বসতেই হুট করে আলআবি ভাইয়া এসে আমার পাশের চেয়ারে বসে পরলেন।প্রত্যেকের জন্য ই আলাদা করে গ্লাস রেখেছি টেবিলে।সেই সুবাদে আমারও একটা গ্লাস আর আলআবি ভাইয়ার ও একটা গ্লাস ।কিন্তু আলআবি ভাইয়া আমার গ্লাস থেকে ইচ্ছে করে তিন বার পানি খেলেন।১ম বার যখন খেলেন আমি মনে করলাম ভুলবশত হয়ে গেছে তাই তাকে আমি তার গ্লাস দেখিয়ে দিলাম কিন্তু তাতে কোনো লাভই হলো না।
আবার আমি যখন এটা ওটা নেয়ার জন্য হাত বারাচ্ছি তিনি তখন সবার সামনে আমার নাম ধরে বলছেন জুইঁ এটা দেও তো, জুইঁ ওটা দেও তো, জুইঁ কাটা ফালাবো কোথায়? জুইঁ জুইঁ করে আমার মাথা টা খেয়ে ফেলছেন। এমনিতে তো উনি সবার সামনে কথা কম বলেন।আর বাবার সামনে তো আরও কম।কিন্তু আজকে এমন ভাবে পটর পটর শুরু করেছেন যে থামার নামই নিচ্ছেন না।
আবার খাওয়া শেষ করে যখন বেসিনে হাত ধুতে আসলাম তখন হ্যান্ডওয়াশে প্রেস করে হাতে হ্যান্ডওয়াশ নিয়ে যখনই হাতটা সরিয়ে নিতে যাব তখনই আলআবি ভাইয়া এসে আমার বৃদ্ধাঙ্গুলির উপরই তার বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে আরেকবার প্রেস করলেন যার ফলে পরিমাণের চেয়ে বেশি হ্যান্ডওয়াশ আমার হাতে পরে যায়।তখন আলআবি ভাইয়া বলেন,,,
–ও সরি!বেশি হয়ে গিয়েছে তাই না?
বলেই উনি ওনার এঁটো হাত টা দিয়ে আমার এঁটো হাতে থাকা কিছু পরিমান হ্যান্ডওয়াশ নিয়ে নিলেন।তার কাজে আমি তার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইলাম ।তার কাজে মনে হচ্ছিল এটা সত্যি ই আলআবি ভাইয়া তো?চোখের পলকে সে পাল্টে গেলেন কীভাবে?মাথার মধ্যে শুধু আলআবি ভাইয়া আর তার কৃতকর্ম গুলো ভনভন ভনভন করছে।
বিকেলবেলা আমি, ভাবি আর নিয়াজ ভাইয়া ছাঁদে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম।আজ নিয়াজ ভাইয়ার অফ ডে।তাই আমাদের ছাঁদে বসে আড্ডা দেয়ার প্ল্যান করা। আড্ডা দেয়ার এক পর্যায়ে আলআবি ভাইয়ার একটা কথা মনে পড়ে গেল। তার চাকরি নিয়ে যখন কথা বলেছিলাম তাকে খুব রেগে যেতে দেখেছিলাম।নিয়াজ ভাইয়া কে ফুরফুরে মেজাজে দেখে জিজ্ঞেস করে বসলাম,,,
–আচ্ছা ভাইয়া আলআবি ভাইয়াকে হঠাৎ করেই চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছিল কেন?
আমি জানি আলআবি ভাইয়া নিজে থেকে রিজাইন দিয়েছিলেন। ভাইয়াও এখন এই উত্তরটাই দিবে। কিন্তু কেন রিজাইন দিয়েছিলেন সেটা আমাকে জানতে হবে। তাই ভাইয়াকে প্রশ্নটা একটু ঘুরিয়েই করলাম।
–তোর বাসা থেকে তোকে কেউ তারিয়ে দেবে?(নিয়াজ ভাইয়া)
–মানে?(আমি)
— মানে হল দীর্ঘদিন ধরে যে অফিসে কাজ করে আসছি সেটা আলআবির বাবার অফিস। ওর বাবা আমাদের অফিসের ৭০%শেয়ার হোল্ডার।আর ও চাকরিটা ছাড়েনি।শুধু সশরীরে অনুউপস্থিত থেকে কাজ করছে।
ভাইয়া কথাটা শেষ করে একটু থেমে পুনরায় বলতে লাগলো,,,
–শোন মজার ব্যাপার হলো ও যখন ওর সার্টিফিকেট পেয়েছে মানে পড়ালেখা শেষ করে কোম্পানিতে জয়েন করে তখন জানতে পারে কোম্পানির ৭০% শেয়ার হোল্ডার ওর বাবা।আলআবির বাবা নিজেও কখনো বিলাসিতা কে ভোগ করেন নি আর আলআবিকেও বিলাস পূর্ণ অবস্থায় রাখেননি। সবসময় মধ্যবিত্ত পরিবারের মতো জীবন যাপন করিয়েছে ওকে। ওর বাবার ধারণা ছিল ছেলেকে দুহাতে ইচ্ছামত টাকা উড়াতে দিলে ছেলে বখে যাবে। সব সময় আদর্শ বাবার আদর্শ ছেলে হিসেবে থেকেছে আলআবি। বাবা ছেলে দুই বন্ধুর মত ছিল।সজল একবার আমাকে বলেছিল আলআবি কলেজে থাকতে মারামারির ওস্তাদ ছিল। ওর জন্য বাসায় নালিশ আসত। কিন্তু এমন নয় যে রাস্তাঘাটে মারামারি করে বেড়াতো। সব সময় ওর বিরুদ্ধে খারাপ লোক গুলোই নালিশ নিয়ে আসতো। ওর বাবা কি করতো জানিস, লোকগুলোকে বলতো ছেলেকে বুঝিয়ে বলবে এটা বলে বিদায় করে বাপ ছেলেকে এসে বলতো যা যা করেছিস একদম ঠিক কাজ করেছিস অন্যায় কে কখনোই প্রশ্রয় দিবি না। খুব বড় ধরনের মারামারি বাধতো না বলে ঝামেলা বাড়িতে নালিশ অব্দিই চুকে যেত।
–তার মানে আলআবি ভাইয়া আঙ্কেলের চলে যাওয়াতে খুব কষ্ট পেয়েছে তাই না
–হ্যাঁ। পৃথিবীতে কোন বাপ ছেলে একসাথে সিগারেট খায় বলতো? আলআবি আর ওর বাবা আমার চোখে প্রথম দেখা বাপ ছেলে ছিল যারা দুজনকে একসঙ্গে সিগারেট ফুঁকত। ও ওর বাবাকে হারিয়ে জীবনে সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা খেয়েছে। তার কারণ কি জানিস? ওর বাবাকে………
নিয়াজ ভাইয়া কথাটা সম্পূর্ণ করতে পারল না সঙ্গে সঙ্গে ভাইয়ার ফোন বেজে উঠলো ফোনে কথা বলতে বলতে সোজা নিচে চলে গেল সম্পূর্ণ কথাটা শোনা হলো না। কিন্তু আলআবি ভাইয়ার জন্য এখন খুব খারাপ লাগছে। আমার সাথে আমার মায়ের খুব বেশি স্মৃতি ছিল না। কম সময়ের স্মৃতি গুলো কে আঁকড়ে ধরে আমি আজো মায়ের জন্য কান্না করি। তাহলে আমার থেকেও তো করুন অবস্থা আলআবি ভাইয়ার। কারণ তার পুরো আঠাশ টা বছরের স্মৃতি জড়িয়ে আছে তার বাবার সাথে । আঠাশ বছরের স্মৃতি হয়তোবা এখনো তাকে কুড়েকুড়ে খায়।
এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে আমরা কখনোই নিজেকে সুখী বলে মানতে পারব না যতক্ষণ না অন্য কোন মানুষের কষ্টের কথা শুনতে পাবো। একটা মানুষকে নিজের থেকে দ্বিগুন কষ্টে দেখলে তখনই আমরা উপলব্ধি করতে পারব এই মানুষটার থেকে আমরা ঢের সুখে শান্তিতে আছি।
সময়ের কাটা ঘুরতে ঘুরতে এক সপ্তাহ শেষ করে ফেলেছে। এই এক সপ্তাহের মধ্যে আমার চোখ জোড়া আর আলআবি নামক মানুষটার দেখা পায়নি। ভার্সিটি থেকে বাসায়, বাসায় থেকে ভার্সিটি। এমন করেই এক সপ্তাহ চলে গিয়েছে। না পেয়েছি বর্ষণ সঙ্গীর কোন খবর।
রাতে ঘুমন্ত অবস্থায় মনে হচ্ছে কেউ আমার পায়ের পাতায় সুড়সুড়ি দিচ্ছে। ঘুমের থেকে লাফিয়ে উঠে পরলাম। আমার সুড়সুড়ি একটু বেশিই।তাই ঘুম যতই গভীর থাক না কেন সুরসুরি অনুভব হলেই ঘুম তার চৌদ্দগুষ্টি নিয়ে আমার চোখের উপর থেকে পলায়ন করে।
আমার ঘুম ছুটতেই দেখি আলআবিব ভাইয়া আমার পড়ার টেবিলের সামনে রাখা চেয়ারটা উপর আয়েশি ভঙ্গিতে পায়ের উপর পা তুলে বসে আছেন। তাকিয়ে দেখে হড়বরিয়ে বিছানা থেকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। পাশ থেকে দ্রুত ওড়না টা নিয়ে ভালোভাবে গায়ে জরিয়ে নিলাম।তারপর আলআবি ভাইয়ার দিকে ক্ষুদ্ধ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললাম,,,
–এতো রাতে একটা মেয়ের ঘরে কি আপনার?হুটহাট এভাবে চলে আসেন কেন?
তিনি হুট করে আমার মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়ে পড়লেন। তারপর বললেন,,,
— যাবে আমার সাথে?
রাগের সহিত আমি তাকে বললাম,,,
— রাত-বিরাতে আমি আপনার সাথে কোথায় যাব?আর রাত এখন কয়টা বাজে জানেন আপনি?
–সরি! আজকে ঘড়ি পড়তে মনে নেই। তাই বলতে পারছি না।(আলআবি ভাইয়া)
তার এই কথাটা আমার রাগে ঘি ঢালতে যথেষ্ট ছিল। আমি রাগে গজগজকরতে করতে তাকে আমার দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ইশারা করে বললাম,,,
–এখন রাত তিনটা বেজে দশ মিনিট। এত রাতে আপনার এখানে আসার মতলবটা কি?
–মতলব কিছুইনা।আজ বর্ষণ সঙ্গীর সাথে দেখা হলেও হতে পারতো। যাই হোক ভালো ভাবে নাক ডেকে ঘুমাও আমি চললাম।
আমি আলআবি ভাইয়ার কথা শুনে তড়িৎ গতিতে বলে উঠলাম,,,
–কোথায় নিয়ে যাবেন নিয়ে চলুন। আমি দুই পায়ে দাঁড়া
আমার কথা শেষ হতে না হতেই আলাবি ভাইয়া আমার হাত ধরে আমাকে বারান্দায় নিয়ে আসলেন। আমি তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠলাম,,
— দাঁড়ান আমি একটু পরিপাটি হয়ে নেই। মুখটা অন্তত ধুয়ে নেই।
–কোন দরকার নেই। তোমার বর্ষণ সঙ্গী তোমাকে এই ভাবেই পছন্দ করে। তার কথায় আমি অবাক না হয়ে পারলাম না। কারণ ঘুমিয়ে থাকার ফলে আমার মুখটা একটু ভার ভার হয়ে আছে। সেইসাথে চুলে অগোছালো একটা হাত খোঁপা বাঁধা পরনে আমার কুঁচকে যাওয়া একটা নীল রঙের সুতি থ্রি পিস। এই মুহূর্তে যে আমাকে ভিকারিবেশ থেকে কম লাগছে না তা আমি ভালই বুঝতে পারছি। এই রূপে আবার কেউ কাউকে কিভাবে পছন্দ করতে পারে? আম আলআবি ভাইয়াকে বলে উঠলাম,,,
–তাহলে বোরখাটা পড়ে নেই? বেশি সময় লাগবে না।
আলআবি ভাইয়া আমাকে একটা ধমক দিয়ে বললেন,,
— এই মেয়ে! বললাম না কিছু দরকার নেই। বিয়ে করতে তো আর যাচ্ছো না।
বলেই উনি আমার পিছনে দাঁড়িয়ে পরলেন।তারপর ওড়না টা দুই হাত দিয়ে আমার মাথায় ঘুমটা তুলে দিলেন।তার এই দু দিনের ব্যবহার আমার ঠিক হজম হচ্ছে না।আমাকে আরও অবাক করে দিয়ে উনি সেইদিন যে মইটা বেয়ে উঠেছিলেন সেই মইটা দেখিয়ে বলে উঠলেন,,,
–এখান দিয়ে সাবধানে নামো।
–এখান দিয়ে নামবো মানে? আমাকে কি আপনি পাগল পেয়েছেন নাকি? এখান দিয়ে নেমে যাব টা কোথায়?(আমি)
–পাতালে যাবো।ইডিয়েট একটা।নামতে বলেছি নামো।
তার ফিসফিসে হুংকার শুনে তাড়াতাড়ি করে আমি রেলিং টপকে মইয়ের উপর দাঁড়ালাম। সাহস করে এসে তো পড়েছি কিন্তু এখন নিচের দিকে তাকালেই ভয় লাগছে। তাই কোন প্রকার দ্বিধা না রেখেই আমার সামনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা আলআবি ভাইয়ার হাত দুটো খপ করে ধরে ফেললাম। আমি ভয় পাচ্ছি তা হয়তো উনি টের পেয়েছেন।তাই আমার সঙ্গে সঙ্গে আলআবি ভাইয়া ও আমার হাত ধরে ধরে নেমে আসলন।
নিচে নেমে ঐদিন আলআবি ভাইয়ার উধাও হওয়ার ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম। আসলে যে বরাবর মইটা রাখা সেখানেই একটা ছোট্ট কালো রংয়ের দরজার রয়েছে।এই দরজা দিয়ে ঢুকলে এই বাড়িটার গ্রাউন্ড ফ্লোরের দেখা মিলবে। অর্থাৎ বলতে গেলে এটা এই বাড়ির পেছনের দরজা। এখানে দিয়ে ঢুকে বাড়ির মেইন গেট দিয়ে বের হওয়ার ব্যবস্থা আছে। আমি মনে মনে ভাবছি হয়তোবা আমরা এখান দিয়েই ঢুকবো। কিন্তু আমার ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে আলআবি ভাইয়া আমাকে বললেন,,,
–উঠে পড়ো।
পিছনে ঘুরে দেখি আলআবি ভাইয়া বিলের কিনারে একটা ছোট খেয়া নৌকার উপরে দাঁড়িয়ে আছে। প্রায় সময়ই আমি এমন একটা নৌকা দেখে থাকি এখানে। তবে এই নৌকা টাই দেখি কিনা তা আমার অজানা।নৌকা আমার কোনদিনই বিরক্তির কারন হয়ে ওঠেনি। নৌকায় চড়ে ঘুরতে আমার বেশ ভালো লাগে। তাই এই মুহূর্তে মনে একরাশ উৎফুল্লতা নিয়ে উৎকণ্ঠা হয়ে বলে উঠলাম,,,
–দাড়ান! দাড়ান! আমি আসছি।
যখনই আমি পা বাড়াতে যাব ঠিক তখনই আলআবি ভাইয়া তার হাত আমার দিকে বাড়িয়ে দিলেন। তার হাত বাড়িয়ে দাওয়াতে মনে হলো তিনি আমার দিকে হাত না বাড়িয়ে একরাশ মুগ্ধতা বাড়িয়ে দিয়েছেন। তার আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দাওয়াতে আমার মনে আনন্দেরা উকিঝুকি মারছে। মনের মধ্যে মুগ্ধতা নিয়ে আমিও আমার হাত বাড়িয়ে দিলাম তার হাতের উপর। তার হাতে ভর দিয়ে নৌকায় উঠে পড়লাম। নৌকায় উঠে দেখি আলআবি ভাইয়া আমার দিকেই তাকিয়ে আছেন। তাই তাড়াতাড়ি করে হাতটা সরিয়ে নিলাম। সে যদি এই মুহূর্তে আমার দিকে না তাকাতেন তাহলে হয়তোবা লজ্জা পেতাম না। কিন্তু তার দৃষ্টি আমাকে এখন লজ্জা দিচ্ছে। তাই যেখানে আছি সেখানেই চুপ্টি করে বসে পড়লাম। আলআবি ভাইয়া আমি যেখানে বসে আছি তার থেকে একটু দূরে গিয়ে নৌকার এক মাথায় বসে হাতে বৈঠা নিয়ে নৌকা চালানো শুরু করলেন। তাকে নৌকা চালাতে দেখে বিস্ময় নিয়ে বলে উঠলাম,,,
–আপনি নৌকা চালাতে পারেন?
আলআবি ভাইয়া একটু ভাব নিয়ে বললেন,,,,
–নৌকা থেকে শুরু করে প্লেন পর্যন্ত চালাতে পারি।
তার গুজবে কান না দিয়ে পরিবেশটাকে উপভোগ করতে লাগলাম। পানির ছলাৎ ছলাৎ শব্দ এসে বারবার কানে বাজনা বাজিয়ে যাচ্ছে। সেইসাথে আকাশে মেঘেরা ও একটু পরপর উকিঝুকি মারছে। এই বিলের পানি থেকে অদ্ভুত একটা পানির গন্ধ নাকে এসে ধাক্কা দিচ্ছে।গন্ধটা অসহ্য কর নয় বরং সহ্য কর। হয়তো বা পানির এই গন্ধটা না থাকলে এই মুহূর্তের পরিবেশটা খাপছাড়া হয়ে যেত। ভাবতেও অবাক লাগে যে বিলের পানিতে আজ নৌকায় চড়ে অজানা গন্তব্যে যাচ্ছি, সেই বিলের পানি ই বর্ষা শেষে নেই হয়ে যাবে। হঠাৎ করে একফোঁটা পানি আমার হাতের উপর পড়তেই চারপাশে তাকিয়ে দেখি টিপটিপ বৃষ্টি শুরু হয়েছে। এই বৃষ্টি আমাদের শরীর ভেজানোর কোনো ক্ষমতা রাখেনা। খুব স্বল্প মাত্রায় ঝিরঝিরে বৃষ্টি হচ্ছে। এর মাঝে কয়েকবার আমার আর আলআবি ভাইয়ার মধ্যে চোখাচোখি হয়েছে। তবে যতবারই আমি তার দিকে টের চোখে তাকিয়েছি ততোবারই দেখেছি সে আমার দিকেই তাকিয়ে আছে।
কিছু সময় অতিবাহিত করে আমরা বিলটা পাড়ি দিয়ে একটা মেইন রোডে এসে উঠলাম। পূর্বের ন্যায়ই আমার হাত ধরে আলআবি ভাইয়া নৌকা থেকে আমাকে নামতে সাহায্য করলেন। এতক্ষণে বৃষ্টি বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তবে আবার যে দেখা দিবে না তার কোন নিশ্চয়তা নেই। রাস্তার ধারে দেখতে পেলাম আলআবি ভাইয়ার সেই পুরনো রয়েল এনফিল্ড বাইক টা কারো অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে।
বাইকের কাছে এগিয়ে গিয়ে ভাইয়া বলে উঠলো,,,
— এখন অনেকটা পথ পাড়ি দিব। অনেক দূর পর্যন্ত যেতে হবে। তোমার কিছু লাগলে অথবা কোন সমস্যা থাকলে বলতে পারো।
আমি তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললাম,,,
— আমার বর্ষণ সঙ্গীর জন্য যত দূর যেতে হয় যাব।
আমার বলা কথাটা শেষ হতেই আলআবি ভাইয়া বাইকে ঝুলে থাকা হেলমেটটা পড়ে নিলেন। আমাকে তার পিছনে উঠতে বললে আমিও উঠে পড়লাম। আমি বাইকে উঠে বসতেই আলআবি ভাইয়া বাইক স্টার্ট দিলেন। চলতে লাগলাম আমার অজানা আর আলআবি ভাইয়ার জানা গন্তব্যে। আশেপাশের দোকানপাট সব বন্ধ। মাঝে মাঝে ছোট ছোট চায়ের টং গুলোর দু একটা খোলা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। রাস্তাঘাটে মানুষ নেই বললেই চলে। রয়েছে দূরপাল্লার কিছু ট্রাক। হলুদ ল্যাম্পপোস্টের আলোতে আমার আর আলআবি ভাইয়ার জামার আসল বর্ণ পাল্টে অন্য বর্ণ ধারণ করেছে। একটা জিনিস খুব সূক্ষ্মভাবে আমার কাছে পরিলক্ষিত হলো।তা হলো আলআবি ভাইয়া আজকে বাইকটা অন্যান্য দিনের তুলনায় একটু জোরে ড্রাইভ করেছেন। যার দরুন আমি নিজের ভারসাম্য সামলাতে না পেরে আমার একহাত আলআবি ভাইয়ার কাধে রেখে বসে আছি। বাতাসের বেগ এসে আমার মাথার ঘোমটা ফেলে দিয়েছে বহু আগে।
চলবে…………
#বর্ষণ_সঙ্গিনী
#হুমাশা_এহতেশাম
#পর্ব_৩১
দীর্ঘ ২ ঘন্টার মতো পথ অতিক্রমের পর আলআবি ভাইয়া তার বাইক টা বন্ধ করে দেন।চারপাশে নীলাভ আলোরা লুকোচুরি খেলায় মেতে উঠেছে।এই আবছা নীলাভ আলোতেই বুঝতে পারছি আলআবি ভাইয়া যে রাস্তায় বাইক থামিয়েছেন তার আশে পাশে বাস টার্মিনাল।আলআবি ভাইয়াকে উদ্দেশ্য করে আমি বলে উঠলাম,,,
— কোথায় এসেছি আমরা?
আলআবি ভাইয়া আমার হাত ধরে হাঁটা শুরু করে আর বললেন,,,
–গেলেই দেখতে পাবে।
কিছুটা আগানোর পর আলআবি ভাইয়া আমার হাত ছেড়ে দিয়ে আমার পাশে দাঁড়িয়ে পরলেন।আমাদের সামনে বিশাল বড় এক জলরাশি। আলআবি ভাইয়া বললেন,,,
–এটা পদ্মা নদী। তুমি এখন মাওয়া ঘাটে।
আশেপাশে পরখ করে দেখি এদিকটায় মানুষের সমাগম খুব একটা নেই। তবে বাস টার্মিনালের ওখানে মোটামুটি মানুষ ছিল।আলআবি ভাইয়া আমাকে ইশারা করে সামনে দেখালেন।সামনে তাকাতেই চোখ জোড়া জুড়িয়ে গেল। ভোর বেলার সূর্যের উদয়ের সময়ে পরিবেশে মৃদু সূর্যালোক ছড়িয়ে পড়ছে। তবে সূর্যটা দিগন্তের নিচে অবস্থান করেছে। সূর্য টা দেখা না গেলেও সূর্যের অবস্থান কোনদিকে তা বুঝিয়ে দিচ্ছে তার লালাভ আলোর রেখা।সূর্যের একাংশ দিগন্তের উপরে চলে আসছে এবং তা ধীরে ধীরে পরিষ্কার হয়ে উঠছে। অজান্তেই ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসির ছাপ পরলো।এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি রক্তিম আভার দিকে।সময় যত অতিবাহিত হচ্ছে রক্তিম বৃত্ত ততই তার রূপ স্পষ্ট করে তুলছে।আশেপাশে থেকেই কানে ভেসে আসছে দক্ষ কন্ঠের মুয়াজ্জিনের আযানের ধ্বনি।আযান শেষ হতেই সূর্য তার পরিপূর্ণ রূপে উদিত হলো।নদীর পানিতে ভেসে উঠেছে সূর্য্যি মামার চোখ ধাঁধান স্বর্নালী অবয়ব।নদী তার চকচকে সোনালী বর্ণের পানিতে দৃষ্টি দিতে বারণ করছে।
হঠাৎ করেই খেয়াল করলাম আমার ঢিলে হাত খোঁপা টা সম্পূর্ণ রূপে খুলে গেছে।মনে হচ্ছে কেউ আমার চুলে হাত গলিয়ে দিয়ে খোঁপা করছে।ঘাড়ে একটা বলিষ্ঠ হাতের ছোঁয়ায় আমি খানিক কেঁপে উঠলাম।পাশে লক্ষ্য করতেই দেখি আলআবি ভাইয়া নেই।বুঝতে দেরি হলো না আমার পিছনে কে দাঁড়িয়ে খোঁপা করছে।খোঁপা করা শেষ হতেই মনে হলো খোঁপায় কিছু একটা গুঁজে দেওয়া হচ্ছে।
মিহি একটা কন্ঠ এসে কানে বাজতেই শুনতে পেলাম,,,
–হবে কি আমার সারাজীবনের বর্ষণ সঙ্গিনী?হবে কি তোমার বর্ষণ সঙ্গীর #বর্ষণ_সঙ্গিনী?
কথাটা কর্ণপাত হতেই আমার চোখ জোড়া অশ্রুসিক্ত হয়ে আসতে চাইল। এই মুহূর্তে কারো মুখে কোন কথা নেই। সেই একই ভঙ্গিমায় দুজন দাঁড়িয়ে আছি। হৃদপিণ্ড ক্রমশ তার ধুকধুক শব্দের বাজনা বাজিয়ে যাচ্ছে। এই মুহূর্তেটার অনুভূতি আমার কাছে অবর্ণনীয়। পৃথিবীর কোনো ভাষাতেই প্রকাশ করে বোঝাতে পারবোনা কতটা সুখ মনে দোলা দিচ্ছে। চোখের অশ্রুবিন্দু কে আর ধরে রাখতে পারলাম না। দরদরিয়ে গাল বেয়ে পানি পড়তে লাগল।একেই বুঝি বলে সুখের কান্না। এই মাহেন্দ্রক্ষণেরই তো অপেক্ষায় ছিলাম আমি।
দুই বছর ধরে যাকে আমি ভালবেসেছি তাকে আমি চিনব না কি করে?আমার বর্ষণ সঙ্গীকে তো চিনে গিয়েছিলাম সেদিনই যেদিন তার অফিসে বসে শাল সেলাই করেছিলাম।আমি এতটাও বোকা নই (যতটা হুমাশার পাঠক পাঠিকারা ভাবে)।সেদিন তার অফিসে তার হাতের সেই গোটা গোটা লেখা আমাকে বলে দিয়েছিল কে আমার বর্ষণ সঙ্গী। হাতের লেখা এক ব্যক্তির সঙ্গে আরেক ব্যক্তির মিল থাকতেই পারে তবে অবিকল একই রকমের হয় না। সেদিন আমি আমার বর্ষণ সঙ্গীর হাতের লেখা চিনতে মোটেও ভুল করিনি। ওইদিনই ভেবে নিয়েছিলাম আলআবি ভাইয়াই আমার অদেখা বর্ষণ সঙ্গী। তবে তার আচার-আচরণে খুব একটা নিশ্চিত হতে পারছিলাম না। আর তাকে পরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়ার সুযোগও পাচ্ছিলাম না। ঠিক সেই সময়ে নিয়াজ ভাইয়া যখন বলে আমাকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে তখনই সঠিক সুযোগটা পেয়ে যাই। ইচ্ছে করেই তার দেয়া শাড়িটা পড়ে যাই। সেদিন ভেবে নিয়েছিলাম যদি আলআবি ভাইয়া আমাকে একটু পরিমাণ হলেও ভালোবাসেন তাহলে ঠিকই আসবেন। আর সে এসে তার বোকামির পরিচয় ও দিয়েছেন। আগে নিশ্চিত না থাকলেও সেদিন নিশ্চিত হয়ে যাই় আমার বর্ষণ সঙ্গী আর কেউ নয় বরং আলআবি ভাইয়াই।
তার হাতের লেখা দেখার পর থেকেই যতবার তার সঙ্গে দেখা হয়েছে ঠিক ততবারই আমার মন বলেছে এই বুঝি সে বলবে “আমি ই তোমার বর্ষণ সঙ্গী”কিন্তু সে বলেনি। তার মুখ থেকে শোনার অপেক্ষায় ছিলাম আমি। আজ তা সার্থক হলো। কিন্তু তার এত অভিনয় এর পেছনের কাহিনী আমার জানা নেই। শুরু থেকেই তিনি অভিনয় করে গিয়েছেন। তাকে তো এমনি এমনি ছাড় দিব না। তার অভিনয়ের পালা শেষ হলেও এবার আমার অভিনয়ের পালা শুরু।
নিজের মনের সঙ্গে যখন কথাগুলো বলছিলাম ঠিক তখন দেখি আলআবি ভাইয়া আমার মুখোমুখি দাঁড়ানো। তিনি কখন আমার সামনে এসেছে তা ঘুণাক্ষরেও টের পাইনি। আমার সামনে দাঁড়িয়েই তিনি তার মোবাইল টা আমার সামনে তুলে ধরে বলে উঠলেন,,,
–কেমন হয়েছে?
আমি মোবাইলের স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখি একটা ছবিতে খুব স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে আমার খোঁপায় একটা বেলি ফুলের মালা নিপুণ হাতে গুঁজে দেওয়া। বেলি ফুলের মালাটা দেখে এতক্ষণে বুঝতে পারলাম কোথা থেকে বেলিফুলের ঘ্রাণের সুবাস আসছিল। মনের মধ্যে খুব খুশি খুশি লাগছে। আলআবি ভাইয়াকেও অনেক উৎফুল্ল দেখাচ্ছে। মুখে হাসি আনতে গিয়ে ও আনলাম না।মুখের মধ্যে গম্ভীরতা টেনে আনলাম।আলআবি ভাইয়া আমাকে কথা না বলতে দেখে মোবাইলটা তার পাঞ্জাবির পকেটে গুঁজে বললেন,,,
–আমার উত্তর কিন্তু এখনো পাইনি?
–আমি আপনাকে বর্ষণ সঙ্গী হিসেবে মানি না।এই দেড় বছরে না ছিল আপনার কোন খোঁজ, আর না নিয়েছেন আমার কোনো খোঁজ।আজ হুট করে এসে বলছেন আমি তোমার বর্ষণ সঙ্গী। বললেই হলো নাকি?(আমি)
আমার কথায় তার মধ্যে কিছুটা রাগের আভাস দেখতে পাচ্ছি। উনি জোরে কথা বলতে গিয়েও বললেন না। তার বদলে আমার হাত দুটো তার হাতের মুঠোয় নিয়ে বলতে লাগলেন,,,
— তুমি কি আমাকে অবিশ্বাস করছো? তাহলে বলতে পারো। আমি তোমাকে প্রমান দেখাতে পারি যে আমিই তোমার বর্ষণ সঙ্গী।
কথাগুলো শেষ করে পাঞ্জাবির পকেট এ পায়জামার পকেট এ হাতাহাতি শুরু করলেন। তাকে দেখে অনেক উত্তেজিত মনে হচ্ছে। পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে, আমাদের সেই পুরনো মেসেজগুলো বের করে আমার সামনে ধরে বলতে লাগলেন,,,
–দেখো এই যে এগুলো, এগুলো তো মানবে। আমাদের পুরনো মেসেজ।
তারপর পুনরায় মোবাইল নিয়ে কিছু ছবি বের করলেন। আমার সামনে ধরতেই দেখলাম তার পাঠানো সব চিঠিগুলোর ছবি। আলআবি ভাইয়া উৎকণ্ঠা হয়ে বললেন,,,
–এগুলো ?এগুলো তো মানবে। তোমাকে পাঠানো সব চিঠির ছবি।
— আমাকে বোকা মনে করেছেন? আজকাল ফেক মেসেজ বানানোর অনেক অ্যাপস আছে। আর আপনিও তো বলেছিলেন বর্ষণ সঙ্গীর সাথে আপনার আত্মার সম্পর্ক। তার মানে নিশ্চয়ই সে আপনার ভাই বা বন্ধু বা কোনো আত্মীয়-স্বজন। তার থেকেই হয়তো ছবিগুলো নিয়েছেন। আমি আপনাকে এই মুহূর্তে মানতে পারছি না(আমি)
–আমিই তোমার বর্ষণ সঙ্গী৷ ট্রাস্ট মি!।বিশ্বাস কেন করছ না।ড্যাম ইট!
লাস্টের কথাটা তিনি আমার হাত ধরে ঝাকিয়ে চিৎকার করে বললেন। আহা! মনে কি যে শান্তি অনুভব হচ্ছে বলে বোঝানো যাবে না। চেয়েছিলাম একদিন সে এই ভাবেই চিৎকার করে বলবে আমিই তোমার বর্ষণ সঙ্গী। এই মুহুর্তটা তার কাছে বিষাদ ময় হলেও আমার কাছে জীবনের সবচাইতে প্রিয় অনুভূতির মুহূর্ত। আশেপাশে মানুষের আনাগোনা বেড়েছে। বেড়েছে বলতে গেলে ভুল হবে। বলতে হবে প্রচুর পরিমানে বেড়েছে। প্রায় প্রত্যেকেই একবার হলেও আমাদের দিকে তাকাচ্ছে। ব্যাপারটা দেখতে শোচনীয় লাগছে না। তাই তার থেকে হাত ছাড়িয়ে বললাম,,,
–সকাল হয়ে গিয়েছে।আমাকে বাসায় দিয়ে আসুন
আমার কথা শেষ হতে না হতেই তিনি আমার হাত খুব শক্ত করে ধরে হাটতে লাগলেন। এমন ভাবে হাতটা ধরে রেখেছেন মনে হচ্ছে তার ভিতরে সকল ক্ষোভ আমার এই হাতের উপরে ঝারছেন। কয়েক কদম এগিয়ে তিনি থেমে গেলে। পিছনে আমার দিকে ফিরে একটা সাদা রঙের মাস্ক পরিয়ে দিলেন। তারপর পুনরায় আবার হাত ধরে হাটতে লাগলেন। এরমধ্যে আমাদের আর কোন কথা হলো না।
তার বাইকটা যেখানে ছিল সেখানে এসে আমার হাতটা ছেড়ে দিলেন বাইকে উঠে বসে আছেন কিন্তু আমাকে ওঠার জন্য বলছেন না। বুঝতে পারছি মশাইয়ের রাগ এখন সাত আসমানে। আমিও কিছু না বলে বাইকে উঠে বসলাম। বাইক স্টার্ট হতেই ভয়ে সিঁটিয়ে গেলাম। বাইকে চড়েছি নাকি রকেটে চড়েছি তা বোঝা মুশকিল। হাত দিয়ে আলআবি ভাইয়ার পাঞ্জাবির কাঁধে অংশ কোনমতে চেপে ধরে বসে রয়েছি। একটু পর অবস্থা বেগতিক দেখে দুই হাত দিয়ে তার কাঁধের পাঞ্জাবি খামচে ধরে বসে রইলাম। রাস্তাঘাটে মানুষের সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে যানবাহনের ভীড়। এই মুহূর্তে আমার একটা হাইওয়ে দিয়ে ছুটে চলেছি। আগের তুলনায় বাইক এখন কিছুটা ধীর গতিতে চলছে। কিন্তু একে ও স্বাভাবিক গতি বলা যাচ্ছে না। প্রায় আধা ঘন্টা থেকে পৌনে এক ঘণ্টার মতো সময় হবে আমরা বাইকে উঠেছি। হঠাৎ করেই দেখি আলআবি ভাইয়া বাইক ঘোরাতে শুরু করেছেন। অর্থাৎ আবার পিছনের রাস্তায় ব্যাক করছেন। পুনরায় আগের রাস্তায় যেতে দেখে আমি তড়িৎ গতিতে বলে উঠলাম,,,
–আপনি কোথায় যাচ্ছেন আবার? এই রাস্তা দিয়েই না আমরা আসলাম?
আমার প্রশ্নের পৃষ্ঠে কোন জবাব পেলাম না। কিন্তু আমি থেমে থাকলাম না। তাকে আবারো জিজ্ঞেস করতে লাগলাম। অনেক সময় ধরে তাকে জিজ্ঞেস করার পরেও কোন জবাব পেলাম না। তখন আমি নিজে থেকেই দমে গেলাম।
এতক্ষণ বাসার চিন্তা না হলেও এখন হচ্ছে। কারণ এখন সকাল সাড়ে ছয়টা।আর কিছুক্ষণ পরেই ভাবী এসে আমার রুমে ডাকাডাকি শুরু করবে। তখন তো আমাকে পাবেনা। আর আমি বাসায় গিয়েই বা কি বলবো? ভেবেছিলাম সকাল-সকাল বাসায় পৌঁছে যাব, কিন্তু এখন পড়ে গেলাম আরেক টেনশনে।
আমার ভাবনার মাঝেই বাইকটা থেমে গেল। আশেপাশে পরখ করে দেখি সারি সারি অনেকগুলো খাবার এর রেস্তোরা। মনে মনে ভাবছি আলআবি ভাইয়ার যখন ক্ষুধা পেয়েছে তখন আগে এখান থেকে খেয়ে নিলেন না কেন? অর্ধেক রাস্তা থেকে আবার কেন ফিরে আসলেন? হাতে টান পড়তে আমার হুশ ফিরে আসলো। এবারও হাতটা একটু জোরে চেপে ধরেছেন। উফ!বুঝি না আমার হাত ধরেই কেন সারাক্ষণ ওনার টানাটানি করতে হবে?
একটা রেস্তোরাঁর ভেতরে যেতেই পেটের ক্ষুধা থেকে মনের ক্ষুধা তরতর করে বেড়ে উঠলো। তার কারণ হলো একটাই- ইলিশ মাছ। চারদিকে মাছির মতো ইলিশ ভাজার ঘ্রাণ ভোঁ ভোঁ করছে।সেই সাথে মানুষের কোলাহল পূর্ণ পরিবেশ তো রয়েছেই।
আলআবি ভাইয়া আমাকে নিয়ে একেবারে শেষের একটা টেবিলে বসে পড়লেন। বসা মাত্রই টেবিল থেকে পানির বোতল নিয়ে ঢকঢক করে খেতে লাগলেন। পুরো বোতলের পানি শেষ করে ফললেন। যখন তিনি পানি খাচ্ছিলেন তখন তার ছোট তিলযুক্ত কন্ঠনালিটা বারবার উপর-নিচ হচ্ছিল।বারবার মনে একটা কথাই ভেসে আসছিল।তা হলো সকল যুবকের ই পানি খাওয়ার দৃশ্য কি এতটা মোহনীয় হয় নাকি শুধু এই মানুষটাই পানি খেলে তার কন্ঠনালি এতটা মোহনীয় লাগে? আমি যখন এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম, তখন তার গম্ভীর কণ্ঠধ্বনি তে আমার সম্বিত ফিরে এলো।
— আমাকে বর্ষণ সঙ্গী হিসেবে নাই মানতে পারো। আলাবি হিসেবেও নাই মানতে পারো। কিন্তু নিজের স্বামী হিসেবে মানতে হবে এই কথাটা নিজের মগজে ভাল করে গেঁথে নাও।কজ, এক কথা আমি তোমাকে বারবার বলব না।
চলবে…………
[বিঃদ্রঃ গল্পটি সম্পূর্ণরূপে কাল্পনিক। অনুগ্রহ করে বাস্তবিক অর্থ খুজতে গিয়ে বিভ্রান্ত হবেন না আর লেখিকা কে ও বিভ্রান্ত করবেন না]