বর্ষণ সঙ্গিনী পর্ব-২৩ + বোনাস পর্ব

0
1489

#বর্ষণ_সঙ্গিনী
#হুমাশা_এহতেশাম
#পর্ব_২৩

আমার কল্পনা জুড়ে
যে গল্পেরা ছিলো
আড়ালে সব লুকোনো
সেই গল্পেরা সব

রঙিন হল পলকে
তোমাকে হঠাৎ পেয়ে যেন
প্রেম তুমি আসবে এভাবে
আবার হারিয়ে যাবে ভাবিনি
আজও আছে সেই পথ শুধু নেই তুমি

হঠাৎ করেই গানটা বন্ধ হয়ে গেল। পিছনে ঘাড় ফিরিয়ে দেখি সাদু এসেছে। এসেই বলতে লাগলো,,,

— ওই তোর যে এক দিন বাদে পরীক্ষা সেই খবর আছে? আর এই জায়গায় এমন কাবির সিং এর ফিমেল ভার্সন হইয়া বইয়া আছোস কেন?

— জানি তো পরশু দিন পরীক্ষা।নোট আনছোস?(আমি)

সাদু মূলত এসেছে আমাকে নোট দেয়ার জন্য। পড়ন্ত বিকেলে লাল আভার চাদর যখন আকাশকে মুড়ে নিয়েছে তখন আমি আর সাদু একসাথে টুকটাক কথা বলছিলাম।কথাচ্ছলে ও আমাকে আসলে হাসাতে চাচ্ছে। হঠাৎ করে সাধু বলে উঠলো,,,

–জুঁই তোকে একটা কথা বলি, ঘুমন্ত মানুষকে জাগানো যায় তবে যে জাগ্রত অবস্থায় ঘুমিয়ে থাকে তাকে জাগানো যায় না।(সাদু)

–কি বলবি স্পষ্ট বল। (আমি)

–যে নিজে থেকে ধরা দেয় না তাকে ধরতে যাবি কেন?

সাদু কথা সত্যি ই তো বলেছে। যে নিজে থেকে ধরা দেয় না তাকে তো কখনো ধরা যায় না।আরও কিছু সময় সাদুর সাথে কথা বলে ওকে বিদায় দিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে পরলাম।

ঘরে থাকা একটা ঘড়ির সময় আমি ঘুরাতে পারবো। কিন্তু পৃথিবীর সময়ের কাঁটা ঘুরাতে পারবো না। পৃথিবীর সময়ের কাঁটার সাথে সাথে বদলেছে মানুষ, বদলেছে পরিস্থিতি, বদলেছে জীবনের চাঁকা। প্রকৃতি এক ঋতু পরিবর্তন করে এনেছে আরেক ঋতু। সময় পরিবর্তন করে এনেছে আরেক সময়। চিরচেনা বর্ষা পার হয়ে এসেছে আরেক নতুন বর্ষা। সময় পরিবর্তন হয়ে আমাকে এগিয়ে এনেছে দেড় বছর সামনে। হ্যাঁ, সময়ের চাঁকা ঘুরতে ঘুরতে আমার জীবনের দেড় বছর অতিক্রম হয়ে গিয়েছে। সবকিছু পাল্টে গিয়েছে এই দেড় বছরে। শুধু পাল্টায়নি আমার সত্তায় নিহিত অনুভূতিগুলো।

সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত আমি আমার প্রিয় মানুষটার দেখা পাইনি। তাকে দেখা তো দূরের কথা তার কোন খোঁজ পর্যন্ত পাইনি। আজ মনে হচ্ছে উনিশের কোঠায় পা দিয়ে জীবনের সবচেয়ে বিভীষিকাময় দিনগুলো টেনে এনেছি। সেদিন ছাঁদে না যেয়ে আমাকে যেতে হয়েছিল হাসপাতালের বেডে। সিঁড়িতে পড়ে যাওয়ার পরে আমি মূর্ছা যাই।৭৮ ঘন্টা অতিক্রম করে যখন আমি সজ্ঞানে ফিরি তখন নিজেকে হাসপাতালে আবিষ্কার করি। জ্ঞান ফেরার পর ডান হাতে, ডান পায়ে আর মাথায় ব্যান্ডেজ দেখতে পাই। জানতে পারি আমার ডান হাতের কব্জি আর কনুইয়ের মাঝ বরাবর হাড় ভেঙে গেছে। সেই সাথে পায়ের গোড়ালি থেকে আঙ্গুলের মাঝ বরাবর থাকা দুইটা হাড্ডি ভেঙ্গে গেছে। মাথায় বেশ ভাল ভাবে আঘাত পেয়েছি যার দরুন প্রায় তিন দিনের বেশি সময় লেগেছে আমার জ্ঞান ফিরতে।

আমি ছাঁদে যাওয়ার প্রায় তিন ঘন্টার মত সময় অতিক্রম হওয়ার পরেও যখন বাসায় ফিরছিলাম না তখন নাকি সাদু ছাঁদের দিকে আসে আমাকে খুঁজেতে। সিঁড়িতে এসেই আমাকে অবচেতন অবস্থায় পায়। আর তারপরেই হাসপাতালে আনা হয়। নিয়াজ ভাইয়া ওকে অনেক জিজ্ঞেস করেছে আমি ওই সময়ে ছাঁদে কি করছিলাম। তবে ওর থেকে কোন উত্তর পায়নি।ও শুধু এতোটুকুই বলেছে “জুইঁয়ের জ্ঞান ফেরার পর ও নিজে মুখে বললেই আপনি শুনতে পাবেন”।

হাসপাতাল থেকে আট দিন পর বাসায় এসে আমি যা শুনি তা শোনার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। বাসায় আসার পরের দিন বিকেলে সাদু এসে বলে,,,

–জুইঁ আলআবি ভাইয়ার আব্বু ইন্তেকাল করেছে।

আমি উত্তেজিত হয়ে বললাম,,,

— কি? কিভাবে? আর কবে হলো?(আমি)

— তোর জন্মদিনের দিন রাতে। (সাদু)

–এতগুলো দিন হয়ে গেল আর আমি জানালাম না। কেমন তোরা? আমাকে একটু বলবি না?(আমি)

— তুই তখন অসুস্থ ছিলে। আর তোর ব্রেনে চাপ দিতে মানা করেছে ডাক্তার।(সাদু)

— কিন্তু তাই বলে এরকম একটা খবর না দিয়ে পারলি কিভাবে?(আমি)

— বোঝার চেষ্টা কর তুই। ওই মুহূর্তে বলাটা উচিত মনে হয়নি। (সাদু)

–কেমন আছেন ভাইয়া? (আমি)

–সে তো এতদিন ধরে আউট ওফ কন্টাক্ট।
(সাদু)

সেদিনের আউট অফ কন্টাক্ট আজ পর্যন্ত শেষ হয়নি। তার কোন হদিস কারো জানা নেই। সজল ভাইয়া আর নিয়াজ ভাইয়া তাকে একটা মাস ধরে খুঁজেছে কিন্তু তার ছায়ারো দেখা পায়নি কেউ। শুনেছি তার আম্মু নাকি মানসিকভাবে খুব একটা ভালো নেই।

এই দেড় বছর আমার জীবনেও পরিবর্তন এসেছে। আর তা হলো ভার্সিটির ওয়ান ইয়ার লস গিয়েছে। আমার জন্মদিনের আগে ভার্সিটির দ্বিতীয় বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা চলছিল। কেবলমাত্র একটা পরীক্ষা দিয়েছিলাম। ওই একটা পরীক্ষার পরে আমাদের ষোল দিনের একটা গ্যাপ ছিল। অর্থাৎ ষোল দিন পর আরেকটা পরীক্ষার ডেট ছিল।এই ষোল দিনের মাঝখানে আমার জন্মদিন পরে। আর তারপর সব ওলট-পালট হয়ে যায়। পরীক্ষা দিতে পারিনি আমি। এখনো দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী আমি আর সাদু তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী।

আমি সুস্থ হয়ে ভাইয়া আর ভাবি কে আমার ছাঁদে যাওয়ার কারণ বলে দেই। ভাইয়া আগে থেকেই এই সম্পর্কে কিছুটা অবগত ছিল বলে তার কাছে আর কোন কিছুই লুকায়িত রাখি নি। তবে বাবা এই সবের কোন কিছুই জানেনা।

সময় যেমন আমার কাছ থেকে দেড়টা বছর নিয়ে গিয়েছে ঠিক সেইভাবে আমার বর্ষণ সঙ্গী কেও নিয়ে গিয়েছে। তাকে ভালোবাসি কিনা বলতে পারবো না। তবে আমার মনের ভালোলাগার জায়গায় পুরোটা জুড়ে সেই ছিল। যদি কাউকে ভালোবাসতে হয় কখনো তবে তাকেই ভালবাসবো। একটা সময় যেই ম্যাসেজ গুলো আমার বিরক্তির কারণ ছিল এখন সেই ম্যাসেজ গুলো আমার একাকিত্বের সঙ্গী। প্রতিদিন রাতে তার পুরনো ম্যাসেজ পড়ে ঘুমাতে যাই। প্রতিদিন আমাদের যেমন দাঁত ব্রাশ করা রুটিন হয়ে গিয়েছে তেমন তার ম্যাসেজ পড়াটাও আমার রুটিন হয়ে গিয়েছে। বারান্দায় যখন একা থাকি তার গাছ গুলো আমাকে সঙ্গ দেয়। দুইদিন একদিন পর পরই রাতে লুকিয়ে লুকিয়ে ঘরের মধ্যে একা একা তার দেওয়া শাড়িটা পড়ে বসে থাকি। তার দেওয়া চুড়িগুলো প্রতিদিন রুটিন করে পড়ি। একদিন সাদা, একদিন কালো, একদিন লাল,একদিন নীল, একদিন হলুদ একদিন সবুজ এভাবেই কাটে আমার দিন। আমার প্রতিটা দিন শুরু হয় তার নাম নিয়ে। প্রতিটা দিন শেষ হয় তার নাম দিয়ে। প্রতিটা মোনাজাত শুরু হয় তার নাম নিয়ে প্রতিটা মোনাজাত শেষ হয় তার নাম দিয়ে।তার প্রতি আমার এমন অনুভূতি গুলোর নাম ভালো লাগাও দিতে পারে না আবার ভালোবাসাও বলতে পারি না। বারবার অনুভূতিগুলোর মানে খুঁজতে গেলে দোটানায় পড়ে যাই।

পরশুদিন থেকে আমার দ্বিতীয় বর্ষের সেই না দেওয়া ফাইনাল পরীক্ষা শুরু। সেই জন্যই সাদু নোট দিতে এসেছিল। আজ রাতেও পড়াশোনা শেষ করে তার পাঠানো চিঠি গুলো নিয়ে বসে আছি। পাশেই চুড়িগুলো রাখা। বসে বসে তার প্রথম দিনের পাঠানো সেই চিঠিটা পড়লাম। আজ দেড় বছর পর্যন্ত পড়ে আসছি। এক মুহূর্তের জন্যেও আমার কাছে মনে হয় না চিঠিটা পুরনো। যতই পড়ি ততই মনে হয় নতুন চিঠি পড়ছি। চিঠিটা পড়ে শুকনো বেলি ফুলের মালা হাতে নিয়ে ছুঁয়ে দেখলাম। তারপর একমুঠো সাদা চুরি আর একমুঠো নীল চুড়ি মিলিয়ে হাতে পড়ে নিলাম। নীল রঙটা তার পছন্দের ছিল।বারান্দায় গিয়ে হাত নেড়েচেড়ে একা একাই চুড়ির রিনরিনে আওয়াজ তুলে তা শুনতে লাগলাম। একটু পর রুমে এসে চুড়িগুলো খুলে ঠিকঠাকভাবে রেখে সবকিছু গুছিয়ে শুয়ে পড়লাম।

মাঝখানে এক দিন চলে গেল। আজ পরীক্ষা দিতে ভার্সিটিতে যাবো।হালকা নীল আর সাদার মিশ্রনে একটা থ্রি-পিছ পড়ে নিলাম। সাথে নীল রঙের একটা হিজাব পড়লাম। গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সাদুর জন্য অপেক্ষা করছি।ওর আমাদের বাসার সামনে আসার কথা। কিছু সময় দাঁড়ানোর পরেই সাদু এসে পড়ে।এসেই বলতে লাগে,,,

–কিরে এত আগে আগে দাঁড়াইয়া আছোস কেন? তোর জন্য তো আর পাত্র দেখতে যাইতাছি না।এতো তাড়া কিসের?

— আচ্ছা এরপর থেকে লেট করে আসবো।(আমি)

বলেই একটা রিকশা ডেকে তাতে চড়ে বসলাম। সাদু এসে আমার পাশে বসলো। রিকশায় পাঁচ মিনিট যাওয়ার পরে হঠাৎ সাদু বলে উঠলো,,,

— তুই আর আগের মত আমার সাথে ঝগড়া করছ না।

আমাদের মধ্যে আর কোন কথা হল না। রিক্সা এসে ভার্সিটির মেইন গেটের সামনে থামল। ভাড়া মিটিয়ে গেট দিয়ে ক্যাম্পাসে ঢুকে মাঠ পেরিয়ে পরীক্ষার হলে চলে আসলাম। ভালো ভাবে পরীক্ষা টা দিলাম। শেষ হতে হতে প্রায় সাড়ে চার টার বেশী বেজে গেল। নিচে নেমে ভবনের সামনে দাঁড়িয়েই সাদু কে কল করলাম। সাদু বললো ও ক্যান্টিনে আছে এখনি এসে পড়বে। একটু পরে হাতে দুইটা চিপসের প্যাকেট নিয়ে আমার সামনে হাজির হলো।

আমরা যে ভবনের সামনে দাড়িঁয়ে আছি তার সোজাসুজি আমাদের ভার্সিটি থেকে বের হওয়ার মেইন গেট। পকেট গেটটা খুলে হা করে রাখা। গেটের ওপাশের কিছু কিছু মানুষের যাতায়াত দেখা যাচ্ছে। সামনে আগানোর উদ্দেশ্যে পা বাড়ানো মাত্রই দেখতে পেলাম দুইটা ছেলে রাস্তা থেকে দৌড়াতে দৌড়াতে ভার্সিটির পকেট গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। ছেলে দুইটা গেট দিয়ে প্রবেশ এর সাথে সাথে পিছনে আরো একজন ঢুকে পরল। প্রথম দুটো ছেলের গায়ে ছেঁড়াফাটা প্যান্ট আর গেঞ্জি। যাকে অনেকেই ফ্যাশন বলে থাকে। মাথার চুলগুলো আরেকটু বড় হলেই বোঝা যেত না এরা মেয়ে নাকি ছেলে। তবে এদের পিছনে যে লোকটা আসছে সে পুরো শুভ্র রঙে ঢাকা। অর্থাৎ সাদা পাঞ্জাবির সাথে সাদা পায়জামা। তবে গলায় একটা কালো রঙের শাল ঝুলিয়ে রাখা। দেখলেই বোঝা যায় শীত নিবারণের জন্য নয় বরং ফ্যাশনের উদ্দেশ্যে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। দৌড়ে আসার ফলে শালের শেষ দুই প্রান্ত দুইপাশে পতাকার ন্যায় উড়ছে। আমাদের থেকে তাদের দূরত্বটা অনেক বলে কারোই মুখমন্ডল স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। পাশ থেকে সাদু গুঁতো মেরে বলল,,,

— কিরে এইটা কোন কাবির সিং এর আবির্ভাব হলো?

ওর এই কথা বলার কারণ হলো সাদা পাঞ্জাবি পরিহিত লোকটার দূরে থেকে গাল ভর্তি দাড়ি ছাড়া আর কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। মাথার চুলগুলো দৌড়ানোর কারণে উপর-নিচ হচ্ছে।আমি সাদু কে বললাম,,,

–এতো কাবির সিং কাবির সিং করছ কে?

–আরে পরশু তোদের বাসায় যাওয়ার আগে মুভিটা দেইখা তারপর তোদের বাসায় গেছিলাম।এখন শুধু মাথায় কাবির সিং ই ঘুড়ে।(আমি)

সাদুর কথা শেষ হতে না হতেই আমি আর সাদু দুজনেই আতঁকে উঠলাম। কারণ দৌড়ে আসা তিনজনের মধ্য থেকে পেছনের পাঞ্জাবি পরা লোকটা যখন দৌড়ে আসছিল তখন তার পাশ দিয়ে আমাদের ভার্সিটির জুনিয়র ছেলেরা হকিস্টিক নিয়ে খেলতে যাচ্ছিল। ওদের থেকে দুইহাতে দুইটা হকিস্টিক নিয়ে সামনের দুইটা ছেলেকে ইচ্ছেমত মারতে শুরু করলো। মারতে মারতে ক্যান্টিনের সামনে গিয়ে হাতে দুইটা কাঁটা চামচ তুলে নিল। এরপর যে দুইটা ছেলেকে মারছিল তাদের মধ্যে থেকে একজনের কাঁধে কাটা চামচ দুইটা বসিয়ে দিল। তখন পাশের ছেলেটা কাতর কণ্ঠে বলে উঠলো,,,

–কে আপনি ভাই? আমাদের সাথে কি শত্রুতা?আপনাকে তো চিনিও না আমরা। তখন পাঞ্জাবি পরিহিত লোকটা জোরে হুংকার দিয়ে বলে উঠলো,,,

–বড় ভাই!!! নাম মনে রাখিস।

সঙ্গে সঙ্গে ছেলেদুটো লোকটার পা জড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। ওদের কান্নাজড়িত কণ্ঠে ওরা কি বলছে তা একেবারেই অস্পষ্ট। এর মাঝেই আমাদের ভার্সিটির প্রিন্সিপাল স্যার নেমে আসলেন। সঙ্গে একখানা চেয়ার নিয়ে আসলেন। চেয়ার টা যে তার নিজের অফিস রুমে বসার তাতে কোন সন্দেহ নেই। আমাদের প্রিন্সিপাল স্যারের পিছনে পিছনে ছুটছে তার অ্যাসিস্ট্যান্ট। আমাদের প্রিন্সিপাল স্যার দৌড়ে গিয়ে পাঞ্জাবি পরিহিত লোকটার পাশে চেয়ার টা রেখে তার হাত দিয়ে ঝেড়ে মুছে বলতে লাগলেন,,,

— স্যার প্লিজ আগে বসেন। প্লিজ বসেন স্যার।

প্রিন্সিপাল স্যার তার অ্যাসিস্ট্যান্ট কে উদ্দেশ্য করে বললেন,,,

–তোমার কি কোনো আক্কেল নেই তাড়াতাড়ি
ছাতা নিয়ে আসো।

স্যার একথা বলেছেন তার কারণ হলো আকাশ থেকে ছিটছিটে বৃষ্টির জল কনা পড়তে শুরু করেছে।

চলবে………

#বর্ষণ_সঙ্গিনী
#হুমাশা_এহতেশাম
বোনাস পর্ব

আজ শুধু অবাকের উপর অবাক হচ্ছি।আসলে হচ্ছে টা কি তা দেখার জন্য আমি আর সাদু ক্যান্টিনের দিকে অগ্রসর হলাম।আমাদের ভিসি স্যার আর সেই লোকটার কাছে আসতেই আমার মুখ হা হয়ে যাওয়ার উপক্রম।পাশ থেকে সাদু গুঁতো মেরে বলল,,,

–ওই ছ্যামরি আমি যা দেখি তুইও কি তাই দেখছ?

–দেখমু না কেন?আমি চোখ কি মঙ্গল গ্রহে রাইখা আইছি নাকি। তুইও যেখানে আমিও সেখানে। একই জিনিস দেখতাছি আমরা। (আমি)

আমাদের অবাকের কারণ হলো এমুহূর্তে ভিসি স্যার আর সেই লোকটা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে হাসছে।আর এর চেয়েও তাজ্জব বেপার হলো মুখে একগাল দাঁড়ি ভর্তি লোকটাই আমাদের নিখোঁজ হওয়া আলআবি ভাইয়া। কিন্তু একি হাল?এ কেমন বেশভূষা? তার এরূপ বেশে আমরা তাকে চিনতে ভুল করছিলাম। কিন্তু কাছে এসে তাকে পরখ করতে ই আর তার কন্ঠেই তাকে চিনতে পারলাম। সাদু আর আমি একজন আরেক জনের দিকে চাওয়াচাওয়ি করে পুনরায় সামনে তাকালাম। এতক্ষণে এখানে সদরঘাটের জটলা পেকে গিয়েছে। এরমধ্যে আলআবি ভাইয়া আমাদের ভিসি স্যার কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন,,,

–স্যার অভিনয় কিন্তু বেশ ভাল করেন।

বলেই দুজনে আবার হো হো করে হাসতে লাগলেন। তাদের কান্ড কাহিনী দেখে কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না। মনে হচ্ছে আমি নিজেই পাবনা থেকে পালিয়ে এসেছি। আমরা আলআবি ভাইয়ার থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। তবে তার দৃষ্টি সীমানার মধ্যেই ছিলাম। কিন্তু একবারের জন্যেও তার চোখ আমাদের দিকে পরল না।

আমাদের ভিসি স্যার হাসি থামে বলে উঠলেন,,,

— চলেন তাহলে স্যার। এদের কাহিনী অফিস রুমে বসে বসে শুনব।

সাদু ফিসফিসিয়ে আমাকে বলল,,,

–ওই স্যারের মাথার তার কি সবগুলা তার বউ রাইখা দিছে নাকি?

–কোন মোমেন্টে কি কছ তুই? (আমি)

–আরে তার যদি বাসায় নাই রাইখা আসে তাইলে আলআবি ভাইয়ারে স্যার স্যার কইতাছে কেন?(সাদু)

–আমারে দেইখা সবজান্তা শমসের মনে করিছ না।(আমি)

–কিরে হঠাৎ কইরা আবার আগের ফর্মে চইলা আসছোস দেখি।(সাদু)

— তোর মুখটা রে একটু শান্তি দে। একটু চুপ কর। আর নিয়াজ ভাইয়া রে ফোন লাগা।(আমি)

–এহ আমার ব্যালেন্স শেষ হইয়া যাইব।আর তোর ফোন কই?(সাদু)

–এখন যদি তোর মোবাইল থিকা নিয়াজ ভাইয়ার কাছে কল না যায় তাইলে তোর হিজাব টা শেষ হইয়া যাইব। আর আমার ফোনে ব্যালেন্স নাই।(আমি)

–ঠিক আছে। কিন্তু কল দিয়া কি কমু?(সাদু)

–কবি তোর জামাই মরছে।বলদ ছেরি!(আমি)

ওর সাথে আর কথা না বাড়িয়ে ওর থেকে ফোনট নিয়ে নিয়াজ ভাইয়া কে কল করলাম। এরমধ্যে আলআবি ভাইয়া আর ভিসি স্যার চলে গেলেন অফিস রুমে। নিয়াজ ভাইয়া কে গুনে গুনে ৮ বার কল করেও পেলাম না।

ভার্সিটি থেকে মাত্র ১০ মিনিট হেঁটে গেলেই ভাইয়ার অফিসে পৌঁছে যাওয়া যায়। সাদুকে নিয়ে ভাইয়ার অফিসে যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। একটু পরেই ভাইয়ার অফিস ছুটি হয়ে যাবে। এখন ভাইয়ার অফিসে গেলে একসাথে বাসায়ও যেতে পারবো। ভার্সিটি থেকে বের হয়ে কিছুদূর আগাতেই বৃষ্টির তেজ কিছুটা বেড়ে গেল। বৃষ্টি মাথায় করেই সামনে পা বাড়ালাম। ঠিক সেই মুহূর্তেই পিছন থেকে পরিচিত কন্ঠ ভেসে আসল,,,

— এই মেয়ে!

আমি আর সাদু দুজনেই পিছনে ফিরে তাকালাম।দেখি আলআবি ভাইয়া দাঁড়িয়ে আছেন।আমাদের ঘুরে দাঁড়াতেই আমার মুখের উপর তার কালো শাল টা ছুড়ে মারলেন।মুখ থেকে ওটা সরিয়ে যেই না কিছু বলতে যাব অমনি সে আবার বলে উঠলেন,,,

–দুজন ভাগ করে গায়ে জড়িয়ে নিও।আর মনে করে কালকের মধ্যে আমার জিনিস আমাকে ফেরত দিয়ে যেও। আমি ফ্রিতে কাউকে কিছু দেই না।

কথা গুলো বলেই আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই উনি গট গট করে চলে গেলেন। আমার মাথায় একটাই প্রশ্ন শুধু ঘুরছে। উনি এতোদিন কোথায় ছিলেন?আর ওই ছেলে গুলোকেই কেন বা মেরেছেন?আমাদের ভিসি স্যার কে কিভাবে চিনেন?আর চিনলেই বা এতো সখ্যতা কিসের? আমার ভাবনার মধ্যেই আমাদের সামনে একটা রিকশায এসে থামে। রিক্সাওয়ালা বলে উঠেন,,,

— আপুমনিরা যাবেন না?

ভাইয়ার অফিসে পৌঁছাতে রিকশার কোন প্রয়োজনই নেই। কিছুসময়ের রাস্তা মাত্র। তাও রিক্সাওয়ালার জোরাজুরিতে আমি আর সাদু উঠে বসলাম। সাদু আর আমি আমাদের ভার্সিটিতে হওয়া ঘটনাগুলো আর আলআবি ভাইয়াকে নিয়ে গবেষণা করতে করতে ভাইয়ার অফিসের সামনে এসে নামলাম।

অফিসের ভিতরে ঢুকে একজনকে জানালাম আমরা নিয়াজ ভাইয়ার সাথে দেখা করতে এসেছি। লোকটা আমাদের বসতে বলে ভেতরে চলে গেলেন। একটু পর আবার এসে আমাদের ভাইয়ার কেবিনে নিয়ে গেলেন। ভাইয়ার কেবিনে ঢুকে কোনরকম ভনিতা না করে গড়গড় করে বলতে লাগলাম,,,

–ভাইয়া আলআবি ভাইয়া ফিরে এসেছেন। আমাদের ভার্সিটিতেই তাকে দেখেছি।

আমার কথা শুনে নিয়াজ ভাইয়া তড়িৎগতিতে বলে উঠল,,,

–এত তাড়াতাড়ি?

আমি আর সাদু ভাইয়ার কথা শুনে কি বলব বুঝতে পারছি না। আমি বললাম,,,

— কি?

ভাইয়ার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছে। কেমন যেন হাঁসফাঁস করছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে ভুল কিছু বলে ফেলেছে। তখনই ভাইয়া বলে উঠলো,,,

— না মানে। এত তাড়াতাড়ি ওকে পেয়ে যাবো এটা ভাবিনি।

কথাটা বলার সাথে সাথেই ভাইয়ার মুখে চওড়া হাসির রেখা স্পষ্ট দেখতে পেলাম। ভাইয়ার অফিসে কিছু সময় বসে থেকে ভাইয়ার সাথেই আমরা বের হলাম।ভাইয়াকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে আজকে খোশ মেজাজে আছেন।হয়তোবা বন্ধুর খবর পেয়ে খুশি। কিন্তু ভাইয়ার আচরণ কিছুটা অস্বাভাবিক লাগলো। তার মধ্যে খুব একটা উৎফুল্লতা দেখতে পেলাম না। তবে এটুকু বোঝাই যাচ্ছে যে ভাইয়া খুব খুশি হয়েছে। ভাইয়া আমার থেকে আর কোন কিছইু জানতে চাইল না।আমরা তিনজন একটা রিকশায় করে বাড়ির পথে রওনা হলাম।

বাসায় এসে শুধু আলআবি ভাইয়ার ব্যাপারটাই বারবার মাথায় ঘুরছে। তখন খেয়াল করলাম আলআবি ভাইয়ার দেওয়া শাল টা পড়ার টেবিলের পাশের চেয়ারটায় ঝুলছে।ওটা দেখেই একটা কথা মনে পরে গেলো – “দুজন ভাগ করে গায়ে জড়িয়ে নিও”।ব্যাস মাথায় শয়তানি বুদ্ধি আসতে আর সময় লাগলো না।

রাতে খাবার খেয়ে রুমে আসলাম। রিলাক্স এর একটা ঘুম দেব বলে।কালকে কোনো এক্সাম নেই আছে তার পরের দিন। খাবার টেবিলে বসেও সেই এক সংবাদ-“আলআবি ভাইয়া কোথায় ছিল”? আজকের দিনটাই পুরো আলআবিময় হয়ে গিয়েছে। রাতে খাওয়া দাওয়ার পর রুমে এসে আমার সেই পুরনো অভ্যাস চালু হলো।একবার করে সব চিঠি গুলো পড়ে, চুড়ি গুলো থেকে কালো রঙের চুড়ি পরে আবার পুনরায় সব পরিপাটি করে রেখে দিলাম।

চলবে………

[বিঃদ্রঃ গল্পটি সম্পূর্ণরূপে কাল্পনিক। অনুগ্রহ করে বাস্তবিক অর্থ খুজতে গিয়ে বিভ্রান্ত হবেন না আর লেখিকা কে ও বিভ্রান্ত করবেন না]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে