বর্ষণ সঙ্গিনী পর্ব-১৮

0
1554

#বর্ষণ_সঙ্গিনী
#হুমাশা_এহতেশাম
#পর্ব_১৮

আমি মোহতারাম হাবিব রহমান এর পুত্র নিয়াজ রহমান মোহতারাম এনামুল হক এর কন্যা তাসফি হক কে **টাকা দেনমহর ধার্য করিয়া নিজের স্ত্রী হিসেবে স্বীকার করিলাম।

–বলুন কবুল।(কাজী)

–কবুল(নিয়াজ ভাইয়া)

–বলুন কবুল(কাজী)

–কবুল(নিয়াজ ভাইয়া)

–বলুন কবুল (কাজী)

–কবুল(নিয়াজ ভাইয়া)

–আলহামদুলিল্লাহ… আমিন।আপনাদের বিবাহ সম্পন্ন হইলো।(কাজী)

নিয়াজ ভাইয়া আর তাসফি আপুর বিয়ে টা হয়ে গেল।তারাও নতুন এক পবিত্র সম্পর্কে আবদ্ধ হয়ে গেল।অবশেষে তাদের ভালোবাসা পূর্ণতা পেল।

বিয়ে সম্পন্ন হতেই সবাইকে খেজুর দেয়া হলো।তাসফি আপু তো কবুল বলেই কান্নায় ভেঙে পরেছে।একপাশে নিয়াজ ভাইয়া আর আরেক পাশে তাসফি আপুর বাবা বসে তাসফি আপকে সামলাচ্ছে। এভাবে কিছু সময় পরে তাসফি আপুকে স্বাভাবিক করলো।

শুরু হলো আমাদের ছবি অধিবেশন।স্টেজের পিছনের দেয়াল লাল গোলাপ দিয়ে সম্পূর্ণ রূপে ঢেকে রাখা। এক ফোটা ফাঁক ফোকড় নেই। আমরা সকলেই শাড়ি পড়েছি ।তবে কারো সাথে কারো শাড়ির মিল নেই। আমরা সবাই শাড়ির সাথে হিজাব পরেছি। কেবল এই একটা দিকেই মিল আছে। আমরা সব মেয়েরা একসাথে ছবি তুলেছি। ছেলেরা একসাথে তুলেছে। আবার আমার পারিবারিক ছবিও তুলেছি। অদ্ভুত ব্যাপার হলো আমাদের ক্যামেরাম্যান ছিল আলআবি ভাইয়া। তার নাকি ছোটকাল থেকেই ফটোগ্রাফির শখ ছিল। আর সে ছবিও খুব সুন্দর তোলেন।বিদায় বেলায়ও তাসফি আপু কান্না করেছিল।

ঘড়ির কাটায় প্রায় দশটা ছুঁই ছুঁই। বর্তমানে আমি, সাদু, রাফিদা আপু, সার্থক ভাইয়া, সজল ভাইয়া আর আলআবি ভাইয়া কাঁচা মাটির রাস্তা দিয়ে হেঁটে আমাদের বাড়ি যাচ্ছি। আমাদের এভাবে হেঁটে যাওয়ার একমাত্র কারণ হল আমার প্রাণ প্রিয় বান্ধবীর ইচ্ছা পূরণ। আসলে আমারও কিছু টা ইচ্ছে ছিল। আমাদের বাড়ির সামনে যে রাস্তা আছে তার ১০ থেকে ১৫ মিনিট পার হলে বড় রাস্তা অর্থাৎ মেইনরোড পাওয়া যায়। আমরা বরযাত্রীর গাড়িতেই আসছিলাম। সুমনা আপুরা অন্য গাড়িতে ছিল।তখন সাদু বায়না করে ও এখান থেকে হেঁটে যাবে। ওর আর বসে থাকতে নাকি ভালো লাগছে না। ওর সাথে আমারও গাড়িতে বসে থাকতে ভাল লাগছিল না। যখন রাফিদা আপুকে বললাম তখন রাফিদা আপুও আমাদের সাথে হেঁটে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। তখন আমাদের বডিগার্ড হিসেবে নিয়াজ ভাইয়া আলআবি ভাইয়া, সজল ভাইয়া আর সার্থক ভাইয়া কে পাঠিয়ে দিল।

পরিবেশটা খুব শীতল সরু কাঁচা রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি আমরা ছয় জন। রাস্তার দুই ধারে রয়েছে গাছপালা। মাঝে মাঝে দু একটা ডোবা দেখা যাচ্ছে। চারপাশ থেকে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক ভেসে আসছে। রাফিদা আপু আর সার্থক ভাইয়া সকল এর পিছনে গল্প করতে করতে আসছে। ওদের সামনেই সজল ভাইয়া আর সাদু দুজন বিয়ের ছবি ক্যামেরায় দেখতে দেখতে আসছে। সকলের সামনে আমি আর আলআবি ভাইয়া প্রায় দুই হাতের মতো দূরত্ব রেখে হেঁটে যাচ্ছি। হাঁটার একপর্যায়ে পায়ের নিচে কিছু একটা বেধে যাওয়ায় আমি নিজেকে সামলাতে না পেরে পড়ে যেতে নেই। সঙ্গে সঙ্গে পাশ থেকে আলআবি ভাইয়া আমার ডান হাতের বাহু ধরে নেয়। এই যাত্রায় আমি পড়ে যাওয়া থেকে বেঁচে যাই। আমি নিজেকে ঠিক করে ভালো ভাবে দাঁড়িয়ে আলআবি ভাইয়ার দিকে তাকালাম। তখন সে বলে উঠল,,,

–চোখ কোথায় রেখে হাঁটো?

আমি তার কথার প্রতি উত্তরে বলি,,,

–ধন্যবাদ ভাইয়া।

তার দিকে তাকিয়ে দেখলাম কপালে তার কিঞ্চিৎ ভাঁজ পড়েছে। ভ্রু যুগলও হালকা কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।
আমার এরূপ আচরণ বা কথা হয়তোবা তিনি হজম করতে পারেননি। তিনি আশা করছিলেন আমিও কিছু বলবো। কিন্তু তার সাথে এখন ঝগড়া করার কোন মুডই আমার নেই। কারণ এখন আমার খুব পানি পিপাসা লেগেছে। আমাদের কাছে পানিও নেই। বাড়িতে গিয়ে তারপর পানি খেতে হবে। আর তাকে কোন কথা বলেও লাভ হবে না। জানতাম সে হয়তো বলবে “সে সরি”আর না হলে বলত “ধন্যবাদ বল। এটা ম্যানার্স এর মধ্যে পড়ে”। উনি পারে তো শুধু এগুলোই বলতে। তিনি আর কিছু বললেন না আমরা পুনরায় হাঁটা শুরু করলাম।

বাড়ি এসে সকলে লেগে পড়লাম বাসর ঘর সাজানোর কাজে।আমি,সাদু রাফিদা আপু সুমনা আপু,আঁখি, সুমাইয়া,সার্থক ভাইয়া আর সজল ভাইয়া মিলে বাসর ঘর সাজাচ্ছি।সাদু বলে উঠলো,,,

–ইশ কারা যে আমার বাসর ঘর সাজাবে।

–বিয়াই তো করলি না।বাসর ঘরের প্ল্যান ও কইরা ফালাইছোস?(আমি)

–শালিকা তো আমার বড় হয়ে গেছে। (সার্থক ভাইয়া)

–আব্বুর কাছে নাকি রফিক আঙ্কেল বলছিল তার ছেলে ময়লা ওয়ালাদের সিনিয়র পদ পাইছে।মানে এখন তার ছেলের আন্ডার সাতজন ময়লাওয়ালা কাজ করে। (রাফিদা আপু)

–আপু রফিক আঙ্কেল বাসায় বাসায় থেকে ময়লা নেয়। তার ছেলেও তো ময়লা নেয়। তাদের কথা এইখানে টাইনা আনার মানে কি?(সাদু)

— পড়ালেখা শেষ না কইরাই বাসর বাসর করলে তোর কপালে ওই ময়লাওয়ালাই জুটব।(রাফিদা আপু)

রাশিদা আপুর কথা শুনে হাসতে হাসতে আমাদের পেট ব্যথা হয়ে গেল। তখন দরজায় কেউ কড়া নাড়লো। দরজা খুলে দেখি আন্টি মানে সাদুর আম্মু এসেছে দেখার জন্য আমাদের সাজানো হয়েছে কিনা। আমরা সবাই একসাথে বললাম আরেকটু সময় লাগবে।

আন্টি চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর আঁখিকে দিয়ে নিয়াজ ভাইয়া কে বাসর ঘর সাজানো হয়েছে যে রুমে সেখানে নিয়ে আসলাম। নিয়াজ ভাইয়া এসে বলল,,,

— আমার আগে দেখি আমার বউকেই বসিয়ে রেখেছিস। বাহ এত সুন্দর করে ঘর কিভাবে সাজালি তোরা?

আমি বললাম,,,

— হাত দিয়ে।

তখন সাদু নিয়াজ ভাইয়ার সামনে এগিয়ে দুই হাত পেতে বলল,,,

–এবার কী দিবেন দেন?

— তোদের সবাইকে একটা করে এক টাকার চকলেট গিফট করবো নে। এখন যা।(নিয়াজ ভাইয়া)

তখন রাফিদা আপু, সার্থক ভাইয়া, সুমাইয়া, আঁখি সুমনা সহ আমরা রুমের যারা ছিলাম সবাই একসঙ্গে ভাইয়ার সামনে এসে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একেক জন একেক জনের মতো করে টাকা চাইতে লাগলাম। কেউ বলছে টাকা দেও! কেউ বলছে টাকা চাই! কেউ বলছে ভাইয়া চিটিং করবেন না! কেউ বলছে বাসর ঘর কিন্তু আমরা ভেঙে দিয়ে যাব! যে যে যার যার মতো করে প্রলাপ শুরু করলাম। একেবারে মাছের বাজার বানিয়ে ফেললাম। ভাইয়া আর সহ্য করতে না পেরে দুই হাতে কান চেপে চিৎকার করে বলে উঠলো,,,

–স্টপ!!!!

ভাইয়ার এক চিৎকারে আমরা সবাই চুপ হয়ে গেলাম। আমরা সবাই সবার দিকে একবার একবার করে তাকিয়ে আবার ভাইয়ার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম। তখন ভাইয়া বলল,,,

–ওকে ফাইন!টাকা কত লাগবে বল।

তখন সাদু বলে উঠল,,,

— পঞ্চাশ হাজার টাকা মাত্র!

ওর কথা শুনে আমি নিজেই বোকা বনে গেলাম। কারণ আমাদের বাজেট এত ছিল না। ওর কথা শুনে সার্থক ভাই ও বলে উঠলো,,,

— হ্যাঁ! হ্যাঁ! আমাদের পঞ্চাশ হাজার টাকা লাগবে। এর থেকে পয়সাও কম না।

আমাদের কথার মাঝেই আলআবি ভাইয়া ঘরে প্রবেশ করল। ভাইয়াকে দেখেই নিয়াজ ভাইয়া বলে উঠলো,,,

–ভাই আমারে গরু জবাই করার মতন জবাই করতেছে তাড়াতাড়ি বাঁচা।

আলআবি ভাইয়া একবার আমাদের সবার দিকে দৃষ্টি দিয়ে আরেকবার নিয়াজ ভাইয়ার আর দিকে দৃষ্টি দিলেন। তারপর বলে উঠলেন,,,

— বিয়ে তোর!বউ তোর! বাসর তোর! তাড়াও তোর।ওদের তো আর তাড়া নেই। তাই যা চাচ্ছে তা দিয়ে দে।

আলআবি ভাইয়ার কথা শুনে আমাদের খুশি আর দেখে কে। আমরাও সবাই হাসি হাসি মুখ করে নিয়াজ ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে থাকলাম।তখন নিয়াজ ভাইয়া বলল,,,

–আমি কি ব্যাংক নাকি যে পঞ্চাশ হাজার টাকা সাথে নিয়ে ঘুরব।এখন এতো নেই আমার কাছে।

–ওকে তাহলে কত দিবে? (আমি)

–আপাতত বিশ।(নিয়াজ ভাইয়া)

–আচ্ছা আমাদের তবে বিশ হাজারই দে। আজকের রাতটা তাসফির ছবি নিয়ে ঘুমা।বাকি ত্রিশ যেদিন দিবি সেদিন বউটাও নিয় নিস।(সার্থক ভাইয়া)

–শালা তুই বিয়ে করে তো পাড় পেয়ে গেলি।বিয়ে না করলে আমিও ভবিষ্যতে দেখাইয়া দিতাম তোরে।( নিয়াজ ভাইয়া)

— ভাইয়া বাসর রাতটা কি ইনজয় করতে মন চাচ্ছে না আপনার? তারাতারি টাকা টা দেন।(সাদু)

–আগে তোরা অ্যামাউন্ট টা কমা। প্লিজ ভাই আমার বোন আমার এমন করিছ না তোরা।(সাদু)

— আচ্ছা ভাইয়া তাহলে ফিফটি-ফিফটি দাও। পঁচিশ হাজার দাও।( রাফিদা আপু)

— ওকে পঁচিশ হাজার। বাকি পঁচিশ হাজার কিন্তু মাফ।(নিয়াজ ভাইয়া)

–আরে ব্যাটা আগে টাকা বাইর কর তুই। (সার্থক ভাইয়া)

ভাইয়া টাকা বের করে আমাদের দাওয়ার পর আমরা সবাই বের হয়ে আসলাম। আমরা কাঙ্খিত ঘটনার জন্য সবাই দরজার বাইরে অপেক্ষা করছি। আলআবি ভাইয়া সামনে এগিয়ে কেবল ৪-৫ কদম ফেলেছে। সঙ্গে সঙ্গে নিয়াজ ভাইয়ার রুম থেকে বিকট আওয়াজ ভেসে আসলো। আমরা সবাই এটার জন্য প্রস্তুত ছিলাম। তৎক্ষণাৎ দরজা খুলে গেল।

আমরা সবগুলো হাসতে হাসতে ফ্লোরে গড়াগড়ি খাচ্ছি। তখন আলআবি ভাইয়া আমাদের এমন অবস্থা দেখে পিছিয়ে এলেন। এসে নিয়াজ ভাইয়ার রুমে ঢুকলেন। একটু পরে তিনিও বের হয়ে আমাদের মতো দমফাটা হাসি তে ফেটে পড়লেন। এই প্রথম লোকটাকে এত সুন্দর করে হাসতে দেখলাম। হাসলে তার চোখ গুলো ঈষৎ সংকুচিত হয়ে যায়। তিনি শরীর দুলিয়ে দুলিয়ে হাসছেন। মনে হচ্ছে তার সাথে তার চোখ দুটোও হাসছে। এক গালে তার হালকা করে একটা টোল পড়ে। এই রকম দৃশ্য দেখে আমার নিজের হাসিই বন্ধ হয়ে গিয়েছে।মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকলাম তার দিকে।

এর মধ্যেই নিয়াজ ভাইয়া আর সজল ভাইয়া রুম থেকে বেড়িয়ে আসলেন। তাদের দুজনকে দেখে আমাদের হাসির মাত্রা আরও বেড়ে গেল। কারণ নিয়াজ ভাইয়ার পাশে সজল ভাইয়া শাড়ি পরে দাড়িয়ে আছে।সবচেয়ে বেশি হাসি পাচ্ছে সজল ভাইয়াকে শাড়ি পরা দেখে।সজল ভাইয়ার মুখেও অট্টহাসির ছাপ।

আসল কাহিনী হলো সাদুর আম্মু চলে যাওয়ার পরে আমরা সবাই মিলে সজল ভাইয়াকে তাসফি আপুর শাড়ির মতো একটা শাড়ি পড়িয়ে বড় একটা ঘোমটা দিয়ে বিছানায় বসিয়ে দেই। তারপর নিয়াজ ভাইয়া কে ডেকে নিয়ে আসি। এটা আমাদের সকলেরই মিলিত পরিকল্পনা ছিল।

ধীরেসুস্থে আমাদের হাসির মাত্রা কমিয়ে নিলাম। এরপর সার্থক ভাইয়া বলল,,,

–ভাই দশ হাজার টাকা হবে?

–এহ্ আমি কি টাকা বিতরণ করতে আসছি। আর তুই যেমনে চাইলি এমনে তো ফকিরও টাকা চায়না।(নিয়াজ ভাইয়া)

— আচ্ছা যা তাইলে এখন কোলবালিশ নিয়ে ঘুমা। তাসফির একটা ছবিও দিবো না তোরে।(সজল ভাইয়া)

–ভাই একটু রহম কর। আজকে এই মুহূর্তে তোদের আমি আর টাকা দিতে পারব না। যা প্রমিস করলাম কালকে তোদের দশ হাজার দিব।

–সত্যি তো?(সুমনা আপু)

–হ।তোদের বাড়ির বিলাইটার কসম।(নিয়াজ ভাইয়)

আমরা সবাই একসাথে বলে উঠলাম,,,

“কি?”

–আব…না মানে দিব দিব। কালকেই দিয়ে দেবো।(নিয়াজ ভাইয়া)

আমরা সবাই এরপর তাসফি আপুকে নিয়াজ ভাইয়ার কাছে রেখে এসে বাড়ির ছাদে উঠলাম।উদ্দেশ্য হলো সবাই মিলে আমরা ছাদে গল্প করব। আমরা ছাদে পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই মোর্শেদ খালুর সেই বিখ্যাত ফোনের রিংটোন কোথা থেকে যেন বেজে উঠল।

চলবে……..……

[বিঃদ্রঃ গল্পটি সম্পূর্ণরূপে কাল্পনিক। অনুগ্রহ করে বাস্তবিক অর্থ খুজতে গিয়ে বিভ্রান্ত হবেন না আর লেখিকা কে ও বিভ্রান্ত করবেন না]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে