বর্ষণের সেই রাতে ❤
পর্ব- ৪
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
.
— একেই বলে আকাশ থেকে পরে খেজুর গাছে আটকে যাওয়া।
ওনার এই কথাটা শুনে আমার বড্ড হাসি পাচ্ছে। কিন্তু এই মুহুর্তে হাসাটা একদমি ঠিক হবেনা। কারণ আমার ক্রাশের রিয়াকশনটা যখন এরকম হতাশ হতাশ তখন আমার রিয়াকশনে হাসি থাকাটা মোটেই শোভনীয় নয়। তাই নিজের এই হাসিটাকে দাবিয়ে রেখে চেহারায় একটুখানি সিরিয়াস ভাব আনার চেষ্টা করে ওনার দিকে তাকালাম। উনি চুপ করে বসে আছেন, এতোক্ষণ কতো কথা বলছিলেন আর এখন একেবারেই চুপ। কিছুক্ষণ নিরবতার পর আমি কিছু বলবো তার আগেই উনি বলে উঠলেন
— সো কালকের হেডলাইন কী হবে?
আমি ভ্রু কুচকে তাকালাম ওনার দিকে। উনি আমার দিকে তাকিয়ে বিরক্তি নিয়ে বললেন
— কী হলো বলো? কালকের হেডলাইন কী হবে? ‘দেখে নিন আদ্রিয়ান আবরার জুহায়েরের রাতের চেহারা’ ‘বর্ষণের রাতে এক মেয়ে জার্নালিস্টের ফ্লাটে রকস্টার আদ্রিয়ান আবরার জুহায়ের ‘ নাকি অন্য কিছু?
আমি এখোনো ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছি আদ্রিয়ানের দিকে। আজব! আমি একজন জার্নালিস্ট ব্যাস এটুকু শুনেই যা খুশি বলে যাচ্ছে? আমার কোনো কথা শোনার কোনো দরকারই মনে করছেনা? ডিসগাসটিং। খুব রাগ লাগছে। ইচ্ছে করছে আচ্ছা মতো কয়েকটা শুনিয়ে দেই। কিন্তু পরে মাথাটা ঠান্ডা করে ভাবলাম যে ওদের সাথে রিগুলারলি যা হয় স্পেশিয়াশি ওর সাথে তাতে ওর এই মুহূর্তে জার্নালিস্ট দেখলে এভাবে রিয়াক্ট করাটাই স্বাভাবিক। তাই মাথা গরম না করে ঠান্ডা মাথায় ব্যাপারটা হ্যান্ডেল করতে হবে। আমাকে এভাবে চুপ থাকতে দেখে উনি একটু জোরেই বললেন
— কী হলো বলো? হেডলাইন কী দেবে? মানে কী লিখলে তোমাদের খবরটা বেশি বিক্রি হবে?
কথাটা আমার গায়ে লাগলো। কারণ এই প্রফেশনটা আমার জন্যে কী সেটা আমিই জানি। কিন্তু ওনার দিক দিয়েও উনি ঠিক তাই সেটাকে গুরত্ব না দিয়ে আমি ওনার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললাম
— ‘খাদ্যসংকোটে অবশেষে এক জার্নালিস্টের ফ্লাটে নৈশভোজের আশায় গ্রেট রকস্টার আদ্রিয়ান আবরার জুহায়ের’
এটা শুনে উনি ভ্রু কুচকে তাকালেন আমার দিকে। আমি একটা মেকি হাসি দিয়ে বললাম
— এই হেডলাইনটা কিন্তু দাড়ুন হবে তাইনা? বেশ চলবে।
আদ্রিয়ান আমার দিকে অদ্ভুতভাবে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ফিক করে হেসে দিলেন আর ওনার হাসি দেখে আমিও হেসে দিলাম। উনি হাসতে হাসতেই বললেন
— তুমি সবসময় এমন চিল মুডে কীকরে থাকো বলোতো?
— আপনার মতো শর্ট টেমপার হলে এই প্রফেশনে টিকতে পারতাম না স্যার।
— আমি শর্ট টেমপার?
— এনি ডাউট? ম্যাক্সিমাম ইন্টারভিউতে তো আপনি রিপোর্টারদের ওপর রেগে বোম হয়ে যান।
— তো? তোমরা প্রশ্নগুলোই এমন করো যে মাথা ঠিক রাখাটা মুসকিল হয়ে যায়। প্রশ্ন করার নাম করে এট্যাক করে কথা বলো। দরকারী প্রশ্নের চেয়ে অদরকারী আর অপ্রয়োজনীয় প্রশ্নই বেশি করো।
আমি একটা ছোট্ট শ্বাস নিয়ে বললাম
— আচ্ছা কফিটা খেতে খেতে কথা বলি ঠান্ডা হয়ে যাবে।
উনি ভ্রু কুচকে কফির মগে চুমুক দিলেন, বুঝতে পারছি উনি আমার ওপর খুব বিরক্ত হয়ে আছেন। আমিও কিছু না বলে কফির মগে চুমুক দিয়ে বাইরে তাকালাম। গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পরা শুরু হয়ে গেছে। হালকা হালকা বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। সবকিছু একদম শান্ত। আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে দেখি উনি ভ্রু কুচকে কফি খাচ্ছে, আমি বললাম
— আচ্ছা সব রিপোর্টারই কী একিরকম আজেবাজে প্রশ্ন করে?
আদ্রিয়ান মাথা বাকা করে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন
— নাহ ঠিক তা না? কেউ কেউ ভালো এবং কাজের প্রশ্নও করে।
— তাহলে? সবাইকে ব্লেম করা কী ঠিক হচ্ছে?
উনি ভ্রুটা কিঞ্চিত কুচকে বাইরে তাকিয়ে কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন
— জানিনা। কিন্তু তোমাদের আই মিন জার্নালিস্ট দের সহ্য হয়না আমার। এরা পারেনা এমন কোনো কাজ আছে নাকি?
আমি মুচকি হেসে কফির মগটা পাশে রেখে ওনার দিকে তাকিয়ে বললাম
— হুমম। তো আপনার আর কী কী অভিযোগ আছে আমাদের মানে জার্নালিস্টদের নিয়ে।
উনিও কফির মগটা আওয়াজ করে পাশে রেখে বললেন
— ইরিটেটিং পিপল। কাজের কাজতো কিছু হয়না এদের দ্বারা সবি অকাজ। একট্রেস স্মৃতির সাথে একদিন একটা রেস্টুরেন্টে দেখা হয়েছে তাই একসাথে লাঞ্চ করেছি। সেটা নিয়ে পরেরদিন হেডলাইন হয়েছে উই আর ডেটিং ইচ আদার। ওয়াও! মানে কিছু বলার নেই।
আমি হেসে দিলাম। উনি বিরক্ত হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন
— তুমি হাসছো? হাসবেই তো তুমিওতো সেই দলেরি তাই না?
আমি কোনোরকমি হাসি থামিয়ে বললাম
— আচ্ছা হাসছিনা এরপর বলুন?
— এদের কীর্তি বলে শেষ করে যাবেনা। এমনকি টাকার জন্যে কাউকে যেমন উচুতে ওঠাতে পারে ঠিক সেইরকমভাবেই এক ধাক্কায় নিচে ফেলে দিতে পারে। রিডিউকিলাস। সেলিব্রেটিদের মধ্যে কার বাচ্চা কতোবার টয়লেটে যায় সেটাও তাদের প্রচার করতে হবে কিন্তু সত্যিই যেই নিউসটা সবাইকে জানানো দরকার সেটার দিকে তাদের কোনো পাত্তাই নেই?
আমি হাটুর ওপর দুই হাত রেখে বললাম
— ইউ আর রাইট। কিন্তু একটা কয়েন এর যেমন এপিঠ ওপিঠ আছে তেমনি সবকিছুরই এপিঠ ওপিঠ আছে।
— মানে?
— সাত বছর আগের কথা। একজন জার্নালিস্ট একজন মন্ত্রীর এগেইনস্টে খুব স্ট্রং একটা আর্টিকেল তৈরী করছিলো উইথ প্রুভ। কিন্তু ওই মিনিস্টার যখন জানতে পারে ওই জার্নালিস্টের কথা তখন উনি ওই জার্নালিস্টকে টাকার লোভ দেখায়, কিন্তু তাতেও যখন ওই জার্নালিস্ট মানতে চায়নি তখন তাকে হুমকি দিতে শুরু করে। তার একমাত্র মেয়েকে রেইপ করার, তাকে খুন করার আরো বিভিন্ন হুমকি দেয়া শুরু করে, কিন্তু উনি মানেননি। উনি অনেক কষ্টে ওনার মেয়ের সম্মান আর জীবণতো বাচিয়ে নিয়েছিলো কিন্তু নিজেকে বাচাতে পারেননি। প্রাণ দিতে হয়েছিলো তাকে।
এটুকু বলে আমি ওনার দৃষ্টির আড়ালেই নিজের চোখের পানিটা মুছে নিলাম আদ্রিয়ান অবাক হয়ে বলল
— উনি মারা যাবার পর ওনার মেয়ের কী হয়েছিলো?
— কারো জন্যে তো জীবণ থেমে থাকে না। তাই ওনার মেয়েও মরে যায়নি শ্বাস নিচ্ছে এখোনো।
আদ্রিয়ান কিছু না বলে চুপ করে রইলো। পরিবেশটা আবারো নিস্তব্ধ হয়ে গেলো। শুধু বৃষ্টির হালকা হালকা ফোটার আওয়াজ আর মেঘের হালকা গর্জন শোনা যাচ্ছে। বেশ অনেকক্ষণ পর আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে বললাম
— এখোনো মনে হয় সব জার্নালিস্ট এক?
— সেটা কখনোই মনে হয়নি আমার তবে ম্যাক্সিমাম তো একই তাইনা?
— হ্যা সেটা ঠিক। আর আমি জানি আপনি আমার বিশ্বাস করে উঠতে পারছেননা। তবে আপনি একরাত বিপদে পরে আমার ফ্লাটে হেল্পের জন্যে এসছেন। এটাকে নিউস করার মতো বিশেষ কিছু আমার মনে হচ্ছেনা। আর আমি ওতোটাও চিপ রিপোর্টার না যে এসব বিষয় নিয়ে নিউস বানাবো। আপনি আমার হিস্ট্রি চেক করে দেখতে পারেন। আমি ঐ লেভের রিপোর্টার নই।
আদ্রিয়ান ইতোস্তত করে বলল
— অব্ আমি আসলে…
“এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন
— আমার কাছে এটা শুধুমাত্র একটা প্রফেশন নয় আদ্রিয়ান, আমার জীবণের বিরাট একটা অংশ আমার বেচে থাকার একমাত্র ভিত্তি বলতে পারেন।
আদ্রিয়ান আমার হাতটা ধরে ওর দুই হাতের মধ্যে নিয়ে নিলো। আমি ওর দিকে অবাক হয়ে তাকালাম, ও আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল
— আই এম সরি। আমার ওভাবে বলাটা ঠিক হয়নি। হঠাৎ করেই যখন জানলাম যে তুমি একজন জার্নালিস্ট তখন
— ইটস ওকেহ.. আপনার দিক দিয়ে আপনি একদমি ঠিক ছিলেন। সত্যি বলতে আজকাল বেশিরভাগ জার্নালিস্ট তো এটাই করে তাইনা?
— হুম বাট তবুও…
— বাদ দিন তো এসব। মগটা দিন সিনে রেখে আসি।
— হুম।
এরপর সিনে মগদুটো রেখে, চোখে মুখে পানির ছিটে দিয়ে জোরে জোরে কয়েকটা শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করলাম। অন্যের সামনে কেদে আর নিজেকে দুর্বল প্রমাণ করতে চাইনা। এরপর মুখটা মুছে গিয়ে ওনার পাশে বসলাম উনি মুচকি হেসে সামনে তাকিয়েই বললেন
— তো আজকালকার দিনে একা একটা ফ্লাটে থাকার কারণ?
— কেউ না থাকলে তো একাই থাকতে হয় তাইনা?
আদ্রিয়ান অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল
— তোমার বাবা মা?
আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে মলিন হেসে বললাম
— মা জন্মের পরেই মারা গেছেন আর বাবা ও কয়েকবছর আগে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছেন।
— আ’ম… আ’ম সরি আমি জানতাম না।
আমি ওনার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললাম
— জানার কথাও না। সো ডোন্ট বি..
— তোমার আর কোনো রিলেটিভ নেই?
— বাবা মা না থাকলে দুনিয়াতে আর কেউ থাকেনা। মামুর বাসাতেই ছিলাম চার বছর কিন্তু…
— কিন্তু?
আমি একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললাম
— বাদ দিন এসব।
— ওকে। আমি হয়তো একটু বেশিই পার্সোনাল ইসুতে ঢুকে যাচ্ছি।
আমি মাথা নিচু করে বসে রইলাম আর মনে মনে বললাম; আ’ম সরি আদ্রিয়ান। আপনি আমার মাত্র এক রাতের অতিথি। তাই আপনাকে আমার জীবণের ভয়ংকর কালো সত্যগুলো বলতে চাইনা। বলতে চাইনা আপনি যার কাছে একরাতের জন্যে আশ্রয় চেয়েছেন সে নিজেই পালিয়ে বেড়াচ্ছে নিজেরই খুব কাছের মানুষদের কাছ থেকে। প্রতিটা মুহূর্তে ভয়ে থাকি ধরা পরে যাবার ভয়। এসব ভাবতে ভাবতেই উনি বললেন
— তোমার বয়ফ্রেন্ড নেই?
আমি ভ্রু কুচকে তাকালাম ওনার দিকে তারপর বললাম
— সেটা দিয়ে অাপনি কী করবেন?
উনি একটু রাগী গলায় বললেন
— আছে কী না বলো?
ওনার রাগী কন্ঠে একটু দমে গেলাম, কারণ ওনার রাগের সাথে খানিকটা পরিচিত আমি। তাই নিচু গলায় বললাম
— না নেই
উনি একটা শ্বাস নিয়ে বললেন
— যাক।
সেটা শুনে আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে কিছু বলতে যাবো তার আগেই উনি বললেন
— বাই দা ওয়ে তুমি রান্নাটা খুব ভালো করো। ভালোই হলো বিয়ের পর আর ওই স্টুপিড সেফদের ডিসগাস্টিং রান্না খেতে হবেনা
আমি বাইরে তাকিয়ে আনমনে বললাম
— হুমম।
পরক্ষণেই খেয়াল হলো কী বললেন উনি চমকে গিয়ে ভ্রু কুচকে ওনার দিকে তাকিয়ে বললাম
— বিয়ের পর মানে?
আদ্রিয়ান হকচকিয়ে গিয়ে বলল
— অব্ ব আই মিন। আমার বিয়ের পর আমার বউ যদি তোমার মতো রান্না জানে তাহলে আরকি।
কথাটা আমার কেমন যেনো লাগল তবুও ছোট করে বললাম
— ওহ।
উনি কিছু বললেন না। কিছুক্ষণ পর আমি বললাম
— ঘুম পাচ্ছে নিশ্চই। আপনি আমার বেডে শুয়ে পরুন আমি সোফার রুমে চলে যাচ্ছি।
বলে উঠে দাড়াতেই উনি আমার হাত ধরে ফেললেন। আমি একটু না অনেকটা অবাক হয়ে তাকালাম ওনার দিকে। উনার চোখে এক অদ্ভুত চাহনী আর ঠোটে ঝুলে আছে মুচকি এক হাসি। আমার কেমন একটা লাগছে, হার্টবিট দ্রুত গতিতে ছুটছে, নিশ্বাস না চাইতেও ভারী হচ্ছে। এই অনুভূতির কারণ আমার জানা নেই। বাইরে বৃষ্টির গতি হঠাৎ করেই বৃদ্ধি পেলো। যেনো বৃষ্টিও আজ কিছু জানাতে চাইছে। উনি স্লো ভয়েজে বললেন
— আজ একটা রাত না ঘুমোলে আমার বিশেষ কোনো সমস্যা হবে না? তোমার কী খুব সমস্যা হবে?
#চলবে…
.
দেরীতে দেবার জন্যে সত্যিই দুঃখিত। ভূলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন আর নিজেদের মতামত জানাবেন। ধন্যবাদ?