#বর্ষণের সেই রাতে- ২
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
শেষ পর্ব.
সময় নিজের মতো করে এগিয়ে চলেছে। দিন, মাস, বছর পেরিয়ে গেছে। ঐদিনের পরের দুটো বছরের একেকটা দিন ভালোবাসাময় ছিল।
ভালোবাসা, রাগ, ঝগড়া, অভিমান, আড্ডা সবমিলিয়ে খুব সুন্দর স্বাভাবিকভাবেই পার হয়ে চলেছে সময়গুলো। সারা রুমজুড়ে দৌড়াদৌড়ি করছে, ছোটাছুটি করছে মিষ্টি আর জাবিন পেছনে পেছনে দৌড়াচ্ছে হাতে খাবারের বাটি নিয়ে। কিন্তু মিষ্টিতে খাওয়াতে ব্যর্থ হয়ে ক্লান্ত শরীরে বিছানায় বসে ঘন-ঘন শ্বাস নিতে নিতে বলল,
” মিষ্টি সোনা, প্লিজ খেয়েনে মা। আর জ্বালাস না।”
মিষ্টি দূরে এক কোণায় দাঁড়িয়ে মাথা নাড়িয়ে বলল,
” নাহ খাবোনা।”
জাবিন অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো তারপর হতাশ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে বলল,
” দেখতে হবেনা কাদের মেয়ে। বাপ সবাইকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরায়। আর মা? মা তো গোটা বাপটাকেই নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরায়। তাদের মেয়ে শান্ত হবে? হাউ কুড আই এক্সপেক্ট দ্যাট!”
এরপর আবার মিষ্টিকে খাওয়ার জন্যে মানাতে লাগল। কিন্তু কোনভাবেই সম্ভব হচ্ছেনা। কিছুক্ষণের মধ্যেই আদ্রিয়ান চলে এলো সাথে অভ্রও এসছে। আদ্রিয়ান কাধ থেকে ব্যাগ রেখে মুচকি হেসে মিষ্টির দিকে তাকিয়ে হেসে বলল,
” কী করছে আমার মা-টা?”
মিষ্টি আদ্রিয়ানকে দেখা মাত্র ‘বাবাই’ বলে দৌড়ে ছুটে এলো। আদ্রিয়ানও মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে গালে চুমু দিলো। মিষ্টি যথারীতি তার বাবার কপালে পরা এলোমেলো চুল নিয়ে খেলা করতে ব্যস্ত হয়ে উঠল। জাবিন এগিয়ে এসে হাঁফানো কন্ঠে বলল,
” ভাইয়া, একঘন্টা যাবত ওর পেছনে ছুটছি খাওয়ানোর জন্যে। মেয়ে হাতেই আসছেনা।এবার তুই কিছু কর!”
আদ্রিয়ান ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে রেখেই ভ্রু কুচকে মিষ্টির দিকে তাকিয়ে বলল,
” কী ব্যাপার মা? খাওনি কেন এখনো?”
মিষ্টি আদ্রিয়ানের গলা জড়িয়ে ধরে বলল,
” মা এলে খাবো।”
জাবিন খাবারের বাটিটা টেবিলে রেখে বলল,
“তোর মেয়ে এবার তুই সামলা, আমি গেলাম।”
বলে জাবিন বেড়িয়ে গেল। অভ্রও আদ্রিয়ানের অনুমতি নিয়ে বের হয়ে গেল। আদ্রিয়ান মিষ্টিকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে ফোন ধরিয়ে দিয়ে বলল,
” চুপচাপ বসে বসে খেলো। আমি ফ্রেশ হয়ে এসে খাইয়ে দেব।”
মিষ্টির যেনো শুনতেই পেলোনা খেলায় ব্যস্ত হয়ে গেল। মেয়ের এমন চঞ্চলতা দেখে আদ্রিয়ান হালকা হেসে চলে গেল ওয়াসরুমে।
__________
জাবিন করিডরের সাথে জয়েন্ট ব্যালকনিতে গিয়ে ওর বন্ধুর সাথে ফোনে কথা বলছিল। কথা বলা শেষ করে পেছন ঘোরার আগেই কেউ ওকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল। বিরক্ততে চোখ-মুখ কুচকে ফেলল জাবিন। অভিমানের ছাপ স্পষ্ট ফুটে উঠল ওর মুখে। কারণ এটা অভ্র। আর ও এখন অভ্রর সাথে কথা বলতে মোটেও ইচ্ছুক নয়। ভীষণ রেগে আছে অভ্রর ওপর আর তার উপর ও নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে নিলে অভ্র আরও শক্ত করে জড়িয়ে নিয়ে বলল,
” এতো রাগ করছো কেনো? সরি বলেছিতো!”
জাবিন হাতের কনুই দিয়ে বেশ জোরে অভ্রর পেটে মারল। অভ্র মৃদু আর্তনাদ করে ছেড়ে দিল জাবিনকে। জাবিন ঘুরে দাঁড়িয়ে ঝাঝালো কন্ঠে বলল,
” সরি মাই ফুট! যাও না যাও তুমি তোমার কাজ করো গিয়ে। এক সপ্তাহ পর আমাদের বিয়ে আর তুমি আমাকে একটু সময় অবধি..। এই আমি তোমার সাথে কথা কেন বলছি? কথাই বলব না। গেট লস্ট।”
অভ্র মুখ ছোট করে বলল,
” আমি কোনদিকে যাই বলোতো? তোমার ভাই আমাকে সারাদিন একটার পর একটা কাজ দিয়ে বসিয়ে রাখে। সেসব কাজ ফেলে আমি তোমার সাথে এসে প্রেম করব? তোমার ভাই যদি দেখে আমার মাথাটা আমার ঘাড়ে থাকবে?”
জাবিন হাত ভাজ করে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বলল,
” তো? ভাইয়ার বোনের সাথে প্রেম করবে আর ভাইয়া এপ্রিশিয়েট করবে?”
” কেনো করবেনা? তোমার ভাই প্রেম করেনি? হাসান স্যারের বাড়িতে কখনও মই ধরে, কখন গাড়িতে হেলান দিয়ে কত রাত মশা মেরেছি সেটা আমি জানি।”
” ভাইয়া যা করেছিল সেটা নিজের বিয়ে করা বউয়ের সাথে করেছে বুঝলে? সোজা হাত ধরে টেনে কাজী অফিস নিয়ে গিয়েছিল বিয়ে করার জন্যে। তুমি কী করেছো?”
অভ্র চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বলল,
” হ্যাঁ সেই আমি তোমাকে হাত ধরে টেনে নিয়ে যাই বিয়ে করতে আর তার পরেরদিন স্যার আমাকে ছবি করে দিক।”
জাবিন ফিক করে হেসে ফেলল। তারপর একটু এগিয়ে গিয়ে অভ্রল গলা জড়িয়ে ধরে বলল,
” এই শোননা চলোনা আমাদের বিয়ের জন্যে তোমার শেরওয়ানি কিন্তু আমি চুজ করব।”
অভ্র ঠোঁটে হালকা হাসি ঝুলিয়ে জাবিনের কোমর জড়িয়ে ধরে বলল,
” যথা আজ্ঞা ম্যাম। পরশু যাচ্ছিতো শপিং এ। তখন চুজ করে দিও। এখন একটু চুপ করোতো। কতদিন পর তোমাকে ভালোভাবে কাছে পেলাম। লেট মি ফিল।”
জাবিন লাজুক হেসে মাথা নামিয়ে নিল। আবছা আলোয় প্রেয়সীর লজ্জার লাল হওয়া মুখটা বেশ ভালোভাবে উপভোগ করছে অভ্র।
______
অনিমা অফিস থেকে ফিরে এসে দেখে আদ্রিয়ান মিষ্টিকে খাওয়াচ্ছে। অনিমাকে দেখে মিষ্টি হাত নেড়ে হাই দিল। অনিমা হেসে দিল। আদ্রিয়ানও অনিমার দিকে তাকিয়ে হাসল তারপর বলল,
” টায়ার্ড না? যাও দ্রুত ফ্রেশ হয়ে এসো। মনিকে বলছি শরবত রেডি করে ফেলতে।”
অনিমা মাথা নেড়ে এগিয়ে এসে মিষ্টির গালে একটা চুমু দিল। মিষ্টি মায়ের দিকে তাকিয়ে চোখে হাসল। ওয়াসরুমে যেতে নিলেই আদ্রিয়ান বিড়বিড় করে বলল,
” শুধু মেয়েকে চুমু দিয়ে গেল। এখানে যে এই বিশাল সাইজেল জলজ্যান্ত আস্ত বর বসে আছে তাকে চোখেই পড়ল না।”
অনিমা শুনতে পেয়েও পাত্তা দিলোনা ঠোঁট চেপে হাসতে হাসতে চলে ও এখন হাসান কোতয়ালের চ্যানেলেই সাংবাদিকতা করছে। যদিও ইন্টারভিউ দিয়ে নিজের যোগ্যতাতেই চাকরিটা পেয়েছে ও। ওয়াসরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে দেখে মিষ্টি আদ্রিয়ানের টিশার্টে খাবার মাখিয়ে ফেলেছে। সেটা দেখে অনিমা ফিক করে হেসে দিল। অনিমার হাসি দেখে মিষ্টিও হাততালি দিয়ে হেসে উঠল। আদ্রিয়ান হতাশ চোখে মা আর মেয়ের দিকে তাকাল। তারপর অনিমাকে বলল,
” হেসোনা প্লিজ। কী অবস্থা করেছে দেখো। একটু যে বকবো সেটাও পারিনা। চোখ রাঙালেই ঠোঁট ফুলিয়ে কেঁদে ফেলে। তোমার মেয়ে তোমার মতোই চালাক। আমার দুর্বলতা খুব ভালোভাবে-ই বুঝে গেছে। আর সেটারই সুযোগ খুব ভালোভাবে নেয়। এক্সাক্টলি লাইক ইউ।”
অনিমা টাওয়ালটা রাখতে রাখতে বলল,
” এখনো অবধি মেয়েটাকে সামলাতে পারেন না আপনি রকস্টার সাহেব!”
আদ্রিয়ান ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বলল,
” ও হ্যালো মিসেস জুহায়ের, দেড় বছর অবধি ওকে আমিই সামলেছি। তখন সামলানোটা আরও ডিফিকাল্ট ছিল।”
অনিমা মলিন এক হাসি দিল। তারপর ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে ব্যালকনিতে চলে গেল। ঐ দেড়টা বছর নিজের প্রিয় মানুষটার কষ্টের কথা কল্পনা করলেও ওর কান্না পায় ভীষণ কান্না পায়। কতটা কষ্ট সহ্য করতে হয়েছিল মানুষটাকে। কিন্তু তবুও ওকে ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবেও নি লোকটা। মাঝে মাঝে নিজের ভাগ্যের ওপরেই বড্ড বেশি হিংসে হয় ওর। ওর আদ্রিয়ান এতো ভালো কেন?
আদ্রিয়ান একপলক অনিমার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে তারপর আবার মেয়েকে খাওয়ানোতে মনোযোগ দিল। মিষ্টিকে খেয়ে খেলতে চলে গেল নিজের মতো। এরমধ্যে মনিও শরবত নিয়ে চলে এসছে। সব ঠিক করে রেখে এসে আদ্রিয়ান দেখে অনিমা আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে ব্যালকনির রেলিং ধরে। আদ্রিয়ান গিয়ে অনিমাকে ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে দু-গালে হাত রেখে বলল,
” আমার আকাশে সবসময় ঝলমলে রোদ-ই মানায়, কালো মেঘ নয়। এবার ঝটাপট একটা হাসি দিয়ে রোদের আলো ছড়াও আর বলে ফেলো মন খারাপ হল কেন?”
অনিমা ছলছলে চোখে আদ্রিয়ানের চোখে চোখ রেখে বলল,
” ঐ সময়ে অনেক কঠিন ছিল আপনার জন্যে তাইনা? বাইরেটা সামলাতে হয়েছে, সবার এতো এতো কথা শুনতে হয়েছে, ঘরে এসে মিষ্টিকে দেখতে হয়েছে, আর আমিতো__। আপনাকে আঘাত পর্যন্ত করেছিলাম। কীকরে পারলাম?
আদ্রিয়ান অনিমার কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলল,
” সেই এক কথা নিয়ে কতবার মন খারাপ করবে বলোতো? অলরেডি দেড় বছর চলে গেছে। ভুলে যাওনা!”
অনিমা কান্নাভেজা কন্ঠে বলল,
” খুব কষ্ট হয়েছিল তাই না?”
” তাতো হয়েছিল। আমার জানপাখির এই মিষ্টি ভালোবাসা ছাড়া আমি ভালো থাকি কীকরে?”
” এতোটা ভালোবাসতে কীকরে পারেন রকস্টার সাহেব?”
আদ্রিয়ান কপাল সরিয়ে কোমর টেনে অনিমাকে নিজের কাছে এনে বলল,
” তুমি বাসোনা?”
অনিমা আদ্রিয়ানের বুকে মুখ গুজে ওকে জড়িয়ে ধরে বলল,
” খুব ভালোবাসি।”
______
আজ জাবিন আর অভ্র বিয়ে। সকাল থেকেই আবরার মেনশনের সবাই কাজে ব্যস্ত। বাড়ির একমাত্র মেয়ের আজ বিয়ে। অনিমা, স্নিগ্ধা, অরুমিতা, রাইমা, স্নেহা, তনয়া সবাই ব্যস্ত জাবিনের জন্যে সকালে গোসলের ব্যবস্থা করার জন্যে। আদ্রিয়ান, রিক, আদিব, আশিস, নাহিদ ডেকোরেশে নজরদারী আর খাবারের ব্যবস্থা করছে। গতকাল রাতে হলুদ সন্ধ্যাতেই ওরা সবাই চলে এসছে আবরার মেনশনে। গতবছর আশিস আর অরুমিতার বিয়ে হয়ে গেছে। নাহিদ আর তনয়ারও একটা ছেলে হয়েছে। এখন সাড়ে ন-মাস। পরের মাসে তীব্র আর স্নেহার বিয়ের ডেট ঠিক করা হয়েছে। কাল থেকেই উৎসবমুখর পরিবেশ গোটা বাড়িজুড়ে।সকালে জাবিনকে তেল-হলুদ দিয়ে গোসল করানোর কাজ শেষ করে ওকে ভালোভাবে শাওয়ার নিতে পাঠিয়ে। অনিমা আবার গার্ডেন এরিয়ায় এসে দেখে মিষ্টি আর স্নিগ্ধ হলুদে মাখামাখি হয়ে গেছে। দুজনেই ভিজে একাকার। স্নিগ্ধ দুচোখ ডলছে। স্পষ্ট-ই বোঝা যাচ্ছে চোখে হলুদ গেছে। আর তাতে যে মিষ্টির ভূমিকা শতভাগ তাতে সন্দেহ নেই। স্নিগ্ধ চোখ ডলছে আর কাঁদছে। মিষ্টির সেদিকে কোন খেয়াল নেই ও নিজেকে পরিষ্কার করতে ব্যস্ত।অনিমা হতাশ শ্বাস ফেলল। এদের দুজনের কান্ডকারখানা নতুন কিছুনা। সকলেই এসব অভ্যস্ত। অনিমা দ্রুত এগিয়ে গিয়ে ওখানে বসে স্নিগ্ধকে কোলে নিয়ে বলল,
” কী হয়েছে বাবা? কোথায় লেগেছে?”
স্নিগ্ধ কান্না থামিয়ে চোখ বন্ধ রেখেই ভ্রু কুচকে বলল,
” বড় আম্মু তোমার মেয়ে আমার চোখে হলুদ ঢুকিয়ে দিয়েছে। জ্বলছে কতো!”
অনিমা পানি দিয়ে ভালোভাবে স্নিগ্ধর চোখ ধুয়ে দিয়ে চোখ গরম করে তাকালো মিষ্টির দিকে। মিষ্টি স্নিগ্ধর দিকে তাকিয়ে মুখ ভেংচি দিয়ে বলল,
” আমার নতুন দামায় হলুদ লাগালো কেনো?”
অনিমা ধমকের সুরে বলল,
” তাই বলে তুমি চোখে মারবে?”
অনিমার ধমক শুনে মিষ্টি প্রথমে মুখ কাঁদোকাঁদো করে ফেলল। এরপর ঠোঁট ফুপিয়ে কেঁদে উঠল। ধীরে ধীরে আওয়াজও বৃদ্ধি পেল। আদ্রিয়ান আর রিক ওদিক দিয়েই যাচ্ছিল। মেয়ের কান্নার আওয়াজ কানে পৌছাতেই প্রায় দৌড়ে ওদিকে গেল। গিয়ে দেখে মিষ্টি কাঁদছে। আদ্রিয়ান দ্রুত গিয়ে মেয়েকে কোলে নিয়ে বলল,
” কী হয়েছে মামনী? কাঁদছো কেনো?”
বাবার আদর পেয়ে আল্লাদী হয়ে গলা জড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে মায়ের নামে অভিযোগ করল মিষ্টি। আদ্রিয়ান চোখ গরম করে অনিমার দিকে তাকাতেই অনিমা বলল,
” দেখুন একদম এভাবে তাকাবেন না। মেয়েটা স্বভাব দিন দিন ঠিক আপনার মতো হচ্ছে। বড্ডো ঘাড়বাঁকা টাইপ। নিজের টা ছাড়া কারোটা শোনেনা। আর নিজে যা ঠিক মনে করে তাই করে।”
আদ্রিয়ান ভ্রু কুচকে বলল,
” কী বললে? আমি ঘাড়বাঁকা?”
অনিমা কিছু বলবে তার আগেই রিক বলল,
” এই তোরা থামবি? ওরাতো বাচ্চা। আর তোরা বাচ্চা বাবা-মা হয়ে গেছিস। বাচ্চাদের মতো ঝগড়া করছি।”
এরপর গিয়ে স্নিগ্ধকে কোলে নিয়ে বলল,
” আর তোকেনা বলেছি মিষ্টি মা কে জ্বালাবি না। একদম মার মতো হচ্ছিস। কারো পেছনে একবার লাগলে আঠার মতো লেগে থাকিস।”
স্নিগ্ধ খিলখিলিয়ে হেসে ফেলল। ছেলের হাসি দেখে রিকও হাসল। তারপর স্নিগ্ধকে নিয়ে ভেতরে চলে গেল। আদ্রিয়ান মেয়েকে হাসাতে ব্যস্ত। অনিমা আদ্রিয়ানের দিকে বিরক্তিমাখা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চলে গেল নিজের কাজে। আদ্রিয়ানও চলে গেল আদিবার কাছে মিষ্টিকে খেলতে দিতে। ওরও কাজ আছে এখন অনেক।
_______
কিছুক্ষণ পর বরযাত্রী আসবে। স্নিগ্ধা রেডি হচ্ছে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে। জাবিনকে সবাই মিলে তৈরী করে দিয়েই এসছে। রিক সবে পোশাক পরেছে। চুল সেট করার জন্যে আয়নার দিকে এগোতেই দেখতে পায়। স্নিগ্ধা ঠোঁটে লিপস্টিক লাগিয়ে আয়নায় চেক করছে। অফ হোয়াইট এর মধ্যে লাল কাজের লেহেঙ্গাতে বেশ সুন্দর লাগছে মেয়েটাকে। রিক আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল স্নিগ্ধার দিকে। একদম ওর পিছে দাঁড়িয়ে দু-হাতের ওপর হাত রেখে কাধে থুতনি রেখে বলল,
” আজ আমার বউটাকে পরীর মতো লাগছে।”
স্নিগ্ধা ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে রেখেই বলল,
” বাহবা! আজ এতো প্রেম?”
রিক দুষ্টু কন্ঠে বলল,
” রোজ থাকেনা বলছো?”
স্নিগ্ধা ঘুরে রিকের দিকে তাকিয়ে বলল,
” না, কিন্তু আজকাল তো সাহেব বেশিই ব্যস্ত। আমিতো ভেবেছি বউ বুঝি পুরোনো হয়ে গেছে।”
রিক স্নিগ্ধার কপালে ঠোঁট ছুইয়ে বলল,
” আমার বউ কখনও পুরোনো হয়না বুঝলে। রোজই আপডেট হচ্ছে। এক বাচ্চার মা হয়েও একইরকম আছে। একদম হট এন্ড..”
স্নিগ্ধা রিকের পেটে গুতো মেরে বলল,
” অসভ্য লোক একটা। ছেলের বাপ হয়ে গেছে এখনো অভদ্রপনা যায় নি।”
রিক হাসল। স্নিগ্ধাও লাজুক হাসল। রিক আয়নায় তাকিয়ে চুল ঠিক করতে করতে বলল,
” স্নিগ্ধকে রেডি করেছো?”
” হ্যাঁ। রেডি করে দিয়েছি এখন খেলছে। আপনি রেডি হয়ে আসুন। আমি গেলাম। নিচে অনেক কাজ।”
বলে স্নিগ্ধা চলে গেল। রিকও তৈরি হওয়াতে মন দিল। রিকের সবটা জুড়েই এখন স্নিগ্ধা আর স্নিগ্ধ। দ্বিতীয়বারও এ এভাবে ভালোবাসা যায় সেটা ও নিজেকে দিয়েই বুঝেছে। স্নিগ্ধা নিজের সর্বস্ব দিয়ে ভালোবাসে ও। প্রথম ভালোবাসা হয়তো ভোলা যায়না। না চাইতেও মনের কোথাও না কোথাও সেই অনুভূতি থেকেও যায়। কিন্তু রিকের এখন কোন আক্ষেপ বা কষ্ট নেই। ও ওর স্ত্রী-সন্তান নিয়ে খুব ভালো আছে, সুখে আছে।
_______
সন্ধ্যা সাতটা বাজে। জাবিন-অভ্র বিয়ে আরও কয়েক ঘন্টা আগেই হয়ে গেছে। এখন ওরা সবাই মিলে এক টেবিলে বসেই খাচ্ছে। হাসান কোতয়ালও এসছেন। অনিমার মামা-মামিও এসছিল। কিন্তু অর্ক আসেনি। ঐ এক্সিডেন্টের পর ও স্বাভাবিকভাবে হাটতে পারেনা, ক্রাচ দিয়ে হাটতে হয়। এটাই হয়তো ওর কর্মফল। আর্জুর মৃত্যুর জন্যে পরোক্ষভাবে ও নিজেও দায়ী। খাওয়া-দাওয়া শেষে জাবিনকে নিয়ে চলে যাবে অভ্র। এতক্ষণ বেশ হৈ হুল্লোড় এর সাথে কাটলেও এখন মোটামুটি সবার মন খারাপ। জাবিনকে রিমা আবরার খাইয়ে দিচ্ছেন। দুজনেই বেশ আবেগী হয়ে পরেছে। মিষ্টি আদ্রিয়ানের কোলে বসে খাচ্ছে। স্নিগ্ধ আদ্রিয়ানের বা পাশের চেয়ারে বসেছে। জাবিনের চোখে জল দেখে মিষ্টি কৌতুহলী কন্ঠে আদ্রিয়ানের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
” বাবা, ফুপি কাঁদে কেনো?”
আদ্রিয়ান মেয়ের মুখে খাবার দিতে দিতে বলল,
” তোমার ফুপি আজ থেকে তোমার অভ্র আঙ্কেলের বাড়িতে গিয়ে থাকবেতো তাই কাঁদছে।”
স্নিগ্ধ সাথেসাথে বলল,
” কেনো থাকবে?”
স্নিগ্ধা বলল,
” এটাই নিয়ম বাবা। যার সাথে বিয়ে হয় তার বাড়িতে গিয়েই থাকতে হয়।”
মিষ্টি সাথেসাথেই বিরক্তি নিয়ে বলল,
” আমি তাহলে বিয়ে করব না। বাবা আর মাকে ছেড়ে যাবোনা।”
আদ্রিয়ান হেসে মেয়ের গালে চুমু খেলো। কিন্তু স্নিগ্ধর কথাটা ভালো লাগেনি। ফুপির মতো মিষ্টিও চলে যাবে কেন? মিষ্টি চলে গেলে ও খেলবে কার সাথে? তাই ও ওর স্বভাবসুলভ ভ্রু কুচকে চোখ খানিকটা উল্টে বলল,
” বিয়ে করতে এসে দেখুকনা কেউ ঠ্যাং ভেঙ্গে দেব।”
সবাই হেসে ফেলল স্নিগ্ধর কথায়। সবাইকে হাসতে দেখে দুহাতে মুখ চেপে মিষ্টিও হেসে দিল। আশিস অরুমিতার দিকে হালকা ঝুঁকে নিচু গলায় বলল,
” কী কিউট না বাচ্চাগুলো? আমাদেরও এবার একটা বেবী দরকার তাইনা?”
অরুমিতা চোখ গরম করে তাকাতেই ও চোখ সরিয়ে খাওয়ায় মনোযোগ দিল যেন কিছু বলেই নি। সেটা দেখে ঠোঁট টেপে হাসল অরুমিতা।
বিদায়ের সময় জাবিন প্রচুর কেঁদেছে। বিশেষ করে আদ্রিয়ানকে জড়িয়ে ধরে অনেক কান্নাকাটি করেছে। ভাইকে খুব বেশিই ভালোবাসে। জাবিনকে এভাবে কাঁদতে দেখে স্নেহা গোমড়া মুখ করে তীব্রকে বলল,
” আমাকেও এভাবে চলে যেতে হবে তোর বাড়িতে?”
তীব্র বিরক্তি নিয়ে বলল,
” তো কী অন্যকারো বাড়ি যেতে চাস?”
” দেখ একদম বাজে বকবিনা কিন্তু!”
নাহিদ তনয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
” কী আর বলব। এই ম্যাডাম গাড়িতে কেঁদে কেঁদে তো কাজল আর চোখের পানি দিয়ে আমার শেরওয়ানিটাই নষ্ট করে দিয়েছিল।”
তনয়া ভেংচি কেটে বলল,
” হ্যাঁ হ্যাঁ। তোমার সব আফসোস তো ঐ শেরওয়ানি নিয়েই। আমি কেঁদেছি তাতে আর কী যায় আসে?”
এভাবেই হাসি, কান্না, খুনশুটি, আনন্দে সন্ধ্যাটা খুব ভালোভাবে পার হলো। রাতে যে যার যার মতো করে ফিরে গেল নিজের বাড়ি। কাল রিসিপশনে অভ্রর বাড়ি যাবে।
_________
রাত প্রায় দেড়টা বাজে। মিষ্টি আর আদ্রিয়ান দুজনেই ঘুমিয়ে আছে। বাইরের তীব্র বৃষ্টির আওয়াজে আদ্রিয়ানের ঘুম ভেঙ্গে গেল। চোখ না খুলেই এক হাত নিজের বুকের একপাশে আলতো করে রাখল। মিষ্টি একদম নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে ওখানে। আরেকপাশে হাত দিয়ে ফাঁকা পেয়ে বিছানায় হাত বুলালো, কিন্তু ফাঁকাই পেল। এবার চোখ খুলে তাকালো আদ্রিয়ান। পাশে তাকিয়ে অনিমাকে দেখতে না পেয়ে অবাক হল। বাইরের বৃষ্টির আওয়াজ শুনে বুঝতে পারল অনিমা কোথায় আছে।মিষ্টিকে আস্তে করে বালিশে শুইয়ে রেখে উঠে ব্যালকনিতে গিয়ে দেখল অনিমা রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে বাইরের বৃষ্টি উপভোগ করছে। মুচকি হেসে আস্তে আস্তে অনিমার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো আদ্রিয়ান। অনিমা না তাকিয়েও বুঝতে পারল আদ্রিয়ান এসছে। একপাশ দিয়ে দুহাতে আদ্রিয়ানকে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা রেখে আবার বৃষ্টি দেখায় মনোযোগ দিল। আদ্রিয়ানও অনিমার মাথার ওপর থুতনি রেখে বর্ষণ উপভোগ করছে। কিছুক্ষণ কেটে গেল এভাবেই। হঠাৎ আদ্রিয়ান বলল,
” এই বর্ষণের সাথে আমাদের দুজনের সম্পর্ক বেশ গভীর তাইনা? আমাদের প্রথম দেখা কিন্তু এই বর্ষণেই হয়েছিল।”
অনিমা মুচকি হেসে বলল,
” হ্যাঁ। একদম অপরিচিত একজন মেয়েকে নিজের বাড়িতে নিয়ে এলেন। যদিও আপনাকে রকস্টার হিসেবে চিনতাম। আর আপনি আমাকে মিস্টার সিনিয়রের মেয়ে হিসেবে। ব্যস এটুকুই ছিল আমাদের পরিচিতি।”
” এরপর এই অচেনা মেয়েটার মায়াতেই তো আস্তে আস্তে জড়িয়ে ফেললাম নিজেকে। তার ভয় পাওয়া, অকারণেই বারবার আমাকে ভুল বোঝা, তারপর ভুলটা বুঝতে পেরে বাচ্চাদের মতো করে কাঁদোকাঁদো মুখে সরি বলা, দুষ্টুমি, হাসি, কথা বলা সবকিছু দিয়েই মায়াবিনী তার মায়ায় জড়িয়ে ফেলল আমাকে। এতোটাই পাগল হলাম যে হাত ধরে টেনে নিয়ে কাজি অফিসে গিয়ে বিয়েই করে নিলাম।”
অনিমা হেসে দিয়ে বলল,
” আর আমি আমার স্বপ্ন পুরুষকে প্রতিনিয়ত নিজের এতোটা কাছে দেখে নিজেও তার প্রতি দুর্বল হয়ে পরলাম। তার অতিরিক্ত পাগলাটে ভালোবাসা আমাকেও বাধ্য করল তাকে ভালোবাসতে। আর আজ তার সন্তানের মা আমি। সত্যিই বলছি, যখন বিগত কয়েকটা বছরে ফিরে তাকাই সবটা স্বপ্ন মনে হয় আমার। যেনো অনেক ভয়াবহ বর্ষণের রাত পার হয়ে চিরস্থায়ী উজ্জ্বল ভোর এসেছে আমার জীবনে।”
আদ্রিয়ান অনিমার মাথায় চুমু দিয়ে ঝট করেই কোলে তুলে নিয়ে বলল,
” আমাদের জীবনের ঐ খারাপ সময়গুলোও এই বর্ষণের রাতের মতোই ছিল। যন্ত্রণা, কষ্ট আর বিষণ্নতা থাকলেও তার প্রতিটা ফোটা আমরা উপভোগ করেছি। ঠিক যেমন এখন করি। আর এইজন্যই হয়তো বর্ষণ আমাদের দুজনেরই এতো প্রিয়। এবার চলুন ম্যাডাম আজ রাতটা আবার দুজনে বৃষ্টিবিলাশ করি।”
অনিমা হেসে আদ্রিয়ানের বুকে মাথা রাখল। আদ্রিয়ানও ওকে কোলে নিয়ে হাটা দিল ছাদের উদ্দেশ্যে। আজ আবারও ওরা ভালোবাসাময় করে তুলতে চায় বর্ষণের এই রাতকে।
.
সমাপ্ত।