বর্ষণের সেই রাতে- ২ পর্ব-৭০+৭১

0
1927

#বর্ষণের সেই রাতে- ২
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল

৭০.

একটা মানুষের জীবনের অন্যতম সুখের মুহূর্ত আসে যখন সে জানতে পারে যে তার সন্তান, তার অস্তিত্ব পৃথিবীতে আসতে চলেছে। আদ্রিয়ানের ক্ষেত্রেও এটার ব্যতিক্রম ঘটেনি। অনিমা মা হতে চলেছে কথাটা শোনার পর ওর মনে হয়েছিল ঐ মুহুর্তে ও পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী ব্যক্তি। এতোটাই আনন্দ হচ্ছিলো যেটা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। আনন্দের এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়েছিল ওর চোখ দিয়ে।নাহিদের সামনেই ঘুমন্ত অনিমার কপালে চুমু দিয়েছিল। কিন্তু পরক্ষণেই নাহিদ যেটা বলেছিল সেটা ছিল ভয়ংকর। অনিমার মানসিক অবস্থার যে অবনতি হচ্ছে সেটার মূল চিকিৎসা শুরু করা এখন কোনভাবেই সম্ভব নয়। কারণ ওর এখন যেই মেডিসিনগুলো প্রয়োজন সেগুলো খেলে বাচ্চাটাকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হবেনা। আর অন্যদিকে খুব শীঘ্রই চিকিৎসা শুরু না হলে ও মানসিকভাবে আরও অসুস্থ হয়ে পড়বে। যতো দিন যাবে ততই অনিমার আচরণ অস্বাভাবিক হতে থাকবে। এমনও হতে পারে যে পরে ওকে আর সুস্থ স্বাভাবিক করা সম্ভব হবেনা। আর সেরকমটা হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। আদ্রিয়ান তখন নাহিদের কাছে জিজ্ঞেস করে,

” এখন কী করব তাহলে?”

নাহিদের কষ্ট হলেও নিজেকে সামলে আদ্রিয়ানের সামনে নিষ্ঠুর দুটো পথ খুলে দিয়ে বলে,

” যদি তুই বাচ্চাটাকে বাঁচাতে চাস তাসলে তোকে অনিমাকে নিয়ে রিস্ক নিতে হবে। কারণ ভবিষ্যতে যে ও সুস্থ হবে তার কোন গ্যারান্টি নেই। আর অনিমাকে এখন সুস্থ করতে চাস তাহলে তাহলে বাচ্চাটাকে…”

আদ্রিয়ান স্হির দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল নাহিদের দিকে। ওর বুঝতে বাকি নেই যে ঠিক কী বলতে চাইছে নাহিদ। কিন্ত এরকম কঠিন সিদ্ধান্ত কীকরে নেবে ও? নিজের সন্তানকে মেরে ফেলবে? যে এখনো পৃথিবীর আলোও দেখেনি? কিন্তু সেটা না করলে তো অনিমার ক্ষতি হয়ে যাবে। আদ্রিয়ান নাহিদকে জিজ্ঞেস করেছিল আর কোন উপায় আছে কি-না। কিন্তু আর কোন উপায়ই নেই বাচ্চাটা অনিমার গর্ভে থাকাকালীন ও এতো পাওয়ারফুল ঔষধ খেতে পারবেনা। আর যদি খায় তো বাচ্চাটা ঠিক থাকবেনা। ব্যর্থ আর অসহায় কন্ঠেই সেটা আদ্রিয়ানকে জানিয়েছে নাহিদ। জীবনে প্রথমবার আদ্রিয়ানের মাথা কাজ করছে না, সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। ‘ আমার একটা বাচ্চা চাই আদ্রিয়ান। আমিও মা হতে চাই।’ বারবার অনির এই কথাটা মাথায় ঘুরছে। এতোটা অসহায় নিজেকে এর আগে কোনদিন মনে হয়নি ওর। কী করবে? কী করা উচিত এখন ওর?

_________

আবরার মেনশনে আজ খুশির বন্যা বয়ে যাচ্ছে। কয়েকমাস আগেই রিক আর স্নিগ্ধার কোল আলো করে স্নিগ্ধ এসেছে। আর আজ সকলেই জানতে পেরেছে যে অনিমাও মা হতে চলেছে। এরচেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে। মিসেস রিমা আর লিমা মিলে আজ সারাদিন রান্নাঘরে থেকে রান্না করেছে। সবটাই অনিমা আর আদ্রিয়ানের পছন্দের খাবার। সকলেই আনন্দে মেতে আছে। আর অনিমার খুশিতো সবচেয়ে বেশি। যদিও সবার সামনে সেটা প্রকাশ করতে পারছেনা। মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে আছে। সবার এতো আনন্দ দেখে লজ্জাও লাগছে অনেকটা। আদ্রিয়ান সোফায় বসে তাকিয়ে শুধু দেখছে সবার আনন্দ। এই আনন্দ কীকরে নষ্ট করবে ও। মাঝে আরও দুটো সপ্তাহ কেটে গেছে। প্রেগনেন্সির খবরটা আদ্রিয়ান বা নাহিদ কাউকে জানায়নি। কারণ আদ্রিয়ান তখনও সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। অনিমা নিজেই জানতে পেরেছে। পিরিয়ড মিস হওয়া, আর শারীরিক বিভিন্ন সমস্যা দেখেই অনুমান করতে পেরেছিল ও। এরপর টেষ্ট করানোর পর জানতে পারে মা হতে চলেছে। সেদিন অনিমার খুশি আর উচ্ছ্বাস দেখে স্হির দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো আদ্রিয়ান। অনিমা যখন আদ্রিয়ানকে জড়িয়ে ধরে আনন্দে কেঁদে দিয়েছিল। তখন আদ্রিয়ান প্রচন্ড অসহায় বোধ করছিল।

রাতে বিছানায় হেলান দিয়ে শুয়ে গম্ভীরভাবে ভেবে চলেছে আদ্রিয়ান ওর হাতে সময় খুব কম। নাহিদ তাড়া দিচ্ছে বারবার। যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার তাড়াতাড়ি নিতে হবে। দরজা লাগানোর আওয়াজে চোখ তুলে তাকাল ও। অনিমা এসেছে। অনিমা বিছানায় উঠে এগিয়ে গিয়ে আদ্রিয়ানের বুকে মাথা রেখে আলতো হাতে জড়িয়ে ধরলো ওকে। আদ্রিয়ানও দুহাতে আগলে নিলো। অনিমা বলল,

” আজ আমি খুব খুশি। আপনি জানেন এতোদিন একটা বাচ্চার জন্যে মনটা কেমন ছটফট করতো আমার? খুব কষ্ট হতো। তাই হয়তো মাঝেমাঝে এমন রুড বিহেভ করে ফেলতাম তাইনা? কিন্তু আর করবোনা দেখবেন। আজ আমি ভীষণ খুশি। আমাদেরও ছোট্ট একটা বাবু আসবে। ছোট ছোট হাত-পা নাড়িয়ে খেলবে। আদো গলায় আমাদের ডাকবে। খিলখিল করে হাসবে। তাইনা?”

আদ্রিয়ান এতক্ষণ মনোযোগ দিয়ে অনিমার কথাগুলো শুনছিল। বাচ্চাটাকে নিয়ে মেয়েটার কতো স্বপ্ন। আর এই কথাগুলো ওর স্বপ্নের পরিধিকেও কয়েকগুন বাড়িয়ে দিয়েছে। আদ্রিয়ানকে চুপ থাকতে দেখে অনিমা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলল,

” আপনি খুশি হন নি?”

আদ্রিয়ান মুচকি হাসলো। এরপর অনিমাকে নিজের বুকের সাথে আরও ভালোভাবে জড়িয়ে ধরে বলল,

” খুশি হবোনা কেন? খুব খুশি হয়েছি। অনেক রাত হয়ে গেছে এবার ঘুমিয়ে পড়। কাল সকালে কথা বলব আবার।”

অনিমা আর কিছু না বলে পরম শান্তিতে আদ্রিয়ানের বুকে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইল। আদ্রিয়ান অনিমাকে বুকের সাথে চেপে ধরে রেখে চুপচাপ শুয়ে আছে। এই কয়েকদিন অনেক ভেবেছে। কিন্তু নির্দিষ্ট কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেনি। কিন্তু এখন ও সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে। ও ওর বাচ্চাকে মারতে পারবেনা, কোনভাবেই না। অনিমা যদি ওর হৃদয় হয় তো ওদের এই বাচ্চা সেই হৃদয়ের স্পন্দন। কাউকেই ছাড়তে পারবেনা ও, সম্ভবই না। তাই ওকেও একটা রিস্ক নিতে হবে। হ্যাঁ যদি অনিমা পরে কখনও সুস্থ নাও হয়। তাতে কী? অনিমা যেমন থাকবে সেরকমভাবেই আগলে রাখবে ও অনিমাকে। হয়তো অনেক কষ্ট হবে কিন্তু ও ঠিক সামলে নেবে। তবুও নিজের সন্তানের কোন ক্ষতি করতে পারবেনা ও। অনিমাকে সোজা করে শুইয়ে দিয়ে ওর মাথায় গভীরভাবে একটা চুমু দিল আদ্রিয়ান। এরপর ওর পেটের দিকে তাকাল। পেটের ওপর হালকা করে হাত বুলিয়ে আলতো করে চুমু দিল। এখানে ওর সন্তান ওর অংশ একটু একটু করে বড় হচ্ছে। যে ওকে ‘বাবা’ বলে ডাকবে। ভাবতেই বুকের মধ্যে প্রশান্তির হাওয়া বয়ে গেলো।

________

জাবিন নিজের রুমের বিছানায় হেলান দিয়ে কারো সাথে একটা কথা বলছে। ওর দৃষ্টি হাতের নখের দিকে আর মুখে মিষ্টি হাসি ঝুলে রয়েছে। সশব্দে দরজা লাগানোর শব্দে জাবিন হালকা চমকে তাকালো দরজার দিকে। অভ্র ভেতরে ঢুকে দরজা লক কর‍ে দাঁড়িয়ে আছে। অভ্রর চোখে-মুখে রাগ স্পষ্ট। জাবিন অভ্রর দিকে তাকিয়ে থেকেই বলল,

” আমি পরে কল করছি বেবি। এখন বাই।”

জাবিনের মুখে বেবী ডাক শুনে অভ্রর রাগ আরও বেড়ে গেল। জাবিন উঠে দাঁড়িয়ে ভ্রু কুঁচকে বলল,

” আপনি এখানে কী করছেন হ্যাঁ? আপনাকে না বলেছিলাম আমার থেকে দূরে থাকবেন। এখানে এসেছেন কেন?”

জাবিনের প্রশ্নকে পুরোপুরি অবজ্ঞা করে অভ্র বলল,

” কার সাথে কথা বলছিলে ফোনে?”

জাবিন একটু অবাক হয়ে তাকাল অভ্রর দিকে। তারপর একটু তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,

” দ্যাটস..”

কথাটা শেষ করার আগেই অভ্র জাবিনের দুই হাত ধরে নিজের দিকে টেনে নিয়ে শক্ত কন্ঠে বলল,

” দ্যাটস ডেফিনেটলি মাই বিজনেস। কজ__”

জাবিন এবার অভ্রর চোখে চোখ রেখে বলল,

” কজ?”

অভ্র আজ কোনরকম সংকোচ ছাড়াই বলে ফেলল,

” আই লাভ ইউ। কেনো বুঝছো না সেটা? আর তুমিওতো আমাকে ভালোবাসো তাইনা?”

জাবিন অভ্রর থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,

” বাসতাম। কিন্তু এখন আর বাসিনা। আপনাকে ভালোবাসার কোন কারণও নেই এখন আর।”

কথাটা বলে জাবিন চলে যেতে নিলেই অভ্র হাত ধরে টেনে আবার নিজের কাছে এনে বলল,

” মজা করছো আমার সাথে? দু’দিনেই সব ভালোবাসা উবে গেলো। আমি তোমাকে রিজেক্ট করেছি বলে?”

জাবিন এবার একটু রেগে গেল। রাগে শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। ও দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

” তো আপনি কী ভেবেছিলেন আপনি আমাকে রিজেক্ট করার পর আমি দেবদাসী হয়ে থাকব? মুভ অন করব না?”

অভ্র এবার নিভল। সত্যিই তো বলেছে। কিন্তু ওতো জাবিনকে ছাড়তে পারবে না। এই কয়েকমাসে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে জাবিনকে ছেড়ে বেঁচে থাকা ওর পক্ষে অসম্ভব। ও এবার ঠান্ডা মাথায় জাবিনের দু-কাঁধে হাত রেখে বলল,

” আমিতো মানছি ভুল করেছিলাম। ক্ষমাও চেয়েছি কতোবার। কেন ওরকম করেছি সেটাও বলেছি।এবার অন্তত ক্ষমা করে দাও প্লিজ। আর কতো কষ্ট দেবে? এদিকে তোমার ভাইও আমার মাথার ওপর খাড়া ধরে দাঁড়িয়ে আছে। যেকোন মুহূর্তে বলি দিয়ে দেবে টাইপ। তুমি সেটা চাও বলো? লঘু পাপে গুরুদন্ড হচ্ছেনা?”

জাবিন এবার আর নিজেকে সামলাতে পারলোনা ফিক করে হেসে দিলো। অভ্র অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল জাবিনের দিকে। জাবিন অভ্রর দু কাঁধে হাত রেখে ভ্রু নাচিয়ে বলল,

” কী মিষ্টার? কেমন দিলাম? এবার বুঝেছো ভালোবাসার মানুষ ফিরিয়ে দিলে কতো কষ্ট হয়?”

অভ্র চোখ ছোট ছোট করে কিছুক্ষণ জাবিনের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে ঠোঁট কামড়ে ধরে বলল,

” তারমানে এতদিন সব নাটক চলছিল?”

জাবিন দাঁত কেলিয়ে বলল,

” জি স্যার।”

অভ্র এক ভ্রু উঁচু করে বলল,

” আর তোমার ক্রাশবয়?”

জাবিন অবাক হওয়ার ভান করে বলল,

” সেটা আবার কে?”

” তোমাকে তো…”

জাবিনকে আর কে পায়। অভ্রর থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে দৌড়ে চলে গেল। অভ্রর ছুটলো ওর পেছনে।

________

আদ্রিয়ানের আজও ফিরতে বেশ রাত হলো। স্টুডিও থেকে বেরিয়ে খুব গোপনে মাদারের কাছে গিয়েছিল সবার চোখে ধুলো দিয়ে। এরপর গোপন মিটিং চলছিল। যেখানে রিক আর হাসান কোতয়ালও ছিল। কবির শেখ আর রঞ্জিত চৌধুরীর বর্তমান অবস্থা আর পরিকল্পনা নিয়েই কথা বলেছিল ওনারা। রুনা নামের মেয়েটাও একেবারে নিখোঁজ। সব ঝামেলা শেষ করে অনিমার জন্যে আইসক্রিম আর বার্গার কিনে নিল। সকালে বের হওয়ার সময় আনতে বলেছে মেয়েটা। বেশ ক্লান্ত শরীরেই রুমে ঢুকলো। কিন্তু রুমটা অন্ধকার। আদ্রিয়ান ভেতরে এসে দু-পা দিতেই পায়ে কাঁচের টুকরো ঢুকে গেল। ব্যথা পেয়ে চোখ বন্ধ করে নিল আদ্রিয়ান। বুঝতে বাকি রইল না এই মেয়ে আজ আবার ক্ষেপেছে। সারাদিন পর বাড়ি ফিরে এসে কারোরই এসব ভালো লাগবে না। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আদ্রিয়ান রাগ না করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কিন্তু কতদিন পারবে নিজের ধৈর্য্য রাখতে?

#চলবে..

#বর্ষণের সেই রাতে- ২
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল

৭১.

আদ্রিয়ানের পায়ে কাঁচটা বেশ গভীরভাবে ঢুকে গেছে। এক পা টেনে গিয়ে রুমের লাইটটা জ্বালিয়ে সারারুমে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল।নিচে পানির গ্লাসটা কয়েক টুকরো হয়ে ছড়িয়ে আছে। তার মধ্যে একটা টুকরোই ওর পায়ে ঢুকে গেছে। অনিমা বিছানায় উল্টো ফিরে শুয়ে আছে আর ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। আদ্রিয়ান পা টেনে এগিয়ে গিয়ে টি-টেবিলে বার্গার আর আইসক্রিমের প্যাকেটটা রাখল। সোফায় ব্যাগটা রেখে বসে পড়ল। এরপর আস্তে করে পায়ের কাঁচটা বের করল। যথেষ্ট ব্যথা করছে কিন্তু দাঁতে দাঁত চেপে ব্যথাটা সহ্য করে নিল। ব্যথা নিয়েই দ্রুত কাঁচগুলো পরিষ্কার করে ফেলল। বাড়ির কাউকে ডাকলে সবাই বুঝে যাবে ব্যপারটা। যদিও অনিমার অস্বাভাবিক ব্যবহারের কিছুটা আভাস সবাই পেয়ে গেছে। কিন্তু যতটুকু তারা দেখেছে সেটুকুতে মুড সুইং-ই ভেবেছে। কারণ অনিমা এখন রুম থেকে খুব কম বের হয়। আর আদ্রিয়ানও চায় না কেউ এখনই জানতে পারুক এই ব্যাপারে। তাহলে সমস্যা হয়ে যাবে। যদিও রিক-স্নিগ্ধাকে জানিয়েছে ব্যাপারটা। কারণ ওরা দুজনেই ডক্টর। অনিমার দিকে তাকিয়ে দেখল বারবার চাদর খামছে ধরছে আর পা ঘষছে বিছানায়। বোঝাই যাচ্ছে নিজেকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। এখনই কিছু করতে হবে নয়তো আবার পাগলামী শুরু করবে। অনিমা প্রেগনেন্ট, তাই ফ্রেশ না হয়ে ওর কাছে যাওয়াও ঠিক হবেনা। তাই কেটে যাওয়া পায়ে ঔষধ না লাগিয়েই শার্টটা কোনরকম খুলে একটা টিশার্ট আর টু কোয়ার্টার প্যান্ট নিয়ে দ্রুত চলে গেল ওয়াসরুমে। কোনরকম ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এলো। বাইরে বেরিয়ে এসে দেখে অনিমা উঠে বসে পড়েছে। দরজা খোলার আওয়াজে অনিমা ক্ষিপ্ত চোখে তাকাল। ছলছলে চোখ দুটো লালচে হয়ে আছে ওর। অনিমা ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল,

” কেনো এসেছেন বাড়িতে? এইটুকু সময়ের জন্যে আসার কী দরকার ছিল? বাকি সময়টা বাইরে কাটিয়ে দিলেই তো পারতেন। আর এসব এনে ন্যাকামো করছেন আমার সাথে? ন্যাকামো?”

কথাটা বলে উঠে দাঁড়িয়ে বার্গারের প্যাকেটটা ফেলার জন্য ধরতে গেলেই আদ্রিয়ান ধরে ফেলল অনিমাকে। একটানে নিজের কাছে এনে জাপটে ধরল। অনিমা ছোটার জন্যে ছটফট করছে কিন্তু পারছেনা। আদ্রিয়ান অনিমার ঘাড়ে আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলল,

” সরি বউ, অনেকগুলো সরি। আর কক্ষনো লেট হবেনা। প্রমিস।”

” দরকার নেই আপনার কোন সরি এর। চলে যান এখান থেকে। আপনার চেহারাও দেখতে চাইনা আমি।”

বলে ঝাড়া দিয়ে নিজেকে ছাড়াতে নিলেই আদ্রিয়ান আরও শক্ত করে অনিমাকে নিজের সাথে জড়িয়ে নিয়ে বলল,

” আচ্ছা আমার চেহারা দেখতে হবেনা চোখ বন্ধ করে থাকো।”

বলে অনিমাকে কোলে তুলে নিল। অনিমা নিজের সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছে আদ্রিয়ানের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়ানোর। কিন্তু গায়ের জোরে আদ্রিয়ানের সাথে পেরে ওঠা ওর পক্ষে সম্ভব না। এদিকে আদ্রিয়ান নিজের পায়ের তীব্র ব্যথাকে উপেক্ষা করে নিজের প্রেয়সীকে সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। অনিমাকে নিয়ে সোজা বিছানায় শুইয়ে দিয়ে অনিমাকে একদম আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিলো নিজের সাথে। অনিমা চেঁচিয়ে যাচ্ছে নিজের মতো করে,আর নিজের সব শক্তি কাজে লাগিয়ে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু আদ্রিয়ান এখন ওকে ছাড়তে পারবেনা। এই মেয়েকে এখন ছেড়ে দিলেই সারা ঘরের জিনিসপত্র ভাংচুর শুরু করে দেবে। এতে বাচ্চাটারও ক্ষতি হতে পারে। তারচেয়েও বড় কথা অনিমা নিজেই হাতে পায়ে ব্যথা পাবে এরকম পাগলামো করতে গিয়ে। অনিমা মোচড়াতে মোচড়াতে বলল,

” ছাড়ুন আমাকে। নইলে আমি কিন্তু..”

আদ্রিয়ান হাতের বন্ধন আরও শক্ত করে বলল,

” আমার বউ আমি ছাড়বো কেন? যদি কেউ চুরি করে নিয়ে যায়?”

অনিমা থেমে গিয়ে কটমটে চোখে তাকিয়ে বলল,

” আপনি মজা করছেন আমার সাথে?”

” আজব! মজা করবো কেন? আমার এতো সাহস আছে নাকি?”

” ছাড়ুন!”

” আচ্ছা ছেড়ে দেব। কিন্তু তুমিতো বার্গার খেতে চেয়েছিলে। আমি কিনে এনেছি। খাবেনা?”

অনিমা কিছুটা শান্ত হয়েছিল। কিন্তু আদ্রিয়ানের কথা শুনে আবার তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো। চেঁচিয়ে আবার নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বলল,

” খাবোনা আমি এসব আর। আপনি আপনার কাজ করুন গিয়ে। আমার খাওয়া নিয়ে একদম ভাবতে যাবেন না। খবরদার না।”

আদ্রিয়ান ব্যপারটা বুঝতে পেরে বলল,

” আচ্ছা কুল! ঠিকই তো। একে তো লেট করে এসেছি। তার ওপর তোমার খাওয়া নিয়ে তদারকি করছি। বড্ড সাহস হয়ে গেছে আমার। শাস্তি দেওয়া উচিত তাইনা?”

অনিমা গাল ফুলিয়ে তাকালো আদ্রিয়ানের দিকে। ছটফটানি একটুখানি কমালো। আসলে অনিমার অবস্থা এখন এরকম যে ওর সাথে যদি কেউ তালে তাল মেলায়, ওর কথায় সায় দেয়। ও যেটা বলছে সেটাকেই গুরুত্ব দেয় তাহলে ও কিছুটা হলেও শান্ত হয়। আদ্রিয়ান অনিমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

” শাস্তি দিতে চাও আমায়?”

অনিমা মাথা ঝাঁকিয়ে হ্যাঁ বলল। আদ্রিয়ান অনিমার পেটে আলতো করে হাত রেখে বলল,

” তুমি কী জানো আমাদের বেবি এখন অনেক টায়ার্ড হয়ে আছে? তুমি যদি জেগে থেকে আমাকে শাস্তি দাও। তাহলে আমাদের বেবি আরও টায়ার্ড হয়ে যাবে। তাই এখন ঘুমিয়ে পড়। কাল সকালে উঠে আমাকে শাস্তি দিও। হুম?”

অনিমা জেদ আর কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বলল,

” না, আমি এখনই দেবো। ছাড়ুন আমায়।”

আদ্রিয়ান হতাশভাবে একবার তাকালো অনিমার দিকে। ওর নিজেরই ভীষণ ক্লান্ত লাগছে। সারাদিনের অনেক পরিশ্রম গেছে। একটু ঘুমের দরকার ছিল এখন ওর। লম্বা দুটো শ্বাস নিয়ে নিজেকে সামলে অনিমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

” জানপাখি, তুমি রাত জাগলে বেবির কষ্ট হবে তো। ওতো তোমার ভেতরে আছে তাইনা? তুমি কষ্ট দেবে ওকে?”

অনিমা ভ্রু হালকা কুঁচকে খানিক অসহায় ভঙ্গিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল আদ্রিয়ানের দিকে। এরপর কিছু একটা ভেবে আদ্রিয়ানের বুকে মুখ গুঁজে শুয়ে পড়ল। আদ্রিয়ান একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। ওদিকে ওর পা দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে, ব্যথা অনুভব করছে। কিন্তু অনিমাকে না ঘুম পাড়িয়ে ঔষধ লাগাতে পারবে না। মানসিক, শারীরিক সব ভাবেই ক্লান্ত ও। মাঝে তিন মাস পেরিয়ে গেছে। অনিমা প্রায় ছ-মাসের প্রেগনেন্ট। কিন্তু গত তিনমাসে অনিমার অবস্থার অবনতি-ই হচ্ছে। নাহিদের পক্ষে বাচ্চার ক্ষতি এড়িয়ে যতটা চিকিৎসা করা সম্ভব সেটুকু করছে। কিন্তু এতে কিচ্ছু হবেনা। হাসান কোতয়াল নিজের মেয়ের এমন অবস্থা শুনে নিজেও মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েছেন। আদ্রিয়ান ওনাকে কথা দিয়েছে যে ওনার মেয়ের কিচ্ছু হবেনা। সুস্থ হয়ে যাবে। এছাড়াও রিক, স্নিগ্ধা, নাহিদ, অভ্র এরা ব্যাপারটা জানে। ওরা বেশ চিন্তিত অনিমার ব্যপারটা নিয়ে। বাড়ির বাকি সবাইকে এখনো বুঝতে দেয়নি আদ্রিয়ান। অরুমিতা, তীব্র, স্নেহা এসেছিল অনিমার সাথে দেখা করতে কিন্তু ওরাও কিছু বোঝেনি। এভাবে চললে বেশিদিন ব্যাপারটা গোপন রাখা যাবেনা সেটাও বুঝতে পারছে ও। বাড়ির লোকেদের ইতিমধ্যেই ব্যাপারটা হালকা নজরে পড়েছে। কিন্তু কিছু করারও নেই। আদ্রিয়ান যখন বাচ্চাটাকে নষ্ট না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। বলেছিল যে যাই হোক না কেন ও অনিমাকে সামলে রাখবে। তখন নাহিদ বলেছিল, ব্যাপারটা কিন্তু এতোটাও সহজ হবেনা, যতোটা সহজ করে আদ্রিয়ান বলছে। আজ আদ্রিয়ান বুঝতে পারছে যে সত্যিই তাই। ব্যাপারটা এতোটাও সহজ নয় যতোটা ও ভেবে নিয়েছিল। অনিমার অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে। ওকে সামলাতে আদ্রিয়ানকে যথেষ্ট কষ্ট করতে হচ্ছে। প্রথমত গর্ভবতী, দ্বিতীয়ত মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছে দিনদিন। অকারণেই হুটহাট রেগে যাওয়া, জিনিসপত্র ভেঙ্গে ফেলা, অসময়ে বিভিন্ন বায়না ধরা এগুলোর মাত্রা সময়ের সাথেসাথে বেড়েই চলেছে। ওকে সামলাতে আদ্রিয়ানকে একপ্রকার যুদ্ধ করতে হচ্ছে। অথচ এই অনিমাই আদ্রিয়ান চোখ রাঙালেই চুপ হয়ে যেত, আদ্রিয়ানকে বুঝতো, সবার জন্য ভাবতো, পরিস্থিতি বুঝে ম্যাচিউরিটির সাথে সিদ্ধান্ত নিতো। ভাবতেই ভেতর থেকে চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো আদ্রিয়ানের। সাথে কবির শেখের ওপর ভীষণ রাগ হচ্ছে। ওনার জন্যেই আজ মেয়েটা এতো কষ্ট পাচ্ছে।
কিন্তু না, ও হাল ছাড়বেনা। কিন্তু কীভাবে সামলাবে এতোসব? তবে আর মাত্র তিনটা মাস ওকে কষ্ট করতে হবে। পারতেই হবে ওকে, যেভাবেই হোক। যাকে ভালোবাসে তার জন্যে এইটুকু পারবেনা? স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কতো এমনই হওয়া উচিত। সুখের দিনগুলো যেমন দুজন একসাথে কাটায়। কোন একজনের দুঃখ বা সমস্যাটাও দুজনকেই ভাগ করে নিতে হয়। এসব ভাবতে ভাবতে অনিমার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলো ও ঘুমিয়ে পড়েছে। মুচকি হেসে কপালে একটা চুমু দিলো। এরপর উঠে বসে দেখল পা দিয়ে এখনো রক্ত ঝড়ছে দ্রুত ঔষধ লাগাতে হবে। উঠে দাঁড়াতে গিয়েও থেমে গেল। আস্তে করে অনিমার পেটের ওপর হালকা করে হাত রেখে পেটে চুমু দিয়ে বলল,

” তাড়াতাড়ি চলে এসো চ্যাম্প। তোমার মায়ের খুব কষ্ট হচ্ছে। তুমি চলে এলে আমরা দুজন মিলে তোমার মাকে সুস্থ করে তুলব। একদম ফিট এন্ড ফাইন। ডান?”

আদ্রিয়ানের যেনো মনে হলো অনিমার পেটের মধ্যে থেকে ওর বাচ্চাও ওকে বলছে ‘ডান’। নিজের এরকম অদ্ভুত ভাবনায় নিজেই হেসে ফেলল ও।

__________

আদ্রিয়ানের গ্যাং এর জন্যে যে অফিস রয়েছে তার কেবিনে আদ্রিয়ান, রিক, অভ্র, আদিব আর হাসান কোতয়াল বসে আছেন।নাহিদ নিজের কাজে গেছে। সকলেই গভীর ভাবনায় মগ্ন। কিছুক্ষণ আগেই কবির শেখ ফোন করেছিল। একপ্রকার কটাক্ষ করেই কথা বলেছে আদ্রিয়ানের সাথে। তার প্রথম কথাই ছিল,

” বউকে সামলে আমার পেছনে লাগার সময় পাচ্ছোতো ভাগ্নে?”

কিছুক্ষণ কথা লড়াই হওয়ার পর আদ্রিয়ান শক্ত কন্ঠে বলেছিল,

” তোমাকে আগেও বলেছিলাম মামা। আমার ওপর আঘাত করলে ততটাই শাস্তি পাবে যতটা অন্যায় করেছো। কিন্তু অনির গায়ে যদি আঁচ আসে তাহলে ভীষণভাবে পস্তাবে। কিন্তু তুমি সেই ভুলটাই করলে। সুতরাং পস্তানোর জন্যে তৈরী থাকো।”

এখন আপাতত ওনারা কবির শেখ আর রঞ্জিত চৌধুরীর লোকেশন জানার চেষ্টায় আছে। সেটা নিয়েই মিটিং। হাসান কোতয়াল অসহায় কন্ঠে বললেন,

” মামনীর কী অবস্থা এখন?”

আদ্রিয়ান স্হির চোখে তাকাল ওনার দিকে এরপর মলিন একটু হাসি দিয়ে বলল,

” সিনিয়র চিন্তা করোনা। ও ঠিক হয়ে যাবে।”

হাসান কোতয়াল এতেই বেশ ভালোভাবে বুঝতে পারলেন যে অনিমার অবস্থার কোন উন্নতি হয়নি। আরও কিছু দরকারি কথা সেরে হাসান কোতয়াল বেরিয়ে গেলেন। ওনাকে আবার নিজের অফিসে যেতে হবে। কিছুক্ষণ পর আদিব বলল,

” আশিসের কোন খবর জানিস?”

আদ্রিয়ান ল্যাপটপ ওপেন করতে করতে বলল,

” হ্যাঁ জানি। কিন্তু তোদের জানাবোনা। ওর আরেকটু শাস্তির দরকার আছে। ও যেটা করেছে সেটা কোন ছোটখাটো অন্যায় না। আগে আমার মনমতো শাস্তি হোক, বাকিটা পরে দেখছি।”

বাকিরা কিছু বলল না কারণ ওরা জানে আদ্রিয়ান ওর সিদ্ধান্তে অটল। অভ্র একটু ইতস্তত করে বলল,

” স্যার আমার কিছু বলার ছিল।”

আদ্রিয়ান ল্যাপটপে চোখ রেখেই বলল,

” জাবিন আর তোমার প্যাচ আপ হয়ে গেছে। তাও তিনমাস আগেই। এই তিনমাস দুজনে জমিয়ে প্রেম করেছো। এটাই বলবে তো? তুমি না বললেও আমি জানি। এসব ঝামেলা মিটে গেলে এনগেইজমেন্ট আর জাবিনের পড়াশোনা কম্প্লিট হলে বিয়ে। কিছু বলার আছে?”

রিক, অভ্র, আদিব একপ্রকার হা করে তাকিয়ে আছে। এতো ঝামেলার মধ্যেও এই ছেলের সবদিকে নজর থাকে। কীকরে? এইজন্যই হয়তো লোকটা স্পেশাল। অভ্র নিজেকে সামলে বলল,

” না স্যার, ঠিক আছে।”

আদ্রিয়ান যেভাবে ওদের তিনমাসের কীর্তির রশিদ এনে হাতে ধরিয়ে দিল এরপর আর কিছু বলার থাকে? সত্যিই এই ছেলে মারাত্মক। হঠাৎ করেই আদ্রিয়ানের মাথায় কিছু একটা এলো। কাউকে কিছু না বলেই ঝটপট বেরিয়ে পড়ল ওখান থেকে।

#চলবে..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে