বর্ষণের সেই রাতে- ২ পর্ব-০৬

0
1937

#বর্ষণের সেই রাতে- ২
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল

৬.

‘ভাবী’ ডাক শুনে অনিমা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। গোলগোল চোখে একবার আদ্রিয়ান একবার অভ্রর দিকে তাকাচ্ছে। সেসবে আদ্রিয়ানের মাথাব্যাথা নেই ও নিজের মত কাজ করে যাচ্ছে। অনিমা কিছু বুঝতে না পেরে বিভ্রান্ত অবস্থাতেই উত্তর দিল,

” ওয়ালাইকুম আসসালাম। জি ভালো আছি। আপনি?”

অভ্র একই ভঙ্গিতে হেসে বলল,

” আগে ভালোই ছিলাম। একটু আগে অপনাকে দেখে সেন্টি খেয়েছিলাম ঠিকই কিন্তু এখন আপনার সাথে কথা বলে আবার দ্বিগুন ভালো হয়ে গেছি। নাইস টু মিট ইউ ভাবী।”

আবারও ভাবী ডাক শুনে অনিমা অবাক কন্ঠে বলল,

” ভাবী?”

অভ্র হকচকিয়ে গিয়ে বলল,

” সরি! আসলে এমনিতে স্যার আমার বস হলেও মনে মনে আমি তাকে বড় ভাই মনে করি। তাই আপনাকে ভাবী বলে ফেলেছি এখন থেকে ম্যাম বলব।”

অনিমা অভ্রর কথার আঘামাথা কিছুই বুঝতে পারল না। বোকার মত শুধু তাকিয়ে রইল অভ্রর দিকে। অভ্র ঔষধের প্যাকেট তুলে আদ্রিয়ানকে উদ্দেশ্য করে বলল,

” স্যার? বিয়েটা কবে করলেন?”

আদ্রিয়ান চুপচাপ নিজের কাজ করছে। অভ্র দ্রুত এসে ঔষধের প্যাকেট টি-টেবিলে রেখে বলল,

” স্যার এটা কিন্তু ঠিক হচ্ছে না আমি কিন্তু কেঁদে দেব।”

আদ্রিয়ান বিরক্ত হয়ে অভ্রর দিকে তাকিয়ে বলল,

” শাট আপ অভ্র! তুমি কী বাচ্চা ?”

অভ্র মুখ কাচুমাচু করে দাঁড়িয়ে রইল। অনিমা এখনও কিছু বুঝতে পারছেনা যে ওর সাথে কী হচ্ছে। কী বলছে এই ছেলে? অভ্রকে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আদ্রিয়ান বলল,

” দাঁড়িয়ে আছ কেন? বসো?”

অভ্র অসহায় কন্ঠে আবারও বলল,

” স্যার বলুন না? কবে বিয়ে করলেন?”

আদ্রিয়ান ল্যাপটপে চোখ রেখেই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল,

” শী ইজ নট মাই ওয়াইফ অভ্র।”

অনিমা চোখ বড়বড় করে তাকাল আদ্রিয়ানের দিকে। এতক্ষণে ওর বোধগম্য হলো যে অভ্র ঠিক কী বলতে চেয়েছিল। অনিমার এখন কাশি উঠে যাওয়ার মত অবস্থা হয়েছে। হুটহাট এস ভেবে বসল ছেলেটা? আদ্রিয়ানের কথা শুনে অভ্র নিজেও অবাক হয়েছে। কী বলছে ওর স্যার? বউ নয়? তাহলে কী এক শ্রেণির সেলিব্রিটিদের মত ওর স্যারও লিভ-ইন করছে? কিন্তু আদ্রিয়ানতো এরকম ছেলে নয়। ও নিজের দেশের সংস্কৃতিকে, নিয়মকে যথেষ্ট সম্মান করে। তথাকথিত আধুনিকতার নামে নিজের সংস্কৃতি নিজের ব্যক্তিত্বকে বিসর্জন দেওয়ার মত ছেলে আদ্রিয়ান আবরার জুহায়ের নন। তাহলে? তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে অবাক কন্ঠে বলল,

” ও আচ্ছা বিয়ে এখনও হয়নি? তা কবে হচ্ছে স্যার?”

আদ্রিয়ান এবার সত্যিই বিরক্ত হলো। এই ছেলেটা নিজে একাই সব বুঝে ফেলে। বাকি সব জাহান্নামে যাক ও ওর মত বলতে থাকবে। আদ্রিয়ান বিরক্তি নিয়েই বলল,

” তোমাকে সবসময় দুই লাইন করে বুঝতে কে বলে অভ্র?”

অভ্র মুখটা ছোট করে ফেলল। কারণ ও বুঝতে পেরে গেছে যে আজ আবারও নিজে নিজেই সবটা বুঝে নিয়েছে। আর পুরোটাই ভুল বুঝেছে। তাই ইতস্তত করে বলল,

” না মানে তাহলে উনি?”

” পরে বলছি। আপাতত এটুকু জেনে রাখ ও এখন এখানেই থাকবে।”

অভ্র এখনও ব্যপারটা বোঝে নি। তবে আদ্রিয়ান যখন বলেছে পরে বলবে তখন পরের জন্যেই অপেক্ষা করা উচিত। কিন্তু এখন কিছুটা মেলাতে পেরেছে ও। এইসব ঔষধ, আর মেয়েটাকেও দেখে অসুস্থ মনে হচ্ছে। তারমানে মেয়েটার জন্যেই এসব করছে? নিশ্চয়ই মেয়েটা কোন বিপদ হয়েছিল আর স্যার ওর সাহায্য করছে। এতদিনে নিজের স্যারকে এটুকু চিনেছে অভ্র। অভ্র হেসে বলল,

” তাহলে আমি এখন আসি স্যার?”

আদ্রিয়ান ল্যাপটপ বন্ধ করতে করতে বলল,

” ব্রেকফাস্ট করে তারপর যাবে।”

অভ্র ভালো করেই জানে যে এখন না করা মানে ফ্রি তে একটা রামধমক খাওয়া। তাই চুপচাপ মাথা নেড়ে সম্মতি দিল। আদ্রিয়ান অনিমার দিকে তাকিয়ে বলল,

” তুমি নিচে যেতে পারবে না-কি তোমার জন্যে খাবার ওপরে আনব?”

অনিমার ভাবল জ্বরটা তো এখন আগের মত ওত বেশি নেই, শুধু শুধু ওনাদের ঝামেলা না বাড়িয়ে নিচে যাওয়াই ভালো। এসব ভেবে অনিমা বলল,

” আমি নিচে গিয়ে খেতে পারব।”

” ওকে চলো।”

বলে আদ্রিয়ান অনিমার হাত ধরে ওকে ওঠাল। অনিমার হাত ধরে রেখেই নিচে ডাইনিং ট্যাবল অবধি নিয়ে গেল আদ্রিয়ান। অভ্রও পেছন পেছন এলো। তিনজনকে খাবার সার্ভ করে দেওয়ার পর আদ্রিয়ান আর অভ্র টুকিটাকি কথা বলছে আর অনিমা মাথা নিচু করে চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছে। অনিমার জ্বর মুখে খেতে ইচ্ছে করছেনা তাই খুব অল্পই খেল। আদ্রিয়ান খেয়াল করলেও জোর করল না। কারণ ও জানে যে জ্বর মুখে এখন খাবার ভালো লাগবে না। বারোটার দিকে মধু মিশিয়ে এক গ্লাস দুধ খাইয়ে দেবে। অনিমার খাওয়া শেষ হতেই আদ্রিয়ান বলল,

” তুমি ওপরে গিয়ে রেস্ট কর, আমি আসছি।”

অনিমা মাথা নেড়ে আস্তে আস্তে গুটিগুটি পায়ে ওপরে চলে গেল। অনিমা যেতেই আদ্রিয়ান অভ্রর দিকে তাকিয়ে দেখল ও উৎসাহি চোখে তাকিয়ে আছে। হয়ত এটা শোনার অপেক্ষায় আছে যে মেয়েটা কে আর এখানে কীকরে এলো? আদ্রিয়ান অভ্রর মনে কৌতূহল মেটাতে ওকে সবটা খুলে বলল গত দুদিনের ঘটনা। সবটা শুনে অভ্র বেশ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল আদ্রিয়ানের দিকে। কিছুক্ষণ অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলল,

” কিন্তু স্যার মেয়েটার যদি যাওয়ার জায়গা নাই থাকে তাহলে ওনাকে নিয়ে কী করবেন? মানে কোথায় পাঠাবেন?

আদ্রিয়ান দুই হাতের আঙ্গুল একত্রিত করে থুনিতে হাত রেখে বলল,

” হুমম। চিন্তার বিষয় এটা। তবে আপাতত যেভাবে চলছে চলুক না। আমার বাড়িটা তো ফাঁকাই থাকে সমস্যা কোথায়?”

” হ্যাঁ স্যার কিন্তু যদি কোনভাবে মিডিয়ায় লোকেদের কানে এসব কথা যায় তাহলে? ওরা তো তিল কে তাল তার সাথে দুধ, চিনি সব মিলিয়ে পিঠা বানিয়ে পরিবেশন করে দেবে।”

আদ্রিয়ান একটু হাসল অভ্রর কথায়। কথাটা খুব একটা ভুল বলেনি। তবুও বলল,

” ওদের কাজই এটা তোমাকে এসব নিয়ে চিন্তা করতে হবে না আমি সব দেখে নেব।”

” স্যার আজকে আপনার রেকর্ডিং ছিল।”

” হুম মনে আছে আমার। আমি ডিরেক্টরের সাথে কথা বলে নেব। শুধু তাই নয় আগামী দুদিন অন্তত আমি বেড়োতে পারব না তুমি একটু ম্যানেজ করে নিও।”

অভ্র বেশ অবাক হল। আদ্রিয়ান কখনই তার কাজের সাথে কম্প্রমাইজ করে না। ওর কাছে ওর কাজটাই সবার আগে। কিন্তু সেখানে শুধু একটা মেয়ের জন্যে মোটমাট চারটা দিন ঘরে বসে থাকবে? ভাবা যায়? যদিও মেয়েটা দেখতে যথেষ্ট কিউট আর মিষ্টি। স্যারের সাথে যদি সেরকম কোন সম্পর্ক তৈরী হয় তো মন্দ হবে না। এসব ভেবে নিজেকে সামলে নিয়ে মুচকি হেসে অভ্র বলল,

” আচ্ছা।”

খাওয়াদাওয়া শেষ করে আদ্রিয়ানের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল অভ্র। আদ্রিয়ানও সার্ভেন্টকে সবটা গুছিয়ে নিতে বলে চলে গেল ওপরে।

দুপুর বারোটা বাজে। আদ্রিয়ান একটা কাচের গ্লাসে দুধ আর মধুর মিশ্রণটা চামচ দিয়ে নাড়ছে আর অনিমা অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে গ্লাসটার দিকে। দেখলেই তো ওর গা কেমন গুলিয়ে উঠছে, খাবে কীকর? কিন্তু নাও করতে পারছেনা। দু-দিনের পরিচয় সবে, এখনও আদ্রিয়ানকে ঠিক করে বুঝতে পারেনি ও, তাই ফ্রি হতে পারছেনা আদ্রিয়ানের সাথে। আদ্রিয়ান গ্লাসটা অনিমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,

” হালকা গরম আছে ঝটপট খেয়ে নাও।”

অনিমা করুণ দৃষ্টিতে দেখছে আদ্রিয়ানকে। আদ্রিয়ান সেটা দেখে চোখ ছোট ছোট করে অনিমার দিকে তাকিয়ে বলল,

” কী হল নাও?”

ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও গ্লাসটা হাতে নিল অনিমা। আদ্রিয়ানের দিকে তাকাতেই ও চোখের ইশারায় বলল শেষ কর। একপ্রকার বাদ্ধ হয়ে চোখ খিচে বন্ধ করে, নাক কুচকে দুধটা শেষ করল অনিমা। শেষ করে আদ্রিয়ানের দিকে গ্লাসটা এগিয়ে দিল। আদ্রিয়ান গ্লাসটা রেখে অনিমার দিকে তাকিয়েই ভ্রু কুচকে ফেলল। আদ্রিয়ানের দৃষ্টি অনিমাকে চিন্তায় ফেলে দিল কারণ ওর দৃষ্টি অনিমার ঠোঁটের দিকে। আদ্রিয়ান অনিমার বেশ কাছে এসে বসল। অনিমা একটু ঘাবড়ে গেল, বেশ অস্বস্তি হচ্ছে এখন। নিশ্বাস ভারী হয়ে উঠছে। ছেলেটা হুট করে এত কাছে কেন আসছে?আদ্রিয়ান অনিমার দিকে ঝুকতেই চোখ খিঁচে বন্ধ করে নিল ও।

#চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে