#বড়_ছেলে (শেষ)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি
মা আমার পাশে বসে আমার ডান হাতটি ধরে। শান্ত গলায় বলে,“তোর ছোট ভাইকে তো বিদেশ পাঠাতে পারবো না। একদিন তোর বিয়ে হবে। তুই তো সারাজীবন একসাথে থাকবি না৷ তখন ওর কী হবে? এসব ভেবে আমরা ওর নামে বাড়িটা আর কিছু জমি দিয়েছি। বাকি জমি তোকেই দিবো। এমনটাই পরিকল্পনা ছিলো।”
মায়ের কথা শুনে আমি কোন জবাব দিলাম না। মা নিজ থেকে আরও অনেক কথা বললো। তবে আমি তার কথায় কান দেই না। কারণ আমি এসব বুঝি। বাবা, মায়ের ধারণা আমি সব টাকা পাঠাতাম না। আমি তো বিদেশ থেকে নিজের জন্য সব গুছিয়ে নিচ্ছি। তাই বাবা, মা এখানে সবটা ভাইকে দিয়ে দিয়েছে। এমনই তাদের ভাবনা। এসব বুঝে আমি বললাম,“তোমরা কেন জানি না সত্যি মানতে চাও না। তবে হ্যাঁ আমি ভুল করেছি। আমার নিজের জন্য আলাদা করে টাকা রাখা উচিত ছিলো। তাহলে আজ তোমাদের এত কথা শুনতে হতো না।”
“বাবার কথায় কষ্ট পাস না।
আমরা তোকে বিয়ে দিতে চাই। আমরা ভেবে দেখলাম তুই যেহেতু বিয়ে করতে চাস। মেয়ে পছন্দ সেহেতু আমাদের তোর বিয়েতে অমত করা উচিত নয়। যা হয়েছে ভুলে যা। আর বাড়ি বিজয়ের নামে হয়েছে তো কী হয়েছে? এখানে তুই থাকবি। এটা তোরও বাড়ি। তোরা অর্ধেকটায় থাকবি, বাকি টায় বিজয়রা। আর আমরা বুড়ো বুড়ি তোদের দুই ভাইয়ের ঘাড়ে বসে থাকবো।”
আমি মায়ের কথা শুনে কোন জবাবে কিছুটা কঠিন গলায় বললাম,“এখন এত মিষ্টি ভাষায় কথা বলছো যে? এখন ভয় হয় না। আমার বিয়ে হলে বউ আমাকে হাত করে নিবে? নাকি বিজয় যাতে ব্যবসা শুরু করতে পারে আমি সেই টাকা দিবো, এই কথাটা নিয়ে বিয়ের আলোচনা সাড়বে বলে ভেবেছো কোনটা?”
আমার কথা শুনে মা চুপ হয়ে যায়। আমি তার হাত ধরে বলি,“মা আমি তোমাদের খুব ভালোবাসি। তোমরা আমাকে ভালোবাসতে না পারলেও আমি ভালোবাসি।”
“যদি আমরা তোর ভাইয়ের ব্যবসার কথা ভেবেও থাকি। তো এটায় তো দোষ নেই। বড় ভাই, বড় ছেলে হিসাবে তোর দায়িত্ব নেই?”
“হ্যাঁ। এই তো। বড় ছেলেকে শুধু দায়িত্বের সময় মনে পড়ে তোমাদের। এছাড়া কখনো মনে পড়ে না। এটাই তো সমস্যা। বড় হয়েছি বলেই হয়তো আমি সারাজীবন খেটে যাবো, তোমার ছোট সন্তান ফ্রী খেয়ে যাবে এমনটা ভেবে বসে আছো। আচ্ছা তোমরা এটা ভাবলে নাহয় মানলাম। কিন্তু একবার কী আমার জন্য নূন্যতম কিছু ভাবতে পারোনি? ছোট ছেলের ফাঁকে বড় ছেলেকে নিয়ে এক বিন্দু ভাবতে পারোনি?”
আমার কথাগুলোতে মা বোধহয় আঘাত পেলো। আমি আমার বাবা, মাকে খুব ভালোবাসি৷ তাদের আঘাত দিতে চাইনি। কিন্তু এখন না দিয়ে পারলাম না। ধীরে ধীরে মনের জমানো কথাগুলো বললাম। এখন আমিই বিয়ে করতে চাই না। বিয়ে করে কী হবে? বউ রেখে যাবো এমন পরিবারে যারা চায় না আমার সুখ। দেখা যাবে নিজের সঙ্গে একটা মেয়ের কপাল পুড়লাম। আমার কথা শুনে মা বলে,“এমন ভাব করছিস যেন কোন টাকাই জমাসনি? তাছাড়া ঐ মেয়ের সঙ্গে এতদিনের পরিচয় তাকে টাকা দিসনি? আমরা কি এসবের হিসাবে চেয়েছি? তাহলে বারবার তুই তোর পাঠানো টাকায় আমরা কী করেছি, কার জন্য করেছি সেটা নিয়ে পড়ে আছিস কেন?”
আমাদের এসব কথার মাঝে বাবা, ভাই চলে আসে। আমি তাদের দেখে কিছুটা কঠিন গলায় বললাম,“না মা। আমি স্বার্থপরের মতো নিজের জন্য কিছুই করিনি। আর না ঐ মেয়েটাকে কিছু দিয়েছি। ঐ মেয়েটা আমার কাছে কিছু চায়নি। কখনো চায়নি। তাই বোধহয় সে আমাকে ভালোবাসতে পেরেছে৷ কারণ তার যে চাওয়া ছিলো না। টাকা পয়সা, জিনিসপত্রের স্বার্থ ছিলো না। যেটা তোমাদের ছিলো। তাই তো তোমরা আমায় ভালোবাসতে পারোনি। আমার টাকায় গড়া বাড়িতে আজ আমাকে অপমান করছো। বের হয়ে যেতে বলতে পারছো।”
আমার এই কথা শুনে বিজয় বলে উঠলো,“তোমার লাগছে কোথায় বলো তো? আমাকে হিংসা হয়। তাই আমার নামে বাড়িটা থাকায় কষ্ট হচ্ছে। কেন ভাইয়া? তুমি বোধহয় ভুলে গেছো বাবা, মা তোমাকে কত টাকা ঋন করে বিদেশ পাঠিয়েছে৷ সেখানে আমার জন্য তো কিছুই করেনি। তুমি বাবা, মাকে স্বার্থপর বলছো। আমার তো তোমাকে স্বার্থপর লাগছে৷ নাহলে নিজের ভাইকে হিংসা করতে না।”
“আমি হিংসা করছি?”
আমার কথা শুনে বাবা বলে উঠে,“হিংসেই তো করছিস। তোর আচরণে বোঝা যাচ্ছে সব।”
“না গো। তোমরা আমার ব্যথাটা বুঝবে না। যাই হোক তোমাদের কাছে আমার কিছু চাওয়া নাই। আর মা তোমাকে বলছি। তুমি তো মা৷ একজন মা তো তার গর্ভে সন্তানকে রাখে। তার টান অন্যরকম। তোমার কী মনে হয় না আমার সাথে তোমরা যা করেছো তা অন্যায়? নিজের ছেলে হই তোমার। এটাও মনে হয়নি?”
আমি একটু থেমে আবার বললাম,“এত বছর তোমাদের থেকে দূরে ছিলাম। তাই হয়তো তোমাদের আমার প্রতি থাকা মায়া কেটে গেছে। এখানে তো তোমাদের জন্য বিজয় ছিলো। তাই সে তোমাদের ভালোবাসা হয়ে উঠেছে। সেজন্য হয়তো তোমরা শুধুমাত্র আমাকে টাকা ইনকাম করা মেশিন ভেবেছো। এটাই হবে হয়তো। নয়তো সব প্রবাসীর পরিবার এভাবে দূরে সরে যাবে কেন? সবাই শুধু তাদের দায়িত্বের নজরে কেন দেখবে বলো? আমি এসব বুঝেছি। তবে এত বছরে আমার তোমাদের প্রতি থাকা কোন টান কমেনি। কেন জানো? কারণ ওখানে তো আমার জন্য তোমাদের মতো কেউ ছিলো না। এখানে তোমাদের একজন সন্তান ছিলো বলেই আমার প্রতি সব মায়া শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু তুমি তো মা। তুমি কিভাবে পারলে মায়াটা কাটাতে?”
আমি এসব বলায় আবার তর্ক বেধে গেলে বাবা, ভাইয়ের সঙ্গে। বেশ খানিকটা তর্ক হওয়ার পর আমি বললাম,“আমি চলে যাচ্ছি তোমাদের বাড়ি থেকে। চিন্তা করো না। আর হ্যাঁ বাবা, মা তোমাদের বলছি। যার জন্য এতকিছু করলে সেই সন্তান শেষ বয়সে তোমাদের দেখে কি-না আমার জানা নাই। তবে চিন্তা করো না। আমি তোমাদের দেখবো। সারাজীবন দেখবো। বড় ছেলে হিসাবে আমার যা দায়িত্ব আছে তা আমি পালণ করবো৷ তবে আগে ভালোবেসে যেটা করতাম সেটা এখন শুধুমাত্র দায়িত্ব হিসাবেই করবো। তাই নিজেদের কখনো অসহয় ভাববে না। রিকশা চালিয়ে হলেও আমি তোমাদের খাওয়াবো।”
“তোর বড় বড় কথা রাখ তো।
তুই আমাদের কী খাওয়াবি? তোর টাকায় খাওয়ার জন্য আমরা পড়ে আছি? আমাদের কিছু নেই?”
“বাবা, মায়ের জন্য তোমাকে ভাবতে হবে না ভাইয়া। তুমি বরং তোমাকে নিয়েই ভাবো। আমি আমার বাবা, মাকে দেখে নিবো।”
বিজয়ের কথা শুনে আমি তার দিকে শান্ত চোখে তাকিয়ে মুচকি হাসলাম। অতঃপর ব্যাগ গুছিয়ে সত্যি বাড়ি থেকে বের হয়ে আসলাম। মা অবশ্য আমার হাত ধরেছিলো। সে চায়নি আমি বের হয়ে আসি। কিন্তু না৷ যেখানে আমার জন্য বিন্দু পরিমান ভালোবাসা নেই সেখানে আমার থাকা উচিত নয়। তাই চলে আসলাম। তবে আমি এটা খুব ভালোভাবে জানি, বাবা-মা আজ আমার মূল্য না বুঝলেও ভবিষ্যতে বুঝবে। অবশ্যই বুঝবে।এসব বাবা, মাকে শেষ বয়সে অবহেলা করা বড় ছেলের ঘাড়ে এসেই পড়তে হয়। সেদিন হয়তো তাদের অনুশোচনা হয়। কিন্তু তাদের ক্ষমা করতে পারে এসব অবহেলিত সন্তানরা। পারে না।
____
আমি বের হয়ে আমার এক বন্ধুর বাসায় উঠি। তাকে সব খুলে বলি। বাবা, মা যে নিজ স্বার্থে আমার বিয়ের কথা বলছিলো। ওটা মুখেই সীমাবদ্ধ, বাস্তবে হতো না। হলেও পরিনতি ভালো হতো না। তাই তাদের সঙ্গে সব সম্পর্ক শেষ করে চলে এসেছি। আমি যেখানে চাকরি করতাম সেখানে বাংলাদেশের এক লোক ছিলো৷ যে আমার বন্ধু। তার নাম ফারুখ। আমি তার কাছে শুনেছি তার জীবন। সে নিজের স্ত্রীকে সন্দেহ করতো। সন্দেহ নয় ভয় হতো। চারদিকে যা হয়। তাতে প্রবাসী সে। বউ টাকা, পয়সা নিয়ে পালালে। এমনই তো ঘটে। সেই ভয়ে বউকে কোন টাকা পয়সা দিতো না। সব বাবা, মাকে দেয়। তার পরিবারও তাকে চরমভাবে ঠকায়। দেশে তার স্ত্রীকে করতো অত্যাচার, আর সেও বউয়ের কথায় গুরুত্ব দিতো না। দিনশেষে ঠকে যায়। তখন তার পাশে পরিবার নয় ঐ বউটাই ছিলো। আসলে আমরা প্রবাসীরা ঠকে না গেলে বাস্তবতা বুঝি না। তার আগে বুঝতে পারলেও সেটা মানতে চাই না। আমাদের কাছে আমাদের পরিবার তো আপনই। কিন্তু তারা আমাদের আপন ভাবতে পারে না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আপন থেকে আমরা কিভাবে যেন তাদের পর হয়ে যাই। শুধুমাত্র তাদের কাছে টাকার মেশিন হয়ে থাকি। এসব ভেবে আমি আবার বিদেশ যাওয়ার প্রস্তুতি নিলাম। ইতিমধ্যে কাজল খবর দিলো তার বিয়ে ঠিক হয়েছে। না এখানে আমি কাজলকে দোষ দেই না। তার স্থান থেকে এটাই যথার্থ সিদ্ধান্ত। তবে তার বিয়ের কথা শুনে একটু কষ্ট লাগলো। নিজের পরিবার থেকে যে কষ্ট পেয়েছি তারপর এই কষ্ট সামান্য ছিলো। তাই মানিয়ে নিতে পেরেছি। অবশেষে আবার দেশ ছাড়ার জন্য বের হলাম। বারো বছর আগে এভাবেই দেশ ছেড়েছিলাম। তবে সেই সময়ে পাশে বাবা, মা ছিলো। এখন কেউ নেই। সেই সময়ে আমিও বাবা, মায়ের জন্য উপার্জন করার স্বপ্ন নিয়ে গিয়েছিলাম। তবে আজ নিজের জন্য ভাবার জন্য যাচ্ছি। নিজের জীবনটা গুছিয়ে তবেই দেশে আসবো। অতঃপর সবটা নতুন করে সাজাবো। এই স্বপ্ন নিয়েই আবার প্রবাস জীবনে পা দিলাম।
(সমাপ্ত)