বক্ষপিঞ্জিরায় তুই বন্দীনি পর্ব-৪+৫+৬

0
240

#বক্ষপিঞ্জিরায়_তুই_বন্দীনি
#সাদিয়া_আক্তার
#পর্ব_৪

{ ১৮+ এলার্ট }

গভীর দৃষ্টিতে আবসারের দিকে তাকিয়ে আছে মিস জুলি পুরো নাম জুলিয়ানা মার্টিন ক‍্যালির্ফোনিয়ার বাসিন্দা। জুলির সাথে আবসারের ব‍্যবসায়িক ক্ষেত্রেই আলাপ হয়। ভীন দেশী জুলিয়ানা মার্টিন মুগ্ধ হয়েছিল আবসারের ব‍্যাক্তিত্বে এই যে মিস জুলি গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার চোখ যেনো আবসারের পোশাক ভেদ করে আবসারের শরীরকে দেখছে এতে আবসারের অস্বস্তি হলেও মুখ তুলে একবারও তাকায় না জুলির দিকে

রিংটোনের শব্দে ঘোর ভাঙ্গে জুলির সে আবসারের দিকে তাকায় ফোনের দিকে তাকিয়ে আবসারের মুখে হাসি ফুটল আবসারের সেই হাসি জুলিয়ানার বুকটা আরো জ্বালিয়ে দিলো

— মিস মার্টিন ক‍্যান উই পোসপন্ড দিস মিটিং

— হোয়াই এ এস

— ফর পারসোনাল রিজন আই উইল ইনর্ফম ইউ আওয়ার নেক্সট মিটিং ডেট বলেই গট গট পায়ে বেরিয়ে পরে মিটিং রুম থেকে মিস জুলিয়ানাকে কিছু বলতে না দিয়ে।
মিটিং রুম থেকে বের হতেই দেখে ফোনটা কেটে গেছে ফুস করে একটা নিশ্বাস ছাড়ে আবসার। সে ঢাকা এসেছে আজ প্রায় একসপ্তাহ এই একসপ্তাহে খুব একটা কথা হয়নি ওয়াসিমার সাথে সে বেশি ডিস্টার্ব ও করেনি কারণ সামনে মেয়েটার এইচ এস সি পরীক্ষা এখন আবসার যদি ওয়াসিমার সান্নিধ্য পায় সে নিজেই মেয়েটার মধ‍্যে মজে থাকবে কোনো পড়া বা কিছু করার সুযোগ দিবে না কিন্তু কাল তো যেতেই হবে তার নানা নানী আসবে ওয়াসিমাকে দেখতে তারউপর দিলরুবা সাখাওয়াত ও এখন আলমনগর আছে সে না গেলে হবে না তাহলে তান্ডব বয়ে যাবে। ভেবেই তার পারসোনাল অ‍্যাসিসট‍্যান্ট পিয়াসকে ফোন দেয় — আগামী দুই দিনের আমার যত মিটিং আছে সব পোসপন্ট করো বলেই রেখে দিয়ে চেয়ারে গা এলিয়ে দেয় তার এখন তৃষ্ণা জেগেছে তার শুভ্র বউকে দেখার তৃষ্ণা

— এই মেয়েটাকে যদি আমি পিষে না ফেলেছি তাহলে আমার নাম আবসার সাখাওয়াত না বিড়বিড় করে বলল।

___________________

ওয়াসিমা ফোনের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে একটু আগে সেই ফোন দিয়েছিল আবসারকে কিন্তু আবসার ফোন রিসিভ করে নি কাল থেকে সে টেনশনে মরছে আর এই লোক নিজের দুনিয়ায় মজে আছে বিড়বিড় করে বলল ওয়াসিমা।
গতকাল রাতেই তাকে সাখাওয়াত বাড়িতে যাওয়ার হুকুম করছে দিলরুবা সাখাওয়াত খবরটা কাল রাতে একজন দারোয়ান এসে দিয়ে গেছে।
একটু পর আরু আসবে তাকে নিতে সেটাই সকালে আরু তার মা আকলিমা রহমানের ফোনে কল করে জানিয়ে দিয়েছে। আকলিমা মেয়ের ঘরে উকি মেরে দেখে মেয়ে চিন্তিত মুখে বসে আছে

— কি হয়েছে আমার মায়ের
বলেই ওয়াসিমার পাশে বসল ওয়াসিমাও মায়ের কোলে মাথা গুজে দিল আকলিমা মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে জিজ্ঞেস করে — কি হয়েছে মা

— আচ্ছা আম্মু আমি কি তোমাদের কাছে এতোই বোঝা হয়ে গিয়েছিলাম যে একজন লোক জোর করল তার হাতে আমাকে তুলে দিলে। লোকটা আমার ভাইয়ের বন্ধু হলেও হাতে গোনা কয়েকবার তার সাথে আমার দেখা হয়েছিল চিনিনা জানিনা এমন একটা লোকের সাথে আমার বিয়ে দিয়ে দিলে।

ওয়াসিমার কথা শুনে চিন্তিত হয় আকলিমা মেয়েটা আজ একসপ্তাহ হয়েছে বাসায় এসেছে সেদিন আবসার দিয়ে গেলেও থাকেনি সে এরপর থেকে মেয়েটাকে খুব একটা জামাইয়ের সাথে কথাও বলতে শুনে নি তাহলে কি সে আবসারের চোখে ভুল দেখল সে যে সেদিন আবসারের চোখে ওয়াসিমার জন‍্যে একরাশ ভালোবাসা দেখেছিল যা তিনি বিয়ের এতো বছর পরেও ইরফান রহমানের চোখে দেখেন আর আবসার দশের মধ‍্যে একজন ছেলে নম্র ভদ্র সবাই তার প্রশংসা করে তাইতো সেদিন আবসার জোর করায় সেও দ্বিমত করেনি বীনা দ্বিধায় দিয়েছিল ওয়াসিমার হাত আবসারের হাতে তাই চিন্তিত স্বরেই জিজ্ঞাসা করলেন

— কেনো আম্মু তোমার কি সেখানে কোনো প্রকার কষ্ট হচ্ছে

— কষ্ট তো তখন বুঝবো যখন আমি সেখানে থাকব বিয়ের আট দিন হয়েছে সাত দিন ধরে তো আমি এখানেই আছি কিভাবে বুঝব কিন্তু প্রথম দিন সবাইকে ভালোই লেগেছে বাকীটা আল্লাহর হাতে

ওয়াসিমার কথা শুনে বুকটা ধক করে উঠে আকলিমার সে কি মেয়ের ভালো চাইতে গিয়ে খারাপ করে ফেলল। সবাই বলে ঘরের ছোট মেয়েরা নাকি চঞ্চল দুষ্টু হয় কিন্তু সেদিকে ওয়াসিমা ভিন্নধর্মী শান্ত শিষ্ট নম্র সভাবের মেয়ে তার পাচঁ ওয়াক্ত নামাজী যথেষ্ট শালীনতা বজায় রেখে চলে সেই দিকে অরিক আলাদা দুষ্টু চঞ্চল কিন্তু ছেলে মেয়ে দুটোই তাদের বাবা মায়ের গর্ব ছেলেটা তাদের জেলার সরকারি কলেজের শিক্ষক মেয়েটারও স্বপ্ন ডাক্তার হওয়ার।

— লিমা
ইরফান রহমানের হাক ডাকে ঘোর ভাঙ্গে আকলিমার
— লিমা দেখে যাও কে এসেছে
— কে ঘরের থেকে বের হতে হতে জিজ্ঞেস করে আকলিমা

— আসসালামু আলাইকুম আন্টি আমি আবসারের ভাইয়ের ছোট বোন আরিশা নিজের পরিচয় দিয়ে বলল

— ওয়ালাইকুম আসসালাম আম্মাজান ভালো আছেন মিষ্টি হেসে বলেন আকলিমা

আকলিমার মিষ্টি ব‍্যবহারের বেশ মুগ্ধ হয় আরিশা তার মনে হয় মানুষ গুলো বেশ ভালো

— আম্মাজান আপনি বসেন আমি নাস্তা আনি

— না না আন্টি এতো ব‍্যস্তা হবার দরকার নেই আমি বাসা থেকে নাস্তা করেই এসেছি

— সে অনেক্ষণ হয়েছে তা এতোক্ষণে হজম হয়ে গেছে আপনি বসেন তো মেয়েটার সাথে গল্প করেন শেষের কথাটুকু ইরফান রহমানের দিকে তাকিয়ে বলল।

— বসেন আম্মাজান এখন আপনার আন্টি এখন দুনিয়া উল্টে গেলেও থামবে না বলেই হালকা হাসে তার হাসি দেখে আরুও হাসে ভাবে লোক গুলো আসলেই ভালো এই জন‍্যেই তার ভাবিটাও ভালো। আরিশা বেশ খুশী তার ভাইয়ের জন‍্যে যাক আল্লাহ্ দয়ায় এইবার অন্তত তার ভাইয়ের জীবনে সুখ নামক বস্তটা ধরা দিবে।
মনে মনে আরিশা নিজের ভাইয়ের জন‍্য দোয়াও চাইল

_________________

দিলরুবা সাখাওয়াত এবং ইসমাত আরা বেগম বসে আছে সামনাসামনি দুইজনের মুখ ভঙ্গিতে চরম বিরক্তিতে ছেয়ে আছে তাদের দুইজনের অবস্থা বর্তমানে এমন যেনো তাদের কেউ নিম পাতা ও করল্লা মিক্স করে শরবত খাইয়েছে।

তাদের দেখে আশে পাশের সবাই মিট মিট করে হাসছে আরিশা তো পারেনা দম ফাটিয়ে হাসতে। কেননা একটু আগেও এখানে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছিল। আবসারের একধমকে থামে দুইজন

আবসার আর ওয়াসিমা এখনো নিচে নামে নি ওয়াসিমা বর্তমানে চাচী শাশুড়ির ঘরে অবস্থান করেছে

— মাশাল্লাহ্ আমাদের আবুর পছন্দ আছে
তানিয়া সাখাওয়াত মুগ্ধ হয় ওয়াসিমাকে দেখে পাট ভাঙ্গা লাল শাড়ি ওয়াসিমার জোরাজুরিতে মাথায় হিজাব পরিয়ে দিয়েছে বড় বড় চোখ কাজল পড়েছে এই অল্প সাজটুকু যেনো ওয়াসিমার রূপ খুলেছে।

_________________

ওয়াসিমাকে নিয়ে নিচে নামল আলিয়া সাখাওয়াত এবং তানিয়া সাখাওয়াত তাকে আবসারের নানী ইসমাত আরা আর নানা ভাই কায়সারে সাহেবের মাঝখানে বসায়। ওয়াসিমা মৃদুস্বরে সালাম দেয়
আবসারের নানী নানা ভাই দুইজনেরই ওয়াসিমাকে বেশ পছন্দ হয় তারা ওয়াসিমা দোয়া করেন সাথে ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করেন ওয়াসিমা তাদের সাথে হেসে গল্প করে। আবসারের নানী নানার সাথে ওয়াসিমাকে হেসে হেসে কথা বলতে দেখে মুখ বাকায় দিলরুবা সাখাওয়াত।

একটু পরে আবসারের নানা কায়সার সাহেব উঠে যেতেই কোথা থেকে আবসার এসে ধপ করে বসে পরে সেখানে একদম ওয়াসিমার গা ঘেসে বসে ওয়াসিমা একটু সরতে নিলেই আবসার ওয়াসিমার শাড়ির কুচিতে পারা দেয় যাতে ওয়াসিমা নড়াচড়া করতে না পারে। ওয়াসিমা আবসারের দিকে তাকায় সে এমন ভাবে বসে আছে যেনো সে কিছুই জানে না

— কি করছেন কুচি ছাড়েন প্লিজ

— ঘরে আসো ওয়াসিমার কথার জবাব না দিয়ে বলে আবসার

— এখন কিভাবে যাবো আর এতোদিন পরে আমার কথা মনে পরল তাহলে ওয়াসিমার অভিমানী স্বরে যার পুরোটাই টের পেলো আবসার কিন্তু কিছু না বলে দাড়িয়ে যায় আর যাওয়ার আগে ওয়াসিমাকে ঘরে যাওয়ার ইঙ্গিত করে দিয়ে যায়।

#চলবে

#বক্ষপিঞ্জিরায়_তুই_বন্দীনি
#সাদিয়া_আক্তার
#পর্ব_৫

সাখাওয়াত ভিলা পুরোটা কবে আমাদের হবে। সাখাওয়াত ভিলার আলিশান বেডে শুয়ে লোকটি জিজ্ঞেস করল রমনীটিকে
— এখনতো আর এহসান সাখাওয়াত ও আসে না এই বাড়িতে সেই হিসেবে পুরো বাড়িটাই তো আমাদের তাই না রমনীটি লোকটির বুকে মুখ গুজে উত্তর দিলো

–হিসেবে হওয়া আর কাগজে কলমে হওয়ার মধ‍্যে একটা তফাৎ আছে সেইটা তুমি বুঝবা না বলেই রমনীটিকে উঠিয়ে ঘর থেকে বের হয় গেলো বার কাউন্টারে সেখানে বসে নিজের মতো ড্রিংকস করতে লাগল তার পিছু গেলো তাকে দেখে কেউ বলবে তিনি পঞ্চান্ন বছরের রমনী ক্রমাগত ফেসিয়াল ডায়েটিং তার উপর আবার শরীরের বাধন ভালো থাকার দারুন তাকে যে কেউ বলবে পয়ত্রিশ বছর বয়সী মহিলা।

— চিন্তা করোনা বাড়ি পুরোটাই আমি দানিশের নামে করে দিব

— দানিশের নামে না আমি বাড়িটা ফাহাদের নামে চাই বলেই নিজের মতো ড্রিংকস করতে লাগল

— কেনো তোমার সব কিছুই তো ফাহাদের নামে আর বাড়িটা অন্তত আমাদের ছেলে দানিশের নামে থাকুক
মহিলাটির কথা শুনে লোকটি তার দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে চলে গেলো ওয়াশরুমের দিকে মহিলাটি একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে লোকটির চলে যাওয়ার দিকে।

________________

আবসারের বাইকের পিছনে বসে আছে ওয়াসিমা আবসারের কাধে তার হাত গম্ভীর মুখে আবসার বাইক চালাচ্ছে বাইক চালানোর অবস্থায় সামনের মিররে ওয়াসিমাকে দেখেতে ভুলে না এক ঝলক তাকাতে বুঝে যায় তার বউ গভীর চিন্তায় ব‍্যস্ত তাই আবসার গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞাসা করল — কিছু হয়েছে কি চিন্তা করছিস

আবসারের কথায় ধ‍্যান ভাঙ্গে ওয়াসিমার সে মুখে হালকা হাসির রেখা টেনে বলল — না কি হবে

আবসার ওয়াসিমার মুখের দিকে তাকিয়ে একবার হুম বলে আবার নিজের মতো কাজ করতে থাকে।

আর ওয়াসিমা ডুবে যায় ভাবনায় তার মনে পরে সকালে ওয়াসিমা শশুর বাড়িতে গেলেও দুপুরে ওয়াসিমার বাপের বাড়ির সবাইকেই দাওয়াত দেওয়া হয়। সেই উপলক্ষ্যে সবাই ওয়াসিমার বাবা মা সহ অরিক ও পৌঁছে যায় সেখানে অরিককে সবাই আগে চিনলেও তার বাবা মায়ের সাথে নতুন পরিচয় তার উপর আবার নতূন তাই ড্রয়িং রুমে সকল পুরুষরা উপস্থিত থাকলেও সকল মহিলারা ছিলো রান্নাঘরে শুধু দিলরুবা সাখাওয়াত বাদে সেখানে ইসমাত আরাও উপস্থিত ছিলো তিনি আবসারের পছন্দের সরষে ইলিশ রান্না করছিল তিনি যখনই এখানে আসেন আবসারের জন‍্য রান্না করে।

সবাই যখন নিজেদের কাজে ব‍্যস্ত ওয়াসিমাকে মিষ্টি জাতীয় কিছু বানানোর জন‍্য বলা হয়েছে তাই সে নিজের মতোই কাজ করতেছিল তখন আলিয়া সাখাওয়াতের কথায় অবাক হয়ে তার দিকে তাকায়

— আন্টি কত চামচ সরিষা বেটে নিব

কেউ কি নিজের মাকে আন্টি বলে ভেবে পায়না ওয়াসিমা
আলিয়া সাখাওয়াতের কথা ওয়াসিমা একবার শাশুড়ি ও একবার নানী শাশুড়ির দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকায়। আলিয়া সাখাওয়াত ও বুঝতে পারে তিনি ভুল জায়গা কথাটা বলে ফেলেছেন তাই আর কিছু না বলে নিজের মতো কাজ করতে থাকেন।
ওয়াসিমাও কেউ কিছু বলছে না দেখে কিছু না বলে নিজের কাজ শুরু করে কিন্তু মনের খুতখুতানি থেকেই যায় তারপর ও সে কাউকে কিছু জিজ্ঞাসা করতে পারছে না কেননা সে নতুন বউ কাউকে এখনই কিছু জিজ্ঞাসা করাটা অনুচিত মনে হবে।

— নাম
— হু

— বাসায় এসে গেছি নাম
আবসারের কথায় ধ‍্যান ভাঙ্গে ওয়াসিমার সে এতক্ষণে নিজের ভাবনার দুনিয়ায় ছিলো সামনে সামনে তাকিয়ে দেখে তাদের বাড়ির সামনে চলে এসেছে। ওয়াসিমার বাবা মা বিকালের দিকে চলে আসলেও ওয়াসিমা আসতে পারেনি সে নানা শশুর নানী শাশুড়িকে বিদায় দিয়ে এসেছে। গ্রাম অঞ্চলে রাত আটটা মানেই গভীর রাত আর ওয়াসিমাদের বাড়িটা একটু গ্রামের দিকেই।

— আপনি যাবেন না ভিতরে

— না আমি রাতের গাড়িতেই ঢাকা ব‍্যাক করব

— একটা দিন থেকে গেলে হয় না অনুনয়ের স্বরে বলল ওয়াসিমা

— থাকলে আমার লাভ
আবসারের কথায় ভরকে যায় ওয়াসিমা শশুর বাড়িতে থাকবে তার আবার লাভ লোকসানের কথা আসছে কোথা থেকে তাই সে অবুজ স্বরেই জিজ্ঞেস করল -” মানে

— এখানে যে থাকব তাতে আমার লাভ কি আপনি তো ব‍্যস্ত মানুষ তাইতো সকাল থেকে আপনার ছায়াটাও দেখে যায়নি রুমের ভিতর

আবসারের কথায় বুঝল সকালের বিষয়টা নিয়েই এই লোক আছে এখন তাই সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল — লাভ লোকসান দেখা লাগে শশুর বাড়িতে থাকতে আর আপনি আগে থাকেন তারপরেই না দেখতে পাবেন লাভ হয় না লোকসান হয়।

ওয়াসিমার কথা শুনে প্রথমে মুখ গম্ভীর থাকলেও শেষের কথাটুকু শুনে তার মুখে হাসি ফুটে ওঠে তাড়াতাড়ি বাইক বাড়ির উঠোনে পার্কিং করে ততক্ষণে ওয়াসিমা ভিতরে প্রবেশ করে আবসারও তার পিছু নেয়।

_______________________

বারান্দায় রকিং চেয়ারে চিন্তিত মুখে বসে আছে এজাজ সাখাওয়াত ঘরে ঘুমানোর জন‍্য বিছানা ঠিক করছে আলিয়া সাখাওয়াত

— কই গো এসো ঘুমাবে
বলেই হাক ছেড়ে স্বামাকে ঘুমানোর জন‍্য ডাকলেন আলিয়া সাখাওয়াত বালিশ দুইটা দুই পাশে রেখেও যখন দেখলেন এছাজ সাখাওয়াত ঘরে আসেনি তখন তিনি বারান্দায় যান স্বামীর কাছে — কি হয়েছে তোমাকে চিন্তিত দেখাচ্ছে স্বামীর কাধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করে আলিয়া সাখাওয়াত
তার কথা শুনে তার দিকে তাকায় এজাজ সাখাওয়াত কিছু না বলে স্ত্রীর হাত ধরে তাকে ঘরে নিয়ে আসে নিজের পাশে বসায়

— আমার কারণে তোমার জীবনটা বিপর্যয় হয়ে গেলো তাইনা আলিয়া স্ত্রীর দুই হাত নিজের মুঠোয় ভরে বলল

— হঠাৎ এই কথা

— হঠাৎই না আলিয়া আসলেই আমার কারণে তোমার জীবনটা এলোমেলো ভালোবাসলেও সাংসারিক সুখ আমি তোমাকে দিতে পারিনি বেশীর ভাগ সময়ই পড়ে থাকি বাড়ির বাইরে ইভেন আমার বড় ছেলেটাকে নিজের ছেলের মতো মানুষ করেছো আমার কারণে আমাদের ছেলেটাও আমাদের কাছে নেই।
স্বামীর কথা শুনে ডুকরে কেদে উঠল আলিয়া সাখাওয়াত পুরোনো ক্ষত আবার তাজা হয়ে গেছে তাইতো কান্নাভেজা কন্ঠেই বলল — হ‍্যা হ‍্যা তোমার জন‍্যই সব কিছু হয়েছে তুমি দায়ী সব কিছুর জন‍্য বলেই এজাজ সাখাওয়াতের বুকে এলোপাথাড়ি কিল মারা শুরু করল আলিয়া সাখাওয়াত। এজাজ সাখাওয়াত ক্রন্দনরত স্ত্রীকে বুকে জড়িয়ে নেয় সেই অবস্থায় আবার বলে– আবসার আমাকে আবার ঢাকার অফিসে জয়ন করতে বলেছে

— কি আবার ঢাকা না না ঐ অভিশপ্ত শহরে আমি আর যাব না ইভেন তোমাকেও যেতে দিব বলেই স্বামীর জামার অংশ খামচে ধরে।
এজাজ সাখাওয়াত চিন্তিত ভঙ্গিতে স্ত্রীর মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে শান্ত করে।

_________________________

আকলিমা বিড়বিড় করে মেয়েকে বকছে আর কাজ করতে কিছুক্ষণ পরে ওয়াসিমাও এসে হাতে হাতে কাজ করতে থাকে মায়ের সাথে

— মা এতো টেনশন করোনা উনি রাতে এতো খায় না আমি দুই দিন ছিলাম ঐ বাড়িতে দুই দিনেই দেখেছি রাতে হালকা খাবার খায়।

— তুই চুপ থাক মেয়ে জামাই প্রথম আমাদের বাড়িতে এসেছে নরমাল খাবার দেওয়া যায় নাকি বলেই আবারও নিজের কাজ করতে থাকে ওয়াসিমাও কিছু বলে না।

_____ ছাদে আড্ডা বসিয়েছে অরিক আবসার তাদের আড্ডার মধ‍্যে অরিকই বেশি কথা বলছে আবসার শুধু হু হা করে চলেছে।

— আমরা চাচ্ছি ওয়াসু মনির এইচ এস সি এক্সামের পর লাবনীকে তুলে নিয়ে আসতে
অরিকের কথা শুনে আবসার ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বলে — এই লাবনী কে আর তুই না বিবাহিত তারপরও একটা মেয়েকে তুলে আনার চিন্তা করতে লজ্জা করে না

— চুপ কর শা*লা আমার বিয়ের দিন আমার বউকে যে জামাল গোটা খাইয়ে আমাদের ব্ল‍্যাকমেইল করে আমার বোনটাকে বিয়ে করে নিলি বেটা যার ফায়দা উঠিয়ে বিয়ে করলি তার নাম ও জানিস না দাতে দাত চেপে বলল অরিক

— তোর বউয়ের নাম লাবনী

— আজ্ঞে হ‍্যা

#চলবে

#বক্ষপিঞ্জিরায়_তুই_বন্দীনি
#সাদিয়া_আক্তার
#পর্ব_৬

ভালোবাসা সতো সুপ্ত এক অনুভূতি যা আবসার নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়ের জন‍্য সৃষ্টি হয়েছিল কিন্তু সেটা পাত্তা দেয়নি পরবর্তীতে তার প্রত‍্যেকটা দিন কেটেছে ওয়াসিমাকে ভেবে সেই অনূভুতি যেনো প্রখর না হয় তাই তো খুব একটা গ্রামেও আসত না এমনিতে আবসার খুব একটা গ্রামে আসে না কিন্তু সেদিন বিয়ের খবর পেতেই দিন দুনিয়া ভুলে চলে আসে প্রিয়তমাকে নিজের করতে করেও নিয়ে ফেলে
পুরোনো সৃত্মি ভেবেই হাসি ফুটে আবসারের। আবসারকে একা একা হাসতে দেখে ভ্রু কুচকে তার দিকে তাকায় অরিক

— কিরে ভুতে ধরছে নাকি একা একা হাসছিস যে

— হু কিছু না স্তম্ভিতে ফিরে আবসার বলেই আবসার অন‍্য কথা উঠায় এর মধ‍্যেই নিচে রাতের খাবারের জন‍্য ডাক পরে নিচে নেমে আসে দুই বন্ধু
টেবিলে খাবারের বাহার দেখে অরিক বলে — কি আম্মু এতো খাবারের ব‍্যবস্থা কেনো
অরিকের কথা শুনে চোখ রাঙ্গায় আকলিমা রহমান।
সবাই খেতে বসে ইরফান রহমানও বসে সেখানে আবসারকে দেখে মুখটা গম্ভীর করে রাখে ইরফান রহমানের গম্ভীর মুখ দেখে আকলিমা আর ওয়াসিমা একে অপরের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ছাড়ে

— আম্মু তুমিও বসে পড়ো ওয়াসু মনি তুইও বসে পড় ভাই তোকে খাইয়ে দিচ্ছি
ভাইয়ের কথা ওয়াসিমা উচ্ছসিত পায়ে বসে পড়ে
অরিক ওয়াসিমাকে নিজের হাতে খাওয়ানো শুরু করে।
আবসার তাকিয়ে দেখে ওয়াসিমার উচ্ছাস তার ভালো লাগে ভাই বোনের এই ভালোবাসা তারও মনে পড়ে তার ভাইয়ের কথা কিন্তু আজ তারা পরিস্থিতির কারণে আলাদা। অবশ‍্য তার কারো সাথেই খুব একটা ভালো সম্পর্ক নেই সে বাসায় থাকলেও চুপচাপ থাকে সে কারো সাথেই কথা খুব একটা বলে না শুধু আরু ছাড়া একমাত্র আরুর সাথেই সে মোটামুটি কথাবার্তা বলে নাহলে না।

ওয়াসিমা ও আকলিমা রহমান টেবিলের সব খাবার গুছিয়ে বেচে যাওয়া খাবার ফ্রিজে রাখছে নাহলে এই গরমে খাবার নষ্ট হয়ে যাবে আকলিমা অনেক বার বলেও মেয়েকে পাশ থেকে সরাতে পারেনি তাই অগত‍্যা হার মেনে নিয়ে দ্রুত কাজ শেষ করার চেষ্টা করছে।
একটু পরেই ঘড়ির কাটা এগারোটা বাজলেই ঘরে ঢোকে ওয়াসিমা দরজার সামনে দাড়াতেই দেখে আবসার পায়চারি করছে আর বিড়বিড় করে কি যেনো বলছে।

— এতোক্ষণ লাগল কেনো সেই কখন না খাওয়া দাওয়া শেষ ওয়াসিমা ঘরে ঢুকতেই আবসার জিজ্ঞাসা করল
উত্তরে ওয়াসিমা মিষ্টি হেসে বলল — আম্মুর সাথে একটু এগিয়ে দিচ্ছিলাম

— ওহ নামাজ পরেছ
— হ‍্যা রান্নার মাঝখানে পড়ে নিয়েছিলাম বলেই ওয়াসিমা ওয়াশরুমে চলে যায়। আবসার ওয়াসিমার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বিছানায় বসে ফোনের মেইল চেক করতে থাকে।
ওয়াশরুমের গেইট খোলার শব্দে সেদিকে তাকায় আবসার ওয়াসিমা হাত মুখ মুছতে মুছতে বের হচ্ছে।
ওয়াসিমা আবসারের দিকে একবার তাকিয়ে চলে যায় বারান্দায় গামছা মেলে দিতে কোমরে এক উষ্ণ স্পর্শ পেয়ে কুকরে গেলো আবসারের হাত অবাধে বিচরণ করছে ওয়াসিমার উন্মুক্ত উদরে ওয়াসিমার ঘাড়ে নাক ঘসতে ঘসতে বলল — লাভ লোকসানের হিসাব করছিলাম না কই লাভের কিছুই তো পেলাম না উল্টো লোকসানের খাতায় নাম লেখালাম

— লাভ হিসেবে কি চাই আপনার ( কাপা কাপা স্বরে বলল ওয়াসিমা )
ওয়াসিমার কথা শুনে আবসার তাকে একটানে সামনে ঘুড়িয়ে নেয় ওয়াসিমা চোখ বন্ধ করে রেখেছে ওয়াসিমার সারা মুখে বন্ধ চোখে অধর ছোয়ায়। ওয়াসিমা নিভু নিভু চোখে তাকায় দেখে আবসার তার দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে

— কিস মি বউ ঘোর লাগা কন্ঠে বলল আবসার
আবসারের কথা শুনে ওয়াসিমা লজ্জায় খামচে ধরে আবসারের টিশার্টের অংশ। কোনোভাবে মাথা নাড়িয়ে না করে

— উহু মানব না আমার দাবী মানতে হবে

— প্লিজ আমার লজ্জা করে

— উহু সেদিনই না লজ্জা ভেঙ্গে দিলাম

— সেদিনের পর সাত দিন কেটে গেছে বলেই জিব কাটল ওয়াসিমা কি বেফাঁস কথা বলে ফেলেছে এখন এই লোক তাকে লজ্জা দিয়ে মেরে ফেলবে ওয়াসিমার কথা উত্তরে আবসার কিছু বলতে নিবে তখনই কর্কশ শব্দে আবসারের ফোনটা বেজে উঠল। আবসার বিরক্ত ভঙ্গিতে ফোনটা পকেট থেকে বের করেই ভ্রু কুচকে ফেলে তার অ‍্যাসিসট‍্যান্ট পিয়াস ফোন দিয়েছে এই সময় তো তার অ‍্যাসিসট‍্যান্ট ফোন দেয় না আর এই সিমের নাম্বার তো তার জানার কথা না।
আবসার ফোন ধরতেই ঐ পাশ থেকে সালাম দিলো
— ওয়ালাইকুম আসসালাম পিয়াস বলো

— স‍্যার ইমাজেন্সি একটু আসতে হবে ফ‍্যাক্টরির ওর্য়াকাররা ঝামেলা করছে আর নতুন প্রজেক্টের জন‍্য যেই জায়গাটা সরকার ঠিক করেছে সেই জায়গাই যেই বস্তির লোকজন থাকত তারা জায়গা ছাড়তে নারাজ।

— আমি আসছি পিয়াস সকাল এগারোটায় ওর্য়াকারদের একসাথে থাকতে বলো আর ঐ ম‍্যাটার ভেবে সলভ করবো বলেই ফোন কেটে আরেকটা ফোন কল করে

— হ‍্যা একটা টিকিট কেটে রাখো স্লিপার কোচের আমি আধ ঘন্টার মধ‍্যে পৌঁছে যাব বলেই আবসার রেডি হয়।

— কোনো সমস‍্যা এখনই চলে যাবেন আবসারের ঘড়ি এগিয়ে দিতে দিতে বলল ওয়াসিমা

— হুম এখনই বের হবো একটু জরুরি কাজ পরে গেছে তুমি নিজের খেয়াল রেখো আর ঠিক মতো থেকো বলেই ওয়াসিমার কপালে একটা দীর্ঘ চুমু দিয়ে বের হয় আবসারের পিছু পিছু ওয়াসিমাও বের হয় তাকে সদর দরজা পযর্ন্ত এগিয়ে দিয়ে সেখানেই দাড়িয়ে থাকে কতক্ষণ।

তার মনটা অশান্ত হয়ে গেছে বিড়বিড় করে আল্লাহর কাছে আবসারের সুস্থতা ও বিপদ মুক্তির দোয়া চায় আল্লাহর কাছে।

____________________

এভাবেই কেটে গেছে তিন মাস এই তিনটা মাস আবসার একবারো আলম নগর আসার সুযোগ পায়নি আজকে ওয়াসিমা এইচ এস সির প্রথম পরীক্ষা। ওয়াসিমার মনটা বেশ উদাসীন ও ভয়ে জর্জরিত আবসারের সাথে কালকে রাতেও কথা হয়েছে লোকটা খুব একটা কথা বলে নি ইভেন কালকে রাতে ভিডিও কলও দেয় নি কোনো বিপদ হলো নাতো ভেবেই ওয়াসিমা উদাসীন আর প্রথম পরীক্ষা সেই নিয়ে একটু ভয়ে আছে অবশ‍্য তার প্রিপারেশন বেশ ভালো কিন্তু তারপরও ভয়টা এসেই পরে।

— ওয়াসু মনি দ্রুত কর আবার হলে যেয়ে সীট খুজতে দেরী হবে
অরিকের ডাকে ওয়াসিমার ভাবনা ভাঙ্গে সে দ্রুত ব‍্যাগ নিয়ে বের হয় মা বাবার থেকে দোয়া নিয়ে সে সহ অরিক বের হয়

পরীক্ষা হলের সামনে দাড়ানো ব‍্যাক্তিকে দেখে ওয়াসিমার পা সেখানেই থেমে যায়।
আবসার অরিকের সাথে কোলাকুলি করে

— তুই না বললি আসতে পারবি না

— আসতে হলো বলেই ওয়াসিমার দিকে তাকায় অরিক বন্ধু আর বোনকে আলাদা স্পেস দিয়ে সামনে আগায় আর যাওয়ার আগে বলে যায় সে ওয়াসিমার সীট খুজে রাখবে। অরিক যেহেতু এই কলেজের টিচার সেই হিসেবে সেও টিচার্স রুমে গিয়ে এন্ট্রি করে বের হয় ওয়াসীমার রুমের সীটের তালিকা দেখতে।

— গাড়ির ভিতরে ঢুকে বস

— কেনো এটা কার গাড়ি আর আপনি কখন এলেন একসাথে গড়গড় করে বলল ওয়াসিমা

— আগে উঠে বস তারপর বলছি
ওয়াসিমাও কথা বাড়ায় না চুপচাপ গাড়ির ভিতরে ব‍্যাক সীটে বসে পড়ে আবসার ওপর পাশ দিয়ে বসে গাড়ি লক করে বসে হ‍্যাচকা টানে ওয়াসিমাকে বুকে জড়িয়ে নেয়। ওয়াসিমাও চুপ করে আবসারের বুকে মাথা রাখে তার ঢুকরে কান্না আসছে সে এখন চাচ্ছে না কান্নাকাটি করতে
— কান্না আসলে থামিয়ে রাখতে নেই বউ
আবসারের আহ্লাদ মাখা কথা শুনে ওয়াসিমা নিজেকে থামিয়ে রাখতে পারে না কান্না করে দেয়।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে