#বক্ষপিঞ্জিরায়_তুই_বন্দীনি
#সাদিয়া_আক্তার
#পর্ব_৪৬ ( অন্তিম পর্বের প্রথমাংশ )
ফার্মেসী থেকে বের হয়ে আবসার তাকায় অরিকের দিকে। ছেলেটা একটা কথাও জিজ্ঞেস করল না কিভাবে কাটল। আষয় বিষয় কিছুই জিজ্ঞাসা করল না কিন্তু কেনো??
— তুই কিছু জিজ্ঞাসা করলি না কেনো??
— কি জিজ্ঞেস করব,, সামনের দিকে তাকিয়ে বলল অরিক।
— অনেক কিছুই জিজ্ঞেস করতে পারতি!!
আবসারের কথা শুনে হাসে অরিক তবে কিছু বলে না। অরিকের নিশ্চুপতায় আবসার ও কিছু বলে না দুই বন্ধু যায় নিজের গন্তব্যস্থল।
— তোরা কি এলিয়েন??? আবসারের প্রশ্নে যারপরনাই অবাক অরিক। অবাক স্বরেই বলল
— মানে
— আমার মাঝে মাঝে মনে হয় তোরা এলিয়েন শুধু আমার শশুর মশাইটা বাদে। আবসারের কথা শুনে অরিক হাসে। তার হাসি দেখে ফুসে ওঠে আবসার।।
কিছু না বলে হনহন করে চলে যায় নিজেদের বাসার উদ্দেশ্যে। আবসার চায় অরিক ওয়াসিমা নিজেদের ক্ষোভ ঝারুক তার উপর। তার সাথে রাগ করুক। কিন্তু তারা দুই ভাইবোন চুপচাপ সব মেয়ে নিচ্ছে আর এতে আবসারের অনুতাপ আরো বেড়ে চলেছে। সে চায় অরিক তার সাথে ঝগড়া করুক ওয়াসিমার জন্য। কেনো তার বোনের সাথে এরকম করেছি তার কইফিয়্যৎ চাক কিন্তু না অরিক এমন ভাব করছে যেনো সে কিছুই জানে না। অথচ আবসার ভালো করেই জানে অরিক সব জানে কিন্তু কিছু বলে না।
________________________
আবসারের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে অরিক। সে বুঝেছে আবসার কি বলতে চায় তবুও না বুঝার ভান করে গেছে।
সেদিন তাদের বাসায় যখন আবসার ওয়াসিমার সাথে চিল্লাচিল্লি করেছিল তখন সব কিছুই শুনতে পায় অরিক। আবসার যে ওয়াসিমাকে সন্দেহ করেছিল সেটাও তারা শুনতে পায়। প্রতিবেশীদের কাছ থেকে। ঐ উড়ন্ত বার্তা তাদের কানে আসে। সেদিন রাগে যখন আবসারের কাছে কইফিয়্যৎ চাইতে গিয়েছিল সেদিন তাক আটকায় আকলিমা।
আকলিমা তাকে বুঝায় সব সময় রাগ ঝেড়ে ঝগড়া করে সমাধান মিলে না। শান্ত মস্তিষ্কে থেকেও কাজ হয়। এখন যেমন তোমার মাথা গরম আবসারের ও মাথা গরম দুইজনের মধ্যে কথা কাটাকাটি হবেই। এতে সম্পর্কে অবনতি আসবে। তোমার সাথে ওর তিনটি সম্পর্কে জড়িত। তাই এখন চুপ থাকো আর আবসার যখন নিজের অনুশূচনায় দগ্ধ হবে। ও তখন নিজেই সব ঠিক করবে সেটা হবে আমাদের সবচেয়ে বড় পাওয়া।
তাই তো অরিক সব জেনেও চুপ থাকে। কিন্তু ইরফান চুপ থাকে না সে আবসারকে তাদের চরম সত্যিটা জানিয়ে দেয় যাতে আবসার অনুতপ্ত হয়ে। নিজের রাগের কাছে হেরে অনুতপ্ত হওয়া হলো সবচেয়ে বড় বিবেক দংশন ।
_______________
আবসার প্রতিদিন ওয়াসিমাকে খাইয়ে দিলেও আজকের তালিকা ভিন্ন। আজকে ওয়াসিমা আবসারকে খাইয়ে দিচ্ছে আবসারও যেনো তৃপ্তি করে খাচ্ছে ওয়াসিমার হাতে। খাওয়া দাওয়া শেষে আবসারকে ঘরে পাঠাতে চাইলেও পারেনা ওয়াসিমা ত্যাড়া আবসার ঠ্যাডার মতো দাড়িয়ে আছে। সেদিকে তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে ওয়াসিমা। এই লোকটা এতো ত্যাড়া কেনো ভেবে পায়না ওয়াসিমা,,,,
— সব কাজ শেষ চলেন ঘরে ঔষধ খেতে হবে বলেই আবসারের আগে ঘরে ঢুকে। আবসারও ওয়াসিমার পিছু পিছু ঘরে ঢোকে
— নেন,, পাতা ছিড়ে ওষুধ গুলো দিয়ে পানির গ্লাস এগিয়ে দেয়।
আবসার চুপচাপ খেয়ে নেয়। ওয়াসিমা পানির গ্লাসটা নিয়ে ঘুরতেই পিছনে থেকে আবসার তাকে পাজা কলে নেয়। হঠাৎই আবসারের এমন কান্ডে ভয় পেয়ে যায় ওয়াসিমা। খামচে ধরে আবসারের টিশার্টের কলার চোখ বন্ধ করে ফেলে।
আবসার ওয়াসিমাকে বিছানায় শুয়িয়ে দেয়। বন্ধ আখি জোড়ায় ফু দেয়।
কেপে ওঠে ওয়াসিমা। আরো শক্ত হয় আবসারের টিশার্টের কলারের বাধন হঠাৎই তার মনে হয় আবসার ব্যাথা পেয়েছে। তার ব্যাথার হাতটাই ওয়াসিমার পিঠের নিচে ধরপরিয়ে উঠতে চায় ওয়াসিমা। আটকে রাখে আবসার বেশ শক্ত বাধন। যেনো ছেড়ে দিলেই পালাবে
— কি করছেন কাটা হাতে ব্যাথা পাবেন তো।।
— উহু পাবোনা বলেই মুখ ডুবায় ওয়াসিমার গলদেশে। চোখ বন্ধ করে নেয় ওয়াসিমা। কিছুক্ষণ পরেই নিজের কাধটা ভিজা অনুভব করে ওয়াসিমা আবসারের শরীরে হাত দিতে দেখে আবসার কেপে কেপে উঠছে। সে বুঝতে পারে আবসার কাদছে
— কান্না করেছেন
— হু। তুই এমন কেনো বউ কোনো অভিযোগ নেই অন্য কোনো মেয়ে হলে আমাকে ছেড়ে দিতো তবুও নিজের প্যাশন,, আশা,, আকাঙ্খা ছেড়ে দিতো না। এতো ভালো কলেজে চান্স পেয়েও আমার এককথায় পড়াশোনা ছাড়তে রাজি হলি। নিজের মুখে এখন পযর্ন্ত এবারও ভর্তির নাম পযর্ন্ত উচ্চারণ করলি না।
তোর এই শান্ত রুপ আমার সহ্য হচ্ছে না। তোকে সন্দেহ করার জন্য আমার সাথে ঝগড়া করতি অভিমান করতি। তাও করলি না। তোর না দেওয়া শাস্তি গুলোই তো আমার মনে তীরের মতো বিধছে বউ। কেনো কেনো নিজের অভিমান ঝাড়লি না????
আবসারের কথা শুনে তার অগোচরে মুচকি হাসে ওয়াসিমা। সে এটাই চেয়েছিল যে আবসার নিজের মনের জটিলতা মিটিয়ে তার কাছে আসুক। হ্যা সম্ভব হয়েছে আবসার নিজে থেকেই তাকে ভর্তি করিয়ে দিবে ওয়াসিমা এটাও জানে।
— হয়েছে আর কান্না করতে হবেনা। ভাবা যায় শক্ত পোক্ত আবসার সাখাওয়াত কান্না করছে তাও আবসার আঠারো বছরের এটা মেয়ের সামনে ,,”মজা করে বলে ওয়াসিমা।
— না ভাবার কি আছে এই আবসার সাখাওয়াত এই আঠারো বছর বয়সী মেয়ের সামনেই কাবু।
ওয়াসিমার নাকে নাক ঘসে বলে আবসার
তা দেখে হাসে ওয়াসিমা আবসারও মুচকি হাসি দিয়ে বলে — কাল সকালে রেডি থাকিস
— কেনো কোথাও যাবো???
— হু তোর ভর্তির জন্য যাব
— আমি যদি ভর্তি না হই _” আবসারের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল
ওয়াসিমার কথা শুনে আবসারের হাসি মুখে গ্রহণ লাগে সে নিচু স্বরে বলল
— আম সরি বউ। তুই তো আমার অতীতটা জানিস তাই যখন ঐ মহিলা কথা গুলো বলেছিল,,
— তখন আপনি ভেবে বসলেন আমার বয়স অল্প চোখে রঙ্গিন স্বপ্ন আবার ভালো মেডিক্যাল কলেজে চান্স পেয়েছি। ভবিষ্যতে যদি আপনার মা যেমন আপনার বাবাকে ছেড়ে গিয়েছে আমিও যদি চলে যাই।
ওয়াসিমার কথা শুনে আবসার কিছু না বলে উঠে বসে মাথা নিচু করে।।
— যদি যাওয়ার হতো আপনি যখন আমাকে বাপের বাড়ি রেখে মাসের পর মাস ঢাকা ছিলেন তখনই চলে যেতাম। সেই কিশোরী বয়স থেকে নিজের আবেগ কন্ট্রোল করা শিখেছিলাম আমি শুধুমাত্র একজনের জন্য আর সেই একজন কে জানেন আপনি।। তাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা আমি দুস্বপ্নেও ভাবিনি।
অনেক গুলো কথা বলে থামে ওয়াসিমা। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে রাত বারোটা পার। তাই সে আবসারের দিকে পিঠ করে শুয়ে বলে — অনেক রাত হয়েছে ঘুমান কালকে আপনার অফিস আছে।।
— তো তুই মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হবি না??
— না ,, ফিতে কাটার মতো কেচত করে একবাক্যে শেষ করে।
আবসারের মুখখানা চুপসে যায়। সে চুপসানো চেহারা নিয়ে ওয়াসিমার পাশে শুয়ে তাকে তার দিকে ফিরায়।।
— এমন করে না বউ। তুই আমার ভালো বউ না ভর্তি হো লক্ষী পাখি আমি ওয়াদা করছি আর কোনো দিন এরকম কোনো কাজ করব না। যদি কোনো জিজ্ঞেস করার হয় তাহলে সরাসরি তোর কাছে এসে জিজ্ঞাসা করব। তুই চাইলে এই বাসাও ছেড়ে দিব প্লিজ বউ আমার রাজি হয়ে যা।।
আবসারের কাতর স্বর শুনে ওয়াসিমা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বলল — আচ্ছা পরে দেখা যাবে এখন ঘুমান।।
— উহু
— তাহলে
— অনেক দিন ধরে বউকে কাছে পাইনা আমার এখন ভীষন প্রেম প্রেম পাচ্ছে।
— আমার এখন ভীষণ ঘুম ঘুম পাচ্ছে
— তুই ঘুমা আমি আমার কাজ করি বলেই আবসার নিজের কাজ বহাল রাখল। ওয়াসিমার চোখে ঘুম থাকলেও আবসারের স্পর্শের তীব্রতায় ঘুমাতে পারল না নিমিষেই এলোমেলো হয় ওয়াসিমা। প্রেম নেশায় মাতাল আবসার ডুব দেয় ওয়াসিমাতে।।
#চলবে
#বক্ষপিঞ্জিরায়_তুই_বন্দীনি
#সাদিয়া_আক্তার
#পর্ব_৪৭ ( অন্তিম পর্বের দ্বিতীয় অংশ )
ড্রয়িং রুমের সোফায় মাথা নিচু করে বসে আছে আবসার। সকাল থেকে এই পযর্ন্ত আবসার কয়েকবার বলেছে রেডি হতে ভর্তির জন্য যাবে কিন্তু সেদিকে ওয়াসিমার কোনো খবর নেই। সে দিব্যি নিজের মতো কাজ করতে থাকে। সকালের নাস্তা বানাতে ব্যস্ত। পরোটা তেলে ভেজে নিয়ে সবজি বাটিতে ঢালে। দুইজনের খাবার এক প্লেটে নিয়ে আবসারের সামনে বসে টুকরো টুকরো পরটা আবসারের মুখে দিতে থাকে। প্রথমে আবসার খেতে চায়নি কিন্তু ওয়াসিমার সাথে পারেনি। প্রথম যখন লোকমা মুখের সামনে ধরে আবসার মুখ সরিয়ে নিলে ওয়াসিমাও ঠ্যাডার মতো তার মুখের সামনেই ধরে রাখে খাবারের টুকরো অগত্যা না পেরে আবসার মুখে নেয় খাবার।
আবসার ভেবে পায়না এই মেয়ের এতো জেদ এতোদিন কই ছিলো। ফুসস করে একটা দীর্ঘ শ্বাস ছাড়ে আবসার । এখন ওয়াসিমাকে বুঝাতে পারে একজনই। দুনিয়ার বাকি সবার কথা ফেলতে পারলেও নিজের বাবার কথা ফেলতে পারেনা। আবসার হাতে নিয়ে সময় দেখে আবসার নয়টা বেজে ত্রিশ মিনিট। মোবাইলটা হাতে নিয়েই উঠে দাড়ায়। ওয়াসিমা ঘরের থেকে আবসারের ওষুধ গুলো আনতে আনতে দেখে আবসার বাহিরে যাচ্ছে,,,,,
— এখন কই যাচ্ছেন???
— আসতেছি!!
— ওষুধ আছে খাওয়ার পর ভুলে গেলেন নাকি বিরক্তি ঝেরে বলল ওয়াসিমা।।
আবসার উত্তর না দিয়েই সিড়ি বেয়ে চলে যায় চার তলায়। নক করে শশুরালয়ের ফ্ল্যাটে। সকাল সকাল আবসারকে দেখে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে ইরফান। কিন্তু আকলিমা একটু অবাক হয়েছে কারণ বিগত কয়েকদিন ধরেই আগে বাসায় ঢুকার আগে এদিকে একবার উকি দিয়ে যেতোই। কিন্তু ইদানীং আসে না আকলিমাও কিছু বলল না গেট থেকে সরে দাড়াল
— আম্মু আরু কোথায়??
— বউমা তার ঘরে পড়তে বসছে
আবসারের ইস্তত লাগছে কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না।
— কিছু বলবে আব্বু??
— হ্যা আসলে ওয়াসিমা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হতে চাচ্ছে না। ওকে যদি একটু মানিয়ে নিতেন ভর্তির জন্য। আবসারের কথা শুনে আকলিমা কিছু না বলে রান্নাঘরে চলে গেলো। এককাপ চা এনে ইরফানের হাতে দিল।
— আব্বু আমার সাথে যদি একটু যেতেন ওয়াসিমাকে রাজি করতে “” বেশ ইস্তত ভাবেই বলল আবসার। তার কেমন জানি লাগছে বলতে এই কথা গুলো।
ইরফান আকলিমার দিকে তাকায় আকলিমা চোখের ইশারায় সম্মতি দিলে রাজী হয় ইরফান।
— আচ্ছা বসো আমি চা টা শেষ করি।।
মাথা নাড়িয়ে বসে পড়ে। এরমধ্যেই আকলিমা একটা বাটি এনে আবসারের হাতে দিয়ে বলে — গতকাল একটু পায়েস করেছিলাম। ইদানিং তো তুমি আসোনা আব্বু তাই তোমার জন্য উঠিয়ে রেখেছি ভেবেছিলাম একটু পরেই যেয়ে দিয়ে আসব ওয়াসু কাছে।
ভালোই হয়েছে তুমি এসে গেছো।
আবসার মাথা নিচু করে বাটি হাতে নেয়। কাপা স্বরে বলে — ইদানীং বেশ চাপের মধ্যে যাচ্ছি আম্মু।
— আমি বুঝেছি আব্বু তুমি খাও তো আমি দেখি আরুর কি অবস্থা পরসু মেয়েটার পরীক্ষা নাওয়া খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে একেবারে,, একটা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে উঠে যায় আরুর ঘরের দিকে।
ইরফান চা খাওয়ার ফাকে ফাকে আবসারকে দেখছে। আবসারও খাওয়ার ফাকে ফাকে শশুরকে দেখছে।
তাদের এখন “” চোখে চোখে কথা হবে মুখে কেনো বলোনা,,,
এই পরিস্থিতি চলছে। দুইজন একসাথে যার যার পাত্র খালি করে।
— চলো ” বলেই ইরফান আগে যায় তার পিছু পিছু আবসার যায়। ইরফানের বেশ ভালো লাগছে গোয়ার আবসারের এই চুপসানো মুখখানা দেখতে। সে মনে মনে হেসে নেয় কিছুক্ষণ,,
— শা*লা হাতি খাদে পরলে চামচিকাও লাথি মারে বিড়বিড় করে বলে আবসার
— উফফস ভুল হয়ে গেলো এইতো তার শশুর। তার প্রান প্রিয় অর্ধাঙ্গীনির জন্মদাতা তার থেকে দুই চারটা লাথি খাইলে দোষ নেই। পরেই আবার ভাবল — আবসার তুই কি সত্যিই শশুরের পায়ের লাথি খেতে চাস। না না না কখনও না। আবসার বউ বিরহে তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে
শেষের কথাটা একটু জোরেই বলল আবসার। তা শুনে ইরফান জবাব দিল — সেই আগে থেকেই তোমার মাথা খারাপ। তুমি আজ স্বীকার করলে এই যা।
আবসার দাতে দাত চেপে চুপ থাকে। এখন শশুরকে রাগান্বিত করা ঠিক হবে না তাই চুপ থাকে।
— আমার আম্মটা কই রে,, ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল ইরফান। বাবার কন্ঠস্বর শুনে ঘর থেকে বের হয় ওয়াসিমা চিন্তিত আদল খানা
— কি হয়েছে আম্মা?? চিন্তিত লাগছে ।
— একটু উনি গেলো কোথায় যেনো এখনো আসছে না।
— ঐ তো আসছে,, ” মাত্রই ঘরে ঢুকা আবসারকে দেখিয়ে বলল
— আপনি কোথায় গিয়েছিলেন ওষুধ খাওয়ার ইচ্ছা নেই নাকি ।।
— দাও ওষুধ
ওয়াসিমা কোনো কথা না বলে ঘরে থেকে ওষুধ এনে আবসারের হাতে দিয়ে ডাইনিং টেবিলের উপরে থাকা জগ থেকে একগ্লাস পানি ঢেলে দেয়। আবসার চুপচাপ ওষুধ শেষ করে।
— আব্বু তুমি বসো আমি চা আনি।
— না আম্মা চা লাগবে না তুমি আমার কাছে বসো
ওয়াসিমা ভ্রু কুচকে বসে ইরফানের কাছে। ওয়াসিমার হাত ধরে বলল — ভর্তি বিষয়ে কি ভাবলে আম্মা ??
— আমি ভাইয়ের সাথে কথা বলেছি। ভাইয়ার কলেজেই ভর্তি হবো।
আবসার ওয়াসিমার কথা শুনে হা। তলে তলে এই মেয়ে এতো চলে গেছে। এরমধ্যেই ইরফান বলল — তোমার ডাক্তারী পড়ার স্বপ্ন
— পরব না
— এইটাই তোমার শেষ ইচ্ছা। মাথা নাড়িয়ে হ্যা বোধক সম্মতি দেয় ওয়াসিমা। তার প্রেক্ষিতে ইরফান আর কিছু বলে না আবসারের দিকে আড়চোখে তাকায়।
বাপ মেয়ের কথোপকথনে আবসারের মটকা গরম। অনেক হয়েছে চিউ চিউ করে কথা এবার আবসার নিজের মতো স্টেপ নেবে। তাই কোনো কথা না বলে ঝট করে ওয়াসিমার হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় ঘরে। ওয়াসিমা কিছু বুঝে উঠার আগেই ঘরে প্রবেশ করে আর ইরফান ও বুঝতে বুঝতে আবসার ঠাসসস করে দরজা লাগিয়ে দিয়েছে।
— বোরকা পর
ওয়াসিমাও তাও ঠ্যাডার মতো দাড়িয়ে থাকে। ওয়াসিমার আপাদমস্তক জরিপ করে আবসার সুতির গোল জামা সাথে প্লাজো সব মিলিয়ে খারাপ লাগছে না। আবসার কিছু না বলে ওয়াসিমার গায়ের ওড়নাটা নিয়ে হিজাবের মতো পেচিয়ে দেয়। সেই অবস্থায় টেনে নিয়ে যায় যাওয়ার আগে প্রয়োজনীয় কাগজ নিয়ে বের হয়।
— এই আবসার আমার মেয়েটাকে এভাবে গরুর মতো টানতে টানতে কোথায় নিয়ে যাচ্ছো??
— আপনার মেয়েকে হাটে বিক্রি করতে
আবসার কথা শুনে ইরফান ছোট ছোট চোখ করে তার দিকে তাকায়। ওয়াসিমার দিকে তাকালে সে ইশারায় বলে — এখন কিছু বলতে না।।
___________________
সি এন জিতে বসে আছে আবসার ওয়াসিমা। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ চত্বরের সামনে আসতেই সি এন জি থামে। আবসার নামলেও ওয়াসিমা নামে না আবসার আর কিছু না বলে টেনে নামায় তাকে।
ভর্তির সকল কার্যক্রম নিজেই শেষ করে। সাথে কবে নাগাত ক্লাস সময় সুচি সব জেনে আসে।
সকল কার্যক্রম শেষ হতে দুপুর হয়। আজকে শেষ দিন তাই একটু বেশী ভীর। আবসার সেখান থেকে বের হয়ে একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকে কারণ বাসায় কিছু রান্না করা নেই। আবসারের প্রচুর খিদে পেয়েছে। খাবার অর্ডার করে দুইজন নিজের মতো খেতে থাকে এর মাঝে কেউই একটা বাক্য বিনিময় করেনি।
খাওয়ার ফাকে ফাকে আবসারের দিকে তাকায় ওয়াসিমা। আবসারের ক্লান্ত মুখে প্রশান্তির ছাপ সে ভাবছে শেষ হাসিটা আবসার হেসেছে। উহু শেষ হাসিটা ওয়াসিমা হেসেছে যেই আবসার বলেছিল তার আর ডাক্তারী পড়ার মধ্যে যেকোনো একটা বেছে নিতে সেদিনই ওয়াসিমা মনে মনে নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছে। আবসারই তাকে নিজের ইচ্ছায় নিজের তাগিদে তাকে ডাক্তারী পড়াবে। হয়েছেও তাই ওয়াসিমা বেশী কিছু করেনি আবসারকে নিরব আঘাত করেছে। তার মনে অনুকম্পা জাগ্রত করেছে।
#চলবে
#বক্ষপিঞ্জিরায়_তুই_বন্দীনি
#সাদিয়া_আক্তার
#পর্ব_৪৮ ( অন্তিম পর্বের তৃতীয় অংশ )
হায়াৎ লেখে কপালে,” মরণ লেখে পায়ে।
যার যেখানে মরণ লেখা যায়।
এই প্রচলিত কথাটি দিলরুবা সাখাওয়াতের সাথে মিলে গেছে। সে কিছুদিন আগেই স্বামীর ভিটেয় যাওয়ার জন্য হাসফাস করলে এজাজ ও এহসান তাকে সেখানে নিয়ে যায়। তারপরের দিন আবার সে বায়না করে ঢাকা যাবে এবং এক্ষুনি যাবে। তৎক্ষণাৎ তাকে ঢাকায় নিয়ে আসলে। দিলরুবা সাখাওয়াত ভিলায় যায়না। সে যায় আবসার ওয়াসিমার সেই ছোট্ট ফ্ল্যাটটিতে। সেখানেই দুই দিন কাটায় ওয়াসিমও নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে দাদী শাশুড়ির খেয়াল রাখে তার যত্ন করে। আজ সকাল থেকেই দিলরুবা সাখাওয়াতের শরীরটা বেশ খারাপ তবে আরুর পরীক্ষা আছে বলে তিনি কাউকে কিছু জানায়নি। আরুকে পরীক্ষার হলে অরিক নিয়ে যায়। আরু যাওয়ার পরপরই দিলরুবা সাখাওয়াতের শরীরের আরও অবনতি হতে থাকে। ওয়াসিমা তার জন্য দুধ নিয়ে যেতেই দেখে দিলরূবা সাখাওয়াত বিছানায় আধশোয়া অবস্থায় ছটফট করছে।।
ওয়াসিমা দ্রুত তার কাছে যায়। দুইদিন ধরে এজাজ ও আলিয়াও এখানে থাকছে সারাদিন ও রাতে চলে যাচ্ছে। আয়মান ভেনিসা নিচে আরুদের বাসায়। ওয়াসিমা চিৎকার করে শশুরকে ডাকে
— কি হয়েছে আম্মা
দিলরুবা সাখাওয়াত এজাজের কথার জবাব দেয়না। কাপা স্বরে ওয়াসিমাকে বলে আবসারকে ফোন দিতে।
— উনাকে ফোন দিয়েছি দাদী আপনি এবার চলেন হাসপাতালে যাই।
— নারে নাত বউ আমি হাসপাতালে যাব না আমার আবসার আসলেই ওর সাথে দেখা কইরা যামু গা।।
— ঠিক আছে যাবেন এখন আপাতত হাসপাতালে চলেন
দিলরুবা সাখাওয়াত তাও যাওয়ার জন্য রাজী হয় না। এর মধ্যে আয়মান ভেনিসা আকলিমা ইরফান ও এহসান তানিয়া চলে এসেছে সবার মধ্যে আরু, আবসার, অরিক মিসিং আরু পরীক্ষার হলে ঢুকার একঘণ্টা পার হয়ে গেছে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই তার পরীক্ষা শেষ হবে। তাই আকলিমা অরিককে বলে দিয়েছে আরু পরীক্ষার হল থেকে বের হলেই দ্রুত বাসায় পৌছাতে দিলরুবা সাখাওয়াতের অবস্থা বেশী ভালো না।
অরিক জানায় সে দ্রুত পৌঁছনোর চেষ্টা করবে। এর মধ্যে আবসারও উপস্থিত হয় দিলরুবা সাখাওয়াত ইশারায় আবসারকে কাছে ডাকে। একহাতে আবসারের হাত অন্য হাতে ওয়াসিমার হাত ধরে ওয়াসিমার উদ্দেশ্যে বলল — আমার এই দাদু ভাইটা ছোটবেলা থেকেই অনেক কষ্ট করেছে নাত বউ তোমাকে বিয়ে করে একটু সুখের নাগাল পেয়েছে। তুমি এখন যেমন ওকে আগলে রাখো ভবিষ্যতেও তেমন আগলে রেখো এটা তোমার কাছে আমার অনুরোধ।
— আমি আমার সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করব দাদী আপনি চিন্তা করবেন না। এখন চুপ করে রেষ্ট নেন তো
ওয়াসিমার কথা শুনে হাসে দিলরুবা।
— রেষ্ট নেওয়ার অনেক সময় পাবো এখন তো আমার রেষ্টের সময়।
আবসার ঘামছে অনেক ঘামছে সে এরকম সিচুয়েশন কোনোদিন ফেস করে নাই তার মনে হচ্ছে এখানে সে দম বন্ধ হয়ে মারা যাবে কিন্তু উঠে দাড়ানোর মতো শক্তি নাই। পা গুলো একস্থানে জমে গেছে মনে হয়।
ওয়াসিমা আবসারের অবস্থা দেখে তার মাকে ইশারায় কিছু বললে আকলিমা আবসারকে একগ্লাস পানি দেয়। ঢকঢক করে এক নিঃশ্বাসে পানিটা খায় আবসার।
ঘন্টা পেরোয় দিলরুবা সাখাওয়াতের অবস্থা খারাপ হয়। আরও কিছুক্ষণ পরেই আরু আসে।
মুখ দিয়ে কথা বের হয়না দিলরুবা সাখাওয়াতের কোনো রকম ঠোট নাড়িয়ে ভালো থেকো বলেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে।
কান্নার রোল পড়ে যায় আলিয়া তানিয়া এমন ভাবে কান্না করছে যেনো নিজের মা মারা গেছে।।
______________________
দিলরুবা সাখাওয়াতের মৃত দেহ নিয়ে যাওয়া হয় তাদের পৈতৃক কবরস্থানে। নিজেদের প্রতিষ্ঠিত মসজিদে এলাহি ভাবে জানাজা দিয়ে তাকে মাটি দেওয়া হয়। তারা সবাই বতর্মানে সাখাওয়াত ভিলায় আছেন। এখানেই চারদিন থেকে সবাই ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিবেন। আরু ওয়াসিমা ভেনিসা মিলে সকল কিছু সামলায়। ভেনিসার বাবা মাও এসে পরেছে।।
এলাহি ভাবে দিলরুবা সাখাওয়াতের মিলায়তনের আয়োজন করা হয়েছে। গ্রামের সকল এতিম বাচ্চাদের দাওয়াত করা হয়েছে। তাদের গ্রামে মোট দুইটা মসজিদ। দুইটা মসজিদেই খাবার দেওয়া হয়েছে। কুরআন খতম দেওয়া হয়েছে।
এই চারদিনে সবাই মোটামুটি নিজেদের সামলে নিয়েছে। এজাজ সাখাওয়াত একটু বেশীই ভেঙ্গে পরেছে ভিতরে ভিতরে তার চোখ লাল হয়ে আছে।
সকল আনুষ্ঠানিকতা শেষ আগামীকাল সবাই ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিবে।
________________________
কেটে গেছে একমাস যে যার কর্মস্থলে ব্যস্ত ওয়াসিমার ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। আরুও একটা সরকারি কলেজের শিক্ষিকা হিসেছে জয়েন করেছে। আয়মান আর অস্ট্রেলিয়া যায়নি সে বর্তমানে সাখাওয়াত কোম্পানি সামলাতে ব্যস্ত ভেনিসা পুরো দমে গৃহীনি। এই ব্যস্ত জিবনের মাঝে এই তিন জুটি প্রতি শুক্রবার নিজেদের মতো কাটায়। আবসারের ব্যবসায়টাও একটু বড় হচ্ছে
ধীর গতিতে।
আজকে শুক্রবার ওয়াসিমা ভীষণ ব্যস্ত সবাই দাওয়াত করেছে আবসার ছোট খাটো একটা পারিবারিক গেট টুগেদার প্রতি সপ্তাহেই হয়। সকাল থেকে ওয়াসিমার শরীরটাও খারাপ ইদানীং অবশ্য খারাপই যাচ্ছে কিন্তু আজকে মনে হচ্ছে মাথা ঘুরানিতে পরেই যাবে ওয়াসিমা।
রান্নাঘরের সিংক থেকে পানি নিয়ে মাথায় পানি দেয় ওয়াসিমা। পানি দিতেই মাথা হালকা লাগে ওয়াসিমা এখন খিদেটা মাথা চারা দিয়ে উঠেছে অথচ একটু আগেই সে আর আবসার সকালের নাস্তা সেরেছেন।
ফ্রিজ খুলে ওয়াসিমা সেখানে হাতরে কিছু চকোলেটস পায়। সেগুলো নিয়ে খাওয়া শুরু করে। আকলিমা এসেছিল মেয়েকে সাহায্য করতে সারা সপ্তাহ ক্লাস আবার নিজের সংসার সামলে মেয়েটা গতকাল অসুস্থ হয়ে পরেছিল।
— আম্মু এভাবে চকোলেট খাচ্ছো কেনো??
— জানিনা আম্মু অনেক খুদা লাগছে। খেতে খেতে বলল ওয়াসিমা
— কেনো সকালের নাস্তা করনি। আর নাস্তা না করে এইসব হাবিজাবি খাচ্ছো,,
— খেয়েছিতো আম্মু। আবার খুদা লাগছে।
মেয়ের কথায় সন্দিহান নজরে তাকিয়ে রান্নাঘরে চলে যায়।।
খাওয়া শেষে ওয়াসিমা দাড়াতেই টের পায় তার বমি বমি ভাব হচ্ছে এখন ওয়াশরুমে না গেলে সে ফ্লোর ভাসিয়ে দিবে। দৌড়ে ঘরে ঢুকে ওয়াশরুমে দৌড় দেয়। ভিতরে থেকে ওয়াসিমার বমির শব্দ আসতেই আবসার সেদিকে দৌড় দেয়। যেয়ে দেখে ওয়াশরুমের বেসিনে ওয়াসিমা গরগর করে বমি করছে।
— এই ওয়াসু কি হয়েছে?? ওয়াসিমার পিঠে মালিশ করতে করতে বলল।
বমি শেষে ওয়াসিমা মুখ ধুয়ে উঠে দাড়াতেই চারিদিকে অন্ধকার হয়ে যায়। ঢলে পরে আবসারের বুকে।।
ওয়াসিমাকে এভাবে অজ্ঞান হতে দেখে আবসারের তো পাগল পাগল অবস্থা। সে দ্রুত ওয়াসিমাকে কোলে তুলে ঐ অবস্থায় বেড়িয়ে যায়। আবসার হটকরিতায় আকলিমাও তার পিছু পিছু আসে।
— ওয়াসিমার কি হয়েছে আব্বু ওরে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ??
— জানিনা আম্মু একটু আগে বমি করল। বমি করার পরপরই অজ্ঞান হয়ে গেছে আমি ওকে নিয়ে হাসপাতাল যাই আপনি আব্বুকে নিয়ে আসেন। বলেই একটা সিএনজি ডেকে সেটাতে উঠে পরে।
অরিক যখন হাসপাতালে ঢুকে তখন আবসার ডাক্তারের কেবিনের সামনে পায়চারি করছে। অরিক সামনে দাড়াতেই একজন নার্স বের হয় আবসারের হাতে একটা প্রেসক্রিপশন ধরিয়ে দেয়। আর বলে এই টেষ্ট গুলো করাতে। আর ওয়েট করতে সে ওয়াসিমাকে নিয়ে আসছে।
ওয়াসিমার জ্ঞান ফিরেছে শুনে সবাই সস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।
আবসার রিসিপশনের থেকে টেষ্টের বিল দিয়ে আসতে আসতেই ওয়াসিমাকে আকলিমা নিয়ে যায় টেস্টের জন্য ।
— এখন কেমন লাগছে হুম
— ভালো
— ডাক্তার কি বলল??
— বলেছে রিপোর্ট আসলেই বলবে।
দশ মিনিট পর রিপোর্ট আসলে এবার আবসার ওয়াসিমা একসাথে ঢোকে কেবিনে।
ডাক্তারের সামনে দূরুদুরু বুকে বসে আছে আবসার। আবসেরের অবস্থা দেখে ওয়াসিমা মিটমিট করে হাসে। সে নিজের সম্পর্কে অবগত কিন্তু আবসারকে বলছে না তার আবসারের এই দুশ্চিন্তা ভরা চেহারা দেখতে ভালো লাগে।
#চলবে