#বক্ষপিঞ্জিরায়_তুই_বন্দীনি
#সাদিয়া_আক্তার
#পর্ব_৪৫
টলমল পায়ে নিজেদের বাসায় ঢুকল আবসার। ওয়াসিমা রান্নাঘরে রয়েছে রাতের রান্না করবে তার প্রিপারেশন করছে। এর মধ্যেই কারো পায়ের আওয়াজ আসলে রান্নাঘর থেকে বের হতে নিলেই দেখে আবসার ঘরে ঢুকছে। পিছন থেকে ওয়াসিমা ডাকলেও সাড়া দেয় না। ওয়াসিমাও পিছন পিছন ঘরে ঢুকতেই দেখে আবসার ওয়াশরুমে ঢুকে দরজা ঠাসসস করে বন্ধ করে দিয়েছে। ওয়াসিমার আর কিছু না বলে চলে যায় নিজের কাজে উদ্দেশ্য আবসারের জন্য কিছু বানাতে বিকেল বেলা ইরফান রহমান এসেছিল তখন ওয়াসিমা বাবার জন্য মালাই চা করেছিল। সেখান থেকে একটু আবসারের জন্য রেখেছিল,, সেই চায়ের সাথে আরও হালকা খাবার বানায়।
ওয়াশরুমে শাওয়ারের নিচে দাড়িয়ে আছে আবসার। আজকে তার নিজের প্রতি অনেক রাগ লাগছে নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছা করছে। তার কানে এখনো বাজছে ইরফান রহমানের বলা কথাটা “” আমার মেয়েটা তোমায় সেই চৌদ্দ বছর বয়স থেকে ভালোবাসে আবসার। তখন আমি নিজের মেয়েকে তোমার থেকে দূরে রাখতে তাকে বলি তুমি তার মোহ,, আবেগ। তবে আমার মেয়েটা মানেনি আবসার সে সেদিন দৃঢ় স্বরে বলেছিল না — আব্বু ঐ আবসার ভাইকে আমি সত্যিই ভালোবাসি।
ইরফান অবাক হয়েছিল ঐটুকু মেয়ের এমন কন্ঠস্বর শুনে। কিন্তু সে চায়নি আবসারের সাথে তার মেয়ের কোনো আলাপ হোক বা অন্য কিন্তু। তাই সে মেয়েকে আটকানোর জন্য বলল,,,,
— এটা তোমার সাময়িক মোহ আম্মা যেটা সময়ের সাথে কেটে যাবে।
কিন্তু কাটেনি সময়ের সাথে বৃদ্ধি পায় সেই আবেগ ভালোবাসায় রুপান্তরিত হয়। সেই দূরন্ত মেয়েটা ছেলেদের থেকে দূরে থাকা শুরু করে পড়া ছাড়া খুব একটা বাহিরেও যায়না। নিজের আবেগ জমিয়ে রাখে মনের সিন্দুকে যার এক অংশ জেনেছিল ইরফান আর বাকীটা ওয়াসিমা নিজের মনে তালা দিয়ে বন্দী করেছিল।
প্রায় আধা ঘন্টা শাওয়ারের নিচে দাড়িয়ে থেকেও তার মাথা ঠাণ্ডা হচ্ছে না। রাগের ঠেলায় হাত মুঠো করে ওয়াশরুমের আয়নায় ঘুসি মারে। গরগর করে রক্ত পরে হাত থেকে কিন্তু আবসারের সেদিকে কোনো ধ্যান নেই। সেতো নিচের অনুতাপের অনলে আছে। যেই মেয়েটা সেই কিশোরী বয়স থেকে তাকে ভালোবাসল সেই মেয়েটাকে বাহিরের মানুষের কথায় সন্দেহ করল আবসার।
মেয়েটা যেদিন মেডিকেলে চান্স পায়। সেদিনও সে ওয়াসিমার সাথে ভালো করে কথা বলে নি। মেয়েটা সারাদিন মলিন মুখে ছিলো। সেদিকে তাকিয়ে ও আবসার কিছু বলেনি। ছিহ নিজের ভালোবাসার উপর ঘৃণা আসল তার। যদি ভালোবাসার মানুষকে বিশ্বাসই না করতে পারলে তো কিসের ভালোবাসা।। সে সার্থপর হয়েছিল নিজের জন্য নিজের ভালো থাকার জন্য ওয়াসিমার তার প্রয়োজন ছিলো তাই তো সর্বোচ্চ চেষ্টা করেই তাকে নিজের কাছে রাখতে চেয়েছিল।।
কারো ডাক শুনে ঘোর ভাঙ্গে আবসারের ভালো করে শুনে বুঝতে পারে এই কন্ঠটার মালিকে তার একমাত্র বউ ওয়াসিমা
— কি হয়েছে আপনার এখনো ওয়াশরুমে আছেন??শুনছেন আপনি। দরজা ধাক্কাতে ধাক্কাতে বলল ওয়াসিমা।
আবসারের উত্তর না পেয়ে ভয় পেয়ে গেলো ওয়াসিমা আবার আবসার কিছু হলো নাকি তাই দ্রুত আরো জোরে দরজা ধাক্কায়। তাও খোলে না আবসার।
— শুনছেন গেটটা খুলেন না।
ওয়াসিমার ডাক শুনে চোখ বন্ধ করে আবসার ইশশ কি করুন স্বর। এই ডাক উপেক্ষা করার মতো মন মানসিকতা আবসারে নেই। সেই শক্তিও নেই। দ্রুত ভেজা কাপড় ছেড়ে কোমরে টাওয়াল জড়িয়ে গেট খুলে।
— আপনি ঠিক আছেন এতো দেরী হলো কেনো। আমি এখনই ভাইয়ার কাছে যেতাম। দরজা ভাঙ্গার জন্য। আবসারের কপাল মুখ হাতরে অশ্রুসিক্ত নয়নে বলল ওয়াসিমা। আবসার তাকায় ওয়াসিমার দিকে তাকিয়ে রয় কোনো কথার উত্তর দেয়না। এইযে মেয়েটার পিচ্চু পিচ্চু হাত দামরা আবসারের মুখমন্ডলে ছড়িয়ে আছে। তার আবসারের মনে শান্তির জোগান দিচ্ছে।।
আবসারকে কিছু না বলতে দেখে ওয়াসিমা এবার একটু জোরেই বলল
— কি হয়েছে আপনার?? আপনি শুনছেন আমার কথা
— আই লাভ ইউ বউ
আবসারের কথায় বিরক্ত হয় ওয়াসিমা এই লোক কি পাগল হয়ে গিয়েছে সে জিজ্ঞাসা করছে কি আর এই লোক বলছে কি। আর এতোদিন পর এই লোকের ভালোবাসার কথাটা বলতে বলেছে কেউ না বললেই হতো একেবারে নাতি নাতনি নিয়ে বুড়ো বয়সে শুনতো তার ভালোবাসার প্রকাশের কথা।
— মাথা খারাপ হয়েছে আপনার। আমি জিজ্ঞাসা করছি কি হয়েছে আপনার এসেই গোসলে গেলেন আবার এতোক্ষণ লাগিয়ে শাওয়ার ছেড়ে ছিলেন আর আপনি কি বলছেন।
— তি আমো বউ
— এটা আবার কি কথা
— ইউ আমু তে ওয়াইফি
— এগুলো কি বলছেন আপনি। এবার আবসারের কথায় বেশ বিরক্তি হয় ওয়াসিমা। তাই কিছু না বলে যেতে নিলেই পিছন থেকে হাত টেনে আটকায় আবহার। টেনে আনে নিজের বক্ষে ওয়াসিমা মাথাটা চেপে ধরে নিজের বক্ষে সেভাবেই বলল — এই যে এই বক্ষে তুই বন্দীনি কোথাও যেতে পারবি না।।
— কি হয়েছে আপনার এমন করছেন কেনো?? আবসারের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল
— অ আই নি শুভ্র বউ
“- এগুলো কি বলছেন আপনি। আমি যাই টেবিলে নুডুলস রইল খেয়ে নিয়েন চুলায় আমার রান্না আছে।
আবসার বেডের পাশে থাকা টেবিলের দিকে তাকায় সেখানে ঢাকা দেওয়া একবাটি নুডুলস আছে। প্লেটটা ধরার জন্য হাত বাকা করতে নিলেই হাতে তীক্ষ্ম ব্যাথা অনুভব হয় আবসারের। চোখ বন্ধ করে ফেলে এতক্ষণ ব্যাথা অনুভব না হলেও এখন হচ্ছে। সে কাটা হাতটা নিয়ে ঐভাবে বসে থাকে। ওয়াসিমা চায়ের কাপ হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকে দেখে নুডুলসের বাটি ঐ অবস্থায় আছে আর আবসার হাত কোলে নিয়ে বসে আছে। ওয়াসিমা কাছে গিয়ে হাতের দিকে তাকাতেই আতকে ওঠে। পরিমরি অবস্থায় হাতের কাপটা কোনো রকম টি টেবিলে রেখে আবসারের হাত ধরে.,, হাতের উপরের অংশ অনেকটা থেতলে গেছে
— এই আপনার হাতে কি হয়েছে হ্যা। এতো বাজে ভাবে কেটে গেছে কিভাবে
ওয়াসিমার কন্ঠে অস্থিরতা টের পায় আবসার। তাকিয়ে থাকে তার দিকে মেয়েটা কেমন অস্থির হয়ে আছে তার জন্য। ওয়াসিমার এই অস্থিরতা আবসারের অনুকম্পা আরো বাড়ায়। হাসফাস করতে হাত ছাড়িয়ে নেয়।।
— কি হয়েছে আপনার এমন করছেন কেনো। এসেছেন থেকে কেমন আজব বিহেব করছেন হাতে ব্যাধা কিভাবে পেয়েছেন কেনো কখন থেকে জিজ্ঞেস করছি সেটাও বলছেন না,, ওয়াসিমার কান্নাভেজা কথা শুনে আবসার নিরুত্তর। সেটা আরো পোড়ায়। সে আর কিছু না বলে হাতের ড্রেসিং করতে থাকে। প্রাথমিকভাবে চিকিৎসা দেওয়ার পর অরিককে ফোন করে। অরিক বোনের কান্নাকাটি শুনে দ্রুত আসে গেট খুলে ভাইয়ের দিকে অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকায়। অরিক বোনকে থামায়। ওয়াসিমাকে নিয়ে তাদের ঘরে যায়।
— ভাইয়া আমি হালকা পরিষ্কার করে দিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিয়েছি। এখন একটু ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাও তো।।
অরিক আবসারের দিকে তাকায় মনে হচ্ছে সে এই দুনিয়ায় নেই তাই তাকে ডাক দিলো -” আবসার
— হু
— চল
বলেই আবসারের হাত টেনে নিয়ে যায়। গোয়ার আবসারও যেনো আজকে কেমন হয়ে গেছে সব সময় ত্যাড়ামিটা আজকে নেই। সেদিকে অবাক নজরে তাকিয়ে রয় ওয়াসিমা। তার মনে হচ্ছে আবসার কিছু নিয়ে চিন্তিত কিন্তু কি নিয়ে তবে কি আবারও কিছু বলেছে কেউ তাকে নিয়ে।
দীর্ঘ শ্বাস ফেলে তাচ্ছিল্যের হাসল ওয়াসিমার তার ভালো লাগছেনা মন চাচ্ছে কোথাও গিয়ে নিরিবিলি একটু কান্না করে মনটা হালকা করতে সেটাও পারবে না। কারণ এই ফ্ল্যাটের প্রত্যেকটা জায়গায় মাইক্রো চিপ আছে যা দ্বারা আবসার তার ভয়েস রেকর্ড শুনতে পারবে। সেদিন জুলিয়ানার ব্যাপারটাও আবসার এভাবেই জেনেছিল এটা পরে ওয়াসিমা বুঝতে পারে। কিন্তু তাও কিছু বলে নাই আবসারকে কি বলবে তার নিজের কাছেই লজ্জা লাগছে এতোটা লয়াল থাকার পরেও লোকটা তাকে সন্দেহ করে।
#চলবে