বক্ষপিঞ্জিরায় তুই বন্দীনি পর্ব-৪২+৪৩+৪৪

0
120

#বক্ষপিঞ্জিরায়_তুই_বন্দীনি
#সাদিয়া_আক্তার
#পর্ব_৪২

রাত তিনটায় যখন ওয়াসিমার ঘুম ভাঙ্গল। তার কানে কারো মৃদু চিৎকারের আওয়াজ গেলো। সাথে নিজের উপর ভারী কিছু আভাস পেলো। সে তড়াক করে বস্তুটিতে তাকায়। আবসার তার গলায় নাক ডুবিয়ে গভীর নিদ্রায় শায়িত। কিন্তু মৃদু চিৎকার আরো একটু বাড়তেই ওয়াসিমা বুঝতে পারল কেউ কাউকে ডাকছে কিন্তু আওয়াজটা সুস্পষ্ট না কারণ তাদের ঘর আয়মানের ঘর উপরে এক কর্নারে। খুব চেচামেচি ছাড়া শোনা যায়না। রাত দেখেই ওয়াসিমা শুনতে পায়। এমনিতেই ওয়াসিমার ঘুম প্রচন্ড পাতলা সে গভীর ঘুমে থাকলেও কান সজাগ থাকে।

গভীর ঘুমে থাকায় বলিষ্ট দেহী আবসারকে সরাতে কসরত করতে হয় ওয়াসিমার কিন্তু ঘুম পাগল আবসারের ঘুম ভাঙ্গে না। ওয়াসিমা বের হয় ঘর থেকে। বেড়িয়ে আসার আগে পিছন ফিরে আবসারকে একপলক দেখে যায়। কাটায় কাটায় দশ মিনিট পর এই লোকের ঘুম ভাঙ্গবে কারণ সে ঘুমে মাতাল তালে ঠিক। ঠিক হাতরে যখন ওয়াসিমাকে না পাবে উঠে যাবে তাই তাকে ডাকার তাড়াও নেই।

ওয়াসিমা যত নিচে নামে আওয়াজটা জোরালো হয় এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে কোথা থেকে আওয়াজ আসছে। এজাজ ও আলিয়ার ঘর নিচেই তাদের ঘরে আলো জ্বালানো দেখে সেদিকে যায় ওয়াসিমা। দরজায় টোকা দেয়,,,,

সাথে সাথে দরজা খুলে দেয় আলিয়া। ওয়াসিমাকে দেখে অবাক হলেও পরক্ষণেই তাকে টেনে নেয় ঘরের ভিতরে। পাগল স্বরে বলে — ওয়াসু মা দেখো তো আবসারের বাবা কথা বলছে না। তার শরীর কেমন নিস্তেজ হয়ে আছে।

শাশুড়ির কথা শুনে আবাক ওয়াসিমা কিন্তু সেদিকে পাত্তা না দিয়ে দ্রুত শশুরের কাছে যায় পালস চেক করে। যেটা খুব ধীরে গতিতে চলছে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে ওয়াসিমা। সে আলিয়ার কথা শুনে ভেবেছিল অন‍্য কথা যা বর্তমানে তার মস্তিষ্কেও আনতে চাচ্ছে না।

— মা বাবার কি প্রেশার মাপার যন্ত্র আছে??
ওয়াসিমা বলতেই বেডের পাশের ড্রয়ার থেকে যন্ত্রটি বের করে দিলো।
ওয়াসিমা প্রেশার মেপে দেখে প্রেশার অনেক হাই। প্লাস এজাজের নাকি ডায়বেটিস ও আছে।

— মা আপনি বাবার হাত পা ম‍্যাসাজ করতে থাকেন আমি আসছি বলেই দৌড়ে চলে যায় রান্নাঘরে।
হাফ গ্লাস পানির মধ‍্যে দুইটা লেবুর রস মিশিয়ে নেয় । চামচ দিয়ে পানিটা মিশিয়ে নাড়তে নাড়ত রান্নাঘর থেকে বের হতেই পরে আবসারের সামনে। তাকে পাশে কাটিয়ে চলে যায়। শশুর শাশুড়ির ঘরে আবসারও তার পিছু নেয় দেখে আলিয়া কান্না করতে করতে এজাজ সাখাওয়াতের হাত মাসাজ করছে।

— কি হয়েছে বাবার ওয়াসু??
আবসার তৎক্ষণাৎ পা মাসাজ করতে করতে বলে। ওয়াসিমা চামচের সাহায্যে এজাজের মুখে অল্প অল্প করে পানিটা খাওয়ায়। পানিটা খাওয়াতে খাওয়াতে বলল

— জানিনা আপনি ডাক্তারকে ফোন করেন। আর নাহলে ইমারজেন্সি হাসপাতালে নেওয়ায় ব‍্যবস্থা করেনা।।
আলিয়া সাখাওয়াত কিছু বলার মতো অবস্থায় নেই। সমানে কান্নাকাটি করছে।।
তাদের হুরোহুরির মাঝে বাড়ির সবাই জেগে ওঠে। তানিয়া এহসান দৌড়ে আসে। এহসান তৎক্ষণাৎ তার পরিচিত ডাক্তারকে ফোন দিলে সে জানায় সে ঢাকার বাহিরে আছে। এজাজকে যেনো দ্রুত হসপিলাইজড করা হয় সে ফোন দিয়ে সব ঠিক করে দিচ্ছে। এর মধ‍্যে প্রায় অনেক খানি লেবু পানি খাইয়ে ফেলেছে ওয়াসিমা।
তাদের ব‍্যস্ততায় নব দম্পতি আয়মান ভেনিসাও জেগে ওঠে।

ইতিমধ্যে অ‍্যাম্বুলেন্স আসলে আবসার এহসান তাকে নিয়ে যায়। আলিয়া সাখাওয়াত যেতে চাইলে তাকে নিয়ে যাওয়ার মতো যায়গা না থাকায় সে বাড়ির গাড়িতে করে যায়। দিলরুবা সাখাওয়াত ও আলিয়া সাখাওয়াতকে নিয়ে আয়মান হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।

— এখন কি অবস্থা ছোট খোকা?? বৃদ্ধা বয়সে ছেলের এই অবস্থা মানতে পারছে না দিলরুবা সাখাওয়াত।

— ইমারজেন্সিতে নিয়েছে আম্মা এখনো কিছু বলে নাই।। আল্লাহ্ ভরসা ভাইজানের কিছু হবে না।।

এহসানের বুকে মুখ গুজে কান্না করতে থাকে দিলরুবা সাখাওয়াত। আলিয়া সামনের বেঞ্চিতে বসে আছে। আবসার তার সামনে গেলে তার হাত ধরে কান্না করে দেয় আলিয়া সাখাওয়াত। আবসারের একটু অস্বস্তি হলেও নিজের হাতটা সরিয়ে নেয় না। কান্না করতে দেয় আলিয়া সাখাওয়াতকে।

কিছুক্ষণ পরে ডাক্তার বেরিয়ে আসে। তার সামনে যায় এহসান
— কি হয়েছে ডাক্তার?? ভাইজানের অবস্থা এখন কেমন??

— বড় বাচা বেচে গেছে। প্রশার অনেক হাই হয়ে গেছিলো এর একটু হলেই ঘুমের মধ‍্যে হার্ট অ‍্যাটাক করত। কেউ মনে হয় অনাকে প্রাথমিক হিসেবে লেবু পানি খাইয়েছে কে সেটা??

ডাক্তারের কথা শুনে সবাই একে অপরের দিকে তাকায়।
— কেনো ডাক্তার কেনো সমস্যা??

— নো মি.. এহসান। কিন্তু পানিটা এই সময় খুবই প্রয়োজন হয়। বিপদের সময় অনেকের জানা থাকলেও এই কাজ গুলো করে না তাই আর কি বললাম। ঐ লেবু পানিটা পেশেন্টের জন‍্য অনেক ইফেক্টিভ তাই বলেছি। মানতে হবে তার তাৎক্ষণিক বুদ্ধি প্রখর।।

— ভাইজানের এখন কি অবস্থা??

— আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো কালকেই নিতে পারেন বাট আমার মতে একটা এনজিওগ্রাম করে নিলে ভালো হয়। বলেই ডাক্তার চলে যায়।

আলিয়া সাখাওয়াত থম মেরে বসে আছে। এই মেয়েটির কাছে আলিয়া আজকে অনেক বড় ঋণি হয়ে গেলো।।
এহসান বাড়িতে ডাক্তারের বলা কথা গুলো বলতেই জানতে পারল ঐ কাজ গুলো ওয়াসিমা করেছে।
আবসারের গর্বে বুকট ফুলে উঠল ছত্রিশ ইঞ্ছি ছাতিটা আটত্রিশ ইঞ্চি হয়ে গেলো।
তার মুখে হাসি ফুটে উঠল। আবার ধপ করে নিভে গেলো নিজের বিগত দিনের কর্ম কান্ডের কথা ভেবে। আটত্রিশ ইঞ্চি ছাতিটাও ফুসস হয়ে গেলো।।

______________________

এজাজ সাখাওয়াতকে পরের দিন বাড়িতে আনা হয়েছে। সে মোটামুটি সুস্থ শুধু হাই প্রেশার ছাড়া আর কোনো রোগ পাওয়া যায়নি। কিন্তু তার খেয়াল রাখতে বলেছে যাতে তাকে কোনো ভাবে উত্তেজিত না হতে দেয়। তাহলে ভবিষ্যতে হার্ট অ‍্যাকটাক হতে পারে।

আজকে আয়মান আর ভেনিসা। ভেনিসার বাবার বাড়ি যাবে। এজাজ সাখাওয়াতকে বাসায় নিয়ে আসার পরপরেই তার সাথে দেখা করে চলে যায় তারা।।
আজকে আসবার ও ওয়াসিমার চলে যাওয়ার কথা থাকলে তারা যেতে পারে না। এহসানরা এখন থেকে এখানেই থাকবে। দিলরুবা সাখাওয়াত যেতে দেয়নি। আবসারকেও আটকায় কিন্তু গোয়ার আবসার কি কারো কথা শুনে সে তার গোয়ারতামি বজায় রেখে থাকবে না জানিয়ে দেয়। আর ওয়াসিমারও এখানে থাকার ইচ্ছা নেই। তার এই চাকচিক‍্য ভালো লাগে না। তার ঐ দুই কামরার ফ্লাটেই তার ভালো লাগে এসি বিহীন ঘর হলেও সেখানে আলাদা একটা প্রশান্তি বিরাজমান। তা সে এই আভিজাত্যে পায়না। কিন্তু অসুস্থ শশুর রেখেও যেতে মন চাচ্ছে না।।

_________________________

— আসি আয়মান ভেনিসা এই গরীব ভাইয়ের বাসায় একদিন ঘুরে এসো দাওয়াত রইল।।
আয়মান আজকে শশুর বাড়ি থেকে ফিরে আসলেই আবসার যাওয়ার তাড়া দেয়।

— তুমি থেকে যেতে ভাইয়া। দুই ভাই একসাথে থাকতে পারতাম করূন স্বরে বলল আয়মান। তার কষ্ট লাগছে। নিজেকে ছোট মনে হচ্ছে যেই আদর ভালোবাসা আবসারের পাওয়ার কথা ছিলো সেটা সে পেয়েছে শুধু তার মায়ের ছলচাতুরির কারণে। গতকাল তার শশুর শাশুড়ি তাকে জানায় আবসার কিভাবে এই পযর্ন্ত এসেছে। তার মম কিভাবে ঐ টুকু ছেলের শেষ আশ্রয়স্থল কেড়ে নিয়েছে। তার তাকে বুঝিয়েছে যেনো কোনোদিন আবসারের সাথে খারাপ ব‍্যবহার না করে। সাথে ভেনিসাকেও বুঝিয়েছে বাকি পড়াশোনা এখানেই করার জন‍্য।।
আয়মানের ঘৃণা করছে নিজের মায়ের চেহারা দেখতে।।
সেতো সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে কয়েকটি দিন দাদুমের সাথে কাটিয়ে আবার অস্ট্রেলিয়া ব‍্যাক করবে তার মাকে বুঝাবে যার জন‍্য এতোকিছু করল সেই এখন তাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে ,,,,,

“” এজাজ ঘরের থেকে সব শুনলেও কিছু বলল না তার আর কিছু বলার নেই। একটা সময় আসে তখন নিজের কর্ম কান্ড গুলো ভেবে আফসোস করা ছাড়া আর কিছু করার নেই। এই তো গতকাল কেমন হইহুল্লোর ছিলো জমজমাট ছিলো চারিদিকে সুখে ছলক ছিলো। আজ তার এই বিশাল বাড়িটা কেমন নিস্তেজ। হাতে গনা সাতজন মানুষ থাকলেও ভেনিসা আয়মান নিজের মতোই থাকে কারো সাথেই কথা বলছে না। শুধু মনে চাইলে তার দাদুমের সাথে কথা বলছে আর কারো সাথে কথা বলছে না।।

#চলবে

#বক্ষপিঞ্জিরায়_তুই_বন্দীনি
#সাদিয়া_আক্তার
#পর্ব_৪৩

বিবেক হলো আত্মার সেই আয়না যা মানুষের জীবনের ভুল গুলো পূর্ণারুপে দেখা দেয়
__জর্জ ব‍্যানক্রফট

আজকে বিবেকের তাড়নায় আলিয়া এজাজের ভুল গুলো চোখের সামনে আয়নার মতো সচ্ছ।।
আয়মান চলে গেছে আজকে দুই দিন। এজাজ যেনো আরো মুছরে গেছে। তার শারীরিক আরো একটু অবনতি হয়েছে। আলিয়া দ্রুত ডাক্তারকে কল করলে সে এসে দেখে যায় এবং টেনশন করতে বারন করেন।
পুত্রের এই কাতরতা মেনে নিতে পারেন না দিলরুবা সাখাওয়াত সে মানসিক ভাবে বেশ ভেঙ্গে পরেছে।। এইতো কিছু দিন আগেই ইরফান ও আকলিমা তার সাথে দেখা করে গেছে। এবং তাকে কয়েকটি দিন তাদের সাথে থাকার আহ্বান করে এসেছেন ।। দিলরুবা সাখাওয়াত যাবে না সে বর্তমানে গ্রামে যাওয়ার জন‍্য পাগল হয়ে গেছে।। তার ইচ্ছা তার মৃত্যুর কিছু দিন আগ পযর্ন্ত সে তার স্বামীর ভিটেয় কাটাতে চায় যেখানে সে বধূ রুপে পা রেখেছিল।।

_____________

আবসার মাথা নিচু করে বসে আছে মাথায় হাজারো চিন্তা চলেছে।। আবসাররা ঐ বাসা ছেড়েছে প্রায় অনেক দিন এর মধ‍্যে ওয়াসিমাকে একবারও তার ভর্তি সংক্রান্ত কোনো জিজ্ঞাসা করতে দেখা যায় নি,,, আবার সব যেনো সাভাবিক হয়েও অস্বাভাবিক কিন্তু কেনো??? জানা নেই আবসারের।। সেদিন ঐ বাসা থেকে আসার পরে রাতে বেশ রোমান্টিক ভাবেই ওয়াসিমার রাগ ভাঙ্গায় ওয়াসিমাও তাকে ক্ষমা চায় এরপর সব ঠিক চলছে কিন্তু এর মধ‍্যে তোতা পাখির মতো কথা বলা ওয়াসিমা যেনো হারিয়ে গেছে।।

— নাহ এইভাবে চলতে পারে না,, ওর সাথে সামনা সামনি বসে কথা বলতে হবে।।
ভেবেই আবার অফিসের একাউন্টস দেখতে লেগে পরে পাচঁটার দিকে অরিক আসলে সে আজকে চলে যাবে। সামনে বড় একটা অর্ডার আছে সেটার জন‍্য কর্মচারিদের অভার টাইম করাচ্ছে।। আল্লাহর রহমতে আবসারের কারখানাটা একটু বড় হয়েছে।। আগে পচিঁশ জন কাজ করলেও এখন ত্রিশ জন কর্মচারী কাজ করে।।

____________________

আছরের নামাজ শেষে হিজাবটা খুলে মাত্র বসেছে ওয়াসিমা এর মধ‍্যেই বেল বাজে,,

— এখন কে এসেছে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলতে বলতে মেইন গেটের সামনে দাড়িয়ে হোল দিয়ে দেখে আবসার।। আবসারকে এই সময় দেখে অবাক ওয়াসিমা আবসার কখনও এই সময় আসে না যদি আসার হয় একেবারে আটটার দিকে আসে।। সে আর না ভেবে গেট খুলে দেয়

— কি হয়েছে আপনার এই সময়, শরীর ঠিক আছে তো?? আবসারের কপালে হাত দিয়ে বলে
ওয়াসিমার এই উদ্বিগ্ন মায়া বাধানো ছোয়াটা আবসার অনেক দিন পর পেলো এইতো তার বউ তোতা পাখির মতো কথা বলছে।।

— কিছু হয়নি এমনিতে চলে আসলাম। কেনো এসে কি খুব কষ্ট দিয়ে ফেললাম??

— আপনার বাসা আপনি আসবেন নাতো কে আসবে??
ওয়াসিমার স্বরে তাচ্ছিল্য নাকি আনুরাগ বুঝল না আবসার।। শুধু তার দিকে ফ‍্যালফ‍্যাল করে তাকিয়ে থাকল। আবসারের নজর থেকে বাচতে ওয়াসিমা রান্নাঘরে চলে যায় উদ্দেশ্য হালকা নাস্তা বানাবে। প্রতিদিন সে একা থাকে কিছু বানায় না আকলিমা কিছু নিয়ে আসে নাহলে সে যায় আকলিমার কাছে।।

— ওয়াসু একটা কথা ছিলো!! নাস্তার প্লেট নিয়ে আসতেই আবসার বলল

— কি কথা বলেন,, আবসার বলতে নিলেই তার ফোনটা বেজে ওঠে হাতে নিয়ে দেখে তার ছোট মিয়া মানে এহসান সাখাওয়াতের ফোন।।

— আসসালামু আলাইকুম ছোট মিয়া

— ওয়ালাইকুম আসসালাম বাবাই সাখাওয়াত ভিলায় একটু আসতে পারবে আম্মা তোমাদের ডেকে পাঠিয়েছে।।

— কোনো জরুরি ছোট মিয়া কাল আসি??

— না এখনই আসলে ভালো হয় বলেই ফোন কেটে দিলো।

— রেডী হো
ওয়াসিমা চলে যায় রেডী হতে। বিরক্ত হয় আবসার আজকেও কোনো কথা বলতে পারল না।।
— ধুরর ভালো লাগে না বলেই দুই হাত দ্বারা চেহারা ঘসে।।
ওয়াসিমা বোরকা পরে আসতেই আবসার সু কেবিনেটের উপর থেকে তালা চাবি নিয়ে নেয়। দরজা আটকে যায় চার তলায় সেখান থেকে আরুকে নিয়ে চলল সাখাওয়াত ভিলার উদ্দেশ্যে।।

_________________

দিলরুবা সাখাওয়াতকে ঘিরে আছে সবাই। সে বেডে আধশোয়া অবস্থায় বসে আছে

— আরু মনি এখানে আয়
দাদীর মিষ্টি ডাকে অবাক হয় আরু। ছোট থেকে এই পযর্ন্ত সে দাদীর ভালোবাসা পায়নি যার পুরোটাই আয়মান পেয়েছে। আবসার এখানে ছিলো না সে আরুকেও কাছে টেনে নেয়নি। যারপরনাই পুরো আদর ছিলো আয়মানের জন‍্য বরাদ্দ। আরু এই ফ‍্যামিলিতে শুধু বাবা ও মায়ের আদর ছাড়া আর কারো আদর ভালোবাসা কোনোটাই পায়নি। সেই হিসেবে সেও আবসারের মতো কপাল পোড়া। সে পরিবারের মধ‍‍্যে থেকেও সব কিছু থেকে বঞ্চিত আর আবসার না থেকে বঞ্চিত।
— কিরে আপা মনি বসবি না

— হু বলেই আরু দিলরুবা সাখাওয়াতের কাছে বসে পরে।। দিলরুবা সাখাওয়াত তার হাত জোরা নিজের হাতের মুঠোয় নেয়।

— আমার একটা ইচ্ছা বলতে পারো শেষ ইচ্ছা রাখবে! আশাবাদী নয়নে তাকিয়ে বলল

— আমি চেষ্টা করব দাদু

— আবসার আয়মানকে ফোন করে তুমি ওকে বাংলাদেশে কয়েকদিনের জন‍্য আসতে বলো। আমি জানি ওর তোমার সাথে যোগাযোগ আছে
আবসার কিছু না বলে আয়মানকে ফোন করে হোয়াটস অ‍্যাপে। সবার সামনে দাড়িয়েই কথা বলে আয়মানের সাথে কথা বলার সময় সবাই চুপ থাকে। আয়মান প্রথমে আসতে চায়নি তবে আবসারের জোড়াজুরির ফলে রাজী হয় সে সামনের সপ্তাহে আসবে।।

— আমি চাই কিছুদিন পুরো পরিবার সহ আমাদের গ্রামের বাড়িতে কাটাতে। মরার আগে অন্তত আমার পুরো পরিবারকে একসাথে দেখতে চাই।।
দিলরুবা সাখাওয়াতের মুখে মৃত্যুর কথা শুনে আরু তার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে। সেদিকে তাকিয়ে হাসে দিলরুবা সাখাওয়াত এই যে মেয়েটাকে আদর করে একটু কাছে ডেকেছে এতেই যেনো মেয়েটা গলে গিয়েছে। তার অভিমানের বরফ গলে পানি হয়ে গেছে।।

অবশেষে সবার মত অনুযায়ী কথা ফাইনাল হয় পরসু আরুর পরীক্ষার পরে সবাই আলম নগর যাবে।

____________________

— তোমরা যাও আমার কলেজে পরীক্ষা আছে আমি আপাতত যেতে পারব না।

— কিন্তু দাদীযে এতো করে বলল

— আমার এতে কিছু করার নাই আমি যেতে পারব না বলেই অরিক হাতের ল‍্যাপটপ নিয়ে বারান্দায় চলে যায়। সেদিকে তাকিয়ে আরু দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। একে এখন তার শাশুড়ি ছাড়া আর কেউ রাজী করাতে পারবে না। তাই আরু চলল শাশুড়ির কাছে
আকলিমা নিজের ঘরে বসে কাপড় ভাজ করছিল তখন আরু দরজায় নক করে আরু
— দরজা খোলা

— আসব আম্মু

— বউমা আসার জন‍্য আবার অনুমতি নেওয়া লাগে নাকি এসো বসো।।

— আম্মু আমি একটা কথা বলতে এসেছি

— হ‍্যা বলো নিজের কাজ করতে করতে বলল

আরু দিলরুবা সাখাওয়াতের ইচ্ছের কথা বলল। সব শুনে আকলিমা বলল — তিনি মুরুব্বি মানুষ তার ইচ্ছার মূল‍্যায়ন করা উচিৎ। আর তোমার শশুর ও অনেক দিন ধরে গ্রামে যেতে চাচ্ছে। তোমার পরীক্ষার জন‍্য যাওয়া হচ্ছে না তাই ভাবছি তোমার পরীক্ষার পর সবাই একসাথে যাব। আর অরিকের সাথে আমি কথা বলবনি।।

আকলিমার কথা শুনে আরু খুশি হয় সে উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলল — সত্যিই আম্মু তাহলে আমি সব গোছানো শুরু করি

— হ‍্যা কিন্তু পরীক্ষা তো সামনে সেদিকে মনযোগ দাও।।
আরু খুশী হয়ে মাথা নাড়িয়ে চলে যায়। সেদিকে তাকিয়ে আকলিমা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। সে ভাবছে এইবার গ্রামে গেলে আর আসবে না। কয়েকটি দিন অরিক আরু নিজেদের মতো সংসার সামলে নিক।।

#চলবে

#বক্ষপিঞ্জিরায়_তুই_বন্দীনি
#সাদিয়া_আক্তার
#পর্ব_৪৪

— ঐ তোর পাগলীবোনকে সামলা তো ভাল্লাগছে না। কি একটা লাগিয়ে রাখছে সে তার দাদির সাথে গ্রামে যাবে।।

— কেনো কি হয়েছে??

— কাল রাতে আমাকে ধরে দাদি নাকি সহ পরিবার গ্রামে যেতে চেয়েছে। সেও যাবে। আমি বলেছি আমার কলেজের এক্সাম শুরু হবে সামনে তোর বোন মানতেই রাজী না। গিয়ে আম্মুকে বিচার দিয়েছে এখন আম্মু আমার পিছনে লেগেছে। আমি বললাম এখন হবে না বেশি দিন থাকতে পারব না বৃহস্পতিবার যাব শুক্রবার থেকে শনিবার এসে পরব। তাও ওর চলছে না।। তার থেমে আবসারকে জিজ্ঞাসা করে — তুই কি যাবি??

— নাহ! আমার এখন যাওয়ার কোনো ইচ্ছা নেই। ওয়াসুর ভর্তি আবার মালের শিপমেন্ট এই সপ্তাহেই দিতে হবে পারব না। আর আরুর কথা চিন্তা করিস না আমি বুঝিয়ে বলব
এই প্রথম দাদুর আদর পেয়েছে তো তাই আবেগে বলছে। কিন্তু আমি তো জানি তারা কেমন আমি তাদের একবিন্দুও বিশ্বাস করিনা। তারা এখন আমাকে সাখাওয়াত ভিলায় নেওয়ার চেষ্টায় আছে। যাতে তাদের ব‍্যবসায় সামলাতে পারি আয়মান তো নিজের মতো চলে গেছে অস্ট্রেলিয়া
শান্ত স্বরে বলল আবসার। অরিক বুঝল আবসার রেগে যাচ্ছে তাই বলল

— তো তুই যাবি না তোর বইন এতো পাগল হইছে কেনো??

— কালকে ওর সাথে একটু মিষ্টি মিষ্টি কথা বলছে তাই রাজি হইছে।। আবার আয়মান আসছে ওরাও যাবে

— তুই না গেলে আমরাও যাব না। যাই হোক কি কি ফাইল না বাকি আছে দে।।

— মনে হয় তো কলেজ থেকে সোজা চলে এসেছিস একটু রেষ্ট নে,,,,

— আরে লাগবো না তুই দেতো। আবসার আর কিছু না বলে পেনডিং থাকা ফাইল গুলো দিয়ে দেয়।।

কাজের ফাকে দুই বন্ধু একসাথে লাঞ্চটাও করে নেয়।। তাদের ইচ্ছা দ্রুত কাজ শেষ হলেই আজকে একটু আড্ডা মারা যাবে। কারণ বহুদিন পর তাদের ভার্সিটি লাইফের বন্ধুমহল ঢাকায় এসেছে। ওরা সবাই অবশ‍্য অরিকের বন্ধুমহল বলা চলে কারণ আবসার কারো সাথে খুব একটা কথা বলতো না তবে তার বহুত শাগরেদ আছে।। যারা একসময় ছাত্র নেতা আবসার ভাই বলতে পাগল ছিলো। এর মধ‍্যে কিছু কিছু এখনো আছে।

___________________

রাত দশটা দুই বন্ধুই ডিনার করে ফিরেছে। দুইজনের মাথায় দুই রকমের চিন্তা একজনের মাথা চিন্তা চলছে আরুকে কিভাবে না যাওয়ার জন‍্য আটকায়। আরেকজনের মাথায় চিন্তা চলছে। কিভাবে ওয়াসুর ভর্তি সংক্রান্ত ব‍্যাপারে কথা বলবে। সে কোন মুখে বলবে তার মনে অনুশূচনা চলছে এখনো যে সে কিভাবে তার বউকে অবিশ্বাস করল।। সে এটা এখনো মেনে নিতে পারছে না। আর ওয়াসুকে ভর্তির ব‍্যাপারটা বলতেও পারছে না ঐদিকে আবার ভর্তির শেষ সময় সামনের সপ্তাহে। কি করছে ভেবে পায়না আবসার।। চার তলায় লিফ্ট থামতেই অরিক চলে গেলো। অরিক বেরিয়ে যেতেই আরেকজন ঢুকল সেদিকে তার খেয়াল নেই। অরিককেও অনেকটা ঘোরের মধ‍্যেই বিদায় দিয়েছে।
পাচঁ তলায় নামতে নিতেই কেউ তার হাত পিছনে থেকে ধরল। চমকে যায় আবসার পিছনে তাকিয়ে দেখে ইরফান তার হাত ধরে আছে।। আবসার কিছু বলতে নিলেই তাকে বলতে না দিয়ে বলল
— তোমার সাথে আমার কথা আছে
এই প্রথম ইরফানের গম্ভীর কন্ঠস্বর শুনল আবসার সাথে অবাকও হলো। তাই অবাক স্বরেই বলল — কিন্তু এখানে কিভাবে কথা বলবেন।

— আমরা এখন ছাদে যাচ্ছি
ইরফানের কন্ঠস্বর এমন দৃঢ় ছিলো গোয়ার আবসার ও আজ কিছু বলল না।
নয় তলায় নামে দুইজন। ইরফান এগিয়ে হাতে চাবি খানা দিয়ে তালা খুলে ভিতরে প্রবেশ করে তার পিছনে আবসারও প্রবেশ করে।

___________________

— এখানে বসো
আবসার ইরফানের মুখোমুখি বসলে ইরফান আবার বলতে শুরু করল — আমার একটা মেয়ের খুব শখ ছিলো। অরিক হওয়ার পর আমরা অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু পারিনি। প্রায় পাচঁ বছর পযর্ন্ত এই চেষ্টা চালিয়ে গেলাম কিন্তু সফল হলাম না পরে হাল ছেড়ে দিলাম।।
“” বলেই দম নিয়ে আবার বলতে শুরু করল — অরিকের যখন দশ বছর তখন। আকলিমা কন্সিভ করে সেদিন মনে হয় আমি প্রথম বাবা হচ্ছিলাম এমন ফিলিংস হচ্ছিলো। কিন্তু সত মাস পরেই আকলিমার একেকটা সমস্যা দেখা দিলো শরীরে রক্ত কম। পানি কম ইত্যাদি ডাক্তার তো একবার বলেই দিয়েছিল যে বাচ্চাটা মনে হয় বাচবেনা কিন্তু আমরা হাল ছাড়িনি। আল্লাহর উপর বিশ্বাস রেখে এগিয়েছিলাম। তখন আল্লাহ্ আমাদের দিকে মুখ তুলে তাকালেও আট মাসের প্রিম‍্যাচুর হয় আমার মেয়েটা। সেটা নিয়ে কত দৌড়াদৌড়ি করেছি এই হাসপাতাল থেকে ঐ হাসপাতালে। মেয়েটাকে নিয়ে রাস্তায় হেটেছি আর চোখের পানি ফেলতে ফেলতে আল্লাহর কাছে নিজের সন্তানের হায়াৎ কামনা করেছি।।
সেদিন আমার মেয়েটাকে বাচাতে পারলেও ডাক্তার বলেছিল ওর মধ‍্যে প্রতিবন্ধকতা দেখা দিতে পারে তবে সিয়োর না।

একসাথে অনেক গুলো কথা বলে হাপিয়ে উঠল ইরফান। কিছুক্ষণ থেমে দম নিতে থাকল। আবসার থম মেরে বসে আছে কি বলবে বুঝতে পারছে না ইরফানকে দেখে মনে হচ্ছে এই ঘটনা এখনই তার সাথে হয়েছে। তার চোখ জোড়া লাল টকটকে মনে হচ্ছে অশ্রু আটকে রেখেছে। আবসারের ভাবনার মাঝখানে ইরফান আবার বলা শুরু করল,,,
— নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে মেয়েটাকে আগলে রাখলাম। তখন আকলিমা অসুস্থ ওয়াসুর খুব একটা দেখবাল করতে পারতাম না। আমারও একুল ওকুলে কেউ ছিলো না। কি করব দিশেহারা হয়ে চাকরি ছেড়ে দিলাম উঠলাম বাবার রেখে যাওয়া ভিটে মাটিতে বেশ কিছু শতাংশ জমি রেখে গিয়েছিল আমার জন‍্য বাবা মা। সাথে আমিও কিছু কিনেছিলাম সেখানে চাষাবাদ শুরু করলাম। পাশাপাশি মেয়ে ও তার মায়ের খেয়াল রাখতে শুরু করলাম।।
এইযে আমার শান্তশিষ্ট ওয়াসুকে দেখছ না সে ছোট বেলায় মোটেই এরকম ছিলো না প্রচুর দুরন্ত ছিলো এই ডাল থেকে ঐ ডাল পাখির মতো উড়ে বেড়াতো। তবে বেশ লক্ষি ছিলো সবার সব কথা মানত একবার আমাদের গ্রামে একটা মেয়ে ডায়রিয়া হয়ে মারা যায় তখন গ্রামে ডাক্তার না থাকায় মেয়েটা মারা যায়। মেয়েটার নাম ছিলো মিনু। ওয়াসু তাকে মিনুবু ডাকত,,,, ওর মৃত্যু দেখে ওয়াসু বলেছিলো সে ডাক্তার হবে। ছোটকাল থেকেই ওর শুধু ডাক্তারী খেলনার উপর আকর্ষণ ছিলো। মিনুর মৃত্যুর পর সেটা আরো প্রখর হয়। তারপরেও দূরন্তপনা কমাতে পারিনি। তাকে থামায় কে জানো???

ইরফানের প্রশ্নে আবসার তার দিকে তাকায় প্রশ্নাত্বক নজরে। তা দেখে ইরফান হাসে

— সে ছেলেটা তুমি ছিলে!!
আবসারের নজর প্রশ্নাত্বক নজর বদলে আদল জুড়ে ছড়িয়ে পরে অবাকতার রেশ। সে বুঝতে পারে না ছোটবেলা থেকেই ওয়াসিমা তার থেকে দূরে দূরে ছিলো। সে যখন মাষ্টার্স ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে বেড়াতে গেছিলো তখন একঝলক ওয়াসিমাকে দেখে থমকে গিয়েছিল কিন্তু বিশেষ পাত্তা দেয় নি পরে তার তিনমাস পরে যখন গিয়েছিল তখনই ষোড়শী ওয়াসিমাকে দেখে সাতাশ বছর বয়সী আবসার থমকে গিয়েছিল। সাদা ড্রেস দুই কাধে দুই বেনী সব মিলিয়ে আবসার হৃদ স্পন্দন থমকে গিয়েছিল। সেই পিছলে পরেছিল আবসার আর উঠতে পারেনি। ঢাকায় এসেও শান্তি মিলেনি একদন্ড সারাদিন কাজে কর্মে গেলেও রাতটা প্রেয়সীকে দেখার জন‍্য হৃদয় ছটফট করত কিন্তু সে তাকে আটকে রেখেছিল। সময় নিয়েছিল ওয়াসিমার আঠারো হওয়ার তবে সে সেখানেও ব‍্যর্থ হয় সতের বছর বয়সেই জড়িয়ে ফেলে নিজের সাথে।। তার জেদের কাছে হার মেনেই তো আবসারের কাছে বিয়ে দিয়েছিল ইরফান কিন্তু এখন কি বলছে ওয়াসিমার দূরন্ত কন্ট্রোল করার পিছনে সে দায়ী কিন্তু কিভাবে?? বুঝতে পারছে না আবসার।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে