#ফ্লুজি
#অনুপ্রভা_মেহেরিন
[পর্ব সংখ্যা ২৬ শেষ পর্ব]
আরশাদের বন্ধু সঞ্জয়ের মাধ্যমে প্রথমবার তুবার সাথে আরশাদের আলাপ হয়।সঞ্জয় ছিল ইন্ডিয়ান সনাতন ধর্মের ছেলে।
আরশাদ, সঞ্জয় এছাড়াও সাতজন ইতালিয়ান ছেলে মিলে সেবার তারা পরিকল্পনা করে কক্সবাজার ঘুরতে যাবে আর কক্সবাজার সম্পর্কে তাদের কারো তেমন কোন আইডিয়া নেই।ভিনদেশী ছেলেগুলো দেশে আসার জন্য উৎসুক ছিল।
এই ট্যুরের সকল দায়িত্বে ছিল সঞ্জয় এবং আরশাদ।তুবা তখন ঢাকায় থাকতো তবে পরিবার এবং বন্ধুদের সাথে তার বেশ কয়েকবার কক্সবাজার যাওয়া হয়েছিল।তুবা এমনটাই জানিয়েছিল আরশাদকে।আরশাদের তো আর দেশ সম্পর্কে কোন ধারণা নেই তাই তুবার সব কথা তার কাছে বিশ্বাসযোগ্য।
কক্সবাজার সম্পর্কে ধারণা নিতে গিয়ে তুবার সাথে গভীর সম্পর্ক তৈরি হয় আরশাদের।যদিও তুবা নিজেই সম্পর্কটা যেচে পড়ে করেছিল।কিন্তু আরশাদ তাকে ভীষণ ভালোবাসতো সম্মান করতো।ভালোবাসার সম্মতিতে
আদর করে তুবার নাম ডাকতো ফ্লুজি।ফ্লুজি অর্থাৎ সুন্দরী।আরশাদের চোখে তার প্রেমিকাই সবচেয়ে বেশি সুন্দর।
ভালোবাসার ভ্রম জালে নিজেকে জড়িয়ে নিজের অস্তিত্ব হারানো সহজ কথা নয়।ভরসা,বিশ্বাস,ভালোবাসা,সবটাই তখন এক গন্তব্যে ঠেকে যায়।
আরশাদের বেলায় ব্যপারটা ভিন্ন হয়নি সে নিজেও তুবার অস্তিত্বে নিজেকে হারিয়েছে বিলিয়েছে।
তুবাকে কেন্দ্র করে সঞ্জয় আর আরশাদের বন্ধুত্বে ফাটল ধরে।সেই সম্পর্ক আজও তাদের ঠিক হয়নি।কে কোথায় আছে কিংবা কোন পর্যায়ে আছে তারা কেউ জানে না।সঞ্জয় সম্পূর্ণ রূপে আরশাদকে ত্যাগ করেছে।
ঘুমন্ত আরশাদের পিঠে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করলো খুশবু।এত মাস পরেও পিঠে সেলাইয়ের দাগটা রয়ে গেছে।এসব দেখলে মেয়েটার কলিজা কাঁপে ভয়েরা হানা দেয় অন্তর জুড়ে।সেদিনের কথা ভাবলে দু’চোখ ঝাপসা হয় তার।শারীরিক ভাবে আঘাত পেলেও তা তো সেরে গেছে কিন্তু মানসিক যে আঘাত পেয়েছে তা তো এখনো সারেনি।খুশবুর মনে ভয় জমেছে বাসে উঠবে না বলে পণ করেছে।আরশাদকে একা ছাড়তে তার ভয় লাগে,এম্বুল্যান্সের সাইরেনে তার স্নায়ুর আন্দোলন বাড়ে,রক্ত দেখলে দম বন্ধ হয়ে আসে।একা থাকলে চোখের কোলে মৃত্যুর চিন্তা আসে, ফলে বেড়ে যায় তার ভয়।আরশাদের সেলাই করা স্থানে হাত বুলিয়ে কেঁদে ফেললো খুশবু।মেয়েটার উষ্ণ নোনা জল আরশাদের পিঠে গড়িয়ে পড়তে ছেলেটার ঘুম ছুটে যায়।পিঠে খুশবুর অস্তিত্ব বুঝতে পেরে রয়ে সয়ে পিঠ উল্টায়।
” ফ্লুজি কাঁদছো কেন?”
” জানি না।”
” কে কি বলেছে?ভয় পেয়েছো?”
” আরশাদ আপনার এই দাগগুলো….”
” থামবে তুমি?আমার থেকেও সবচেয়ে বেশি আঘাত তুমি পেয়েছো।”
” চা করেছি।”
” তুমি আবার এসব কেন করলে?আমি কি বলেছিলাম আমার কথা শুনবে না তুমি তাই না?”
” শুয়ে বসে আর কত দিন কাটবে।তাই একটু…”
” যা ইচ্ছে করো কিন্তু হাত বাড়িয়ে বিপদ ছোঁয়ার মানে নেই।”
আরশাদ চায়ের কাপটা হাতে তুলে চুমুক দিল।তৃপ্তিতে জুড়িয়ে গেল মন প্রাণ।
” চা ভালো হয়েছে।”
” আরেকটু আনবো?”
” না।বসো আমার কাছে।”
” শাশুড়ী মা একটু আগে ফোন করলেন।”
” কি কথা হলো?”
” জানতে চাইলো ইতালিতে যাব কবে।আমি কিছু জানাইনি।”
” তুমি বলো কবে যাবে?”
” চলুন আজকে যাই।”
খুশবুর বোকা বোকা কথায় আরশাদ হেসে ফেললো।চায়ের কাপে পুনরায় চুমুক দিয়ে উঠে দাঁড়ালো সে।
” বাবা মায়ের বিবাহ বার্ষিকি আসছে।ভাবছি এবার একটা সারপ্রাইজ তাদের দেব।”
“তবে টিকেট কাটুন আমি যত দ্রুত সম্ভব যেতে চাই।”
.
খুশবু চলে যাবে শুনে সাহস করে দ্বিতীয় বারের মতো নীরা আজ খুশবুর বাসায় এসেছে।বাহারুল হক কিংবা অনিমা কেউ পছন্দ করেন না নীরাকে,তারা চাননা নীরার সাথে খুশবু কিংবা আরশাদ কেউ কোন সম্পর্ক রাখুক।কিন্তু খুশবু এসবে পরোয়া করে না নীরার সাথে তার সম্পর্ক ভীষণ ভালো।গরম গরম পকোড়া মুখে তুলে নীরা বলে,
” ধরো আমরা তিন বোন এক বাড়িতে থাকতাম।”
” আমরা একই জামা পরতাম।”
” ইসস কত সুন্দর হতো তাই না?”
” কিন্তু একজন তো মরেই গেল!আমার যে আরেকটা বোন আছে তা আমি জানলাম কিন্তু তার মৃত্যুর পর।আমাদের জীবনটা কি অদ্ভুত তাই না?”
” তুবার কোন খোঁজ আরশাদ নিয়েছিল?মেয়েটার পরিবার কোথায়?কার কাছে মানুষ হয়েছে?”
” তুবা বেশ ভালো ঘরেই বড় হয়েছে।ওর বাবা মা দুজনে সরকারি চাকরিজীবি।ওর একজন বড় ভাই আছে।এক কথায় ওঁকে নিয়ে বলা যায় মেয়েটা ভীষণ ছটফটে ছিল।”
” তুমি ওর মা বাবার সাথে দেখা করেছিলে?”
“একদমি নয়।আমার বাবা মা চাননা এসব নিয়ে চারদিকে কথা সৃষ্টি হোক।”
” হুম তোমার বাবা মা আমাকেও পছন্দ করেন না।না করাই স্বাভাবিক।”
“তুবাকেও কিন্তু ছোট বেলায় বিক্রি করা হয়েছিল।”
” জানি।শুধু আমাকেই রেখে দিল।রেখে কি হলো?আমার জীবনটা কেমন যেন হয়ে গেল।”
” নীরা তোমার কি এই পাপ থেকে বের হতে ইচ্ছে হয় না?আমি তোমায় সুন্দর জীবন দেব,মা বাবা দেব প্লিজ নীরা তুমি বেরিয়ে এসো ওই বিশ্রি জীবন থেকে।”
” সুন্দর জীবন!এতই সহজ?”
” আমাকে একটুখানি ভরসা করো।কথা দিচ্ছি আমি তোমার জীবন পালটে দেব।একটা স্বাভাবিক সুস্থ জীবনে তুমি ফিরবে।”
নীরার দু’চোখ চকমক করে উঠলো।সুস্থ জীবনে বেঁচে থাকার লোভ তারো আছে কিন্তু পরিস্থিতি যে তার প্রতিকূলে।
” বলা সহজ করা কঠিন।”
” মোটেও না।প্লিজ নীরা তুমি পারবে।আমি আমার বাবা-মাকে বোঝাবো তারা তোমাকে ঠিকি মেনে নেবে।”
” দেখা যাবে।”
” তুমি ইতালি যাবে নীরা?আরশাদ তোমাকে কোন জব সেক্টরে সুযোগ করে দিতে পারে।”
” ভেবে দেখবো।”
” আমি যেদিন চলে যাব সেদিন তুমি আমাকে টেক অফ করতে আসবে?”
” আসবো।”
” আমি অপেক্ষায় থাকবো তোমার।”
খুশিতে নীরার হাত জড়িয়ে ধরলো খুশবু।ভাই বোন না থাকার যে আফসোসটা খুশবুর ছিল তা নীরা এসে ঘুচে দিল অতি সহজে।
.
এক্সিডেন্টের পর খুশবুর শারীরিক অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল যে অন্যদিকে আর মন ঘুরাতে পারেনি আরশাদ।নিজের শারীরের জখম নিয়েও ছুটেছে এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত।মেয়ে জামাইয়ের অবস্থায় অনিমা ভীষণ ভাবে অসুস্থ হলেন তাকে নিয়ে শুরু হলো হসপিটাল ছোটাছুটি।তিনদিন তিনি হসপিটাল ভর্তি ছিলেন।সব মিলিয়ে আরশাদের জীবন থেকে নয় মাস কেটেছে।সে এবং খুশবু এখন সম্পূর্ণ সুস্থ।আরশাদ ছাদের এক কোনায় দাঁড়িয়ে,
চোখ মুখ ঢেকে বাসা থেকে বেরিয়ে গেল নীরা,ছাদে দাঁড়িয়ে তা চুপচাপ দেখলো আরশাদ।তখনি অনিমা এসে আরশাদের উপর চড়াও হলেন,
” তোমাকে বারবার বলেছিলাম নীরার সাথে খুশবু যেন যোগাযোগ না করে।শুনলে না আমার কথা।”
” সরি।খুশবুর খু্শি আমি কেড়ে নিতে পারবো না।”
” যা ভালো বুঝো করো।”
অনিমা রাগ দেখিয়ে চলে গেলেন নিচে।আরশাদ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।আর তো বেশিদিন নয় কয়েকদিন পরেই ইতালিতে পাড়ি জমাবে ফ্লুজিকে নিয়ে।নীরার সান্নিধ্যে খুশবু আর একটা দিনেই তো।
কথায় আছে কেঁচো খুঁড়তে কেউটে।আরশাদ প্রথম পর্যায়ে খুঁজে ছিল তুবাকে অথচ পেয়ে গেল খুশবুকে।দ্বিতীয় পর্যায়ে নীরা সামনে এলো, নীরার সত্যতা যাচাইয়ে দেশে এলে কয়েক মাস পর বেরিয়ে এলো তুবার পরিচয়।
তুবার মৃত্যুর দিন আরশাদ তাকে শেষ বারের মতো দেখেছে।এক্সিডেন্টের প্রথম তিন মাস তার ব্যস্তায় কেটেছে বিঁধায় তুবার সম্পর্কে তেমন কোন খোঁজ নেওয়া হয়নি।
খুশবু যখন সুস্থের পথে আরশাদ তুবার পরিবারের খোঁজ লাগালো।সেদিনের এক্সিডেন্টের প্রতিটা নিউজ সবটা ঘেটেছে সে।মৃত ব্যক্তিদের পরিচয় তালিকা থেকে আরশাদ তুবার সম্পর্কে কিছুটা তথ্য জানতে পারে।আর সেই সব ইনফরমেশন নিয়ে তুবার পরিবারকে খুঁজতে লোক লাগায়।
সেদিন গ্রাম থেকে ভাইয়ের সাথে শহরে ফিরছিল তুবা,মেয়েটা কি জানতো সেদিনি তার জীবনের ইতি টানতে চলেছ?খুশবু এবং আরশাদ যে বাসে ছিল তার বিপরীত বাসে ছিল তুবা এবং তার ভাই।মেয়েটার মৃত্যু আরশাদের কাছে কিছু অপ্রকাশিত অধ্যায় রেখে গেছে।
” সম্পর্কের একটা সময়ে এসে অযথা বাড়াবাড়িতে তুবা কেন সম্পর্ক ছিন্ন করলো?”
” আরশাদকে ছেড়ে যাওয়ার কারণ কি ছিল?”
” তুবা কি আসলেই ভালোবেসেছিল তাকে?”
” এত এত যত্ন আদরে মাখা বুলি সবটাই কি লোভ আরশাদের টাকার উপর ছিল?আরশাদ যখনি অতিরিক্ত দূর্বল হয়ে পড়লো সুযোগ বুঝে সরে গেল তুবা..কিন্তু কেন?”
এসবের উত্তর আজও অজানা আরশাদের কাছে।তুবার মৃত্যুর পর নিশ্চয়ই এসব প্রশ্নের সমাধান পাওয়া মুশকিল।তুবার বন্ধুদলের কেউ আরশাদকে চেনে না।তুবা যখন আরশাদের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে ছিল তখন আরশাদ নামক প্রেমিকের কথা কাউকে জানায়নি।
তুবার মৃত্যুর পর সবার কাছে আরশাদ জানতে চেয়েছে কেউ আরশাদ নামের ব্যক্তিকে চেনে কি না।যে ছেলেটা একটা সময় তুবার প্রেমিক ছিল।
এই প্রশ্নের উত্তরে সবাই অবাক হয়েছে কেউ চেনে না আরশাদকে।কেউ না।সবাই বরং পালটা প্রশ্ন করেছে তুবার আবার কবে প্রেমিক ছিল?
সবশেষে ছেলেটার দীর্ঘশ্বাস ছাড়া উপায় নেই।ভাগ্যিস সরল সহজ খুশবুটা ছিল তা না হলে আরশাদের কী হতো?খুশবু যদি কোন একদিন তুবার মতো হারিয়ে যায়?এসব ভাবলে আরশাদের অস্থিরতা বাড়ে দম বন্ধ লাগে।আরশাদের আর বুঝতে বাকি নেই তুবা তাকে ঠকালো।তাই তো তুবার নামটাই তার কাছে বিষাক্ত রসের মতো।নামটা শুনলেই বিরক্তে মুখ কুচকে ফেলে সে।যার বর্তমান এত মধুর,স্নিগ্ধ,সরল সে কেন অতীতের বিষাক্তকে নিয়ে ভাববে?বর্তমান নিয়ে সুখে থেকেও যারা যেচে বিষাক্ত অতীতের পেছনে ছুটে তারা সত্যি কারের বোকা,নির্বোধ।
কিন্তু সব শেষে সত্যটা তো অপ্রকাশিত, সত্যি কি তুবা ঠকিয়েছিল আরশাদকে?নাকি বিপর্যয় পরিস্থিতিতে পড়ে মেয়েটা বাধ্য হলো আরশাদকে ছাড়তে।
আরশাদ ছাদ পেরিয়ে ঘরে ফিরলো।অনিমা আর খুশবুর ভীষণ ভাবে ঝগড়া চলছে,তাদের ঝগড়া কি নিয়ে তা নিশ্চয়ই বলতে হবে না?আরশাদ মা মেয়ের পাশ কাটিয়ে নিজের কক্ষে ফিরলো।ইতিউতি করে হাঁক ছেড়ে ডাকলো খুশবুকে।
“ফ্লুজি এদিকে আসো একটা জিনিস খুঁজে পাচ্ছি না।”
খুশবুর ঝগড়া থেমে গেল।আরশাদের উদ্দেশ্যে চেচিয়ে বলে,
” কী খুঁজে পাচ্ছেন না?”
” আরে রুমেই তো ছিল।এখন খুজে পাচ্ছি না”
” কি পাচ্ছেন না বলবেন তো।”
” তুমি এসে খুঁজে দাও?”
খুশবু মায়ের সাথে আর তর্ক ছেড়ে চলে যায় আরশাদের কাছে।দরজার কাছে খুশবুকে দেখে চটজলদি মেয়েটাকে টেনে আনে সে।
” এই তো পেয়েছি।”
” কি পেয়েছেন?”
” তোমাকে।তোমাকেই তো খুঁজছিলাম হানি।”
” কেন খুঁজছিলেন?”
” তুমি ঠিক আছো?”
” হ্যাঁ আছি কেন?”
” তাহলে চলো।”
” কোথায়?”
আরশাদ প্রত্যুত্তর করলো না।তার আগেই শার্টের বোতামে হাত রাখলো।খুশবুর আর বুঝতে বাকি নেই আরশাদ কি চাইছে।মেয়েটা কপট রাগ দেখিয়ে আরশাদকে বলে,
” আরশাদ এখন না।”
“এখনি।”
” অসময়ে…”
” রোমান্সে সময় লাগে?আমি আরশাদ ইহসানের সব পরে রোমান্স আগে হোক সেটা সময় অসময়।”
” আমি বলে আপনাকে সামলাই অন্য কেউ হলে….”
” অন্য কেউ লাগবে না তুমি আছো তো।”
” না আমি নেই।”
খুশবু ছুটে পালাতে যায়।দরজা দিয়ে বের হওয়ার আগেই আরশাদ তার ওড়না চেপে ধরে টেনে আনে।দরজাটা সশব্দে বন্ধ করে বাঁকা হাসে।
” এমন ভাব করছো যেন আমরা নব দম্পত্তি।তুমি লজ্জায় পালিয়ে যাচ্ছো ”
” আপনিও তো এমন ভাব করছেন যেন আপনি…. ”
খুশবুর কথা থেমে যায়।আরশাদ তার কাছে এসে খোলা চুল গুজে দেয় কানে।দু’হাতের আঁজলায় দখল করে মেয়েটার দু’গাল।আরশাদের ডাকে সাড়া দেওয়া ছাড়া খুশবু আর উপায় খুঁজে পায় না।পাবে কি করে?প্রতিবার আরশাদ তাকে উস্কে দিয়ে ইনোসেন্ট ভাব ধরে সরে যায়।
.
এয়ারপোর্টের সামনে নীরার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে খুশবু।মেয়েটার আজ আসার কথা ছিল কিন্তু এখনো আসছে না ফোনটাও রিসিভ করছে না।কোন বিপদ হলো না তো?ভয়ে খুশবুর গলা শুকিয়ে আসছে।অনিমা বাহারুল এবং আরশাদ অনেকবার খুশবুকে যেতে বলেছে নীরা নিশ্চিয়ই আসবে না কিন্তু মেয়েটা জেদ ধরে বসে আছে যত যাই হয়ে যাক নীরা নিশ্চয়ই আসবে।সময় গড়িয়ে গেল আরো কিছুক্ষণ, আরশাদ আর দাঁড়ালো না ব্যাগপত্র হাতে তুলে যেতে নিলে খুশবু চোখ ঝাপসা হয় আরশাদকে অনুরোধ করে আরেকটু থাকতে।হঠাৎ একটি মেসেজের শব্দে মনোযোগ সরে খুশবুর।চেক করতে দেখতে পায় নীরা মেসেজ পাঠিয়েছে।
” এয়ারপোর্টে আসতে পারিনি বলে দুঃখিত।আমি অনেক ভেবে দেখিছি কেউ কখনো আমাকে গ্রহণ করবে না মূলত আমি এমন কোন পথে নিজেকে ধাবিত করিনি যে, যে কেউ আমাকে সাদরে গ্রহণ করবে।তোমার পরিবার নিয়ে তুমি খুশি থাকো খুশবু।আমি তোমার সাথে যোগাযোগ চালিয়ে যাব।মন খারাপ করেনা লক্ষ্মী বোন পরে কথা হবে।আমি এখন নতুন ক্লাইন্টের সাথে সিলেট যাচ্ছি।ভালো থেকো।”
.
প্রচন্ড ঠান্ডায় আরশাদের বুকে নিজেকে আরো গুটিয়ে নিয়েছে খুশবু।বিড়াল ছানার ন্যায় ঘুমের মাঝে উষ্ণতা খুঁজছে সে।ঠান্ডায় শরীর থেমে আসছে আরশাদের রুম হিটার গত রাতে চালানো হয়েছে তাহলে এত ঠান্ডা হঠাৎ লাগছে কেন?আরশাদ পিটপিট চাহনিতে চোখ খুললো।পর্দার দরুনে বাইরের দৃশ্য চোখে পড়ছে না।আবহাওয়ার পূর্বাভাস অনুযায়ী আগামী দুদিনের মধ্যে তুষারপাত হবে।তবে কি তুষার পড়ছে?আরশাদ খুশবুকে শুইয়ে উঠে দাঁড়ালো।মেয়েটার উন্মুক্ত দেহে ব্লাঙ্কেট জড়িয়ে দিয়ে ছুটে গেল করিডোরে।
করিডোরের দরজা খুলতে হানা দিল তুলতুলে বরফেরা।চারদিকে ঘেরা তুলো পেঁজার ন্যায় বরফেরা ঘিরে রেখেছে চারিদিক।আরশাদ আনন্দে উত্তেজিত হয়ে পড়লো দ্রুত ছুটে গেল খুশবুর কাছে।মেয়েটাকে ব্লাঙ্কেট সহ পাঁজাকোলে তুলে ছুটে গেল বারান্দায়।তুলতুলে বরফেরা ছুঁয়ে দিল খুশবুর গাল গলা।ঠান্ডায় চমকে উঠে সে।চোখ খুলতে পৃথিবীর অন্যরকম সৌন্দর্যে বিমোহিত মেয়েটা।
” আরশাদ আমি কি সত্যি দেখছি?”
” হ্যাঁ সত্যি জান।ফাইনালি তুমি স্নোফলের দেখা পেলে।”
” চলুন নিচে যাই।”
বাংলাদেশ থেকে এসে আরশাদ পরিকল্পনা করে স্নোফল দেখার উদ্দেশ্যে ফ্লুজিকে নিয়ে মিলান শহরে যাবে।এর আগের বার মিলানে গেলেও তাদের সেই স্মৃতিগুলো সুখকর ছিল না কেননা নীরার আগমন সবটাই উলটে পালটে দেয়।
জীবনের আনন্দেরা আজ এই পর্যায়ে এসে থমকে যায়।টিভিতে,অনলাইনে,মুভিতে সে কত দেখেছিল স্নোফল ফাইনালি খুশবু নিজে ছুঁয়েছে দেখেছে।তুষারে ঢেকে গেছে চারদিকে।আরশাদ তার ফ্লুজিকে নিয়ে একটি হোটেলে উঠেছে।হোটেলের মাঠে তুষারের বৃষ্টিতে নিজেকে বিলিয়ে দিচ্ছে মেয়েটা।এক দলা তুষার নিয়ে আরশাদের মাথায় ছুড়ে খুশবু আরশাদ কয়েক সেকেন্ড স্থির থেকে তুষার কুড়িয়ে খুশবুকে তাড়া করে।দুজনে ছুটতে থাকে উদ্দেশ্যহীন।একটা পর্যায়ে খুশবু ছিটকে পড়ে বরফের গোলায় সেই সাথে পড়ে যায় আরশাদ।
” আরশাদ সরি।আমি…”
খুশবু কথা শেষ করার আগেই আরশাদ বরফের গোলা নিয়ে খুশবুর মুখে ঠেসে দেয়।
” এটা কি করলেন আপনি?ঠান্ডা লাগছে তো।”
” উষ্ণতা লাগবে?”
আরশাদ চট করে খুশবুর ঠোঁটে ঠোঁট মেশায়।আশেপাশে অনেক ইতালিয়ান দম্পত্তি তাদের দেখে সিটি বাজায় কেউ বা হাসতে হাসতে ঠোঁট মেশায় তার স্ত্রী/প্রেমিকার।
.
এরপর সম্পর্কের চড়াই-উতরাইয়ে আরো তিনটে বছর পেরিয়ে গেল।এই তিন বছরে কি আরশাদ এবং খুশবুর সম্পর্ক মধুর হয়েছে?নাকি হেমলোকের বিষাক্ততা ঘিরে ধরেছে তাদের সম্পর্কে?
মানুষের সুখের সন্ধান তৃতীয় ব্যক্তির আড়ালে রাখা শ্রেয়।বদনজর বলেও তো একটা কথা আছে।
আরশাদ এবং খুশবুর সম্পর্কে কি তাই আছে?একজোড়া কপোত-কপোতীর সুখ পছন্দ হলো না তৃতীয় ব্যক্তির।নিজের হিংসাত্মক মনোভাবে একটা মেয়ের সংসার ভাঙতেও কুণ্ঠা বোধ করেনি নীরা।
শেকলের শব্দে আচমকা আরশাদের ঘুম ভেঙে যায়।পিটপিট চোখে তাকাতে দেখতে পেল খুশবু পা টিপে টিপে কক্ষ ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে।মেয়েটার বোকা বোকা কার্যক্রমে আরশাদ হাসে।বিছানার সাথে বাঁধা শেকলটা টানতে খুশবু হুমড়ি খেয়ে পড়তে যায়,অবশ্য পড়তে পড়তেও নিজেকে ধরে নেয় সে।হাতের শেকলটার দিকে তাকিয়ে ভীত চাহনিতে তাকায় আরশাদের পানে।আরশাদ তখন বাঁকা হাসছিল।
” কোথায় যাচ্ছো ফ্লুজি?”
খুশবু ভয় নিয়ে বলে,
” আমার খিদে পেয়েছে।”
” খাবার তো ডয়ারে রাখাই আছে।”
” সব শেষ।”
আরশাদ উঠে বসে।দ্রুত পায়ে তার ফ্লুজিকে টেনে এনে বসায় বিছানায়।
” একটু অপেক্ষা করো জান আমি আসছি।”
এখনো পরিপূর্ণ সকাল হয়নি।ফ্লুজির খিদে পেয়েছে বলে আরশাদ তাড়াহুড়ো করে ফ্রিজ থেকে কিছু ফ্রোজেন খাবার নিয়ে গরম করলো।
খুশবু বিছানার এক কোণে বসে রয়।মেয়েটার বাম পায়ে এবং বাম হাতে শেকল বাঁধা।অবশ্য এই দশার জন্য সে নিজেই দায়ী।নীরার প্ররোচনায় আরশাদের সাথে অনেক মনোমালিন্য করেছে সে।ঝগড়া বিবাধে লিপ্ত হয়েছে।খুশবু যখন বাবা মায়ের কাছে ফিরতে চায় আরশাদ বারণ করেনি ইমার্জেন্সি টিকেট কেটে মেয়েটাকে দেশে যাওয়ার ব্যবস্থা করেছে কিন্তু দেশে গিয়ে খুশবু তার রূপ পাল্টেছে।আরশাদকে ছাড়বে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে।ঝগড়ার মাঝে একদিন বলে বসলো আরশাদকে ডিভোর্স দেবে…সহ্যের সীমা অতিক্রম করে ফেললো আরশাদ কৌশলে তার ফ্লুজিকে নিয়ে এলো ইতালিতে।
তারপরেই খুশবুকে বাঁধা হলো শেকলে।ফ্লুজি ছেড়ে যাবে মানে কী?আরশাদের কাছে ভালোবাসার সজ্ঞা ভিন্ন, ভালোবাসার মানুষকে মুক্তি দিয়ে ভালোবাসা মানে নিজে কষ্ট পাওয়া।আরশাদ কষ্ট পেতে চায় না সে চায় ভালোবাসার মানুষটিকে নিয়ে বছরের পর বছর কাটাবে।নীরার সকল ষড়যন্ত্র আরশাদ ঠিকি বুঝলো একটা সময় পর খুশবু নিজের ভুল বুঝতে পারলো।সে যে ভুলটা করেছে এর হয়তো ক্ষমা হয়না।আরশাদের মতো মানুষকে কষ্ট দিয়ে সে ভুল করেছে।না শুধু ভুল নয় মহাভুল।
এত সবের পরেও নিশ্চয়ই প্রশ্ন থেকে যায় নীরার এসব করার কারণ কি?মূলত হিংসা মানুষকে ধ্বংস করে দেয়।
যেভাবে আগুন কাঠকে জ্বালিয়ে নিঃশেষ করে দেয়।মানুষের চরিত্রে যেসব খারাপ দিক আছে, তার মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষ অন্যতম। ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজে পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষ, ঈর্ষাকাতরতা, কলহ-বিবাদ প্রভৃতি মানুষের শান্তিপূর্ণ জীবনকে বিষাক্ত করে তোলে।
খুশবুর জীবনে না পাওয়ার কি আছে?মেয়েটা ভালো পরিবার পেয়েছে,বিশ্বস্ত স্বামী পেয়েছে।খুশবুর এতটা সুখ নীরার আর সহ্য হলো না।নানান প্রবঞ্চনায় খুশবুকে জড়িয়ে আরশাদের নামে ইন্ধন জোগায় নীরা।সবশেষে বোকা খুশবু আরশাদকে ভুল বুঝলো সুখের সংসারটা গলা চেপে বিষময় করে তুললো।এসব নিয়ে খুশবুর এখন আফসোস হয় বড্ড বেশি আফসোস, সে কেন বোকামিটা করলো?আরশাদ এসব নিয়ে নীরার সহিত মুখোমুখি হয়নি।তার মনে একটাই প্রশ্ন জাগে তার ভালোবাসায় কী কমতি ছিল যে তার ফ্লুজি তাকে ভুল বুঝলো?ছেড়ে যাওয়ার প্রশ্ন তুললো?
সব মিথ্যা সত্য হয়ে যাক,সুখেরা ডানা ঝাপটে মরে যাক,এই জগৎ সংসার আরশাদের বিপক্ষে যাক তবুও আরশাদ তার ফ্লুজিকে ছাড়বে না।আরশাদ বড্ড স্বার্থপর নিজের ভালোর জন্য ফ্লুজিকে তার চাই।
গরম গরম পাস্তা ফুঁ দিয়ে খুশবুকে খাইয়ে দিচ্ছে আরশাদ।এত কিছুর মাঝে আরশাদের ভালোবাসা দেখানো স্বভাবটা থামেনি কিন্তু বেড়েছে উগ্রতা, জেদ, রাগ।খুশবর শেকল বন্দি জীবন সম্পর্কে অনিমা কিংবা বাহারুল হক কেউ জানেন না।ইমরান ইহসান,আফরোজ এসব নিয়ে আরশাদের সঙ্গে যতবার আলোচনায় বসেছে ততবার আরশাদ এড়িয়ে গেছে।তার একটাই কথা তার ওয়াইফ সবটা তাকে বুঝে দেওয়া উত্তম।
খাওয়ার শেষে খুশবু পুনরায় বিছানায় শুয়ে পরে।শেকলের শব্দ তার জীবন থেকে ঠিক কবে যাবে সে জানে না।আরশাদ চুপচাপ এসে শুয়ে পড়ে তার ফ্লুজির পাশে।মেয়েটার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে আচমকা খুবলে ধরে সব চুল।ব্যথায় চাপা আর্তনাদে চেচিয়ে উঠে খুশবু,
” আরশাদ আমার লাগছে ছেড়ে দিন।”
” নীরা তোমায় কি বলেছিল জান?”
” আপ.. আপনি আমায় ভালোবাসেন না। আপনি তুবাকে ভালোবাসতেন আমাকে শুধু শারীরিক চাহিদার…”
” এতটা চাহিদা থাকলে তোমার মতো একটা মেয়েকে আনতাম?শুধু শারীরিক চাহিদার জন্য আমার রুচি এতটাই জঘন্য?আরশাদ ইহসানের জন্য মেয়ের অভাব নেই।”
যেদিন থেকে শেকলে বন্দি খুশবুর জীবন সেদিন থেকে আরশাদ একই প্রশ্ন করেছে এবং একই উত্তর দিয়েছে।খুশবুর ভীষণ ভাবে কান্না পায় সাজানো সংসারটা সে নিজ হাতে তছনছ করেছে। আরশাদ খুশবুর গাল চেপে পুনরায় প্রশ্ন করে,
” ছেড়ে যাবে আমায়?ডিভোর্স চাই?”
খুশবু প্রত্যুত্ত করার আগে গলগলিয়ে উগড়ে দেয় পেটের সব।মেয়েটার মাথা ঘুরছে,আরশাদ উঠে দাঁড়াতে খুশবু চেপে ধরে আরশাদের টি-শার্ট।
” আপনি যাবেন না আপনাকে আমার দরকার।আরশাদ আমার ভালো লাগছে না।আমার কেমন যেন লাগছে।”
কাঁপতে কাঁপতে আচমকা নিস্তেজ হয়ে গেল খুশবুর শরীর।আরশাদ ভীষণ ভয় পেলো।ভয়ের চোটে ছেলেটা কেঁদেই ফেললো।দ্রুত শেকল খুলে ফোন করলো আরিবকে।মেয়েটাকে ইমিডিয়েট হসপিটাল নিতে হবে।
.
খুশবু ভীত চাহনি শুধু আরশাদকে খুঁজছে।হসপিটালের একটা কক্ষে সে একাই শুয়ে।আরশাদ এলো বিধ্বস্ত অবস্থায়,খুশবু তাকে দেখে খুব চমকালো।ছেলেটা ঘেমে নেয়ে একাকার অবস্থা,দু’চোখ লাল,চুলগুলো উষ্কখুষ্ক।
” আরশাদ আপনি ঠিক আছেন?”
আরশাদ প্রত্যুত্তর করলো না।খুশবুর পাশে বসে জড়িয়ে ধরলো মেয়েটাকে।নিরবতা ছিন্ন করে আচমকা আরশাদ কেঁদে উঠলো হুহু করে।খুশবু ভয় পেল এক হাতে আরশাদের পিঠে হাত বুলিয়ে বলে,
” আরশাদ আমার কি খুব বড় অসুখ হয়েছে?”
” আমি বাবা হতে চলেছি জান।আসো মিষ্টি মুখ করি।”
খুশবু কিছু বুঝে ওঠার আগে ঠোঁটে ঠোঁট মেশালো।মেয়েটা হাঁপিয়ে ওঠতে আরশাদ তাকে ছেড়ে উঠে বসে।
” তোমার আদরে ভাগ পড়েছে জান।না না আমার আদরে ভাগ পড়ে।বলো কী চাই?সব দেব সব।এতটা খুশি আগে কখনো হইনি আমি।এলোমেলো আমি কি না বাবা হচ্ছি!”
” আমার আগের জীবন ফিরিয়ে দিন আরশাদ আমি যা করেছি সবটাই ভুল ছিল।”
” মানছো তবে?”
” অনেক আগেই মেনেছিলাম।”
” তুমি বুঝো না?আমার সব ক্লান্তি তেষ্টা নয়নের তৃপ্তি সবটা তোমায় ঘিরে।”
খুশবু হাসে আরশাদের গালে হাত রেখে বলে,
” অভিনন্দন জনাব।আপনি অবশেষে সফল।”
” ফ্লুজি আমার জান অভিনন্দন তোমাকেও, ৭৮ কেজির ভার সহ্য করেছো বলে।
খুশবু চোখ রাঙিয়ে তাকালো আরশাদের পানে।আরশাদ মুচকি হেসে পেছনে তাকাতে দেখতে পেল আরিব হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে তাদের পানে।
__সমাপ্ত__