#ফ্লুজি
#অনুপ্রভা_মেহেরিন
[পর্ব ২৪]
” চা’য়ে চিনি কম কেন আম্মু?”
বিধস্ত একটা মুহূর্তে খুশবুর এমন প্রশ্নে উপস্থিত তিনজন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়।সকলের প্রশ্নবিদ্ধ চোখ এড়িয়ে সে পুনরায় চায়ে চুমুক দিলো।
” চা’য়ের সাথে যে আমার টোস্ট বিস্কুট লাগে তুমি কি ভুলে গেছো?”
দ্বিতীয় বারের মতো অবাক হলো সকলে।অনিমা হতবিহ্বল হয়ে ছুটে গেলেন বিস্কুট আনতে।খুশবু বাহারুল হকের পানে চেয়ে বলে,
” আব্বু তোমার না খুব তাড়া আছে?দাঁড়িয়ে আছো কেন?যাও তবে।”
মেয়ের আচরণে বাহারুল হক কিছুই বুঝ উঠতে পারলেন না তিনি কি যাবেন নাকি থাকবেন তা নিজেই বুঝে উঠতে পারছেন না।আর দুই-চার না ভেবে তিনি চলে গেলেন নিজ কাজে।অনিমা বিস্কুট নিয়ে আসতে খুশবু বলে,
” আম্মু তুমিও নাস্তা করে নাও।”
আরশাদ বিভ্রান্ত হয়ে পড়লো।সে ভেবেছিল খুশবু কাঁদবে,উন্মাদ হয়ে যাবে কিন্তু এই মেয়েতো স্বাভাবিক।অনিমার অপ্রস্তুত চাহনি দেখে খুশবু বলে,
” এখন কি আমায় বের করে দেবে?আমি তো তোমার মেয়ে নই।শুনো জন্ম না দিলেও তুমি আমার মা অতীতে যা হয়েছে তা নিয়ে এখন মন কষাকষি করলে আমাদের নিজেদেরি লস।শুধু শুধু সম্পর্কগুলো নষ্ট হবে।”
অনিমা মাথা দুলালেন।কি প্রতিক্রিয়া তিনি করবেন নিজেই ভেবে পাচ্ছে না।যাকে আদর যত্নে এত বছর যাবৎ লালন পালন করেছে সেই এখন তার মেয়ে নয়!বললেই হলো নাকি।
.
ম্যাজমেজে শরীরটা নিয়ে আবার কাঁথা মুড়িয়ে শুয়ে পড়লো খুশবু।বাইরে থেকে শীতল হাওয়ায় গায়ে কাটা তুলছে।আসমানটা আজ একটু বেশি নীল।
আরশাদ বসলো খুশবুর পাশে ছেলেটা চিন্তায় মূঢ় হয়ে বলে,
” তুমি স্বাভাবিক!”
” হ্যাঁ কেন?”
” আসলে…”
” কি ভেবেছিলে?আমি কেঁদে-কেটে সবাইকে দূরে সরিয়ে দিব?নাকি কাঁদতে কাঁদতে জ্ঞান হারাবো।আমার নিজের বাবা মা আমাকে বিক্রি করে দিয়েছে বুঝতে পারছেন আপনি?আমার ভাগ্য ভালো বলেই আজ এ পর্যায়ে এসেছি যদি তা না হতো হয়তো আমার নিয়তি হতো নীরার মতো।”
আরশাদ খুশবুর পাশে শুয়ে পড়লো।মেয়েটাকে শক্ত করে জড়িয়ে লুকিয়ে রাখলো নিজের বুকে।এলোপাতাড়ি চুমুতে ছুঁয়ে দিল খুশবুর গাল কপাল।
” এসব নিয়ে ভাববে না।আমি আছি তো?”
” আপনি আছেন বলেই এসব সত্যি সামনে এলো।”
” সত্য আড়াল করে লাভ নেই একদিন না একদিন ছিটকে বেরিয়ে আসবেই।”
” হুম তা ঠিক।”
” শরীর খারাপ লাগছে?”
” মাথাটা ধরে আছে।”
” ঘুম দাও তবে।”
.
বাহারুল হক বাড়ি ফিরলেন দুপুরে।স্ত্রীর মুখের দিকে তাকানোর সাহস তার নেই।অনিমা রান্না ঘরে ব্যস্ত।অনেকক্ষণ যাবৎ পায়চারি করে অনিমাকে হাঁক ডাকলেন তিনি।অনিমা কক্ষে ফিরে জানতে চাইলো কেন ডেকেছে? এই প্রশ্নের জবাব বাহারুল হকের কাছে নেই।তিনি কি বলবেন বুঝে উঠতে পারছেন না।শ্বাস টেনে সাহস জুগিয়ে বলেন,
” সত্য প্রকাশে তোমার মতামত কী?”
” আমার মতামত আপনি জেনে কী করবেন?”
” অনিমা তুমি রেগে আছো?”
অনিমা বিছানায় বসলেন।ভেতর থেকে তার সব উজাড় হয়ে গেলেও বাইরে থেকে কেন তিনি কাঁদতে পারছেন না?
” আমি কাঁদতে পারছি না কেন?”
” অনিমা নিয়তি মেনে নাও।”
” আপনি আমাকে কেন জানালেন না?আমি কি ওই নিষ্পাপ শিশুকে ফেলে দিতাম?নাকি অস্বীকৃতি জানাতাম?”
” মেয়েটার মুখের দিকে তাকালে একবারেও কি তোমার মনে হতো না সে তোমার গর্ভজাত সন্তান নয়।”
” এখন কী মনে হবে না?”
” না হবে না।নিজে সবটুকু দিয়ে খুশবুকে তুমি মানুষ করেছো সে তোমার সন্তান।”
অনিমা চুপ করে রইলেন।সত্য মিথ্যা এখন জেনে কী হবে?খুশবুকে তিনি পর কেউ ভাবতেই পারেন না।খুশবু তার নিজের মেয়ে।দু’হাতের আদর, ভরসা,যত্ন মেখে তিনি খুশবুকে বড় করেছেন।
” অনিমা তুমি আমার অনুরোধ রাখবে?খুশবুর সামনে মন খারাপ করে থেকো না।আমি জানি সত্যটা জানার পর তোমার খারাপ লাগলেও খুশবুর সামনে কখনোই তা প্রকাশ করবে না।সবসময় মাথায় রাখবে খুশবু তোমার মেয়ে।”
” খুশবু আমার মেয়ে সে শুধু আমার মেয়ে।”
.
আরশাদ কি ভেবেছিল?সত্যটা যেনে কি খুশবু থমকে যাবে?নাকি অনিমা সর্বদা খুশবুর প্রতি দূরত্বের দেয়াল তৈরি করবেন?সেই সব ভাবনাই ফিকে পড়ে গেছে।একমাস পর সবাই মাথা থেকে ঝেরে দিল সবটা।সবার জীবনের গতি ফিরলো আগের মতো।তবে খুশবুর মাথায় চলছে ভিন্ন কিছু সে চায় নীরার একটি সুন্দর জীবন হোক।মেয়েটা খুশবুর পরিবারকে নিজের পরিবার ভেবে বাকিটা জীবন কাটিয়ে দিক কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত ঘোর বিরোধিতা করলেন বাহারুল হক এবং আরশাদ।তারা কেউ চায় বা খুশবুর সাথে নীরার কোন সম্পর্ক থাকুক।
জীবনের ছন্দ ভিন্ন ভাবে কাটছে আরশাদের।শুয়ে বসে থাকা ছাড়া তার তেমন কোন কাজ নেই।দেশে এসেছে একমাস হতে চললো খুশবুকে নিয়ে সময়টা নিদারুণ ভালোই কাটছে।আরশাদের মনে হঠাৎ ইচ্ছে জাগলো সে গ্রাম ঘুরে দেখবে।বাংলাদেশে এলেও তার গ্রাম ঘোরা হয়নি।লীলাভূমির সৌন্দর্যে ঘেরা এই দেশটাকে আরশাদের এখনো তেষ্টা মিটিয়ে দেখার সৌভাগ্য হয়নি।আরশাদের গ্রাম ঘোরার এই ইচ্ছের কথা জেনে বাহারুল হক উচ্ছ্বসিত হলেন তিনি জানান গ্রামে তার একজন মামা থাকেন।বৃদ্ধ মামা সেই গ্রামের প্রভাবশালী ব্যক্তি।আরশাদের খেয়াল রাখতে তার আয়োজনের কোন কমতি হবে না।
বাহারুল হকের দেওয়া ঠিকানা মোতাবেক আজ সকালে গ্রামে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বের হয় আরশাদ।শহর থেকে সেই গ্রামে যেতে তিন ঘন্টার বেশি সময় লাগবে।আরশাদ ভেবেছিল তার গাড়ি নিয়ে যাবে কিন্তু খুশবু বাঁধ সাধলো।আরশাদকে কখনো বাসে ঘুরানো হয়নি,বাসে জার্নির যে অনুভূতি আরশাদ কখনো পায়নি।এই সুযোগটা মিস করা বোকামি ছাড়া আর কিছুই না।খুশবুর জোরাজোরিতে আরশাদ বাসে যাওয়ার জন্য রাজি হলো।
গাড়ির গন্ধে গা গুলিয়ে আসছে আরশাদের।বাকি সময়টা সে কি করে পার করবে ভেবে কোন সমাধান খুঁজে পাচ্ছে না।খুশবু জানলার পাশে বসে চিপস খেতে ব্যস্ত।তার কোলে চিপস জুস চকলেট আচারের প্যাকেট।একের পর একটা সাবাড় করছে মেয়েটা।জার্নির সময় নাকি তার মুখ না চললে ভালো লাগে না।আরশাদের দিক্র তাকিয়ে সে বলে,
” খাবেন?”
” না তুমি খাও।”
” আমার পছন্দের চিপ্স মিস্টার টুইস্ট।একটা খেয়ে দেখুন অনেক মজা।”
আরশাদ একটা চিপস মুখে তুললো তবে তার ভালোলাগলো নাকি খারাপ লাগলো তা আর বোঝা গেল না ছেলেটার মুখের এক্সপ্রেশন পাল্টায়নি।
চলে গেল বেশ কিছুটা সময়।লোকাল বাসে সবার হিড়িক দেখে আরশাদের মেজাজ খারাপ হয়ে গেল।একটি পুরুষ তার পাশে দাঁড়িয়ে নিশব্দে দেদারসে বায়ু দূষণ করছে গন্ধে তার গা গুলিয়ে উঠছে, অপরদিকে ঘামের গন্ধে যাচ্ছে তাই অবস্থা।কিছুক্ষণ বাদে বাদে জ্যামে গাড়ি আটকে আছে।ছেলেটার গরমে সাদা চামড়া কেমন রক্তিম হয়ে উঠছে।
আরশাদের এমন দশায় খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো খুশবু।
” কিরে বিদেশি গরু দেশের ফিল নেবে?গ্রামের ফিল নেবে?তার আগে লোকাল বাসের ফিল নাও।”
” একদম হাসবে না।আমি উঠতে চেয়েছি বাসে?”
” এই শুনো সবকিছুর সাথে পাল্লা দিয়ে বাস জ্যাম এগুলাও ফিল করার বিষয়।”
” আমার এত ফিল নিয়ে কাজ নেই শুধু তোমাকে ফিল করলেই চলবে।”
” শুনুন আরশাদ,গ্রামে যাচ্ছেন সারাক্ষণ আমার পিছু পিছু ঘুরাঘুরি বন্ধ করবেন।সবাই কিন্তু এসব কটু চোখে দেখবে,খারাপ ভাববে।কেউ কেউ আপনাকে লজ্জায় ফেলতে পারে।”
” কেউ খারাপ ভাববে বলে আমি তোমার পিছু থাকবো না?তোমার আশেপাশে থাকবো না? তাহলে বিয়ে করলাম কেন? আমার বউ আমি থাকাবো তাদের কি সমস্যা?”
” সমস্যা হাজার খানেক।এই ধরুন আপনি আমার পাশে বেশি থাকবেন এটা তাদের পছন্দ হবে না।আবার আপনি আমার পাশে কম থাকবেন এটাও তাদের পছন্দ হবে না।”
” তাহলে তাদের পছন্দ হবে কি?”
” তারা সেটা নিজেরাও জানে না।”
” অদ্ভুত!”
” হু আপনার মতো।”
” আমি আবার কী করলাম?”
” আমাকে ভালোবাসলেন।”
আরশাদ প্রত্যুত্ত করার আগে তার পাশে দাঁড়ানো লোকটি আবার বায়ু দূষণ করলো।সহ্যের শেষ সীমানায় পৌঁছে গেল আরশাদ নাক চেপে খুশবুর কাঁধে মাথা আড়াল করে বসে রইল চুপচাপ।
সময় যত গড়ালো আরশাদের ভালোলাগার মাত্রা বাড়লো।মানুষ জনের চাপাচাপি কমেছে।জ্যামের মাত্রাও আগের তুলনায় অনেক কম গাড়ি ছুটছে তার আপন গতিতে।খুশবু ঘুমিয়ে আছে,তার মাথা লেপ্টে আছে আরশাদের কাঁধে।আরশাদের কাছে এই মুহূর্তটা একটু
বেশি সুন্দর।শুধু সুন্দর নয় ভালোলাগারো।অনেকক্ষণ এক রকম বসে থাকায় ছেলেটার কাঁধে ব্যথা অনুভব হচ্ছে তবুও একটুও নড়লো না আরশাদ।সে চায়না খুশবুর ঘুম ভাঙুক।
আরশাদ যখন প্রেয়সীর ঘুমন্ত মুখটা আড় চোখে দেখছিল তখনি আচমকা বাসটি ঝাকুনি দিল।আরশাদ কিছু বুঝে উঠার আগে দ্বিতীয়বার ঝাকুনি দিল বাসটি।কাঁচ ভাঙার শব্দে শিউরে ওঠলো তার শরীর।ডানে বামে তাকিয়ে বুঝে উঠার আগে আরশাদের গালে এসে বিঁধলো একটি কাচের টুকরো।একটি বাচ্চা এসে ছিটকে পড়লো আরশাদের ঘাড়ে।আরশাদ নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সিট থেকে হুমড়ি খেয়ে পড়লো।ব্যথায় টনটন করে উঠলো তার সমস্ত শরীর।কানের ভেতর কেমন যেন শো শো শব্দ তুলছে।হাতড়ে হাতড়ে খুশবুকে খুঁজতে গিয়ে পেল মেয়েটা সিটের নিচে পড়ে আছে।খুশবুর মাথা ফেটে গলগলে রক্ত ঝরছে।আরশাদ দিশাহীন হয়ে শোয়া থেকে উঠে বসতে চাইলো কিন্তু তার আগে বাসটি তৃতীয়বার ঝাকুনি দিল।লোহার সাথে মাথা লেগে ফেটে গেল আরশাদের মাথা।খুশবুর কাঁচ বিঁধে থাকা হাতটার দিকে তাকিয়ে নিশব্দে দেখে চোখ বুঝলো আরশাদ।
দু’টো গাড়ির মুখোমুখি সংঘর্ষে চোখের পলকে একটি এক্সিডেন ঘটে গেল।রাস্তার মানুষজন ছুটে এলো বাসের কাছে তারা সবাই মিলে যে যাকে পারছে সাহায্য করছে।সময়ের তালে তালে এম্বুলেন্সের সাইরেনে ভারী হয়ে এলো চারপাশ।
চলবে….
#ফ্লুজি
#অনুপ্রভা_মেহেরিন
[পর্ব ২৫ ]
সেই বাসে থাকা প্রত্যেকটা মানুষের কিছুনা কিছু ক্ষতি হয়েছে।কেউ হাত হারিয়েছে কারো আবার পা ভেঙেছে।বাসে থাকা দুজন ড্রাইভার ঘটনা স্থলে মারা যান।এই মৃত্যুর মিছিলে সবাই তাদের আপজনদের খুঁজতে ব্যস্ত।হসপিটালে সাংবাদিকদের ঢল নেমেছে।তারা সরাসরি সম্প্রচারে ব্যস্ত।দেশবাসী টিভির পর্দায় এই নির্মম দৃশ্য দেখে চোখের পাতা ফেলছেন।এ এক মৃত্যুর মিছিল হাহাকার।
অনিমা টিভিতে ধ্যান বসিয়েছেন আরশাদ কিংবা খুশবু কাউকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না।বাহারুল হক নিশ্চিত হলেন আরশাদ খুশবু ভালো নেই তাদের কিছু তো হয়েছে।
আহত এবং নিহতদের যে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে সেই হাসপাতালে খুশবু এবং আরশাদের খোঁজ নিতে রওনা হয়েছে বাহারুল হক এবং খুশবুর মামা শামীম।
খুশবুর বাবা মনকে যতই জোর দিক তবে তিনি ভেতর থেকে ভেঙে পড়ছেন দু’কদম গিয়ে বসে পড়লেন রাস্তায়।খুশবুর মামা বাহারুল হকের হাত ধরে টেনে বলেন,
” দুলাভাই সময় নেই অনেকদূর যেতে হবে।”
“আরশাদ,আমার কলিজা ঠিক আছে তো?”
” আল্লাহ’র উপর ভরসা রাখুন আল্লাহ আপনার বুক খালি করবেন না।”
বাহারুল হক উঠে দাঁড়ালেন তাকে এখন ভেঙে পড়লে চলবে না।তাকে তো যেতে হবে অনেকটা দূর।
আরশাদের কপাল ফেটেছে।গালে কাচ বিঁধেছে,হাতে পায়ে কেটে গেছে,বাম হাতের একটি আঙুল ভেঙে গেছে।এই ছাড়া তার আর তেমন কোন সমস্যা নেই।কপালে সেলাই করে অনন্য স্থানে প্রথমিক চিকিৎসা নিয়ে সে উঠে দাঁড়ালো।নার্সরা বারবার বলছিল তাকে বিশ্রাম নিতে কিন্তু সে তো তার ফ্লুজিকে খুঁজে পাচ্ছে না।সে কি করে স্থির থাকবে?
পা খুঁড়ে খুঁড়ে হসপিটালের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত ছুটছে আরশাদ।প্রতিটা মানুষের শরীরে রক্ত,মেঝেতে মৃত দেহগুলোকে শুইয়ে রাখা হয়েছে।লাশের সারিতে একটি ছেলেকে দেখে আরশাদ চিনে ফেললো।এই ছেলেটা তার পাশের সারিতে বসেছিল।দীর্ঘ কয়েকমাস পর সে তার বাড়ি ফিরছে বলে মা’কে ফোন করে মনগোপনে থাকা উচ্ছ্বাস জানালো।ভাগ্যের পরিহাস মায়ের কাছে আর ফেরা হলো না ছেলেটির।মানুষের কোলাহল,এম্বুলেন্সের সাইরেন সবকিছু মিলিয়ে আরশাদের মস্তিষ্ক বার বার থমকে দিচ্ছে।মাথায় ঘুরছে নানান রকম চিন্তা।রক্তাক্ত শরীর টেনে হসপিটালের আনাচে-কানাচে খুশবুকে খুঁজছে সে।কোথাও নেই, কোথাও নেই মেয়েটা।একজন নার্স দ্রুত পায়ে অন্যদিকে যেতে নিলে আরশাদ তার পথ আটকায়,
” এক…একটা মেয়েকে দেখেছেন?ফর্সা নাম খুশবু।”
” এত মানুষের ভিড়ে সঠিক বলা মুশকিল।আপনি প্রতিটা ওয়ার্ডে খুঁজুন।”
” আমি খুঁজে পাচ্ছিনা।”
” তবে লাশের সারিতে খুঁজুন।”
বুকটা কেঁপে উঠলো আরশাদের।লাশের সারিতে খুঁজবে মানে কি?তার ফ্লুজি মারা যাবে?তাকে রেখে চলে যাবে?আরশাদ উন্মাদ হয়ে উঠলো আবারো খুঁজতে শুরু করলো তার ফ্লুজিকে।মানুষের আহাজারিতে ভারি হয়ে এলো তার অন্তর, একটি বাচ্চা লাশের সারিতে পড়ে আছে।তার নিথর দেহটি আরশাদের বুক কাঁপিয়ে দেয়।হসপিটালের নিচতলা ছেড়ে দোতলায় আসে সেখানেও একই অবস্থা সব আহত রোগীরা চিকিৎসা নিচ্ছে।একে একে প্রতিটা কোন,প্রতিটা মানুষকে সে দেখলো নাহ নেই, খুশবু কোথাও নেই।
তখন বাসে আরশাদের জ্ঞান হারালে হসপিটালের বেডে তার জ্ঞান আসে এর মাঝে কি হয়েছে খুশবু কোথায় সে কিচ্ছু জানে না,কিচ্ছু না।
অন্ধকার হয়ে আসে আরশাদের পৃথিবী।কি করবে সে?কার কাছে যাবে?শরীরের সমস্ত ব্যথা খুশবুকে না পাওয়ার যন্ত্রণা থেকে খুব বেশি নয়।চারদিকে দ্বিতীয় বারের মতো দৃষ্টি ঘুরালো সে।কোন উপায়ন্তর না পেয়ে দ্রুত ছুটে গেলো নিচে।আরেকটি এম্বুলেন্সের গাড়ি এসেছে সেখান থেকে একে একে আহত নিহত সবাইকে হসপিটালে আনা হচ্ছে।চাতকপাখির ন্যায় এক কোনায় দাঁড়িয়ে সবটা দেখছে আরশাদ।হঠাৎ তার চোখ যায় লাশের সারিতে থাকা একটি মেয়ের দিকে।আরশাদের চিন্তারা স্থির হয়।এই তো তার ফ্লুজি।অবশেষে সে পেয়েছে তার ফ্লুজিকে।আরশাদ ছুটে যায় তার ফ্লুজির কাছে মেয়েটার মাথা কোলে তুলতে শার্টে লেপ্টে যায় তরল রক্ত।মেয়েটি বীভৎস ভাবে আঘাত পেয়েছে।মাথার পেছনটা অনেকটা ফেটে গেছে।গলায় বিঁধে গেছে কাচের টুকরো।মুখের একপাশ কান সহ থেতলে গেছে।
” ফ্লুজি চোখ খুলো।দেখো আমি এসেছি খুব কষ্ট হচ্ছে তাই না?শহরের সবচেয়ে ভালো ডাক্তারের কাছে চিকিৎসা হবে তোমার।আরেকটু ধৈর্য ধরো আরেকটু।”
আরশাদ উন্মাদ হয়ে গেলো।মেয়েটার মাথা ঝাকিয়ে ডাকলো বারংবার।অথচ মেয়েটার কোন সাড়া শব্দ নেই।মেয়েটা নিশ্বাস অবধি নিচ্ছে না।
” কি হলো ফ্লুজি এই ফ্লুজি চোখ খোলো।আমি এখন থেকে তোমার কথা মতো চলবো তুমি যা বলবে তাই হবে শুধু একবার চোখ খুলো ফ্লুজি।”
একটি ছেলে এসে আরশাদের হাত সরিয়ে দেয়।এবং মেয়েটাকে শুইয়ে দেয় মেঝেতে।সেই ছেলেটাও কাঁদছে চোখের জলে গাল ভিজে চিবুক চুইয়ে অশ্রুপাত ঘটছে।আরশাদ রেগে যায় ছেলেটার দিকে চোখ রাঙিয়ে বলে,
” আমার ফ্লুজিকে আপনি সরিয়ে দিলেন কেন?”
” কে আপনার ফ্লুজি?ও আমার বোন।”
” আপনার বোন মানে?”
” আমার বোন তুবা।”
আরশাদ থমকে যায়।তুবা নামটার সাথে সে ভীষণ ভাবে পরিচিত।আরশার নজর ঘুরায় ভালোভাবে পরখ করে দেখলো মেয়েটির গায়ে একটি হলুদ রঙের জামা।অথচ খুশবু পড়েছে সাদা থ্রিপিস।আরশাদ মেয়েটির গলায় থাকা পেন্ডেন্ট দেখে চমকে যায়।তুবা নামক মেয়েটির সাথে আরশাদের যখন প্রেমের সম্পর্ক থাকে তখন এই পেন্ডেন্ট নিজের পছন্দ মতো কাস্টমাইজ করে আরশাদ বানিয়েছিল।দামি হীরের এই পেন্ডেন্টটি তুবা এখনো গলায় রেখেছে!বিধস্ত এই পরিস্থিতিতে আরশাদের মাথায় আসে সেদিনের কথা খুশবু বারবার তাকে বলেছিল সে ফ্লুজি নয় তবে তো খুশবুর কথাই সত্যি তুবা অন্য আরেকটি মেয়ে।এই পৃথিবীতে একই চেহারার তিনটে মেয়ের!আরশাদ কি কখনো ভেবেছিল তার সাথে এমনটা হবে?
” তুবা আপনার বোন?ওর চিকিৎসা করছেন না কেন?”
আরশাদ নিস্তেজ গলায় প্রশ্ন করলো।মুহূর্তে হুড়মুড়িয়ে কেঁদে উঠলো ছেলেটি,
” আমার বোন আর এই দুনিয়াতে নাই ভাই।আমার বোন আর নাই।”
আরশাদ থমকে গেল।খুশবুকে সে অবিশ্বাস করে না।অন্তত বিয়ের পর খুশবু যতবার বলেছে আরশাদের প্রেমিকা সে নয় আরশাদ তা বিশ্বাস করেছে।তুবার মৃত্যু আরশাদের কষ্ট বাড়িয়ে দিল দ্বিগুণ।তার মনে জমে থাকা প্রশ্নেরা বারবার তাকে আঘাত করে।
হঠাৎ তুবা কেন তার সাথে অযথা ঝগড়ায় লিপ্ত হয়?কেন এই দূরত্ব?তবে সেকি আরশাদকে কোনদিন ভালোবাসেনি?সবটাই তবে ছলনা।
আরশাদ শেষবার তাকালো তুবার পানে।
” আমি তোমায় ভালোবাসি না।ভালোবাসা কি আমি জানি না।তুমি আমায় শিখিয়েছিলে ছলনা।আমার ভালোবাসা আমার কাছে আছে,আমার ভালোবাসার ফ্লুজি আমার কাছে আছে।কিন্তু এই আফসোস তো আমার কখনোই যাবে না তোমার সাথে আমি মুখোমুখি হতে চেয়েছি তবে এভাবে নয় তোমায় মৃত অবস্থায় দেখার ইচ্ছে আমার কখনোই ছিল না।”
.
ব্যস্ত হসপিটালে ক্লান্ত পায়ে আরশাদ বসে যায় এক কোনায়।ছেলেটা কেমন অসহায় নজরে কাঁদছে।পুলিশের সাথে যোগাযোগ করেছে সে কিন্তু সবাই খুশবুর ছবি চাইছে ছবি ছাড়া মুখের বর্ননায় এত মানুষের ভীড়ে কি করে খুঁজে পাবে?আরশাদের ব্যাগ,ফোন কোথায় সে জানে না তাহলে কি করে খুশবুর ছবি সবাইকে দেখাবে?
হসপিটালে এসে উপস্থিত হন বাহারুল হক এবং খুশবুর মামা শামীম। মুহূর্তে আরশাদ বাহারুল হককে দেখতে পায়।জলের স্রোতে ভাসা আরশাদ যেন খড়কুটো খুঁজে পায় এবং আঁকড়ে ধরতে ছুটে যায়।আরশাদকে জীবিত দেখে বাহারুল হক আশ্বস্ত হন।খুশবু কোথায় আছে জানতে চাইলে সেই সম্পর্কে কোন উত্তর দিতে পারেনা ছেলেটা।
হাসপাতালের করুন পরিস্থিতিতে সম্পূর্ণ রূপে ভেঙে যান বাহারুল হক।শামীম পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং খুশবুর ছবি দেয় তাদের।খুশবুকে খুঁজতে তারা তিনজন তিন দিকে ছড়িয়ে যায়।অবশেষে শামীম খুঁশবুকে পেয়েও যায়।মেয়েটা তিনতলায় একটি বেডে শুয়ে কাতরাচ্ছে।ব্যথায় টনটন করছে তার সমস্ত কায়া।শামীমের নির্দেশ মোতাবেক তিন তলায় এসে উপস্থিত হয় আরশাদ এবং বাহারুল হক।
খুশবুর মাথা ফেটেছে, বাম হাতটা ভেঙে গেছে।বেশ কয়েক জায়গায় পিঠের মাংস উঠে গেছে।গালে গলায় বিঁধেছে কাচ।ঠোঁট ফেটে ফুলে আছে।হাসপাতাল থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে খুশবুকে।শামীম ডাক্তারদের সাথে কথা বলেন,যত দ্রুত সম্ভব খুশবুকে ভালো একটি হসপিটালে এডমিট করতে হবে।মেয়েটার শারীরিক এবং মানসিক অবস্থা দু’টোই ঝুঁকিপূর্ণ।আরশাদের সমস্ত শরীরের কার্যক্রম তখনি থমকে যায় যখন দেখলো তার ফ্লুজি ভালো নেই।মেয়েটার গালে হাত বুলিয়ে আরশাদ কেঁদে ফেলে।
বাচ্চাদের মতো ফুঁপিয়ে সে বলে,
” আমি ভয় পেয়েছিলাম।আমাকে কেন ভয় দেখালে?”
চলবে….