#ফ্লুজি
#অনুপ্রভা_মেহেরিন
[পর্ব ২২]
আরশাদের সান্নিধ্যে খুশবু কি পেয়েছে কি হারিয়েছে তার সঠিক জবাব খুশবুর কাছে নেই।তবে আরশাদের সান্নিধ্যে আস্ত একটা সুখের আকাশ পেয়েছে।এক কোণে বানানো কোণ ঠাসা জগৎটা ছিড়ে বেরিয়ে এসেছে।আরশাদের হাত ধরে ঘুরছে অজানা শহরে।এসব শহরের ঐতিহ্য ইতিহাস তার তো আগে জানা ছিল না কোনদিন ধারণাও করেনি বাংলাদেশ পাড়ি দিয়ে সে আসবে অন্য এক দেশে বসবাস করবে অন্য আরেক মানুষের সাথে।
মিলান শহরে এডনা এই প্রথম বারের মতো এসেছে মেয়েটা আজ ভীষণ এক্সাইটেড।এলোনের পাশে দাঁড়িয়ে তার ছবি তোলা আর শেষ হলো না।আরশাদ তার ফ্লুজির হাত ধরে হাটছে।খুশবু অনেকবার মিলান ক্যাথেড্রাল দেখেছে তবে সামনা সামনি নয় মুভিতে গানে।ক্যাথেড্রালের সম্মুখে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ হয় খুশবু।এত সুন্দর!এত চমৎকার দৃশ্য! এতো তার ভাবনার বাইরে ছিল।মিলান ক্যাথেড্রালকে নিজের চোখে দেখা ফটোগ্রাফে দেখার মতো এক নয়। সামনা সামনি ক্যাথেড্রালের সৌন্দর্যের কাছে উচ্ছ্বসিত হয় মনপ্রাণ।ভ্রমন পিপাসুদের কাছে এটি একটি উত্তম স্থান।
” আরশাদ আপনি আগে এসেছিলেন এখানে?”
” হুম।তিন বছর আগে এসেছিলাম।”
আরশাদ খুশবুর হাত ধরে হাটতে থাকে।মেয়েটা বোঝাতে শেখাতে তার কোন কার্পণ্য নেই।
মিলানের সবচেয়ে বিখ্যাত স্মৃতিস্তম্ভটি পরবর্তীকালে এই ক্যাথেড্রালে পরিণত হয় যার পুরো নাম ‘সান্তা মারিয়া নাসেন্টে’।গথিক স্থাপত্যের এই দুর্দান্ত ভবনটিকে মিলানের প্রতীক বলা হয়, কারণ এটি শহরের কেন্দ্রে অবস্থিত। ।
গথিক যুগের গির্জাগুলো ঐতিহ্যগত ভাবে অসংখ্য ভাস্কর্য দিয়ে সজ্জিত, কারণ অন্তহীন বিবরণ গথিক ভবনগুলির প্রধান সজ্জা হিসাবে বিবেচিত হয়।
মিলান ক্যাথিড্রালে ২২৪৫ টি ভিন্ন এবং খুব অসাধারণ ভাস্কর্য রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে সাধুদের মূর্তি, বাইবেলের গল্পের দৃশ্যের চিত্র এবং অদ্ভুত ফ্যান্টাসমাগোরিক প্রাণী। বিল্ডিং সজ্জিত বিবরণ অনেক মধ্যযুগীয় মুখ চিত্রিত।
সামনের ভাগে কেন্দ্রীয় ব্যালকনিতে অবস্থিত কিছু মহিলা চিত্রগুলি নিউ ইয়র্ক স্ট্যাচু অফ লিবার্টির সাথে খুব মিল।
ডিলান, আরশাদ এবং খুশবুর বেশকিছু ছবি তুললো।জনের কথাগুলো মাথায় আসতে মন মরে যায় ডিলানের।খুশবু এমন মেয়ে?আদৌ কি এই কথা বিশ্বাস হয়!কোথায় যেন শুনেছে একই চেহারার মানুষ পৃথিবীতে সাতজন আছে তাহলে খুশবুর সাথেও কি সেই তেমনটা ঘটছে?ক্যাথেড্রালের আশেপাশে মানুষজনের অভাব নেই।নানান শহরের নানান দেশের মানুষ এখানে উপস্থিত।বন্ধুরা যে যার মতো ঘুরছে ডিলান ক্যাথেড্রালের সৌন্দর্য ক্যাপচার করতে ব্যস্ত।মনের ভুলে তার সাথে ধাক্কা লেগে একটি মেয়ের ফোন ছিটকে পড়ে রাস্তায়।মেয়েটির পাশে দাঁড়ানো ছেলেটি চেচিয়ে উঠে।ডিলান নিজের ভুলে মাথা নত করে।মাফ চায় ছেলেটির কাছে।মেয়েটি ফোন হাতে তুলে দাঁড়াতে ডিলান চমকে যায়।থমকে যায় তার স্নায়ু। কি এক অদ্ভুত প্রহেলিকায় আটকে গেছে তার জ্ঞান বুদ্ধি।
মেয়েটি ফোন হাতে তুলে ন্যাকামিতে বলে,
” আমার ফোন…দেখে হাটবেন তো।”
মেয়েটির সম্মুখে থাকা ডিলান নামক ছেলেটাকি বাংলা বুঝে?একদমি না।অথচ মেয়েটির কথা ছিল বাংলায়।ডিলানের নিরবতায় সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি বিরক্ত হয়।তার পাশে থাকা ছেলেটিকে তাড়া দিল।দু’জনে যখনি যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয় তখনি ডিলান মেয়েটির হাত ধরে ফেলে।
এক অপ্রতিভ অবস্থায় আটকে যায় দুজনে।ডিলান লাহমায় উত্তেজিত হয়ে পড়ে।মেয়েটি ঝটকায় সরিয়ে ফেলতে চায় তার হাত।ডিলান চেচিয়ে উঠে,আরশাদকে ডাকে হাঁক ছেড়ে।ডিলানের এমন চিৎকারে আরশাদ ছুটে আসে।খুশবু তখন এডনার সাথে ছিল বিধায় ডিলানের ডাকা ডাকিতে সে আগ্রহ দেখাল না।
আরশাদ ডিলানের সামনে আসতে চোখ পরে ওয়েস্টার্ন পরাহিত একটি মেয়ের দিকে।মেয়েটি দেখতে হুবহু খুশবুর মতো।আশ্চর্য!অবিশ্বাস্য কান্ড!আরশাদ ঢোক গিললো মেয়েটির পানে তাকিয়ে কড়া গলায় বলে,
” হু আর ইয়ু?”
আরশাদের এমন আচরনে হতবুদ্ধ হয়ে যায় মেয়েটি।আরশাদের দিকে প্রশ্নবোধক চিহ্ন বসিয়ে তাকিয়ে রইল পিটপিট চোখে।ডিলান উত্তেজিত হয়ে বলে,
“হোয়াট’স ইয়ুর নেম?”
” নীরা।”
মেয়েটির গলার স্বর ফুরিয়ে এলো।হঠাৎ এই দু’টি ছেলের আচরণ নীরাকে চিন্তায় ফেললো।পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটি তাড়া দিয়ে বলে,
” তুমি যাবে?এই ছেলেরা কী চায় তোমার কাছে?”
নীরার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটির বিরক্তিকর চাহনি বুঝতে পারলো।ব্যাগ থেকে একটি কার্ড নিয়ে ডিলানের হাতে ধরিয়ে দিল নীরা।
” এটা আমার কার্ড।নাম্বার আছে যোগাযোগ করবেন।চার্জের ব্যপারে না হয় ফোনেই আলাপ হবে।”
ডিলান এবং আরশাদ ভড়কে গেল।চার্জ!কিসের চার্জ?ততক্ষণে এলোন এগিয়ে এলো।নীরাকে দেখে দু’কদম পিছিয়ে গেল সে।নীরার বাহুতে সেই চিরচেনা টেটু দেখে এলোন বলে,
” এতো সেই কলগার্ল মেয়েটা।”
আরশাদ চমকে গেল।ডিলান এলোনের কথায় সায় জানালো।নীরাকে নিয়ে এই তিনটা ছেলের এতটা আগ্রহ দেখাচ্ছে কেন?এসব নিয়ে নীরা বেশ অপ্রস্তুত হলো সে,এরা এতটা আলোচনা করছে কেন?
এডনা এলোনকে বারবার ডাকছিল কিন্তু এলোন কি আর তার ডাক শোনে?ছেলেটার চোখের সামনে আশ্চর্যজনক একটি কান্ড ঘটেছে তার কর্ণকুহুরে আজ আর কোন ডাক যাবে না।
এডনা এলোনের কাছে আসে তার সাথে খুশবু এগিয়ে এসে দাঁড়ায়।নীরার দিকে তাকিয়ে চমকে যায় সে।হুবহু তার মতো দেখতে এই মেয়েটি কে? ডিলান এলোন আরশাদ সবাই খুশবুর দিকে তাকিয়ে।খুশবুর সন্ত্রস্ত চাহনিতে ঘুরে তাকালো নীরা।খুশবুকে দেখে সে নিজেও চমকে যায়।মুখোমুখি হয় দু’টো সত্তা।কডি স্তম্ভিত হয়ে বলে,
” কি হচ্ছে এসব?”
খুশবুর মাথা ঘুরে যায়।তার শরীর কাঁপে লাগামহীন।আরশাদ তাকে দ্রুত ধরে তার মাঝে যতটা না ভয়ভীতি দেখা যাচ্ছে নীরার মাঝে তা কিছুই দেখা যাচ্ছে না।নীরা এগিয়ে আসে খুশবুর গাল চেপে বলে,
” তুমি খুব সুন্দর।আমার মতো সুন্দর।”
নীরার কথার পালটা জবাব খুশবু দেয় না মূলত দিতে পারে না।মেয়েটা এখনো তার হোচট খাওয়ার জগৎ থেকে বের হতে পারেনি।আরশাদ নীরাকে বলে,
” আপনি কে?আপনার পরিচয় কী?”
” আগে আপনি বলুন,আপনি কে?”
বিস্মিত হয় আরশাদ।নীরা কারো দিকে মনোনিবেশ করলো না সে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল খুশবুর পানে।এই মেয়েটা দেখতে তার মতো কেন?নীরার পাশে দাঁড়ানো ছেলেটা তাকে ভীষণ তাড়া দিল।।নীরা আর দাঁড়ানোর সুযোগ সময় কোনটাই পেল না।খুশবু নীরাকে বলে,
” আপনি কে?আমার মতো দেখতে আপনি?আপনার আসল পরিচয় দিন দয়া করে।”
” আমার কার্ড দেওয়া আছে।পরে যোগাযোগ করা যাবে।এখন আমার হাতে সময় নেই।”
খুশবুর মাঝে ভয়ের বাসা বাঁধে।আচ্ছা আরশাদ যে মেয়েটাকে ভালোবাসতো সেই মেয়েটা এই মেয়েটা নয়তো?নীরা মেয়েটা যে কলগার্ল খুশবু এখনো বুঝতে পারলো না।তাই সে তার সন্দেহে জোরালো হলো আরশাদের প্রেমিকা নিশ্চয়ই এই মেয়েটাই ছিল।
খুশবু নীরার পথ আটকে দাঁড়ায়।আরশাদের দিকে ইশারা করে বলে,
” আপনি উনাকে চিনেন?”
নীরা আরশাদের দিকে তাকিয়ে বলে,
” না।”
” সত্যি করে বলুন আপনি উনাকে চিনেন না?”
” না।”
” উনি আপনাকে ভালোবাসতো আপনার জন্য পাগল ছিল।ভালো করে মনে করে দেখুন উনি আপনাকে ফ্লুজি বলে ডাকতো।”
নীরা বিরক্ত হলো।আরশাদের দিকে তাকিয়ে বলে,
” আমি উনাকে চিনি না।কে ভালোবাসতো আমায়?আমি কাউকে ভালোবাসিনি,চাহিদার কাছে ভালোবাসা ফিকে।শোনো আমার তাড়া আছে তোমার সাথে পরে কথা বলবো।”
নীরা চলে গেল ছেলেটার হাত ধরে।ডিলান সহ বাকিরা এবার শিওর হয়ে গেল জন মিথ্যে বলেনি।খুশবুর মতো দেখতে মেয়েটির নাম নীরা।আর নীরা মেয়েটা কলগার্ল।
.
ঘুরাঘুরির সব আনন্দে ভাটা পড়ে গেছে।খুশবু তখন থেকে কেঁদেই যাচ্ছে।নীরা নামের মেয়েটির সাথে খুশবুর কি সম্পর্ক এর সঠিক কোন ব্যাখ্যা পাচ্ছে না সে।আরশাদ কি বলবে কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না।সব মিলিয়ে কি একটা বিশ্রি পরিস্থিতির শিকার তারা।খুশবু চোখ মুছলো ব্যাগ হাতড়ে খুঁজলো তার ফোন।ফোন হাতে পেয়ে বাহারুল হককে ফোন করতে গেলে আরশাদ বাঁধা দিল।
” খবরদার ফ্লুজি কাউকে ফোন করবে না তুমি।”
” কিন্তু কেন?বাবা মা নিশ্চয়ই জানেন এই মেয়েটি কে?আমার তো কোন বোন নেই তাহলে এই মেয়েটি কে?”
” সে যেই হোক।এখন কাউকে কিচ্ছু জানানোর দরকার নেই।”
” কেন দরকার নেই হ্যাঁ?বলুন কেন দরকার নেই?”
” নীরা নামের মেয়েটির সাথে বিস্তারিত আলাপ না করে এভাবে সবাইকে চিন্তায় ডুবিয়ে মারা কি ঠিক হবে?”
” আরশাদ আপনি যেদিন আমায় ফ্লুজি বলেছিলেন,আপনি দাবি করেছিলেন আমি আপনার প্রেমিকা আমি ভেবেছিলাম আপনার বোধহয় মাথায় সমস্যা কিসব বলছেন আপনি।আমি কোন ছেলের সাথে প্রেম করিনি তাহলে হঠাৎ একটা ছেলে এসে আমাকে কেন তার প্রেমিকা দাবি করবে?এখন বুঝতে পারছি ওই মেয়েটা আপনার প্রেমিকা ছিল তাই না?”
” আমি যাকে দূর থেকে ভালোবেসেছি সেই মেয়েটার সাথে এই মেয়েটার অনেক ফারাক।এই মেয়েটার গা ভরতি টেটু,হাতে কাটা গর্ত দাগ।অথচ আমার ফ্লুজির কোন কাটা দাগ ছিল না।অন্তত চাল চলনে মিল নেই।”
খুশবু নাক টেনে শ্বাস নেয়।আরশাদের হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলে,
” আরশাদ আমাকে বিশ্বাস করেন?আমাকে একটু বিশ্বাস করুন।আগেও বলেছি এখনো বলছি আমি আপনার প্রেমিকা নই।নীরা যদি আপনার প্রেমিকা না হয়,আমি যদি আপনার প্রেমিকা না হই তাহলে আপনার প্রেমিকা কে?কার সাথে আপনি মন বদল করেছিলেন?কাকে ভালোবেসেছিলেন?”
খুশবু কেঁদে ফেললো।প্রশ্ন তো আরশাদের মনেও জেগেছে।কিন্তু অতীতের কালো অধ্যায়গুলো ভাবতে চায় না সে।এই মেয়েটাকে নিয়ে সে ভীষণ খুশি।আরশাদ তার ফ্লুজির দু’গাল আঁজলায় নেয় মেয়েটার চোখের পানি মুছে বলে,
” ‘ফ্লুজি’।মানে কি জানো?ফ্লুজি মানে সুন্দরী।তুমি আমার সুন্দরী।ভুল ভ্রান্তি এখন আর চাইলেও সংশোধন হবে না আমি করতে চাই না।আমার পুরোনো প্রেমিকা যদি তুমি সত্যি না হও, তাও তুমি আমার ফ্লুজি।আমি আমার অনুভূতিহীন পাষাণ মন নিয়ে তোমার ক্ষতি করতে গেলাম অথচ ফিরে এলাম এক বুকে ভালোবাসার বাগান নিয়ে।আমাকে আর ব্যথিত করো না।আমার পাশে থাকো।তুমি জানো?,
তুমি আমার মন গোপনের সুখের ব্যথা।”
চলবে…
এবার বলুন তো আরশাদের সেই প্রেমিকা তাহলে কে?
__রাত জাগা পাখিরা সবাই সাড়া দিয়ে যাবে কিন্তু 🥺