ফ্লুজি পর্ব-১৩

0
585

#ফ্লুজি
#অনুপ্রভা_মেহেরিন
[পর্ব ১৩]

বন পালং ফুলটি ছিড়ে হাতে তুলে নিল আরশাদ।ফুলটার সৌন্দর্য অবলকন করে দু’ঠোঁটের সাহায্যে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিল উদ্দেশ্যহীন।আরশাদের ফুঁ’তে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সকল পাপড়ি উড়ে ছিন্নভিন্ন।ডেইজি ফুল গুলো তার দিকে তাকিয়ে যেন হাসছে।আরশাদ একটি ডেইজি হাতে তুলে ভাবলো ফ্লুজির কথা।তার ভিলার ব্যাক ইয়ার্ডে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে একটি আপেল গাছ।এত এত আপেল গাছে ধরেছে যে এত আপেল কে বা খাবে?অধিকাংশ আপেল গাছের পদতলে পড়ে নষ্ট হয়ে আছে।নিজ হাতে আরশাদ সবটা পরিষ্কার করলো।হালকা গরমেও সে কেমন ঘেমে একাকার।

” ফ্রাটেলো আরশাদ।”

হাতের কু ড়া ল রেখে ঘুরে তাকালো আরশাদ।তার দিকে ছুটে আসছে একমাত্র ফুফাতো বোন এলিনা।মুহূর্তে তার ঠোঁট জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে চমৎকার হাসি।এলিনা ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে আরশাদকে।ইতালিয়ান ভাষায় চলতে থাকে দুজনের বাক্যালাপ।

” কেমন আছো এলিনা?”

” অনেক অনেক ভালো।দিন দিন তুমি হ্যান্ডসাম হয়ে যাচ্ছ ভাইয়া।”

” সিরিয়াসলি?”

” ইয়াহ।”

এলিনা আরশাদকে ছেড়ে আপেল গাছটার কাছে গেল একটি আপেল ছিড়ে কামড় বসাতে বাঁধা দিল আরশাদ।

” না ধুয়ে খাওয়া ঠিক নয় এলিনা।”

” ভাইয়া তোমার গাছটা অনেক সুন্দর ভাবে বেড়েছে।”

” ফুফু এসেছে?”

” হ্যাঁ তোমার জন্য অপেক্ষা করছে চলো তুমি।”

এলিনার হাত ধরে ভিলার দিলে এগিয়ে গেল আরশাদ।

আরশাদের দাদা দাদি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেও আরশাদের ফুফু ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেননি।তিনি তার খ্রিস্টান ধর্মতে ছিলেন এবং আছেন।সেই সূত্রে এলিনা খ্রিস্টান ধর্মের মেয়ে।
আরশাদের হাত ধরে ঘরে ফিরলো এলিনা।আফরোজা তখন রান্নার কাজে ব্যস্ত।সেই ব্যস্ততাকে সঙ্গ দিয়ে কথা বলে যাচ্ছেন আরশাদের ফুফু ‘গ্লোরিয়া’র সহিত।
আরিব ফোন চালাতে চালাতে বাইরে আসছিল তখনি অনুভব করে তার নাকে এসে সুড়সুড়ি দিচ্ছে মিষ্টি ঘ্রাণ।চকিতে তাকাতে আচমকা তাকে জড়িয়ে ধরলো এলিনা।মেয়েটার নরম হাতের ছোঁয়ায় আরিবের গলা ধরে ঝুলে আছে।এলিনার প্রতি তার অন্যরকম টান এই টান সামলাতে হিমশিমে পড়তে হয় ছেলেটাকে।অথচ এলিনার মেদহীন নরম শরীরটা তাকে আষ্টেপৃষ্টে জটিল সমীকরণে ফেলছে।আরিব বিভোর হলো দুহাতের শক্ত বন্ধনীতে জড়িয়ে ধরতে চেয়েও পারলো না।আরশাদ দাঁড়িয়ে, ভাইয়ের সামনে নিশ্চয়ই এই ভুল করা যাবে না।

” আরিব ভাইয়া কেমন আছো?”

” আ’ম গুড সুইটি।কোথায় ছিলে এতক্ষণ?”

” আরশাদ ভাইয়ার সাথে ব্যাক ইয়ার্ডে।”

” ওর ভুতুড়ে ভিলায় গেলে নাকি?যেও না কিন্তু।”

” ভাবি এলে সেই ভুতুড়ে ভিলায় পরির দেখা মিলবে।আমরা সেই পরির অপেক্ষায়।”

এলিনার কথায় দুই ভাই কিঞ্চিৎ হাসলো।তাদের হইহুল্লোড়ে এগিয়ে এলো আরশাদের ফুফু গ্লোরিয়া।আরিব এবং আরশাদকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খেলেন তিনি।

” বউকে ছাড়া দেশে এলে কেন?”

“আমার আরেক বউ যে হসপিটালে।”

” সেটা বুড়ো হয়ে গেছে,তাকে বাদ দিয়ে দাও।”

” মায়া ফুফু মায়া।মায়া বড় ভয়ানক জিনিস।”

” বিদেশি বউ কি দেশি বউকে মানবে?দুই সতীন কিন্তু হেব্বি জমবে।”

ঘর জুড়ে হাসির রোল পড়লো।বহুদিন পর হাসলো সকলে।গ্র‍্যানির সুস্থতার খুশিতে সবার মাঝে বিরাজ করছে স্বস্তি আনন্দ উল্লাস।
.
আরশাদ ঘুম থেকে উঠার পর থেকে অনেকবার বার ফ্লুজিকে কল, ম্যাজেস করেছে কিন্তু মেয়েটা অনলাইনে আসেনি।আরশাদ ভেবেছে ও হয় ঘুমে তাই আর বিরক্ত করেনি।ইতালির ঘড়িতে সময় এখন সময় দুপুর একটা তাহলে বাংলাদেশ সময় বিকেল পাঁচটা আরশাদ ফ্লুজিকে না পেয়ে অনিমাকে ফোন করলো।একের পর এক বারোটি মিসকল্ড দেওয়া শেষ তাও অনিমা ফোন তুলেনি।সাহস নিয়ে বাহারুল হক’কে ফোন করলো আরশাদ।বাহারুল হক কিছুক্ষণ পরে ফোন তুললেন,

” আসসালামু আলাইকুম বাবা, আরশাদ বলছিলাম।”

” কে তোমার বাবা?”

” কেন আপনি।শ্বশুর বাবা।কেমন আছেন বাবা?”

” খবরদার বাবা ডাকবে না।”

” রেগে আছেন মনে হচ্ছে।মা ভালো আছে?আর খুশবু কেমন আছে।”

বাহারুল হক তাচ্ছিল্য হাসলেন।এই তো সুযোগ আরশাদকে বকে দেওয়ার।তিনিও আজ সুযোগ ছাড়লেন না মন মতো রাগ জেদ সবটা উজাড় করে দিতে প্রস্তুত হলেন।

” আমার মেয়েকে কী পেয়েছো তুমি?মানলাম তোমার বিপদে তুমি চলে গেছ।আমার মেয়েটা কতটা নাজুক সেকথা আমি জানি।সকাল থেকে তার জ্বরে গা পুড়ছে।তুমি একবারো খোঁজ নিয়েছো?জ্বর কমার কোন অবস্থা নেই।ডাক্তারের কাছে এনেছি খোঁজ নেওয়ার হলে নেবে না হলে ছেড়ে দাও আমার মেয়েকে।”

আরশাদ হতবাক,হতভম্ব।এমনটা যে হবে সে তো ভাবেনি।

” খুশবুকে দিন আমি কথা বলতে চাই তার সাথে।”

” কোন দরকার নেই।বাসায় গিয়ে কথা বলবে এখন রাখছি।”

আরশাদের হাঁসফাঁস বাড়লো।এক ছুটে চলে যেতে ইচ্ছে হলো বাংলাদেশে।দু’হাতের সাহায্যে মাথার চুল খামছে টেবিলে সাজানো কাচের ফুলদানিটা মেঝেতে ছুড়ে ফেললো।আরশাদের ভিলায় আরিব নিচ তলায় এসে সবে দাঁড়িয়েছিল।কাচ ভাঙার শব্দে চমকে গেল সে।দেরি না করে দ্রুত দোতলায় উঠে আরশাদের হাঁসফাঁস অবস্থা দেখে ভীষণ ভয় পেল ছেলেটা।

” ব্রো কি হয়েছে?”

” সর সামনে থেকে সর।”

” প্লিজ এমন করছো কেন কি হয়েছে?”

” ব্লাডি বিচ সর।”

কফি মগটা আরশাদ ছুড়ে ফেললো আরিবের পায়ের কাছে।ভাগ্যিস ছেলেটা ছিড়কে দূরে সরেছিল।আরিব ভীষণ অবাক হলো ভাইয়ের এমন আচরণে।ফ্লুজি চলে যাওয়া নিয়ে আরশাদের জঘন্যতম আচরণের সাক্ষি হয়েছিল আরিব।তবে কি আবার শুরু হতে চলেছে?কিন্তু কেন?ফ্লুজি তো এখন তার স্ত্রী।দুরত্ব চাইলেও সহজে মুক্তি নেই।থরথর করে কাঁপতে থাকে আরশাদ আরিব দ্রুত আরশাদকে জড়িয়ে ধরে।

” ব্রো কি হয়েছে আমায় বলো।”

” আমি কি করেছি?আমার কি দোষ?”

” আরে কি হয়েছে বলবে তো।”

” ফ্লুজি অসুস্থ আরিব।আঙ্কেল…আঙ্কেল আমার সাথে ধমক সুরে কথা বলেছেন।উনার প্রতিটা কথায় এটাই বুঝায় ফ্লুজির অসুস্থার জন্য আমি দায়ী।”

” তাই বলে তুমি এমন করবে?ডাক্তার তোমাকে কি বলেছে ভুলে গেছো?সহজে হাইপার হওয়া যাবে না।প্লিজ ক্লাম ডাউন।”

” আমি ফ্লুজির সাথে কথা বলবো।এক্ষুনি মানে এক্ষুনি।ব্যবস্থা কর আরিব যেভাবে পারিস ব্যবস্থা কর।”

” আমি দেখছি তুমি শান্ত হও।”
.
ডাক্তার দেখানো শেষে বাসায় ফিরলো খুশবু।জ্বরের দাপটে দু’চোখে যে ঝাপসা দেখছে সে।কাঁপা কাঁপা হাতে ফোন চেক করে আরশাদের ম্যাসেজ দেখে এক চিলতে হাসি ফুটে ঠোঁটের কোনে।অনিমা বুঝতে পারেন মেয়ে কি চায় তাই তো তিনি খুশবুকে রেখে চলে যান অন্য রুমে।সেই সুযোগে আরশাদকে ভিডিও কল করে খুশবু।

” ফ্লুজি ঠিক আছো?”

আরশাদের এলোমেলো বিধস্ত অবস্থা দেখে কিঞ্চিৎ অবাক হয় সে।

” আপনাকে এমন লাগছে কেন?”

” তুমি খাওনি ঘুমাওনি অনিয়মে জ্বর বেঁধেছে তাই না?”

” না।”

” জিহ্বা টেনে ছি ড়ে ফেলবো।আমার সাথে কোন মিথ্যা কথা নয় বলো কি করেছিলে গতকাল।”

আরশাদের কথায় নমনীয়তা নেই আছে অধিকারবোধ জেদ।খুশবু ভয় পেল ঢোক গিলে চুপচাপ তাকিয়ে রইল আরশাদের পানে।

” রনিকে পাঠাব?পরিস্থিতি কিন্তু পালটে যাবে ফ্লুজি।”

রনি!সেই ছেলের নাম যে ছেলের মাধ্যমে আরশাদ খুশবুকে খুঁজে পেয়েছে।যে ছেলে আরশাদের ফোনে ম্যাসেজ দিয়েছিল বলে খুশবু সেদিন জেনেছিল তার বাবার অসুস্থতার কথা।আরশাদ নিজেই বলেছে রনি মোটেও ভালো ছেলে নয়।

” রনির হুমকি কেন দিচ্ছেন আরশাদ?”

” তা তো রনি গেলেই বুঝতে পারবে।পাঠাবো?নাকি তুমি বলবে।”

” আব্বু গতকাল থেকে এত এত কথা শুনিয়েছে যে আমার ধৈর্য কুলায়নি।সন্ধ্যা থেকে ওয়াশরুমে ভিজেছি,খাইনি ঘুমাইনি সব মিলিয়ে…”

” সাহস দেখে অবাক হই।সামনে থাকলে আবার গোসল করাতাম বে য়া দ ব মেয়ে।”

” গ্র‍্যানি কেমন আছে?”

” ভালো।সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আগামী সাপ্তাহে আবার ফিরবো।কিন্তু আমি ফিরছি না।আমি কি বলেছিলাম নিজের যত্ন নেবে।তুমি নাওনি নিজের যত্ন।তুমি আমার দেওয়া কথা রাখনি তাহলে আমি কেন কথা রাখবো?”

খুশবু আচমকা রেগে গেল।পালটা রাগ নিয়ে সে বলে,

“আসতে হবে না আপনাকে।আমি বলেছি আপনি আসুন?আপনি ছাড়াও আমার চলবে।শুধু চলবে না দৌড়াবে অন্তত এবার ফ্রিডম লাইফে ফিরছি।”

” সাহস তো তোমার কম না।”

খুশবু ফোন কেটে দিল।হাতের ফোনটি ছুড়ে ফেললে দূরে।এসব মানসিক যন্ত্রণা আর নেওয়া যাচ্ছে না।জীবনে শান্তি চাই শুধুই শান্তি।

অপরদিকে আরিব ভাই ভাবির ঝগড়া সবটাই পরখ করলো।তবে ছেলেটা কোন প্রতিক্রিয়া দেখালো না।ল্যাপটপ কোলে নিয়ে অনলাইনে প্লেনের টিকেট দেখছিল সে।আরশাদের কথা মতো আগামী সাপ্তাহে বাংলাদেশে যাওয়ার কথা।হঠাৎ আরশাদের মত পালটে গেল আরিবের উদ্দেশ্যে বলে,

” আরিব টিকেট দেখতে হবে না ক্যান্সেল কর।যাব না বাংলাদেশে।
চলবে…..

#ফ্লুজি
#অনুপ্রভা_মেহেরিন
[পর্ব ১৩ বাকি অংশ]

” আরশাদ ভাইয়া ফিশ ফ্রাই নেবে না?”

” না। ”

” একটু মাংস নাও।”

” লাগবে না।”

” তুমি তো কিছুই নিলে না।শুধু ডাল দিয়ে কেউ খায় নাকি।মামীর বাড়িতে এলে তবেই তো ভিন্ন ভিন্ন খাবার হয় ভেবেছিলাম সবাই আড্ডা দিতে দিতে জমিয়ে ডিনার করবো।তোমার কী হয়েছে বলতো?”

আরশাদ পূর্ণ দৃষ্টি রাখলো এলিনার চোখে।ছেলেটার ভাব ভঙ্গিমা যে বুঝিয়ে দিচ্ছে সে কতটা রেগে।আক্রমণাত্মক হওয়ার আগে আরিব আড়ালে আরশাদের পায়ে ধাক্কা দিল।চোখ ইশারায় বুঝিয়ে দিল এলিনার সাথে কোন রাগ দেখানো যাবে না।আরশাদ দমে গেল গ্লাস ভরতি পানি খেয়ে নিজের রাগটা সংবরন করলো।পরিস্থিতি পাল্টাতে আরিব এলিনাকে বলে,

” আমাকে ফিশ ফ্রাইটা দাও এলিনা।”

খাবার টেবিলে আবারো হইচই আড্ডা।আফরোজা ইমরান বুঝতে পারলেন ছেলের কিছুতো হয়েছে।ফ্লুজির সাথে আবার কোন ঝামেলা হয়নি তো?আর যদি কোন ঝামেলা হয়ও এসব মানতে পারবেন না তারা।সুস্থ সবল ছেলেটাকে কেমন উন্মাদ বানিয়ে ছেড়েছে।আফরোজার মনে জেদ ঢুকল এই মেয়েকে একবার হাতের কাছে পেলে ইচ্ছা মতো শাসিয়ে ছাড়বে।
.
খাবার আর খাওয়া হলো না আরশাদের।নিজের ভিলায় ফিরে নিচতলায় কিছুটা গোছগাছ করে দোতলায় গেল।দোতলার একটি কক্ষে বিশাল তিনটে বুকশেল্ফ।সেই কক্ষটা লাইব্রেরী হিসেবে সাজিয়েছে আরশাদ।মন মেজাজ ঠিক রাখতে বই খুলে বসলো সে।কিন্তু অস্থির মন এসব কি মানে?মূলত মানতে চায় না।আচমকা তার ফোন বেজে উঠলো ইতালিয়ান বন্ধু ডিলান ফোন করেছে।
আরশাদ আর ডিলানের অনেকক্ষণ কথা চললো এর মাঝে ডিলান বলে,

” তুমি জানো অ্যাডেন লিভ ইনে আছে ”

” কি!কবে কখন হলো এসব।”

” তুমি যাওয়ার পর থেকেই।আমাদের মাঝে তুমি ফাস্ট যে আগে নিজেকে ভার্জিনিটি হারিয়েছে।”

চট করে আরশাদের মুখভঙ্গি পালটে গেল।সে যেন একটা মজার কথা শুনেছে।আরশার হলো বিবাহিত ব্যাচেলর এসব কথা যদি ডিলান জানে ছেলেটা নিশ্চয়ই হাসবে।তার বিবাহিত স্ত্রীকে কাছে পাওয়ার স্বীকৃতি সে আদৌ পায়নি অথচ তার বন্ধু গালফ্রেন্ডের সহিত….পালটা মেজাজ খিঁচে গেল আরশাদের ভেতটায় জমলো রাগ জেদ।ফ্লুজির জন্য মনটা কেমন কেমন করছে।ডিলান তাড়া দিয়ে বলল,

” আরশাদ নাইট ক্লাবে চল অনেকদিন হই হুল্লোড় করা হয় না।”

” শরীর ভালো লাগছে না ডিলান এখন ফোন রাখছি পরে কথা হবে।”

আরশার অস্থির হলো কোলের বইটা রেখে নিজের কক্ষে ফিরলো।ইতালি সময় অনুযায়ী রাত এখন বারোটা।বাংলাদেশে নিশ্চিয়ই চারটা বাজে।আরশাদ অনলাইনে ঢুকতে দেখতে পেল ফ্লুজি এক্টিভ।চট করে তার মেজাজটা আবার পালটে গেল।এই অসুস্থ মেয়েটা কেন জেগে আছে?দেরি না করে ফ্লুজিকে ফোন করলো সে,ভেবেছিল রাগের মাথায় মেয়েটা ফোন রিসিভ করবে না কিন্তু আরশাদকে অবাক করে দিয়ে ফ্লুজি ফোনটা ধরলো।আরশাদ নিজের অনুভূতি লুকিয়ে রাগান্বিত স্বরে বলল,

” এত রাত অনলাইনে কেন?”

” এই কেন’র কোন উত্তর নেই।”

” কি করছো?”

” ক্যান্টিনে বসে গরম গরম সিঙারা খাচ্ছি।”

“মজা নাও আমার সাথে?এই রাতে… ”

” তো?আপনি অদ্ভুত প্রশ্ন করলে আমিও অদ্ভুত জবাব দিব।এই রাতে বিছানায় থাকা ছাড়া আর কোথায় থাকব?”

আরশাদ দমে গেল।

” জ্বর কমেছে?”

” হুম।”

” রাগ দেখাও আমাকে?এই রাগের ফল কিন্তু ভালো হবে না জান।”

” এমনিতেও কোন কিছু ভালো হচ্ছে না।ফোন করেছেন কেন?”

” আমার বউ আমি খোঁজ নিব না?”

” কে আপনার বউ?”

” বাংলাদেশের এক কোণে বসে থাকা এক ঝগড়াটে মহিলা যে পারে আমার দূত্বে ঝগড়া করতে।কাছে গেলে দম ফুসস।”

আরশাদের সহিত খুশবু ন্যাকা রাগ দেখালো দ্রুত সে ফোন কেটে অফ লাইনে চলে গেল।
.

ছয়দিন পর হসপিটাল থেকে গ্র‍্যানিকে বাসায় আনা হলো।গ্র‍্যানির ফিরে আসা নিয়ে ঘরে চললো ক্যান্ডেল লাইট ডিনানের আয়োজন।ডাইনিং স্পেচ টাকে সুন্দর করে সাজালো এলিনা।মেয়েটা ভেনিস থেকে প্রতিবার আসার সময় প্রস্তুত হয়ে থাকে যতটা পারা যায় আনন্দ করে যাবে।আরিব আড় চোখে বার বার নজর ঘুরালো এলিনার দিকে।বাদামি চুলের গোছায় খোঁপা করে কেমন তাড়া দিয়ে কাজ করছে মেয়েটা।একটা শাড়ি পড়ে কোমড়ে আঁচল গুজলে এই মেয়েকে নির্ঘাত বউ বউ লাগবে।সবার আড়ালে চুপিসারে বাইরে গেল আরিব।হাতে করে নিয়ে এলো কয়েকটা ডেইজি ফুল।

আরিব সবার আড়ালে এলিনার খোপায় গুঁজে দিল একটি ডেইজি ফুল।এলিনা অবাক হয়ে হাসলো।আরিব সেই হাসিতে মুগ্ধ হয়ে বলে,

” এলিনা মাই প্রিন্সেস।”

” আমি প্রিন্সেস!”

” তুমি কবে বড় হবে বলতো?”

এলিনা বুঝলো না আরিবের বাংলা কথা মেয়েটা শুধু আগ্রহ নিয়ে হা হয়ে তাকিয়ে রইল।

” ভাইয়া কি বলছো আমি তো বাংলা কথা বুঝিনা।”

” বুঝতে হবে না।”

আরিব মাছি তাড়ানো ভঙিমায় চলে গেল।আরশাদ এসে বসলো গ্র‍্যানির পাশে।গ্র‍্যানি আদেশ সুরে বলেন,

” ফ্লুজিকে ফোন করো আমি তার সাথে কথা বলতে চাই।”

” বাংলাদেশে এখন গভীর রাত গ্র‍্যানি।ফোন করলে মেয়েটার ঘুম ভেঙে যাবে তো।”

” তুমি যাবে কবে?আরিবকে রেস্টুরেন্টের দায়িত্ব দিয়ে তুমি চলে যাও।”

” ওর পড়াশোনা আছে শুধু শুধু ওঁকে ঝামেলায় ফেলবো কেন?”

” হঠাৎ এত বুঝদার হলে যে?ফ্লুজির সাথে দেখা করার ইচ্ছে নেই নাকি?”

” সেই ইচ্ছা আমার কোন দিন ফুরাবে না।’

গ্লোরিয়া তখন গরম গরম মাংসের বাটি নিয়ে এলো।গরম বাটি টেবিলে রাখতে তাতে আঙুল পুরে দিল এলিনা।মাংস খাওয়ার তাড়ায় বেচারির চিরল দু’আঙুলে আচমকা ছ্যাকা লেগ গেল।এলিনা এসবে অভ্যস্ত নয় অল্পতে চেচিয়ে উঠলো সে আরিব পাশেই ছিল।এলিনার দুই আঙুল তৎক্ষনাৎ নিজের মুখে পুরলো।গ্লোরিয়া দৌড়ে গেলেন পানি আনতে।আরিব অধৈর্য হয়ে বলে,

” এলিনা জ্বালা কমেছে?”

” জ্বলছে তো।”

গ্লোরিয়া আসতে পানির বাটিটায় হাত চুবালো এলিনা।গ্লোরিয়া,গ্র‍্যানি আরিবের কর্মকান্ড স্বাভাবিক ভাবে নিলেও আরশাদ কিন্তু ঠিকি সরু চোখে তাকিয়ে আছে ভাইয়ের দিকে।আরিবের অস্থিরতা সে জহুরি চোখে পর্যবেক্ষণ করলো।এলিনা সরে যেতে, আরিবের সহিত চোখাচোখি হয় আরশাদের।ব্যস আরিবের সব দম যেন ফুরিয়ে গেল।ইতস্তত বোধ কাটাতে ক্যাবলাকান্ত রূপে হাসলো আরিব।আরশাদ উঠে এলো আরিবের কাধে হাত দিয়ে চাপা স্বরে বলে,

” আমি পুরুষ,আমি প্রেমিক তাই তোর অস্থির দু’চোখের ভাষা আমি সহজে বুঝতে পারি।”

” না তুমি কিছুই বুঝ না ব্রো।”

” পড়াশোনায় লেগে আছো পড়াশোনায় থাকো একবার এসবে ফেসে গেলে শরীর মন দু’টোকে সামলাতে হিমশিমে পড়বে।”

আরিব প্রত্যুত্তর করলো না।এলিনার ভীতি মুখখানি দেখে শুধু দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।

.
আরশাদের রেস্টুরেন্টে আজ বাঙালিদের ঢল নেমেছে।যেহেতু আজ শুক্রবার অফডে সেই হিসেবে ইতালিতে থাকা প্রত্যেক প্রবাসী তাদের দিনটিকে আনন্দ উপভোগে কাটানোর জন্য রেস্টুরেন্টে এসেছে।কেউ এসেছে পরিবার নিয়ে কেউ বা এসেছে বন্ধুদের সঙ্গে।আরশাদ সবার কার্যক্রম পরখ করছিল, হাসি মুখে সবটা দেখে বেরিয়ে গেল রেস্টুরেন্ট থেকে।এই রেস্টুরেন্ট থেকে যে তার ভালো পরিমানে আয় আসবে সে স্বপ্নেও ভাবেনি।মূলত শখের দরুনে রেস্টুরেন্ট শুরু করেছিল সে।
আরশাদ সরু রাস্তায় গান গাইতে গাইতে হাটছিল তার সাথে সঙ্গ দিয়ে নাম না জানা এক পাখি ক্রমশ ডেকে চলছে।রাস্তার ধারে বিক্রি করা লিলি দেখে থেমে গেল সে।দোকানির কাছে গিয়ে জানতে চাইলো দাম কত।আরশাদ দামাদামি করে মুঠ ভরতি লিলি কিনলো।ইতালির জাতীয় ফুল লিলি।সাদা লিলি ইতালির একটি জাতীয় প্রতিক।সাধারণত ধর্মীয় প্রসঙ্গে ভার্জিন মেরি এবং পবিত্র পরিবারের সাথে যুক্ত।

নিজ ভিলায় ফিরে লিলিফুল গুলো একটি টবে রেখে সটান হয়ে শুয়ে পড়লো আরশাদ।মন শরীর দুটোই ক্লান্ত। ফ্লুজি তাকে ইদানীং একটু বেশি এড়িয়ে চলছে ঠিক আগের বারের মতো।
আগের বার যেমন একেরপর এক এড়িয়ে যাওয়া আরশাদকে বিক্ষিপ্ত,রাগান্বিত করেছিল ঠিক তেমনটাই হচ্ছে।কিন্তু আরশাদ হাল ছাড়ার পাত্র নয় এখন আর পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ তো নেই।এই মেয়েটা বিবাহিত যতই এড়িয়ে যাক আর আড়াল হোক তার শেষ গন্তব্য আরশাদের বুকে।মুখ লুকালে আরশাদের বুকেই লুকাবে।

ফোন হাতে তুলে খুশবুর ছবি দেখছিল আরশাদ।ছেলেটা নিজের দাম্ভিকতা বজায় রেখে বলে,

” যেদিন তুমি বলবে আমি সেদিন ফিরবো তোমার কাছে।আমাকে এড়িয়ে যাওয়ার প্রত্যেকটা জবাব আমি নিয়েই ছাড়বো।”

আচমকা বাতাসে উড়ে গেল জানলার সব পর্দা।সফেদ পর্দা গুলোর এলোমেলো উড়াউড়ি দেখে আরশাদ উঠে দাঁড়ালো দ্রুত হাতে জানলা বন্ধ করে বসলো কাউচে।এখন টিভি দেখলে মন্দ হয় না কিন্তু মনের সায় না পেয়ে রিমোট রেখে ফোন হাতে নিয়ে বসলো সে।

আরশাদ প্রতিদিনের ন্যায় ডু মারলো খুশবুর বন্ধু মায়া এবং রিয়ার আইডিতে।এই দুইজনের আইডি পাবলিক বলে আরশাদ খুব সহজে আপডেট পেয়ে যায়।খুশবুর বন্ধু বলেই এরাই আছে তাই খুশবুর সাথে সাথে এদের উপরেও গভীর পর্যবেক্ষণ চলে আরশাদের।কিন্তু আরশাদের সাথে আজ ঘটলো ভিন্ন পরিস্থিতি।মায়ার আইডিতে তার জন্মদিন উপলক্ষ্যে পোস্ট করা কিছু ছবিতে চোখ আটকে গেল তার।

খুশবু আজ শাড়ি পরেছে।বেগুনি পাড়ের সাদা শাড়িতে মেয়েটাকে শুভ্র শীতল লাগছে।আরশাদের নজর আটকে গেল একদিকে।এমন সাজে ঢঙে রূপে ফ্লুজি কখনো ধরা দেয়নি তার কাছে।এত সুন্দর লাগছে কেন মেয়েটাকে?নাকি আরশাদের চোখে সে সুন্দর।

শেষ ছবিটায় তারা তিন বান্ধবী মিলে দাঁড়িয়ে আছে।খুশবুর হাত মায়ার কাঁধে তোলা মেয়েটা খিলখিলিয়ে হাসছে।হাত উপরে তোলার দরুনে শাড়ি সরে সাদৃশ্য হয়েছে মেদহীন পেটের কিছুটা অংশ।ছেলেটা অস্থির হলো দ্রুত হাতে শার্টের উপরের দুটো বোতাল খুলে গা ছাড়া দিয়ে বসলো।আরশাদ উষ্কখুষ্ক চুলগুলো চুলকে বলে,

” আমার একটাই মাথা তাও আবার নষ্ট করে দিল এই মেয়েটা।উফফ আরশাদ কন্ট্রোল কন্ট্রোল।”

আরশাদ ফোন করলো তার ফ্লুজিকে।কয়েকবার ফোন কাটার পর ফোন ধরলো সে।অবশ্য ফোন ধরে ঝাঁঝালো গলায় বলে,

” কী সমস্যা আপনার?দেখছেন তো ফোন কাটলাম।কি চাই?”

” তোমাকে জান।”

” সুর দেখি উলটো দিকে ঘুরছে বুঝলাম না।”

” আগে বলো শাড়ি যে পরলে আমাকে ভিডিও কল দিলে না কেন?”

“আপনি কি করে জানলেন আমি শাড়ি পরেছি আজ।”

” কখন কি করছো সবটা খরব রাখি।শাড়ি পরেছো ভালো কথা কিন্তু সামলে রাখনি কেন?যেটা আমার দেখার কথা সেটা সবাইকে দেখানো কি খুব জরুরি ছিল?”

” মানে?”

” শাড়ির আড়ালে যে আমার সুখ শান্তি উকি দিচ্ছিলো এটা আমার দেখার কথা কিন্তু অসংখ্য লোক দেখে ফেলেছে।আমি এসব মানতে পারবো না।তোমার ফ্রেন্ডকে বলে দিও এই ছবি যদি রিমুভ না করেছে তবে তার আইডির সাথে সাথে তাকেও গায়েব করে দেব।প্রমিস।”

খুশবু ঢোক গিললো।আরশাদের সাথে যতই রাগ জেদ দেখায় না কেন এই ছেলেটার হুমকিতে সে মারাত্মক ভয় পায়।খুশবু স্বল্প সরে বলে,

” আরশাদ।”

” বলো জান।”

” সব কাগজ পত্র তৈরি।ভিসার ঝামেলা শেষ।”

আরশাদ চমকে গেল।চমকের মাঝেই হাসলো চমৎকার।

“তুমি বললেই আমি দেশে আসবো।কি আসবো?”

খুশবু রেগে গেল।রাগের দরুনে কান্না পাচ্ছে তার।মেয়েটা ধরা গলায় বলে,

” কেন আসবেন আপনি?আপনি নিজে বলেছেন আপনি আসবেন না তাহলে আপনার আসা যাওয়ায় মতামত আমি কেন দেব?”

” ফ্লুজি আমাকে তুমি আবার রাগ দেখাচ্ছো?”

” কি করবেন আপনি?কিছুই করতে পারবেন না।দূরে বসে বসে শুধু নাটক করুন।আমি আপনার ধারাবাহিক নাটকের দর্শক।”

” ওকে যা খুশি তাই করো।”

” ঠিক আছে খুশি মতোই সবটা করবো।”

খুশবু চট করে ফোন কাটলো।রেগে মেগে আগুন হয়ে গেল আরশাদ।হঠাৎ ফ্লুজি তাকে একটি ছবি পাঠালো মেয়েটা শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে।আরশাদের আগুনে যেন জল পড়লো।রাগ দেখাতে গিয়েও অনুভূতি কাছে ব্যর্থ সে।
আরশাদ দাঁতের সাহায্যে ঠোঁট চেপে ধরলো।আফসোস সুরে বলে,

” কাকে বকবো আমি?কাকে রাগ দেখাবো?এই মেয়েকে বকলে যে নিজেকে নিজে খু ন করতে মন চায়।”

চলেবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে