ফ্লুজি পর্ব-১২

0
577

#ফ্লুজি
#অনুপ্রভা_মেহেরিন
[পর্ব ১২]

” আজ রোহানকে দেখলাম হসপিটালে ভর্তি।অনিমা তুমি যদি ছেলেটার মুখ দেখতে আঁতকে উঠতে।”

” তুমি কেন গেলে সেখানে?”

” আমার কাজ ছিল বিধায় আমি গিয়েছি।হঠাৎ দেখা হলো রোহানের দুলাভাইয়ের সাথে সে বললো সবটা।আমিও গিয়ে এক নজর দেখে এলাম।ঠোঁট ফুলে কলাগাছ জিহ্বা নাড়ানোর শক্তিও নেই।”

” পোকা কামড়েছে নাকি?”

” না না তাকে নাকি কে বিছুটি পাতা খাইয়ে দিয়েছে।চুলকাতে চুলকাতে ছেলেটার অবস্থা ভীষণ খারাপ।”

ভাতের লোকমা তুলে কেশে উঠলো খুশবু।রাত বাজে বারোটা তার মনটা উড়ো উড়ো করছে কখন আরশাদের সাথে কথা বলবে আর রোহানের ব্যপারে আপডেট পাবে।তার আগেই বাহারুল হক খবর নিয়ে হাজির।খুশবুর হাসি হাসি মুখটা দেখে জহুরি চোখে তাকালেন তার বাবা,

” আরশাদের সাথে রাতে কোথায় ছিলে তুমি?”

” কোথায় আর থাকবো রেস্টুরেন্টে।”

” তুমি যে রাতভর তার সাথে এমন ঘুরোঘুরি করছো এসব কিন্তু আমার একদম পছন্দ হচ্ছে না।আমি মেয়ে তুলে দেইনি তাই নিজের মর্জি মতো চলা বন্ধ করো।”

খুশবু মাথা ঝাকালো।বাহারুল হকের চিন্তা ভাবনায় অনিমা সায় দিলেও তবুও বিপক্ষে একটা উত্তর যেন তার তৈরি থাকে।তিনি ফোড়ন কেটে বলেন,

” এসব কি বলছো তুমি?মেয়ে তার স্বামীর সাথে ঘুরছে আমরা বাঁধা দেওয়ার কে?”

” এইজন্যই তো চুপচাপ থাকি।তবুও এটাই আমার ফাইনাল অর্ডার সাতটার মধ্যে তোমাকে বাড়তে ঢুকতেই হবে।মেয়ে বিয়ে দিয়েছে বিদায় তো আর করিনি।যেদিন মেয়ে বিদায় হবে সেদিন সারারাত বাইরে থাকবে আপত্তি থাকবে না।”

” আচ্ছা বাবা তুমি যা বলবে তাই হবে।”

খাবার টেবিলে পুনরায় নিরবতা ছেঁয়ে গেল।খুশবুর ছোট মামারা চলে গেল আজ দুপুরে তাই সারা ঘরটা কেমন নিরব শান্ত।অনিমা ভাতের লোকমা মুখে পুরে বলেন,

” নুহাটা চলে গেল ঘরটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে ঘরে বাচ্চা-কাচ্চা থাকলে ঘরটা আমেজে থাকে।কবে যে নিজের নাতি নাতনির মুখ দেখবো।”

অনিমার কথায় ফোড়ন কাটলেন বাহারুল হক

” নাতি নাতনির মুখ দেখা তো দূরের কথা এমন জায়গায় মেয়ে দিয়েছো সচক্ষে নিজের মেয়েকে দেখতে পাবে কি না সন্দেহ।”

“আমার মেয়ে ভালো থাকলে তাকে না দেখার আফসোস আমার জাগবে না।”

খুশবুর গলায় খাবারটা বিধে গেল।বাবা মায়ের এমন ধীর স্থির রেষারেষি আর কতকাল চলবে?
.
সাধা সিধে জীবনটায় কীভাবে উড়ে এসে জুড়ে বসে জীবন পালটাতে হয় তা যেন আরশাদ থেকে শিখতে হয়।খুশবুর জীবনটা ছিল সাধাসিধা অন্যরকম।অথচ আরশাদ এসে পালটে দিল সবকিছু।তাদের ভালোবাসার বন্ধনে কেটে গেছে তিনমাস।খুচরো হিসেবে বললে এই তো চারমাসের কাছাকাছি।খুশবুর ইতালিতে যাওতার পাসপোর্ট সহ সকল কাগজ পত্র তৈরি হলেও ভিসায় গন্ডোগোল দেখা দিয়েছে।এখন শুধু ভিসার কাগজ পত্রের অপেক্ষা,একবার ভিসাটা ঠিক ঠাক হোক আরশাদ আর এক মুহূর্ত দেরি করবে না।সেদিনি উড়াল দেবে তার ফ্লুজিকে নিয়ে।

খুশবুর পরিক্ষা চলছে,এই পরিক্ষা নিয়ে আরশাদের সাথে খুশবুর খুব কম সময় কাটানো হচ্ছে।পরিক্ষার পূর্ব সময়টাতে পড়াশোনার প্রতি ভীষণ সিরিয়াস হয়ে যায় মেয়েটা অথচ সারা বছর বইয়ের সাথে তার বিচ্ছেদের প্রহর কাটে।

আরশাদ গাড়ি নিয়ে গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।আরিব তার পাশে দাঁড়িয়ে এটা ওটা বিশ্লেষণ করছে।খুশবু তাড়াহুড়ো করে আরশাদের সামনে এসে দাড়ালো।বাসা থেকে ভার্সিটির দূরত্ব বেশি নয় কিন্তু খুশবু আজ একটু আগে বেরিয়েছে।অবশ্য এর পেছেনেও একটা কারণ আছে।আরশাদের সাথে কিছুটা সময় কাটানোর বাহানা।আজ পরিক্ষা শেষ এরপর আবার আগের বেশভুষায় ফিরে যাবে খুশবু।

খুশবুর দিকে আগাগোড়া তাকিয়ে কিঞ্চিৎ অবাক হলো আরশাদ।ইদানীং তার মনে বাসা বাঁধছে কিছু প্রশ্নেরা।অনলাইনে যখন ফ্লুজির সাথে প্রেম চলছিল তখন সে দেখেছে ফ্লুজি সবচেয়ে বেশি খোলামেলা পোশাক পড়ে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।এক কথায় মেয়েটা ওয়েস্টার্ন লাভার।আর খুশবুকে শুরুর দিন থেকে দেখছে গাউন বা থ্রিপিস যেটাই পরবে ওড়নাটা এক পাশ ঝুলিয়ে চুল খোলা রাখবে।
আরশাদের মনে কিছু প্রশ্নেরা উকি দেয়। সেই মেয়েটির নাম তুবা ছিল।
খুশবুর সাথে এই মেয়েটার চাল-চলন আচার-আচরণের অনেক ফারাক যেমন তুবার সর্বদা এটা চাই ওটা চাই আরশাদের কাছে তার বায়নার শেষ নেই।আর খুশবু লজ্জায় কখনো আরশাদের কাছ থেকে কিচ্ছুটি নিতে চায় না।আরশাদের সান্নিধ্যে যেন মেয়েটার সকল প্রাপ্তি।

আচ্ছা সত্যি কি এই মেয়েটা তার ফ্লুজি নয়!আরশাদ আর ভাবতে পারে না।মাথাটা তার কেমন কেমন করছে।সত্য আর মিথ্যা সে বোঝে না জানে না।আরশাদের ভেতরের মনটা যেন বলে উঠে, তোমাকে হারালে আমি সব হারাবো।তোমাকে হারালে মুখ থুবড়ে পড়বো ঠিকানা হারানো পাখির মতো।”

আরশাদের চিন্তিত মুখটা দেখে খুশবু অবাক হলো আলতো হাতে ধাক্কা দিল আরশাদকে।

” এই কি হলো আপনার? ”

” ক..কিছু না।গাড়িতে বসো।”

আরিব খুশবুর দিকে মন বসালো সে ইনোসেন্ট ভাব নিয়ে বলে,

” ভাবি আমি কিন্তু কাবাবে হাড্ডি হতে আসিনি সামনেই নেমে যাব।”

” আরিব ভাইয়া তুমি আমাকে আর তোমার ভাইকে একসাথে দেখলে পালাই পালাই কর কেন?”

” আমি চাইনা তোমার প্রাইভেসি নষ্ট কর‍তে।”

” আমাদের আবার কিসের প্রাইভেসি!”

বিড়বিড় করে বললো খুশবু।আরশাদ বুঝতে পেরে কিঞ্চিৎ হাসলো।তাদের গন্তব্য বেশি দূর নয় আরিব নেমে গেল মাঝ পথে।আরশাদের চুপচাপ মুখখানি দেখে খটকা লাগলো খুশবুর।

” আপনি আজ এমন চুপসে আছেন কেন?”

” জানি না কিছু ভালো লাগছে না।”

” আমার প্র‍তি কি বিরক্ত এসে গেছে?”

আরশাদ আচমকা ব্রেক কষলো টেনে ধরলো খুশবুর হাত।

” এসব কথা কখনো বলবে না প্লিজ তোমার প্রতি আমার কেন বিরক্ত আসবে?”

” জানি না।”

দুজনের মাঝে ছড়িয়ে গেল নিরবতা।আরশাদ মনটা খচখচ করছে।এলোমেলো তার সকল ভাবনা।

” ভিসাটা নিয়ে আপনি চিন্তিত আরশাদ?”

” একদম না ভিসা আজ না হোক কাল হবে এসব ছাড়ো।”

দুজনের কথা চললো দীর্ঘক্ষণ।ভার্সিটির কাছাকাছি আসতে আরশার গাড়ি থামালো।দুহাত আগলে জড়িয়ে ধরলো তার ফ্লুজিকে।ফ্লুজিও আজ নিজ থেকে আরশাদের কপালে চুমু খেল।দুজনের গভীর আলিঙ্গন শেষে মন খারাপেরা বিদায় জানিয়েছে।

” পরিক্ষা দেখে শুনে ভালোভাবে দেবে।যাওয়ার সময় আমি আসবো নিয়ে যাব।আজ কিন্তু সন্ধ্যায় মুভি দেখবো।ডিনার শেষে ছাড়বো তোমায় এর আগে যদি বাহারুল হক আমার নামে যু দ্ধ ঘোষণা করেন তাতেও আমি আমার বউ ছাড়বো না।”

” শ্বশুরের নাম ধরে কেউ ডাকে?”

” আমি ডাকলাম।মাঝে মাঝে মনে হয় উনি আমার শ্বশুর নয় শত্রু।”

“আরশাদ।”

” লাভ ইউ জান।এবার যাও।”
.

খুশবু পরিক্ষা শেষে প্রায় এক ঘন্টা দাঁড়িয়ে রইল আরশাদের আশায়।কিন্তু আরশাদ আসেনি।ছেলেটার কোন বিপদ হয় নি তো?দুশ্চিন্তারা এসে দখল করে খুশবুর মন মস্তিষ্ক।মনের ভুলে আজ ফোনটাও নেওয়া হয়নি, একটা খবর যে নেবে সেই উপায়ও নেই।খুশবু বাড়ি ফিরে দেখতে পেল অনিমার ফ্যাকাশে মুখ।

” আম্মু কিছু কি হয়েছে?তোমায় এমন লাগছে কেন?”

” ফ্রেশ হয়ে নে।আমি ভাত বাড়ছি।”

” না আমি এখন ভাত খাব না।তুমি বলো কি হয়েছে?”

” আরশাদ চলে গেছে মা।”

” চলে গেছে মানে?কোথায় চলে গেছে?”

” ইতালি।”

ধপ করে মেঝেতে বসে পড়লো খুশবু।আরশাদ তাকে না বলে চলে গেল!কেন চলে গেল?মেয়ের অবস্থা দেখে অনিমা বিচলিত হলো খুশবুকে আগলে ধরে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন,

” তুই ভয় পাচ্ছিস?আরশাদ আসবে তো।ওর দাদিমাকে হসপিটালে ভর্তি করা হয়েছে উনার অবস্থা নাকি ভীষণ খারাপ।আরশাদ যাওয়ার আগে আমার সাথে দেখা করে গেছে।”

” আমি উনার কাছে যাব আম্মু।”

” আরশাদ আসবে তো।তোর কাগজ পত্র তৈরি হলে তোকে নিয়ে যাবে।”

খুশবু উঠে দাঁড়ালো।দ্রুত নিজের কক্ষে গিয়ে ফোন চেক করলো।হোয়াটসঅ্যাপে আরশাদের মেসেজ এসেছে।

” আমার ফ্লুজি,আমি চলে যাচ্ছি মানে ভেবো না আমি তোমাকে ছেড়ে যাচ্ছি।গ্র‍্যানি হসপিটাল ভর্তি।মম ড্যাড পূর্বে আমাকে এই কথা না জানালেও গ্র‍্যানির শারিরীক অবস্থা অবনতিতে আমাকে জানাতে বাধ্য হলো।সুযোগ মতো আমি তোমাকে সব আপডেট দেব।আমি জানি এখন তুমি আশাহত হয়ে ছিটকে পড়েছো তুমি শুধু বিশ্বাস রাখো আমার উপর।আমি ফিরে আসবো।আজ হয়তো আমাদের সবচেয়ে সুন্দর সন্ধ্যা হতো কিন্তু তা যে এভাবে বিষাদে রূপ নেবে কে ভেবেছিল?আমি তোমাকে এই ম্যাসেজ যখন লিখছি তখন আমার হাত কাঁপছে,একেকটা শব্দ তুলতে আমার ভীষণ কসরত করতে হচ্ছে।এক দিকে গ্র‍্যানির চিন্তা অন্যদিকে তোমাকে রেখে যাওয়ার আফসোস,শোক।
দৃঢ়তা দিয়ে বলছি আমি ফিরবো।যদি আমি ফিরে না আসি তবে তুমি আমাকে ফিরিয়ে এনো,যেমনটা আমি তোমায় ফিরিয়ে এনে পুনরায় তোমাকে বদ্ধ করেছে আমার পিঞ্জিরায়।নিজের যত্ন নেবে,নিজেকে ভালোবাসবে।আজ আবারো বলছি,এই ম্যাসেজটি যখন পড়ছো, মন থেকে ভেবে নিও তোমার চোখের জলে ভেজা ঠোঁট দুটো আমার দখলে।
চলবে___

#ফ্লুজি
#অনুপ্রভা_মেহেরিন
[পর্ব ১২ বাকি অংশ]

” ছেলে চলে গেছে এই ছেলে আর ফিরবে কি না কে জানে।এখন রুমের দরজা আটকে শোক পালন করে কী হবে?”

” আহ চুপ করবে তুমি।মেয়েটাকে কষ্ট দিয়ে কথা বলা এবার ছাড়ো।”

” আমি কষ্ট দিচ্ছি?ওই আরশাদকে বিয়ে করতে তুমি নিজেই তো উষ্কে দিয়েছিলে অনিমা।”

” আমি উষ্কেছি?তুমি যদি রোহানের সাথে মেয়ের বিয়ে দিতে রাজি না হতে আমি কখনোই মেয়ের বিয়ে আরশাদের সাথে দিতাম না।তুমি নিজের মতামতের জোর খাটালে আমিও খাটালাম।”

বাহারুল হক প্রত্যুত্তর করলেন না।তবে আপন মনে বকতে বকতে চলে গেলেন নিজের কক্ষে।বাবা মায়ের ঝগড়া খুশবু সবটাই শুনলো।আরশাদ এভাবে চলে যাওয়ায় তার ভেতরটা যে কতটা পুড়ছে কেউ কি বুঝতে পারছেনা?না চাইতেও মনের কোনে উকি দিচ্ছে একটাই কথা আরশাদ কি আমায় ঠকালো?নাকি আরশাদ প্রতিশোধ নিল।আমি তো আরশাদের সেই প্রেমিকা নই আমি কেন সব দায় মাথায় নেব। অঝরে কাঁদলো খুশবু।হাতে থাকা ফোনটার দিকে তাকিয়ে তার অপেক্ষা কখন আরশাদ যোগাযোগ করবে তার সাথে!
.
টানা ১৪ ঘন্টা জার্নি শেষে বাসায় ফিরলো আরশাদ।মন মেজাজ সবটাই তার বিক্ষিপ্ত।গ্র‍্যানির চিন্তায় ছেলেটার পা গ ল পা গ ল অবস্থা।আরিবের দু’চোখ ফুলে আছে, সর্বদা হাস্যজ্বল ছেলেটা যে আজ সারাটা রাস্তায় কেঁদেছে এই কথা কি কেউ মানবে!

দুই ভাই বাড়ি ফিরে দেখা পেল বাবা ইমরান ইহসানের। দুই ছেলেকে বুকে জড়িয়ে অঝোরে কাঁদলেন তিনি।তার শ্বেত মুখখানি রক্তিম বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে।কান্নার আওয়াজে এগিয়ে এলেন আরশাদের মা আফরোজা।বাঙালি মায়ের দিকে তাকিয়ে আরশাদের মনে পড়ে গেল তার ফ্লুজির কথা।মেয়েটা এখন কেমন আছে?

” মম কি করে হলো এসব?”

” তোমার গ্র‍্যানির শ্বাস কষ্ট আছে সেটা তো জানোই হঠাৎ বেড়ে গেল কি থেকে কি হলো নিজেও বুঝলাম না।হাসপাতাল নেওয়া হয়েছে অবস্থা ক্রমশ খারাপের দিকে যাচ্ছে আরশাদ।”

” তোমরা আমাকে আগে জানাওনি কেন?”

” তোমার গ্র‍্যানি অসুস্থ হয়েছেন দুইদিন হলো আমরা ভেবেছি সবটা ঠিক ঠাক হয়ে যাবে।উনার তো মাঝে মাঝেই এমন হয়।”

” গ্র‍্যানির সাথে আমি দেখা করতে চাই।”

” এখন গিয়েও লাভ নেই দেখা করা যাবে না।কাল যেও।”

আরশাদ মাথা দুলালো।ইমরান ছেলের দিকে তাকিয়ে কাধে হাত দিয়ে বলেন,

” খুশবু কেমন আছে?”

” ভালো।”

” তাকে বলে এসেছো?”

” না।ফ্লুজির এক্সাম ছিল।আমার শাশুড়ীকে বলে এসেছি।”

” যাও বিশ্রাম করো।আরিব তুমিও তোমার ঘরে যাও।”

আরশাদ এবং আরিব দুজনে লাগেজ হাতে তুললো।আরশাদ উলটো দিকে হাটা দিতে আফরোজা বলেন,

” আরশাদ আজ আরিবের সাথে থাকো।আর না হয় গেস্টরুম ফাঁকা আছে সেখানে থাক। তোমার ভিলা পরিষ্কার করা হয়নি।”

” আমি যাওয়ার পর সব কি গোছগাছ করা হয়নি?”

” তা হয়েছে।তবে আজ আর পরিষ্কার করিনি।”

” আমি পারবো সমস্যা নেই।”

আরশাদ পুনরায় লাগেজ নিয়ে হাটা শুরু করলো।
সিড়ি ঘর পেরিয়ে নিচে তাদের স্টোর হাউজ।স্টোর হাউজের মাধ্যমে আরশাদের ভিলায় যাওয়ার শটকাট মাধ্যম।ভিলার দরজা খুলে গহীন অন্ধকারের গহ্বরে হারিয়ে গেল আরশাদ।

কতদিন পর এসেছে সে নিজের নীড়ে।তার বয়স যখন সতেরো তখন এই বাড়িটা নতুন কেনা হয়।আরশাদের অনেক ইচ্ছা নিজের মতো করে একটি ভিলা সাজাবে সেখানে তার পছন্দে সব হবে।আরশাদের প্রতিটা চাওয়া পাওয়া রাখার চেষ্টা করে তার বাবা ইমরান ইহসান।যেহেতু আরশাদের চাওয়া খুব কম আর সেই কম টুকুকে অধিক গুরুত্ব দেয় তার বাবা মা।মোবাইলের ফ্লাশ অন করে সুইচ বোর্ড খুঁজে বের করলো আরশাদ।আফরোজা প্রতিটা আসবাবপত্রে আলগা কাপড় বিছিয়ে রেখেছে যেন ধুলো জমে নষ্ট না হয়।

এসব ফেলে আরশাদ চললো দোতলায় নিজের কক্ষে।যতটা পারা যায় পরিষ্কার করে শাওয়ার নিতে প্রস্তুত হলো।একটা লম্বা শাওয়ার শেষে মোবাইল হাতে জানলা খুলে বসলো সে।বর্তমানে গরম পড়লেও মৃদু বাতাসে গায়ে কাটা তুলছে তার।বিন্দু বিন্দু জলকণা এখনো দখল করে আছে আরশাদের দেহের প্রতিটা ভাজে।আরশাদ ঘড়িতে তাকালো সময় এখন রাত বারোটা তাহলে বাংলাদেশে এখন নিশ্চয়ই ভোর চারটা।ফ্লুজি নিশ্চয়ই ঘুমাচ্ছে।তিমিরে ঢাকা আকাশটায় তাকিয়ে মনটা হুহু করে কেঁদে উঠে আরশাদের।আকাশের নিরবতা যেন আজ তার দুঃখ বুঝে।

আকাশকে সাক্ষি রেখে আরশাদ বার বার বলতে চায়, আমি ফিরবো ফ্লুজি আমি ফিরবো।আমি ফিরবো তোমার কাছে,আমি তোমার সহিত থাকতে চাই যেমনটা অশ্রু মিশে থাকে দু’লোচনে।

আরশাদ ফোন তুলে ফ্লুজিকে মেসেজ করলো ভেবে রেখেছিল মেয়েটা ঘুমে নিশ্চয়ই এখন মেসেজ দেখবে না।কিন্তু আশ্চর্যের ব্যপার ম্যাসেজটি সাথে সাথে সিন হলো।আরশাদ তৎক্ষনাৎ ফোন করলো তার ফ্লুজিকে।অপর পাশ থেকে ফোন রিসিভ করে নিরব হয়ে রইল মেয়েটা।

” ফ্লুজি আমার জান।”

” আমাকে একা ফেলে কেন চলে গেলেন?”

” আমি আসবো।”

” জানি।”

” বিশ্বাস করো আমায়?”

” খুব বেশি।”

” তাহলে ভয় কিসের?”

” নিঃসঙ্গতার।”

আরশাদ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।হিম বাতাসে তার গায়ে কাটা তুললেও বসে থাকতে মন্দ লাগছে না।

” গ্র‍্যানি কেমন আছে আরশাদ?”

” আমি দেখতে যাইনি।কাল যাবো।”

” আঙ্কেল আন্টি ভালো আছেন?”

” এই সময়ে আর কতটা ভালো থাকতে পারে।”

” ভয় পাবেন না।ইনশাআল্লাহ খুব শীঘ্রই সুস্থ হয়ে যাবে।”

” গ্র‍্যানির তোমায় নিয়ে কতটা আহ্লাদ ছিল তুমি ভাবতেও পারবে না।আমি চাই না গ্র‍্যানি এই অসময়ে আমাদের ছেড়ে চলে যাক।”

” মনোবল রাখুন।”

” তুমি ঘুমাওনি কেন?গলা ভাঙা লাগছে কেন?”

” ঘুম আসেনি তাই ঘুমাইনি।”

” এই মেয়ে তুমি কাঁদছিলে?”

” ক..কই একদম না।আমি তো মুভি দেখছিলাম।”

” মিথ্যা বলছো আমায়?আগে পরে যা করেছো এবার আমি তোমায় সামনা সামনি দেখেছি চিনেছি বুঝেছি।কখন তোমার নিশ্বাসের তাল ঘন হয় কখন হালকা হয় আমি সবটাই জানি।পুরো তোমাকেই চিনে ফেলেছি।”

” কিন্তু আমি আপনাকে চিনতে পারিনি আরশাদ।”

দুজনের মাঝে ছেয়ে যায় নিরবতা।আরশাদ জানলা বন্ধ করে শুয়ে পড়ে বিছানায়।

” আমি চলে যাওয়ার পর আঙ্কেল নিশ্চয়ই তোমাদের কথা শুনিয়েছে তাই না?”

” ক…কই..”

” মিথ্যা বলবে না।আঙ্কেল আমায় একটুও পছন্দ করেন না।তিনি নিশ্চয়ই ভেবে বসে আছেন আমি তোমাদের ঠকিয়ে এখানে চলে এসেছি।”

” হুম বলেছে।”

” যাও ঘুমাও ভিসাটা হয়ে যাক তুমিও আসবে আমার সাথে।”

খুশবু ফোন রাখলো।এই সম্পর্কের কোন নিশ্চয়তা সে পেল না।আদৌ কি আরশাদের ফেরা হবে?
.
সেই রাতে আরশাদের আর ঘুম হলো না।সকাল হতে তৈরি হয়ে সে আর আরিব মিলে চলে গেল গ্র‍্যানিকে দেখতে।সবচেয়ে খুশির ব্যপার ডাক্তাররা আশার আলো দেখিয়েছেন।গ্র‍্যানি ডেঞ্জার জোন থেকে ফিরে এসেছেন সুস্থ হতে সময় লাগলেও আশা করা যায় তিনি খুব শীঘ্রই আগের মতো ফিরবেন।

আরিবকে হসপিটালে রেখে আরশাদ তার রেস্টুরেন্টে ঘুরতে এলো।সম্পূর্ণ নিজের জমানো টাকা দিয়ে আরশাদ একটি বাঙালিয়ানা রেস্টুরেন্ট দিয়েছে।ইতালির রোমে অনেক বাংলাদেশির বসবাস।মাঝে মাঝে তাদেরো ইচ্ছে হয় কব্জি ডুবিয়ে বাঙালি খাবার খেতে।ব্যস্ততায় সব পদের খাবার সেভাবে রান্না করাও হয় না।বাঙালি মায়ের বুদ্ধিতে আরশাদ এই রেস্টুরেন্টের যাত্রা শুরু করে।শুরু থেকেই সে সফলতার মুখ দেখেছে।পুরোটা রেস্টুরেন্টের সব কর্মচারী বাঙালি।কেউ ইন্ডিয়ান কেউ বাংলাদেশের।

রেস্টুরেন্টের একজন হাস্যজ্বল কর্মচারীর নাম রিমি।মেয়েটা পড়াশোনার তাগিদে রোমে থাকছে।আরশাদের সাথে তার ভীষণ সখ্যতা।রেস্টুরেন্টে আরশাদকে দেখেই খুশিতে আত্মহারা রিমি।

” শুভ সকাল স্যার।কেমন আছেন আপনি?”

” ফাইন।সবটা কেমন চলছে?”

” বেশ ভালো।ইমরান স্যার মাঝে মাঝে এসে সবটা চেক করে যান।স্যার আপনার জন্য ব্রেকফাস্ট তৈরি করবো?”

” না চা নিয়ে এসো।”

রিমি কিছুটা অবাক হলো।আরশাদ রেস্টুরেন্টে এসে কখনো চা চায়নি।মূলত আরশাদ চা খুব একটা পছন্দ করে না।আরশাদ কফি লাভার।কিন্তু হঠাৎ চা চাওয়ার রসহ্যটা রিমি বুঝতে পারলো না।মেয়েটার মনে খেল গেল প্রশ্নেরা।

” স্যার চা?”

” অভ্যস হয়ে গেছে।আমার উনি চা টা ভিষণ ভালো বানায়।আগে পছন্দ করতাম না আর এখন…ভিষণ মিস করছি।”

” ম্যাডাম কেমন আছে স্যার?”

” ভালো আছে।”

” স্যার ম্যাডামকে খুঁজে পাওয়ার গল্পটা বলবেন কবে?”

আরশাদ শ্লেষ হাসলো।চেয়ারে বসে ফোন হাতে তুলে বলে,

” এক কাপ চা আনো।আর যারা যারা প্রেমের গল্প শুনতে চায় তাদের ধরে আনো আজ আমি আমার গল্প শোনাবো।”

মালিক হিসেবে আরশাদ ভীষণ অমায়িক একজন মানুষ।এত মাস সবারি কৌতূহল ছিল আরশাদকি সত্যি তার ফ্লুজিকে পেয়েছে?আজ বুঝি সেই কৌতূহলের অবসান ঘটলো।আরশাদ সবাইকে সামনে বসিয়ে তার গল্প শোনাতে ব্যস্ত।

অপরদিকে জ্বরে কাঁপছে খুশবু।শরীরে যেন আগুনের লাভা সৃষ্ট হচ্ছে।একেরপর এক জল পট্টি দিয়েও জ্বর কমাতে ব্যর্থ অনিমা।খুশবু কখনো প্রেম করেনি,ভালোবাসায় মজেনি।সে জানে না প্রিয় মানুষের দুরত্ব কতটুকু পোড়ায়।আজ আরশাদের শূন্যতা তাকে বুঝিয়ে দিচ্ছে বদ্ধ যন্ত্রণা কাকে বলে।কাউকে বলা যায় না বোঝানো যায় না।নিরবে সহ্য করার এক ব্যর্থ চেষ্টা।
চলবে___

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে