#ফ্লুজি
#অনুপ্রভা_মেহেরিন
[পর্ব ৯]
” দুলাভাই আপনার সব সিদ্ধান্তে আমি সহমত পোষণ করলেও এই ব্যপারটা নিয়ে এক হতে পারছি না।”
শামীমের কথায় আড় চোখে তাকালেন বাহারুল হক।আরশাদের পরিবার যাওয়ার পর সবাই তার বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লেগেছে।বাহারুল হক বিস্তার হাসলেন,
” সবাই দেখছি উঠে পড়ে লেগেছো আমার বিরুদ্ধে।”
” এমন সিদ্ধান্ত নিলে বিরোধিতা করবে না কেন?”
শেষোক্ত কথাটি অনিমা ঝাঁঝালো গলায় বললেন।খুশবু পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে বাবা মায়ের মন কষাকষি দেখছে।
” দুলাভাই এই ছেলের বিয়ের আগেও সম্পর্ক ছিল সেই কথা আমাদের থেকে গোপন করেছে মানলাম কিন্তু খুশবুর কাছে প্রকাশ করলো না কেন?বিয়ের আগে সবটা ক্লিয়ার করে নেওয়া দোষের কিছু না।”
” বর্তমান সময়ে এসে প্রেমের ব্যপারটা চায়ের সাথে বিস্কুটের মতো।থাকলেও চলে, না থাকলেও চলে। স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া সকলেই এখন প্রেম করছে বিয়ের আগে সম্পর্ক থাকতেই পারে।”
” আমি মানলাম থাকতে পারে।কিন্তু একটা কথা ভাবুন তাদের সম্পর্ক কতটা গভীর হলে মেয়েটা বিয়ে বাড়িতে এসে ঝামেলা করে।”
বাহারুল হক ব্যপারটা প্রতিবার এড়িয়ে যাচ্ছেন।তিনি শুধু জানেন রোহানের একটা মেয়ের সাথে সম্পর্ক ছিল ব্যস এতটুকু।কিন্তু এই সম্পর্কের নেপথ্যে কি চলছিল তা কি বাহারুল হক জানেন?একাধিক মেয়ের সাথে শারীরিক সম্পর্ক,মিথ্যা প্রতিশ্রুতি সবটাই রোহানের নিকট পুতুল খেলার মতো সহজ।সহজ সরল ভদ্রতার লেবাসধারী রোহানের পেছনের গল্প খুশবুর পরিবারের কাছে যে অজানা।
বাহারুল হকের এড়িয়ে যাওয়াটা মেনে নিতে পারলেন না অনিমা।তিনিও জেদ ধরে বসলেন আর যাই হোক রোহানের কাছে মেয়ে দেবেন না।
“তোমাকে আমি বলে দিচ্ছি পস্তাবে পস্তাবে নিজের সিদ্ধান্তে তুমি পস্তাবে।”
” অনিমা একদম চেচামেচি করবে না।আরশাদ যে ভালো তার প্রমান কী?”
শামীম এগিয়ে এলো বিনয়ের সহিত বাহারুল হককে বলেন,
” মোশারফ ভাইকে তো আপনি চেনেন জানেন।তিনি নিজে আমাকে ভরসা দিয়েছেন।”
” নিজের ভাগিনার ব্যপারে কেউ কি বাজে কথা বলবে?”
” মোশারফ ভাই সৎ এবং সত্যবাদী।একবার বিশ্বাস করেই দেখেন দুলাভাই।”
” আমি রোহানের মা’কে কথা দিয়েছি।তোমরা আরশাদের ব্যপারটা ভুলে যাও।”
অনিমা রেগে গেলেন।এই প্রথমবার স্বামীর সিদ্ধান্তে তিনি ঘোর বিরোধী।
” কথা যখন দিয়েছো তখন কথা তুমি ফিরিয়েও নিতে পারবে।”
” অনিমা জেদ করে লাভ নেই।আমি কথা ফিরিয়ে নিতে পারবো না।”
” তাহলে আমি দেব।”
” তোমাদের যা ইচ্ছে তোমরা করো এসবে খবরদার আমাকে টানবে না।”
” সত্যি যা ইচ্ছে তাই করবো?”
” অন্ধ হয়ে গেছ।”
” অন্ধ হয়েছো তুমি।আজকেই চলে যাব ভাইয়ের বাসায় থাকবো না তোমার সাথে।”
ফজরের আযানের সুর ভেসে এলো।ঝগড়া বিবাধে কখন যে ভোর হয়ে এলো কেউ টের পেল না।শামীম নেহা যে যার ঘরে চলে গেল।অপরদিকে অনিমা মনে মনে কষলেন এক জটিল সিদ্ধান্ত।
.
“খুশবু আম্মু উঠে যা।কইরে আম্মু উঠ।”
এত আদরের ডাক পেয়ে আচমকা খুশবু চোখ খুলে তাকায়।ভোরে যখন যে যার কক্ষে ফিরেছিল তখনো খুশবুর ঘুম আসনি।সারাটা সময় ছটফট করেছে মেয়েটা।তার চোখ লেগেছে আধা ঘন্টা আগে অথচ এখনি অনিমার ডাক,তাও কি না এত আদর সোহাগ মাখিয়ে!
” আম্মু মাত্র আটটা বাজে এখন… ”
“ছেলে পক্ষের মেহমান চলে আসবে উঠে আয়।”
” ছেলে পক্ষ মানে?”
“আগামীকাল নয় আজকেই তোর বিয়ে।বেশি কথা বলতে পারবো না তুই এক্ষুনি উঠে গোসল সারবি।”
” আম্মু….”
” চুপ কোন কথা নয় দেরি হলে কিন্তু ভালো হবে না বলে দিচ্ছি।”
খুশবু উঠে বসল ফোন চেক করে আরশাদের কোন আপডেট পাওয়া গেল না।গতকালের মেসেজ চেক করে কোন রিপ্লাই নেই।খুশবু আবার মেসেজ পাঠালো আরশাদকে এবং জানাল আজকেই তার বিয়ে।আরশাদ মেসেজটি সিন করে রেখে দেয়।প্রায় বিশ মিনিট পর রিপ্লাই দেয়, ” বিয়ে যখন হচ্ছে করে নাও আর কিছু বলার নেই।”
এক নিমিষে চুরমার হয়ে গেল খুশবুরব সকল আশা।আরশাদ কথাটা এভাবে বললো কেন?তবে কি আরশাদ তাকে ঠকিয়েছে!হতাশার সাগরে ডুবে ম রা র অবস্থা হয়েছে মেয়েটার তবুও বাইরে থেকে সে নিরব।কিন্তু রোহান যদি আজ বিয়ে করতে আসে তবে একটা না একটা অঘটন ঘটবেই আর তা ঘটাবে খুশবু নিজে।মনে মনে নিজের সিদ্ধান্ত পাকাপোক্ত করলো সে।
.
অনিমা এবং নেহার রান্না ঘরে ব্যস্ততা চলছে।শামীম সবকিছু তদারকি করছে।কিয়ৎক্ষণ বাদে উপস্থিত হয় খুশবুর বড় মামা,খুশবুর ছোট খালা এবং ফুফু। বাহারুল হক অবাক হয়ে দেখছেন সব।কি চলছে?তিনি রান্না ঘরে উপস্থিত হলেন অনিমার দিকে তাকিয়ে কঠোর হয়ে বলেন,
” কি হচ্ছে এসব?”
” তোমার মেয়ের বিয়ে তাই কাছের মানুষেরা এলো।এদের ছাড়া তো আর বিয়েটা সম্পর্ণ হয় না।”
” বিয়ে!কি বলছো অনিমা।”
” গতরাতে কি বলেছিলে মনে নেই?আমার যা ইচ্ছা আমি যেন করি তুমি এসবে নেই।তোমার কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করছি।”
” সহ্যের সীমানা পেরিয়ে যাচ্ছি তোমার এসব বাচ্চামো রাখো।”
অনিমা বাহারুল হকের কথায় গা দিলেন না।তিনি তার কাজে ব্যস্ত।সকাল দশটা বাজতে আরশাদের পরিবার এসে উপস্থিত হয়।সফেদ সাদা পাঞ্জাবিতে আরশাদকে ভীষণ মোহনীয় লাগছিল।বাহারুল হক কি করবেন বুঝে উঠতে পারলেন না,কেমন বেমিল হিসাবে আটকে গেলেন তিনি।অপরদিকে খুশবুর পরিবারের বাদ বাকি সদস্যরা ভীষণ অবাক এমন ভীনদেশী ছেলেকে কি করে খুঁজে পেল!সকলের মাঝে চলছিল ভীষণ কানাকানি।
আরশাদ যেন গতদিনের কথা বেমালুম ভুলে বসে আছে।সে হাসি হাসি মুখে কোলাকুলি করলো বাহারুল হকের সহিত।আরশাদ সবার সাথে বিনয় হয়ে সাক্ষাৎ করছিল,তার বাংলা কথা শুনে সকলের বেহুশ হওয়ার অবস্থা।
বাহারুল হকের পক্ষ নিয়ে কেউ কথা বললো না সবাই যেন অনিমাকে পক্ষে।এই প্রথম মেয়ের ব্যপারে সিদ্ধান্ত নিতে তিনি কি তবে ভুল ছিল?
খুশবুকে তৈরি করে দিচ্ছিল নেহা।টকটকে লাল জামদানির সাথে মেয়েটাকে পুতুল লাগছিল।লাল দোপাট্টা মাথায় দিয়ে চুপচাপ বসে রইলো সে।খুশবুর কক্ষে উকি দিয়ে এগিয়ে আসে তার ফুফাতো ভাই রিমন।
” খুশবু রানী কইরে?”
রিমনের কথায় মিষ্টি হাসে খুশবু।খুশবু এবং রিমন একই বয়সী দুজনের সম্পর্কটা খুনশুটির।
“কিরে খুশবু কালি ময়দা মেখে ফর্সা হয়েছিস।”
” ময়দা কি তোর দোকান থেকে কিনেছি?”
” তোর বরটা তো সেই।বিদেশি মাল।”
” ছিহ্ কথার কি ছিরি ভদ্র ভাবে কথা বল রিমন। ”
” উমম জ্বলে গেল ওমনি জ্বলে গেল।এখন থেকেই বরের জন্য পাগল বিয়ের পর তোর যে কি হবে।”
” কিছুই হবে না।তোর জন্য বিদেশিনী খুঁজে আনবো ঠিকাছে?”
” তা তো অবশ্যই।”
” রিমন একটু কষ্ট করবি পাড়ার দোকান থেকে আমার জন্য একটা গোলাপের গাজরা নিয়ে আয় হাতে লাগাবো সুন্দর লাগবে না?”
” হ্যা তাই তো।অপেক্ষা কর আসছি আমি।”
.
বসার ঘরে আরশার এবং খুশবুকে একসাথে বসানো হলো।আরিব তাদের পাশে বসে এটা ওটা বলে খেপাতে লাগলো।শামীম বিয়েতে দেরি করতে চাননা রোহানের পরিবার যদি জানতে পারে এমন কথা তবে আর রক্ষে নেই।বিয়ে পড়ানো শুরু হলো।ভিডিও কলে বিয়ের সকল কার্যক্রম দেখছিল আরশাদের বাবা মা এবং গ্র্যানি।
খুশবুকে যখন সই করতে বলা হলো তখন মেয়েটার হাত কাঁপুনিতে কলম ধরতে বেশ হিমশিমে পড়লো।একটা সই’য়ে সে আজ নিজের জীবনের বীজ বপন করবে।ভালো মন্দ কী আছে তার কপালে জানা নেই।
খুশবুর হাত থেকে কলম নিয়ে চোখ ইশারায় থামতে বলল আরশাদ।
” পানি খাবে?বেটার লাগবে।”
” আমি ঠিক আছি।”
” তা তো দেখতে পারছি।”
খুশবুর গলার স্বর নরম হলো।স্বগতোক্তি স্বরে আরশাদকে বলে,
” আমি ফ্লুজি নই আরশাদ আরেকবার ভাবুন।”
” ওকে ওকে। টুমি আমার খুচবু ওকে?”
আরশাদের কথায় সকলে চাপা হাসলো কি বিদঘুটে উচ্চারণ।গলায় শানিত তরবারি নিয়ে সই করে ফেললো খুশবু।যা হবার তা হবেই, ভাগ্যে যা আছে তা কেউ ঠেকাতে পারবে না।
বিয়ের কার্যক্রম শেষ হতে দুপুর হয়ে গেল।শামীম বাইরে থেকে আগেই খাবার অর্ডার করে রেখেছিল বিধায় খুব বেশি ঝামেলা হলো না।খাবার শেষে আরশাদ এবং খুশবুকে একা কথা বলার উদ্দেশ্যে কক্ষে পাঠানো হলো।আরশার বেশ কিছু ছবি তুললো খুশবুর।এই মানুষটা বউ নিয়ে কতটা সৌখিন বুঝতে আর বাকি নেই মেয়েটার।
ড্রেসিং টেবিলে থাকা খুশবুর প্রতিটা জিনিস আরশাদ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল।কিছু জিনিসের সে ছবি তুলে নিয়েছে।এমনটা করার ঠিক কি কারণ বুঝতে পারলো না খুশবু।
” আরশাদ এসবের ছবি তুলছেন কেন?”
” তুমি কি কি ব্যবহার করো আমি তো জানি না ফ্লুজি।আজকেই সব কিনে ফেলবো।”
” আর কী কী কিনবেন?”
” জামা কাপড় কিনতে হবে মেয়েদের এসব আমি বুঝিনা।শাড়িটা দেখো কত বুদ্ধি খাটিয়ে কিনেছি।এই তোমার গহনা পছন্দ হয়েছে?মম বলেছে বাঙালিদের স্বর্ণই বেস্ট মানানসই।আমি নিজে পছন্দ করে কিনেছিন।”
খুশবু প্রত্যুত্তর করলো না।সে তাকিয়ে রইলো আরশাদের পানে।কি সুন্দর অবুঝ ভাব এই ছেলেটার কিন্তু কে বলবে রেগে গেলে আস্ত একটা বদমাইশে পরিণত হয়।হঠাৎ ফোন বেজে উঠলো খুশবুর রোহান ফোন করেছে আরশাদ দ্রুত ফোন কেটে তার ফ্লুজির পানে তাকালো।আরশাদ আদেশ সুরে খুশবুকে বলে,
” খবরদার ওঁকে নিয়ে ভাববে না।”
” ভাববো না।”
” এখন থেকে আমাকে নিয়ে ভাববে।আরশাদ ইহসান তোমার হাজবেন্ড একবার না দুইবার বিয়ে করেছো।”
খুশবু হাসলো মাথা এলিয়ে দিল আরশাদের কাঁধে।তার কেন যেন ভীষণ কান্না পাচ্ছে।
” তুমি কি কাঁদতে চাইছো ফ্লুজি?একদম কাঁদবে না।কাঁদতে কিন্তু আমি অবাধ্য অভদ্র হয়ে যাব।দেখো ভদ্র ছেলের মতো বসে আছি আমি চাই না তোমার মেকাপ নষ্ট হোক।”
আরশাদ থামলো।খুশবুর নিরবে হাসলো।আরশাদ তার ফ্লুজির হাতের উলটো পিঠে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলে,
” তোমার হাতে ফুল কে দিল ফ্লুজি?”
” রিমন এনে দিয়েছে।”
আরশাদের মুখভঙ্গিমা পালটে গেল।ছলকে উঠলো তার রক্ত।হিংসাত্মক মনোভাবে বার বার চুরমার হলো তার ভদ্রতা।খুশবুর হাতের ভাজে হাত মিলিয়ে দুমড়ে মুচড়ে দিল সব ফুল।গোলাপের প্রত্যকটা পাপড়ি ঝড়ে পড়লো নিমিষে।আরশাদ স্বস্তি পেল।ফ্লুজির আলতো ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁইয়ে কিঞ্চিৎ হাসলো।
” জান ফুল লাগবে?আনছি জান অপেক্ষা করো।”
খুশবু হতবাক হতভম্ব।আরশাদ উঠে গেল রুম থেকে বেরিয়ে বিড়বিড় করে বলে,
” আমার ফুলকে আমি ফুল দিব।আর কেউ না কেউ না ।”
চলবে____