#ফ্লুজি
#অনুপ্রভা_মেহেরিন
[পর্ব ৭]
ভয় নিয়ে আরশাদের প্লেটে খাবার তুলে দিচ্ছেন আনিমা।এই ছেলের খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে তার ধারণা নেই।ঝাল খেতে পারে নাকি পারে না।মাংস পছন্দ নাকি মাছ?সব ভেবে তার নাজেহাল অবস্থা।অনিমার অপ্রস্তুত মুখ দেখে আরশাদ কিঞ্চিৎ হাসলো।সম্মোহনী স্বরে বলে,
” ভয় পাবেন না আন্টি দেশি খাবারে আমার অভ্যস আছে।ঝাল টক সবটাই খেতে পারি।আমার মম বাঙালি।আর বাঙালিদের কি বাঙালি খাবার ছাড়া চলে?আমার মুখের বাংলাটা একটু বেশি এলোমেলো হলেও আমার ভাইয়ের কথা শুনেছেন তো।”
” শুনে খুশি হলাম বাবা।আমি যে ভয়ে ছিলাম।হাসের মাংসটা নাও।”
আরশাদ মিষ্টি হাসলো।ভাগ্যক্রমে শ্বশুর বাড়ির আপ্যায়ন যে এভাবে কপালে জুটবে কে জানতো।আচ্ছা আনিমা কি জানে এই ছেলেটাই তার মেয়ের জামাই।আড় চোখে খুশবুর পানে তাকালো আরশাদ।খুশবু তার মামার পাশে বসেছে।ছোট মামা শামীমের একটা অভ্যস আছে এই বাড়িতে এলে তিনি খুশবুকে ছাড়া খেতে বসেন না।খুশবুর অমনোযোগী ভাবটা ভীষণ ভাবে লক্ষ করলেন বাহারুল হক।তিনি গম্ভীর গলায় বলেন,
” আম্মু খাও না কেন?রান্না পছন্দ হয়নি?”
” আব্বু খেলাম তো।”
” কি খেলে আমি কি দেখিনি?”
” সন্ধ্যায় ভারি নাস্তা করেছি তো তাই পেট ভরা আব্বু।”
বাহারুল হক বাটি থেকে মাছের মাথাটা তুলে মেয়ের পাতে দিলেন।
” তোমার পছন্দের মাছের মাথা। এটা খেয়ে উঠবে।ভাত না খেলেও চলবে।”
আরশাদ ভ্রু নাচিয়ে তাকালো খুশবুর পানে।সবার মনোযোগ ছিন্ন করে সে বলে,
” তুমি মাছের মাথাও খাও!আমি তো ভাবলাম শুধু মানুষের মাথা খাও।এই যে আমার মাথাটা যেভাবে ফাটিয়ে খেতে চেয়েছিলে।”
সবার মাঝে হাসির রোল পড়লো।আরশাদের দিকে একপলক তাকিয়ে নজর সরালো খুশবু।বেয়াদব ছেলে হাড় মাংস সব জ্বলিয়ে খাচ্ছে।
খাওয়ার টেবিলে আরশাদের পরিবার সম্পর্কে কথা উঠে।সবাই বেশ আগ্রহ নিয়ে শুনছিল সবটা।আরিব তার মামার পরিচয় জানাতে চমকে গেল খুশবুর মামা।মুখে থাকা অর্ধেক ভাত ছিটকে গেল নাকে।শামীমের এমন কার্যকলাপে সবাই যে ভড়কে গেল।শামীম পুলকিত হয়ে আরিবকে বলে,
” আরেহ মোশারফ ভাই তোমার মামা।”
” হ্যা আমার আপন মামা।”
” সিরিয়াসলি!উনি আমার সিনিয়র তবে আমরা বন্ধু।চাকরির সূত্রে মোশারফ ভাইয়ের সাথে আমার পরিচয় উনি ব্রিলিয়ান্ট একজন মানুষ।উনার যে কোন পরামর্শ আমি সাদরে গ্রহণ করি।এই তো গত মাসে মোশারফ ভাইয়ের বাড়িয়ে দাওয়াত ছিল নুহার আম্মু সহ গেলাম।”
আরশাদ পুলকিত হলো।তার কাজটা আরো সহজ হয়ে যাচ্ছে এরা পরিচিত!এবার নিশ্চয়ই বাহারুল হক মেয়ে বিয়ে দিতে দ্বিমত করবেন না।
” মোশারফ ভাই আমাকে সবসময় তার বোনের কথা বলতেন।ভীষণ ভালো বর পেয়েছে সে।তার দুইজন ছেলেও নাকি মাশাল্লাহ দুই রত্ন।তোমরাই যে তারা তা তো আমি বুঝতেই পারলাম না।”
” এবার মামার বাড়ি যাওয়ার আগে অবশ্যই আপনাদের সাথে করে নিয়ে যাব।প্লিজ কেউ বারণ করবেন না।”
সবার আড্ডা চললো রাত প্রায় একটা পর্যন্ত এরপর আরশাদ ফিরে এলো তার নিজ বাসায়।
হাতে হাতে সবটা গোছগাছ করছিলেন নেহা এবং অনিমা।খুশবুর উপস্থিতি পরখ করে নেহা,না খুশবু নেই।মনের কথাটা চেপে না রেখে নেহা বলে,
” আপা একটা কথা মাথায় এলো কিছু মনে করবেন না তো?”
” কি মনে করবো?কি বলতে চাস আগে সেটা বল।”
” মানে… আরশাদকে তোমার কেমন লেগেছে?খুশবুর সাথে আরশাদের যদি বিয়ে হতো।”
অনিমা চমকে গেলেন।চাপা হেসে বলেন,
” আমিও তো তাই ভাবলাম।”
” কেন যে মনে হয় খুশবুকে আরশাদ বেশ পছন্দ করে।দেখলে তো আসার পর থেকে কেমন চোখে চোখে রাখছিল।তাদের চোখাচোখি কথা দেখেছো?”
” কি বলছিস আমি তো এতকিছু খেয়াল করিনি।”
” আমাদের ভাবনা যদি সত্যি হতো ইসস কি ভালো হতো বলতো।”
” আকাশকুসুম ভেবে কি লাভ নেহা।উনারা নিশ্চয়ই ওখানকার মেয়ে বিয়ে করাবেন শুধু শুধু এসব ভেবে লাভ নেই।”
” হ্যাঁ ঠিক বলেছো।আরশাদের মামার সম্পর্কে তো তুমি টুকটাক জানো।কত নাম করা তারা।”
.
খুশবুর সকালটা শুরু হলো প্রতিদিনের নিয়মে।বাহারুল হক ঘরের সামনের উঠোনটাতে কিছু সবজি চারা লাগিয়েছেন সেসব তিনি পরিচর্যা করলেন।বিশাল উঠোনের মাঝে একটি একতলার ঘর।বাড়িটাকে তিনি নিজ মন মতো সাজিয়েছেন।ঘরের পছনে পুকুর কেটেছেন সবটাই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা।খুশবু তার বাবার দিকে তাকিয়ে ছিল কয়েক পল, অনিমাকে আসতে দেখে সে নজর সরায়।
” আম্মু একটা কথা বলবো?”
” বল।”
” আমার কি ভুলে যাওয়ার রোগ আছে?”
মেয়ের মুখে এমন কথা শুনে কিঞ্চিৎ অবাক হলেন অনিমা।
” ছোট বেলায় তোর নানু কোমড় ভাঙার আগে তোকে কি বলেছিল?”
” পাকনা বুড়ি সুন্দর জামাই পাইবা।দেখি খাও তো আমার পান।আমিও নানুর হাত থেকে পান নিলাম এরপর তো পুকুর ঘাটে গিয়ে নানু কোমড় ভাঙলেন সেই যে পড়লেন আর শক্ত হয়ে উঠে দাড়ানোর সামর্থ্য হলো না।”
” দেখলি ছোট বেলার কথা মনে আছে।তাহলে তোর ভুলে যাওয়ার রোগ আছে কি না মনে সন্দেহ জাগলো কি করে?”
” আমার কি জমজ কোন বোন ছিল?”
” এক চড়ে মুখে তালা লাগিয়ে দিব।তখন থেকে কিসব বাজে বকছিস।চা রেখে এসেছি যা গিয়ে চা টা শেষ কর।”
বাহারুল হক এসে বসলেন বসার ঘরে।দরজায় বেল বাজতে অনিমা ছুটে গেলেন দরজা খুলতে।রোহানের মা’কে দেখে অনিমার মুখটা কেমন ফ্যাকাশে হয়ে যায়।
” আপনারা? ”
” বেয়াইনের বাড়িতে আসবো না!বেয়াই কোথায়?”
রোহান এবং রোহানের মা বাহারুল হকের সামনে বসলেন।খুশবু এগিয়ে এলো কে এসেছে দেখতে। রোহানকে দেখে তার বুকের ভেতরটা ভয়ে কুঁকড়ে উঠলো।
বাহারুল হক অকপটে বলেন,
” আপনারা কেন এলেন হঠাৎ?”
” আপনি কেমন আছেন বেয়াই সাহেব?”
” বেয়াই।বড্ড বেমানান ঠেকছে যে।সম্পর্কটা যে আর নেই আপনি কি বুঝতে পারছেন না।”
” যা হওয়ার তা হয়েছে এসব নিয়ে যদি মন কষাকষি বাড়তে থাকে তবে লাভ কী?”
” লাভ লসের হিসেব আমি বুঝি না।কিন্তু আমার মেয়ের ব্যপারে কোন রিস্ক আমি নিতে চাই না।পূর্বের সিদ্ধান্তটা নিঃসন্দেহে আমাদের নেওয়া ভুল সিদ্ধান্তগুলোর একটি।তবে যা হয়েছে বা যা ঘটেছে তা তো আর ভুলে যাওয়া যায় না।আমি সোজাসাপটা বলতে চাই আপনাদের সাথে আমরা কোন আত্নীয়তা করতে চাই না।”
অপমানে থমথমে হয়ে গেল রোহানের মুখ।কিন্তু অসময়ের কথা গায়ে মাখতে নেই।নেহা এসে দাঁড়ালেন সবার সামনে রোহানের ছটফটে ভাবটা দেখে তিনি বলেন,
” শোনো রোহান আমরা মেয়ে যার তার হাতে তুলে দিতে গিয়ে একবার ভুল করেছি।আর কোন ভুল আমাদের দ্বারা হোক আমরা সেটা চাই না।”
পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা খুশবুকে
দেখে রোহান এগিতে গেল।খুশবুর হাত ধরে টেনে আনলো সবার সামনে।
” খুশবু তুমি জান না আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি।তোমার পরিবারের নেওয়া সিদ্ধান্তে তুমি বাঁধা দিচ্ছ না কেন?আমি তোমার চোখে স্পষ্ট আমার জন্য ভালোবাসা দেখেছি।”
খুশবু দ্রুত নিজের হাত ছাড়িয়ে দূরে সরে দাঁড়ালো।সকলের চাহনি যে তাকে অপ্রস্তুতের দুয়ারে ঠেলে দিয়েছে।তবুও নিজের দায় এড়াতে সে বলে,
” এসব বিষয়ে আমার কোন সিদ্ধান্ত নেই।আমার পরিবার যা বলবে তাই হবে।”
খুশবু আর দাঁড়ালো না।দ্রুত পায়ে চলে এলো নিজের কক্ষে।বুকের ভেতরে যে তার ঝড় বয়ে যাচ্ছে।সহসা ফোন বেজে উঠলো তার।আরশাদ ফোন করেছে।এই সময়ে আবার আরশাদ ফোন করলো কেন!
” হ্যালো।”
” কোথায় ছিলে তুমি?কয়বার কল করলাম একবারো দেখেছো?”
” রোহান এসেছে আরশাদ।”
” কাবাবের হাড্ডিটা আবার কেন গিয়েছে?”
” পুনরায় বিয়ের প্রস্তাব রেখেছে।”
” তোমার পরিবার কি বলেছে?”
” তা জানা কি খুব জরুরি?”
” তুমি কি বলেছো?”
” জানি না।”
” একদম কথা ঘুরাবে না ফ্লুজি।আমার শর্ত ভাঙলে কিন্তু জাহান্নাম করে ছাড়বো সব।”
” এতটা ধকল আমি আর নিতে পারছি না।এবার দয়া করুন আমাকে রেহাই দিন।”
” চলো।”
” কোথায়?”
” বিয়ে করবো।”
” ফা ল তু কথা।”
” তোমাকে ছাড়া আমার ঘুম হচ্ছেনা ফ্লুজি?তুমি ছাড়া আমার ঘুম হারাম।”
” আর আপনাকে বিয়ে করলে আমার ঘুম হারাম হয়ে যাবে।”
“হতেই হবে।আরশাদ ইহসান বলে কথা কোন ছাড় নেই।”
খুশবু ফোন কেটে বসলো বিছানায়।এলোমেলো লাগছে তার সবকিছু।অপরদিকে আরশাদ ফোন রেখে ভীষণ চিন্তায় পড়লো।বিছানায় পড়ে থাকা স্ট্যাম্পটা হাতে তুলে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ।পরবর্তী পদক্ষেপ ভীষণ কঠিন। যদি একবার বাহারুল হক রোহানের সাথে মেয়ে বিয়ে দিতে রাজি হয়ে যায় তবে সব আবার এলোমেলো।আরশাদের মাথা গরম হয়ে গেল সে দ্রুত ছুটলো ওয়াশরুমে।মাথায় পানি ঢেলে বের হতে দেখতে পেল আরিব দাঁড়িয়ে আছে।তার হাতে সেই স্ট্যাম্প।
” ব্রো তোমরা বিয়ে করেছো।”
” ইয়েস।”
” মম ডেড জানলে ভীষণ কষ্ট পাবে।তুমি বুঝে শুনে বিয়ে করেছো নাকি জেদে।”
” আরিব খবরদার এই কথা কিন্তু কেউ জানে না।আশা করি তুই কাউকে বলবি না।”
” ভাবি কি সেচ্ছায় বিয়ে করেছে?”
” না।সে তো জানে না বিয়ের কথা।”
আরিব মাথায় হাত দিয়ে বসলো।তার ভাই যে তাকে গোলকধাঁধায় ফেলেছে।আরশাদের ফোন পুনরায় বেজে উঠলো।ফ্লুজি ফোন করেছে।ফ্লুজির কান্নার শব্দে ভয় পেল আরশাদ অবচেতন মন যে ভিন্ন কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছে।
“আরশাদ আব্বু কথা দিয়ে ফেলেছে।”
” আর তোমার মতামত?”
” জানি না।”
” তুমি এক্ষুনি গিয়ে সবাইকে সবটা বলবে তুমি বিয়েটা করছো না।”
” আব্বুর চোখে চোখ রেখে কথা বলার সাহস আদৌ আমার হয়নি।”
” শর্তের কথা ভুলে গেলে?”
খুশবু দ্রুত ফোন কেটে দিল।অশনি ঝড়ের কথা ভেবে ভয়ে তার শরীর কাঁপছে।
দরজায় দাঁড়িয়ে সব কথা শুনছিলেন অনিমা।খুশবু চোখ মুছে পেছনে তাকিয়ে অনিমার রাগে অগ্নিশর্মা মুখখানি দেখে দু’কদম পিছিয়ে গেল।মেয়ের দিকে এগিয়ে এসে তিনি স্থির হয়ে বলেন,
” আরশাদকে ফোন কর।আমি কথা বলবো।আমি দেখতে চাই এই ছেলের কতটা সাহস।”
__চলবে…..