#ফ্লুজি
#অনুপ্রভা_মেহেরিন
[পর্ব ৬]
” আমার ফ্লুজি একটা কঠিন অসুখে ভুগছি আমি।ওষুধটা রাত দিন চব্বিশ ঘন্টা সেবনের জরুরি হয়ে পড়েছে।ডাক্তার বলে দিয়েছে সারাক্ষণ সেই ওষুধটা সাথে নিয়ে ঘুরবেন দেখবেন এই অসুখ সেরে যাবে।গত কয়েকটা রাত তোমার কাছাকাছি থাকার লোভে আমার ঘুম হয়নি।সেচ্ছায় ঝামেলা করতে বারবার তোমার কাছে ছুটে গিয়েছি।আজ আমার একা লাগছে ভীষণ একা।তোমার রেখে যাওয়া এলোমেলো রুমটা আমি আর সাজাতে দেইনি, থাক না পড়ে থাকুক ওভাবে।যতদিন না তুমি আসছো রুমটা ওভাবেই থাকবে।ডাক্তারের পরামর্শে একটা ক্রিম খুঁজে পেয়েছি তোমার জন্য,ইতালিতে থাকা তোমার দেওর দেশে আসতে নিয়ে আসবে।মনে প্রশ্ন আসতে পারে এই ক্রিম দিয়ে তোমার কাজ কি!গলায় সে দাগ দিয়েছি মনে আছে?এই দাগ সহজে গায়েব হয়ে যাবে।দাগ দেওয়াতো সবে শুরু এমন হাজার খানেক দাগ পড়বে,মানতে না চাইলেও তোমাকে মানতে হবে।সহ্য করতে হবে।
তুমি কি সুন্দর ঘুমের রাজ্যে ডুবে আছো আর আমি!আমার চোখে ঘুম নেই জান।একটা ঘুমের ওষুধ খেয়ে কোন কাজ হলো না।এবার দুটো খেয়ে ফেলেছি।গুরুত্বপূর্ণ কথাটা শুনো আমার এই দীর্ঘ ম্যাসেজটা তুমি যখন পড়ছো মন থেকে ভেবে নিও তোমার ঠোঁট জোড়া তখন আমার দখলে।”
খুশবু ফোনটা ছুড়ে ফেললো বিছানায়।বেলা বারোটা বাজে এখন ঘুম ভাঙলো তার।আরশাদের এই হাবিজাবি ম্যাসেজ কেন যে সে মন দিয়ে পড়লো কে জানে।খুশবুর মন আটকে গেল একটা লাইনে এই মানুষটা তিনটা ঘুমের ওষুধ খেয়েছে!
দ্রুত গোসল সেরে তৈরি হয়ে নিল খুশবু।যখনি রুম থেকে বের হবে এমন সময় অনিমার ফ্যাকাশে মুখটা দেখে ঘাবড়ে যায় সে।
” আম্মু কি হয়েছে?”
” আরশাদের সাথে তোর বাবার গতকাল দেখা হয়নি।তাই ভাবলাম ছেলেটাকে আজ দুপুরে দাওয়াত করি কিন্তু এই ছেলে আমার ফোন তুলছে না।কম করে হলেও আশিটা ফোন দিয়েছি।”
খুশবুর ভেতরটা কু-ডাকছে ঘুমের ওষুধ খেয়ে কি চিতপটাং হয়ে গেছে নাকি?
খুশবু নিজেও ফোন করেছে বেশ কয়েকবার কিন্তু আরশাদ ফোন ধরছে না।মেসেজ ফোন দিতে দিতে খুশবুর কেঁদে দেওয়ার অবস্থা হয়েছে কি হয়েছে এই মানুষটার?
.
গতরাতে ঘুম হয়নি আর আজ যে ঘুম থেকে উঠতেই পারছে না।আরশাদ যখন আধো আধো চোখ খুললো তখন বাজে দুপুর দুইটা।দেয়াল ঘড়িতে সময়টা দেখে মাথায় হাত তার।আজ আরশাদ খুশবুর সেই এলোমেলো রুমটা ঘুমিয়েছে বুকে চেপে আছে খুশবুর রেখে যাওয়া ব্যবহৃত ওড়না।মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে খুশবুর লেহেঙ্গা।এই লেহেঙ্গা নিশ্চয়ই রোহানের বাড়ি থেকে এসেছে যখনি কথাটা মাথায় এসেছে সম্পূর্ণ লেহেঙ্গা যেভাবে পেরেছে ছিড়েছে।আরশাদ হাঁক ডেকে ডাকলো আনজুমকে।
” স্যার কিছু বলবেন?”
” এই ভারি জামাটা নিয়ে যান যেভাবে পারেন আ গু ন লাগিয়ে ছাই করে ফেলবেন।”
আনজুম মাথা দুলিয়ে চলে যায়।
আরশাদ উঠে চলে যায় নিজের কক্ষে।সারাটা শরীর ম্যাজম্যাজ করছে।মাথাটা কেমন ভারি হয়ে আছে।এই মুহূর্তে গোসল নেওয়া জরুরি তার জন্য। এলোমেলো পা ফেলে ওয়াশরুমে গিয়ে আয়নায় নিজেকে কতক্ষণ দেখলো।টি-শাট খুলে যখনি ঝরণার নিচে গেলে গায়ে পানি পড়তে সে ছিটকে দূরে সরে এলো।পিঠে ঘাড়ে বিভিন্ন অংশে পানি লাগায় ভীষণ জ্বলছে।
আরশাদ পুনরায় আয়নার কাছে দাঁড়ায় বুঝতে পারে আসল কারণটা কি।তার ফ্লুজির নেইল এক্সটেনশনের রা ক্ষা সী নখ গুলোর আঁচড়ে তার এই হাল।আরশাদ হাসলো ফ্লুজির প্রতিটা স্পশে তার ভালো থাকার সুরেরা টানছে।লম্বা শাওয়ার নিয়ে কোমড়ে তোয়ালে জড়িয়ে বের হলো আরশাদ।বিছানায় ছোট ভাই আরিবকে দেখে ভূত দেখার মত অবস্থা তার।
আরিব এখানে কী করছে!আরিব নাটকীয় ভঙ্গিমায় জড়িয়ে ধরলো আরশাদকে এবং মিষ্টি হেসে বলে,
“সারপ্রেসা।”
“রাখ তোর চেংচুং কথা।বাংলায় কথা বল।”
” ভাই তোমার বাংলা শুনে এই দেশের লোকেরা কি হাসে না?কি বিদঘুটে বাংলা বলো তুমি।অথচ আমার বাংলা বলা দেখো একদম নিখুঁত।”
আরশাদ ঠোঁট বাঁকালো।আরশাদের মুখে বাংলা কথা শুনলে যেখানে কানের তালা লেগে যায় সেখানে আরিবের বাংলা বলার ধরণ সত্যি অসাধারণ।আরিব আর আরশাদের চেহারার অনেকটা মিল থাকলেও আরশাদের তুলনায় আরিব ফর্সা,লম্বায় আরশাদের তুলনায় খাটো।ছেলেটা যেন রাগতে জানে না সর্বদা হাসি লেগে থাকে ঠোঁটের কোণে।
” এখানে কেন এসেছো আরিব?”
” আহ ভাই তুমিতুমি করো না তো, তুই করে বলো অন্যরকম ফিলিংস আসে।বন্ধু বন্ধু ব্যপার।”
“এবার বল এখানে কেন এসেছিস?”
” সেটা তুমি ভালো করেই জানো কেন এলাম।”
” আমায় পাহারায় রাখতে?”
” ইয়েস।
আরশাদের ফোন বেজে উঠলো অনিমা ফোন করেছেন।তিনি জানিয়েছেন আরশাদের সঙ্গে আজ তারা ডিনার করতে চান।আরশাদ দ্বিমত পোষণ করলো না সে তো অপেক্ষায় কখন দেখা হবে তার ফ্লুজির সাথে।আরশাদ যখন ফোনে ব্যস্ত তখ ন তাকে জহুরি চোখে পরখ করছিল আরিব।ফোন রাখতে আরিব আরশাদকে বলে,
” তুমি নাকি বিয়ে এখন করবে না তাহলে কি ইয়ে করে ফেলেছো?বিবেক বুদ্ধি কি লোপ পেয়েছে?”
” এই কিসব হাবিজাবি বকছিস?”
” পিঠে ঘাড়ে কিসের দাগ ব্রো?”
আরশাদ বিষম খেল।ছোট ভাইটার সামনে লজ্জায় পড়লো যে।
” আরিব তুমি ছোট ছোটর মতো থাকবে।”
” ওকে ওকে। কপাল ফাটলো কী করে? ”
” ভালোবাসার ওভার ডোজ সহ্য করতে পারিনি কপাল ফেটে বেরিয়ে গেছে।”
আরিব হেসে ফেললো।ভাইয়ের মতিগতি তার যে সন্দেহ লাগছে।
” তুমি বিয়ে করবে না বলে মমকে আসতে বারণ করলে।তাই মম আমাকে পাঠিয়েছে তোমার খেয়াল রাখতে আর বেতালের মতো তোমার কাঁধে ঘুরতে।”
” ড্যাড,গ্র্যানি কেমন আছে?”
” তারা ভীষণ এক্সাইটেড তুমি কখন ভাবিকে নিয়ে যাবে।”
” যাব।খুব শীঘ্রই যাব।”
.
আরশাদ এসেছে শুনে ভয়ে গুটিয়ে গেছে খুশবু।আরশাদের আসার কথা ছিল রাতে অথচ সে এই সন্ধ্যায় কেন এলো?কী উদ্দেশ্যে এলো?আরশাদের গলার আওয়াজ খুব অল্প পাওয়া গেলেও তার ভাই আরিবের হাসির শব্দে সাড়া বাড়ি মুখোরিত।ছেলেটার একেকটা কথার বাঁকে সকলে হাসছে।হই হুল্লোড়ে মেতে আছে সারা ঘর।
নেহা এবং অনিমা রান্না ঘরে সময় দিচ্ছে এখনো তাদের কত রান্না বাকি।খুশবুর বড় মামা চলে গেলেও ছোট মামা আসবেন ডিনারের সময়।নুহা ঘুমিয়ে আছে খুশবুর কক্ষে।পর্দার আড়ালে আরিবকে দেখে চোখ আটকে গেল খুশবুর।পাশে বসে থাকা আরশাদের সাথে চোখাচোখি হলেও খুশবু পুনরায় চোখ রাখলো আরিবের পানে।এত কিউট কেন ছেলেটা?এত সুন্দর হাসি!
খুশবুর হৃদযন্ত্রের ধুকপুক বাড়লো।লজ্জা মিশিয়ে হাসলো সে।ওই আধাপাগল আরশাদকে কে বিয়ে করবে?আরিবের মতো একটা ছেলেকেই তো সে চায়।আচ্ছা আরশাদ যদি তার কেউ হয় তবে আরিব তার দেওর।ছিহ!কিসব ভাবছে খুশবু।
আরশাদ কেমন করে তাকিয়ে আছে খুশবুর পানে।নিজেকে আড়াল করে কক্ষে ফিরলো সে।বাহারুল হক এখনো সম্পূর্ণ সুস্থ নয়।বিছানায় আধোশোয়া অবস্থায় কথা বলছেন তিনি।আরশাদ আরিবকে মেসেজ করে বলে এদিকটা সামলাতে সে এখন তার ফ্লুজির সাথে দেখা করতে যাবে।ফোন আসার বাহানায় আরশাদ উঠে গিয়ে খুশবুকে খুঁজতে থাকে।
দরজা খোলা কক্ষে খুশবুকে পেয়ে যেতে আরশাদের সময় লাগলো না।কক্ষে এসে দ্রুত দরজা রুদ্ধ করে আরশাদ।হঠাৎ তাকে দেখে চমকে গেল খশবু তার চমকে যাওয়া মুখ ভঙ্গিমা দ্বিগুণ বাড়ালো আরশাদ।আলতো হাতে খুশবুকে জড়িয়ে ধরে নিজেকে স্থির করলো।দ্রুত আরশাদকে ছাড়াতে চাইলো খুশবু কিন্তু আরশাদ যে নাছোড়বান্দা সে যে এই সুযোগ ছাড়বে না।
” ফ্লুজি আমার জান কেমন আছো?”
” ভ..ভালো।”
” আমাকে মিস করেছো?”
” না।”
” আরিবের দিকে ওভাবে তাকিয়ে ছিলে কেন?”
” ক..কই।”
” আমি দেখেছি।এখন তুমি আমার দিকে তাকাও।”
দু’হাতের আঁজলা খুশবুর গাল জড়ালো আরশাদ।
” ফ্লুজি আমাকে দেখো।”
” আর কত দেখবো?”
” দেখতে থাকো।”
” দেখার মতো কিছু আছে?”
” দেখার মতো কি দেখতে চাও?”
” ধূর ভাল্লাগে না।”
আরশাদ খুশবুর গালে ঠোঁট ছোঁয়ালো।পকেট থেকে একটি রিং বের করে আলগোছে পরিয়ে দিল খুশবুর হাতে।
” নাও বিয়ের গিফট।”
” কিসের বিয়ে?আর এটা কেন দিচ্ছেন।”
” হাত থেকে খুলেছো তো…।”
খুশবু জেদ দেখিয়ে খুলতে নিলে আরশাদ খুশবুর আঙুলে কামড় বসায়।দুই পাটি দাঁতের পিষে ব্যথায় চিৎকারের আগে মুখ চেপে ধরলো আরশাদ।
” একদম বাড়াবাড়ি করবে না জান।তুমি সোজা আমিও সোজা।তুমি বেঁকে গেছো মানে আমি সম্পূর্ণ রূপে বেঁকে যাব।”
” এমন কেন আপনি?”
” যেমনি হই মেনে নেবে তো।”
আচমকা ফোন বেজে উঠলো খুশবুর।রোহান ফোন করেছে।এই ছেলে কি ফোন করার আর সময় পেল না!খুশবু ভয়ে ফোন তুললো না।আরশাদ ফোন তুলে খুশবুর হাতে দিল,
” কথা বলবে?”
” বলবো না কেন?”
” আচ্ছা বলো।”
আরশাদ ফোনটা তার ফ্লুজির হাতে দিয়ে বিছানায় বসলো পাশে টেনে বসালো ফ্লুজিকে।রোহান আর খুশবুর সব কথা নিরব দর্শক হয়ে শুনছিল সে।যখনি রোহান ইমোশনাল কথা বলে খুশবুর মন ঘুরাতে চাইলো তখনি অপরপাশ থেকে খুশবুর কোন সাড়া শব্দ পেল না রোহান।মেয়েটা কথার মাঝে কি উধাও হয়ে গেল?রোহান সাড়া শব্দ পাবে কি করে?
স্বাভাবিক নির্ঝঞ্ঝাট পরিস্থিতিতেও দুটি মানব মানবির মনে তখন চলছিল উত্তাল ঝড়।ঝড়ের বর্ষণে ক্রমশ ঘনিষ্ঠ হতে থাকে দুটি ওষ্ঠের ছোঁয়া।খুশবুর কানে আসছে রোহানের কথা কিন্তু আরশাদের কারসাজির কাছে সে বারবার হেরে যায়।ক্রমশ আরশাদের আদলে হারিয়ে যায় তার ছোট্ট দেহখানি।খুশবু যতবার ইশারায় ফোনের ধরতে যায় আরশাদ ততবার একধাপ এগিয়ে যায়।খুশবু বুঝতে পারে এই বদ্ধ উন্মাদ ছেলেটা চায় খুশবুর অগ্রাধিকার তালিকায় একমাত্র সে থাকবে।খুশবুর ছটফট বাড়তে আরশাদ উঠে বসে।খুশবু দ্রুত ওড়না নিয়ে ঠোঁট মুছতে গেলে আরশাদ হাত ধরে ফেলে,
” খবরদার এমন করলে আবার আবার করবো কিন্তু।এবার থুথু না খাইয়ে ছাড়বো না।আমি কিন্তু ভালো ছেলে নই।”
#চলবে___