ফুলশয্যা_সিজন(০৩)
☀পর্ব- ০১☀
লেখা- অনামিকা ইসলাম।
বিয়েটা যখন হয়েই গেছে, তখন আর কেঁদে কি হবে?এখন চলুন শুরু করা যাক।
চমকে উঠে নুহা। শুভ নামের এক অচেনা যুবক, যার সাথে মাত্র কয়েক পরিচয় ওর। তার মুখ থেকে আচমকা এ ধরনের কথা শুনেছে। চমকে উঠার’ই কথা। বিস্মিত নুহা শুভ’র মুখের দিকে ফিরে তাকায়। ভয়ার্ত গলায় প্রশ্ন করে। মানে? শুশুশুশুরু ক্কককরব মমানে? কিকিকিকিকিকিকি বুবুঝাতে চাচ্ছেন আপনি? হেসে উঠে শুভ। আশ্চর্য! শুরু করব কথাটা শুনে আপনি এত তুতলাচ্ছেন কেন? এবারো কাঁপা গলায় নুহার জবাব, তুতলাচ্ছি আপনার উদ্ভট কথা শুনে। ভ্রু’টা কিঞ্চিৎ বাঁকা করে ফেলে শুভ। Strength! উদ্ভটের কিছু তো আমি বলিনি। আমি জাস্ট বলেছি, শুরু করা যাক। কি শুরু যাক সেটা তো শুনবেন আগে, নাকি? নুহা হাত দুইটা বুকের মধ্যে নিয়ে ভয়ে কুঁকড়ে দেয়ালের সাথে মিশে যায়। আমি কোন কথা শুনতে চাই না। উফফ! কপালে জমে থাকা ঘামগুলো মুছে নেয় শুভ। তারপর নুহার দিকে তাকিয়ে বলে উঠে, শুনোন মিস নুহা! আপনি যে ভয়টা পাচ্ছেন সেটা সম্পূর্ণ অমূলক এবং ভিত্তিহীনও বটে। আপনি হয়তো ভাবছেন, যেভাবেই হোক বিয়েটা তো হয়েই গেছে। এখন ওনি নিশ্চয় আমার উপর অধিকার খাটানোর জন্য ঝাপিয়ে পরবেন। না, মিস নুহা! আমার এসবে ইন্টারেস্ট নেই। বিশেষ করে আপনার মত পিচ্চি মেয়ের সাথে তো এসব করার প্রশ্নই উঠে না। আমি একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা শুরু করতে চাচ্ছিলাম। আর সেই গুরুত্বপূর্ণ কথাটা হলো রাত পোহালে আমাদের দু’জনের রাস্তা আলাদা হয়ে যাবে। আজকের পরে আমার সাথে আপনার কখনো দেখা হবে না। এ ব্যাপারে আপনি নিশ্চিত থাকুন।
কাঁপা গলায় প্রশ্ন করে নুহা। আর বিয়ে? ঐটার কি হবে? একটা বড়সড় নিশ্বাস ফেলে শুভ। মিস নুহা! বিয়েটা জাস্ট একটা এক্সিডেন্ট। আর সে এক্সিডেন্ট’টাও আপনার কারনেই হয়েছে। আপনি মানুষ না চিনে এক বখাটের সাথে এফবিতে ফ্রেন্ডশিপ করেছেন। তারপর স্কুল থেকে শিক্ষাসফরে এসে সেই বখাটের সাথে দেখা করেছেন। বখাটে আপনাকে একটা বানোয়াট কাহিনী শুনালো। আপনি সেই কাহিনী বিশ্বাস করে ফেললেন। শুধু বিশ্বাস করেই ক্ষান্ত হননি। ফ্রেন্ডস সার্কেল আর স্যারদের সবার চোখ এড়িয়ে বখাটের সাথে চলে গেলেন বখাটের অসুস্থ মাকে দেখার জন্য। ব্যাস, হয়ে গেল। ঘটে গেল ঘটনা। আপনি ওখানে গিয়ে জানতে পারেন বখাটে আপনাকে বানোয়াট কাহিনী শুনিয়ে ফাঁদে ফেলানোর চেষ্টায় ছিল এতদিন। আজ সফল হয়েছে। এদিকে কলেজের ছাত্র ছাত্রীদের সাথে নিয়ে আমিও সফরে এসেছি। সবুজের সমারোহ আর প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে দেখতে কখন যে গহীন অরণ্যে ঢুকে পরেছি, বুঝতে পারিনি। হঠাৎ করে আপনার চিৎকার শুনতে পেলাম। ছুটে গেলাম। বখাটে ছেলেটা চলে গেল দৌঁড়ে। স্থানীয় লোকজন এসে আমাকে আপনাকে নির্জন স্থানে দেখতে পেল। ঘটনা হয়ে গেল রটনা।ওরা বিয়ে পরিয়ে দিল। শুধু বিয়ে পরিয়েই ক্ষান্ত হয়নি। আমাদের বাবা মায়ের ফোন নাম্বার নেয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিল। মান সম্মান অবশিষ্ট বলে যেটুকু ছিল, সেটুকু বাঁচানোর জন্য কৌশল করে বন্ধুকে ভাই বানিয়ে ফেললাম। কল করলাম ওকে। ও আসল। আমাদের উদ্ধার করে ওর বাসায় আশ্রয় দিল। বোকামি করেছেন আপনি আর তার খেসারত গুনছি আমি। এখন আবার বলছেন, বিয়ে? গুষ্টি কিলায় এমন বিয়ের। সকালটা হোক। আপনাকে আপনার স্যারদের কাছে পৌঁছে দিয়ে আমি আমার রাস্তা মাপতো।
এটুকু বলে লাইট জ্বালিয়েই শুয়ে পড়ে শুভ। ক্ষাণিক বাদে মাথা উঁচু করে। প্রশ্ন করে নুহাকে। আচ্ছা কিসে পড়েন আপনি? দেয়ালের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে ফ্লোরে বসে পড়েছিল নুহা। শুভর প্রশ্নে মাথা তুলে তাকায়। জ্বি, আমি এইটে পড়ি। শুয়া থেকে উঠে বসে পড়ে শুভ। ‘কি? এইটে পড়েন আপনি? এইটে পড়া একটা বাচ্চা মেয়ে কি না ফেসবুক চালায়?’ দুঃখের মাঝেও হেসে দেয় নুহা। অামি তো ভালোই। এইটে পড়ি। অথচ আমাদের পাশের বাসার এক আন্টি আছে। ওনার ছেলেও এফবি চালান। ওনার ছেলে কিসে পড়ে জানেন? ভ্রু-কুঁচকে তাকায় শুভ। প্রশ্নবোধক জবাব দেয়, সেভেনে? খিলখিলিয়ে হেসে দেয় নুহা। আরে না, ক্লাস থ্রিতে। কপালে ভাঁজ পড়ে যায় শুভর। কিছু একটা বলতে যাবে তার আগেই ভেসে এলো নুহার প্রশ্ন। সাথে উত্তরও। তার কয়টা আইডি আছে জানেন? ৭টা। শুনবেন কি, কি আইডি? শুভ নুহার দিকে ফিরে তাকালো শুধু। শুভ’র উত্তরের অপেক্ষা না করে নুহা আঙ্গুল খাড়া করে গিটগুলো গুনতে লাগল-
১) অবুঝ বালক।
২) শান্ত বালক।
৩) দুষ্টু বালক।
৪) রোমান্টিক পোলা।
৫) ঢাকার কিং।
৬) বসন্ত বাতাসে, লুঙ্গি আকাশে।
৭) কিশোরগঞ্জের পোলা জিকু।
সাতটা নাম বলে নুহা আঙ্গুলের গিটগুলো আবারো প্রথম থেকে গুনা শুরু করে। শুভ সে দৃশ্য দেখে আনমনেই হেসে দেয়। প্রশ্ন করে নুহাকে। ‘তা তোমার সেই পাশের বাসার আন্টির ছেলে জিকুর সাথে তোমার কতদিনের রিলেশন?’ শুভ’র এমন প্রশ্নে নুহা হাত দিয়ে মুখ ঢেকে নেয় নুহা। তারপর লম্বা স্বরে বলে উঠে, এ্যা মা! এসব কি বলছেন? জিকু তো আমার ৫বছরের জুনিয়র। ওর সাথে আমার যায় নাকি? হেসে দেয় শুভ। আনমনেই বলে উঠে, বাব্বাহ! বেশ চতুর। প্রশ্ন করে নুহা। কিছু বলছেন? কথা ঘুরায় শুভ। ‘আমার বড্ড ঘুম পাচ্ছে, আমি ঘুমাচ্ছি। তুমি বরং আমায় পাহাড়া দাও বসে। ‘হু, আচ্ছা বলে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে পূর্বের ন্যায় দু’হাঁটুর ফাঁকের ভিতর মাথা রেখে নিচু হয়ে বসে পড়ে নুহা।
শুভ চোখ দুটো বন্ধ করবে তখনি খেয়াল হয় কথার ছলে নুহাকে সে হুট করে আপনি থেকে তুমি সম্বোধন করে ফেলেছে। চোখ মেলে তাকায় শুভ। উঠে বসে বিছানায়। ডাক দেয় নুহাকে। শুনোন… মাথা তুলে তাকায় নুহা। ধীর গলায় বলে উঠে শুভ- আমি, স্যরি। চোখ দুটো মার্বেলের মত গোলগোল করে ফেলে নুহা। ‘কেন? আর কিসের স্যরি?’ জবাব দেয় শুভ। আমি তোমাকে ভুলে তুমি ডেকে ফেলেছি। সে জন্য স্যরি। খিলখিল শব্দে হেসে উঠে নুহা। আপনি তো এখনো আমায় তুমি ডাকছেন। তবে মন্দ লাগছে না। আর এমনিতেও আমি আপনার থেকে কম করে হলেও ১০,১২বছরের ছোট হবো। তাই এ হিসেবে ডাকতেই পারেন। আপনি করে ডাকলে আমার আবার নিজেকে মুরুব্বী মুরুব্বী লাগে। হেসে দেয় শুভ। ঠিক আছে। আমি তোমাকে তুমি বলেই ডাকব। আচ্ছা, গুড নাইট। প্রতিউত্তরে ‘উম্মমমম, নাইট’ বলেই আবারো পূর্বের ভঙ্গিতে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে ফ্লোরে বসে পড়ে নুহা।
মাঝ রাত্রিতে ঘুম ভেঙে যায় শুভর। মনে পড়ে নুহা নামের সেই পাকনা বুড়িটির কথা। ভাবছে রাত তো অনেক হয়েছে। নিশ্চয় সোফায় শুয়ে ঘুমিয়ে পরেছে। সোফার দিকে তাকিয়ে হতাশ হয় শুভ। ফ্লোরের দিকে চোখ যেতেই দেখতে পায় সেই পূর্বের ন্যায় দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে, মাথাটা হাটুর ভিতর ঢুকিয়ে বসে আছে মেয়েটি। বাচ্চা বাচ্চা হাত দুটো সামনের দিকে ছড়ানো। দীঘল কালো কেশগুলো এলোমেলো অবিন্যস্ত ভাবে এদিক ওদিক ছড়ানো। না চাইতেও ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠে শুভর। বিছানা থেকে নেমে কাছে যাচ্ছিল। পায়ের শব্দে চুলগুলো আংশিক ফাঁক করে মাথা তুলে তাকায় নুহা। শুভকে এভাবে ওর দিকে আসতে দেখে ভয়ে জড়োজড়ো হয়ে যায়। ‘ওহ, জেগে আছ? আমি ভাবছি ঘুমিয়ে গেছ। এভাবে বসে ঘুমাচ্ছো, অসুবিধে হচ্ছে কি না! তাই ভাবলাম সোফায় শুইয়ে দেই।’ হেসে দেয় নুহা। না, না! আমি ঘুমাইনি। প্রশ্ন করে শুভ। এভাবে বসে থাকতে থাকতে তো মনে হয় ঘাড় ব্যথা হয়ে গেছে তোমার। না ঘুমালেও অন্তত সোফায় গিয়ে শুয়ে থাকো। জবাব আসে, মন খারাপের সময় আমি শুই না। এভাবেই বসে থাকি। এতে আমার চিন্তা কিছুটা সময়ের জন্য হলেও দুর হয়ে যায়। মনে মনে হেসে উঠে শুভ, ‘ওরে পাকনা বুড়িটা। এই বয়সে আবার চিন্তা।’ প্রশ্ন করে শুভ, তা এখন কিসের চিন্তা করছ? কার জন্য মন খারাপ? অপ্রত্যাশিত বিয়ের জন্য কি? গম্ভীর গলায় নুহার জবাব- মায়ের জন্য মনটা বড্ড পুড়ছে। পুনরায় প্রশ্ন করে শুভ। কোথায় থাকে তোমার মা? জবাব আসে, বিদেশ। কৌতূহলী মনে শুভ আবারো প্রশ্ন করে। সে কি! তোমার বাবা নেই? নুহার ছোট্ট জবাব, আছে। প্রশ্ন করে শুভ, তাহলে বাবা থাকতে মা কেন বিদেশ?
শুভর দিকে ফিরে তাকায় নুহা।
” আমার দাদা এক্সিডেন্টে মারা গেছে আমি যখন ফাইভে পড়ি তখন। আর এক্সিডেন্ট’টা মায়ের চোখের সামনেই হয়েছিল। সেই থেকে আমার মা পাগল। প্রথমে একটু একটু পাগলামি করত। পরে সম্পূর্ণ পাগল হয়ে যায়। চিকিৎসা করিয়েছে অনেক। কিন্তু ভালো হয়নি। বাধ্য হয়ে আব্বু শিক্ষকতার চাকরী ছেড়ে দিয়ে আম্মুকে নিয়ে বিদেশে উন্নত চিকিৎসার জন্য চলে যান। ২বছর হলো বিদেশে আম্মুর চিকিৎসা চলছে। এখনো আগের মতই পাগলামি করে। আমাদের ভাই-বোনদের কাউকে আর বাপজান, আম্মাজান বলে ডাকে না আম্মু। আব্বুর মুখেও আদিরা মামনি কিংবা নীলয় বাবাই ডাকটা আর আমরা শুনি না। বাসায় দাদিমা শুধু নীলয়কেই আদর করেন। আমি দেখতে মায়ের মত কালো হয়েছি। এই জন্য আমায় সহ্য করতে পারেন না ওনি। বলে কি, লেখাপড়া করে আর কি করবি? দেখতে তো একদম পাতিলের তলার মত। কে বিয়ে করবে তোকে? আমি কি করব বলুন। যে যা ক্রিমের কথা বলে, সেই ক্রিম’ই মুখে লাগাই। কিন্তু স্থায়ীভাবে ফর্সা আর হইনা। এটুকু বলে থেমে যায় নুহা। বোধ হয় গলাটা ধরে এসেছে কিংবা আর বলতে পারতেছে না। অদুরে বসে থাকা শুভর চোখ দুটিও কখন যে জলে ভিঁজে একাকার হয়ে গেছে, সে নিজেও জানে না।
চলবে….