ফুলশয্যা_সিজন(০৩)
পর্ব- ১৬
লেখা- অনামিকা ইসলাম।
সকালে ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসে শুভ এদিক ওদিক করতে থাকে। চোখ দেখে মনে হচ্ছে যেন কাউকে খুঁজছে। সেটা দেখে হিয়ার প্রশ্ন-
” কিরে! কাউকে খুঁজছিস?”
আমতাআমতা করে শুভর জবাব, ইয়ে ফুপ্পি! আর সবাই কোথায়?
চারিদিকে চোখ বুলিয়ে হিয়ার স্বামী হৃদয়ের জবাব, ‘কই! সবাই তো এখানে উপস্থিত আছে…’
শুভ পুনরায় এদিক ওদিক তাকাতে থাকে। তারপর অনেকটা নিচু গলায় জবাব দেয়- ইয়ে মানে! ফারহানাকে যে দেখছি না…?
শুভর মুখে ফারহানার নাম শুনে চমকে উঠে সবাই। হিয়া’তো ভাত মুখে দিতে গিয়ে রীতিমত বিষম খায়।
হৃদয় পানির গ্লাসটা স্ত্রীর দিকে এগিয়ে দিতে অনেক বিস্মিত গলায় প্রশ্ন করে-
‘শুভ? তুই সত্যি সত্যি ফারহানাকে খুঁজছিস তো?’
ভ্রু-কুচকে শুভর জবাব, হ্যাঁ, আমি ফারহানাকে খুঁজছি। কেন? কোন সমস্যা?
ক্ষাণিক কেশে হিয়ার জবাব, আরে না, না! সমস্যা কেন হবে? আসলে জানতে চাচ্ছিলাম হঠাৎ
করে এভাবে ফারহানাকে কেন খুঁজছিস?
স্বাভাবিক গলায় শুভর জবাব, শপিংয়ে যাবো…
আনন্দে পারলে লাফ দিতে পারছে না ফারহানার মা। এতক্ষণ টেবিলে বসে থেকে সবার সব কথা নিরবে শুনে গেলেও আর চুপ থাকতে পারছে না।
আর এত বড় একটা সু-সংবাদ শুনার পর চুপ থাকতে পারার কথা’ও নয়। তাই অনেকটা জোর গলায় বলে উঠে-
— বাবা! ও তো ঘরেই আছে। ভালো করছো বাবা। ও অনেকদিন ধরে বাহিরে যায় না।
— হু, সেই জন্য’ই তো এ সিদ্ধান্ত।
— এখানে কি খায়, না খায় সেটাও জানি না। তুমি তো ওকে এখানে আসতে মানা করেছ। বলছিলাম কি ফেরার পথে ওকে নিয়ে কোন ভালো রেস্টুরেন্ট থেকে লাঞ্চটা করে এসো।
— জনমের লাঞ্চ করাবো আজকে…(বিড়বিড় করে)
— কিছু বললে বাবা?
— বলছিলাম কি- আমার ব্রেকফাস্ট করা শেষ। ওকে একটু ডাকুন। আমার এখনি বেরোতে হবে।
— ঠিক আছে বাবা! আমি এখনি ডাকছি…
“ফারহানা মা, কইরে….”
ফারহানাকে ডাকতে ডাকতে ওর মা উপরের দিকে চলে যায়।
টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় নুহা। পাশ থেকে দাদীমার প্রশ্ন- ‘সে কি! তুইও উঠছিস যে?”
নীচু গলায় নুহার জবাব, আমার জরুরী কাজ আছে দাদীমা!
এবার হিয়ার প্রশ্ন- ব্রেকফাস্ট’টাতো করে যা…
— না, আন্টি! আমার এখনি যেতে হবে।
— দাঁড়া, তোর আংকেল তোকে পৌঁছে দিবে।
— না, আমার এখনি বের হতে হবে।
— আচ্ছা, যা ভালো মনে হয়…
নুহা দ্রুত হেঁটে উপরতলায় চলে যায়। চটজলদি বোরকা পরে রেডি হয়ে নেয়। হিয়া’রা তখনো টেবিলে বসে ব্রেকফাস্ট করছে। বিনীত ভঙ্গিতে নুহা সবাইকে জানায়- “আমি তাহলে আসি। আসসালামু আলাইকুম…”
সালাম দিয়ে রুম থেকে বের হয়ে যায় নুহা। ডেকে আনে রাস্তার ওপাশ থেকে এক সিএনজিওয়ালাকে।
তারপরের কথোপকথনঃ-
” কোথাও যাবেন, আপা?”
— হু…
— কোথায়?
— একটু দাঁড়ান আপনি…
— দাঁড়িয়ে তো আছি’ই। কোথায় যাবেন আপনি সেটা তো বললেন না।
— ২মিনিট পর বলছি…(এদিক ওদিক তাকিয়ে)
— আপা কি সত্যিই কোথাও যাবেন, নাকি মস্করা করার জন্য ডেকে এনেছেন?
— চলেন…
— কোথায় যাবো?
— ঐযে সামনের ঐ গাড়িটাকে ফলো করেন।
— ওহ, আচ্ছা!
— হু, দ্রুত চলেন…
শুভ চলছে ফারহানাকে সাথে করে সামনের দিকে। তাদের ফলো করে পিছন দিয়ে যাচ্ছে নুহা। যদিও রাতে হোস্টেলে চলে যাবার ব্যাপারে ফাইনাল কথাবার্তা হয়ে গিয়েছিল হিয়ার সাথে। কিন্তু ভোরে কি মনে করে যেন নুহা হিয়াকে না করে দেয়। বলে দেয়- ‘আপাতত হোস্টেলে যাবে না। গেলেও ঈদের পর যাবে…’
যায় হোক! যে কথাটি বলছিলাম। শুভর গাড়ির পিছু নিয়ে একসময় নুহা কাঙ্খিত গন্তব্যে পৌঁছে যায়। সিনএনজি ওয়ালা ধীর গলায় জানায়-
‘ ঐতো, তারা শপিংমলের সামনে নামলো…’
‘ঠিক আছে। আমার গন্তব্যও তাহলে এটাই।’ নুহা সিএনজি থেকে নেমে সিএনজিওয়ালাকে ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে একটা বিল্ডিংয়ের আড়ালে দাঁড়ায়।
এদিকে শুভ গাড়ি থেকে নেমে অনেকটা অস্বস্তির সাথে, ভেতরে বিরক্তি পুষে নিয়ে ফারহানাকে কোলে করে বাহিরে বের করে হুইলচেয়ারে বসিয়ে দেয়।তারপর হাসোজ্জল মুখে হুইলচেয়ার ঠেলে, ফারহানাকে সাথে করে ভিতরে ঢুকে শুভ।
চোখের জল মুছতে মুছতে আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে নুহা। এ দৃশ্য দেখার পর সামনে এগিয়ে যাওয়ার সমস্ত শক্তি হারিয়ে ফেলেছে সে। তারপরও বহুকষ্টে, ভারাক্রান্ত মনে পিছু নেয় শুভদের।
শপিংমলের দোকানে দোকানে শুভ ফারহানাকে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর কেনাকাটা করছে। কখনো কখনো হেসে কুটিকুটি হয়ে যাচ্ছে।
ভেতরটা ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে নুহার। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে ওর। কিন্তু পারছে না। ছোট্ট বাচ্চাদের ন্যায় ঠোঁটজোড়া কেবল মৃদু কাঁপছে ওর। মনে হচ্ছে কিছুক্ষণের ভেতর কান্না চলে আসবে। না, না! আমি আর পারছি না এভাবে কান্না লুকাতে।
দৌঁড়ে শপিংমল থেকে বেরিয়ে যায় নুহা।উত্তেজিত নুহা কান্না করতে করতে কখন যে রাস্তার মাঝখানে চলে এসেছে টের পায়নি। যখন টের পায়, তখন খুব কাছ থেকে একটা গাড়ির হর্ণের আওয়াজ ভেসে আসে। ভয়ে দৌঁড় দেয় নুহা। গাড়িটি তার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে নুহাকে একটা ধাক্কা দেয়।
মাথায় প্রচন্ড ব্যথা অনুভূত হয় নুহার। মনে হচ্ছে কেউ যেন কোন ভারী পাথর দিয়ে মাথায় আঘাত করেছে। আশেপাশে অনেক মানুষের শোরগোলের আওয়াজ ভেসে আসছে।
এটুকুই… এর বেশী কিছু শুনতে পায়নি নুহা। তার আগেই জ্ঞান হারায়।
শপিংমল থেকে বের হয় শুভ’রা। রাস্তার পাশেই রক্তের স্তুপ জমে আছে। চেঁচিয়ে উঠে ফারহানা। একরাশ বিরক্তি নিয়ে শুভ ফারহানার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়- ” কি? সমস্যা কি?”
ফারহানা ওর আঙ্গুল দিয়ে রক্তের দিকে ইঙ্গিত করে। শুভ ডানে ফিরে তাকায়। রক্ত দেখে শুভ নিজেও ভড়কে যায়। এত রক্ত? কোন মানুষের শরীর থেকে বের হয়েছে? না জানি কতটা আঘাত পেয়েছে মানুষটা…!
পাশ থেকে ফারহানার জবাব, দেখছ! গরু জবাই করার মতই রক্ত। একদম তরতাজা। মনে হয় এই মাত্র এক্সিডেন্ট হয়েছে। বাঁচবে না মনে হয়।
চেঁচিয়ে উঠে শুভ, চুপ করো। আর ফালতু, অলক্ষুণে কথা বলা থেকে বিরত থাকো।
কথা বাড়ায় না ফারহানা। হুইলচেয়ারে করে শুভর সাথে করে ওপাশে যায়। অতঃপর শুভর কোলে উঠে গাড়ির ভেতরে পৌঁছে।
গাড়ি স্টার্ট দেয় শুভ। বাসার ঠিক বিপরীত দিকে গাড়ি চলছে। আনন্দে আত্মহারা ফারহানা প্রশ্ন করে শুভকে- ” আচ্ছা, আমরা কোন রেস্টুরেন্টে যাচ্ছি?”
ব্যাঙ্গাত্বক গলায় শুভর জবাব, আহা, রেস্টুরেন্ট!
রেস্টুরেন্টে যাবে। শুভর কোলে চড়ে রেস্টুরেন্টে যাবে মহারানী। শখ কতো…
কিছুটা ভয় পেয়ে যায় ফারহানা। প্রশ্ন করে শুভকে, তুমি আমার সাথে এভাবে কথা বলছ কেন শুভ?
— হারামজাদী! কথা কম বল…
— শুভ! কোথায় যাচ্ছি আমরা? কিছু তো বলো?
— কোর্টে…
— কো…কো…কোর্টে মানে?
— অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করার জন্য…
— মানে?
— ঝুলিয়ে রাখা সম্পর্ককে চিরতরে শেষ করে দেয়ার জন্য…
— না, শুভ। এটা হয় না। তুমি এটা করতে পারো না।
— সবই হবে। হতে বাধ্য।
— গাড়ি থামাও শুভ।
— চুপ করে বসে থাক।
— শুভ প্লিজ গাড়ি থামাও।
— ……..
— আমি কিন্তু গাড়ি থেকে লাফ দিচ্ছি।
কোর্টের সামনে এসে প্রচন্ড ঝাঁকুনিতে শুভ গাড়িটা থামায়। দম নেয়ার টাইম পায়নি শুভ। তারআগেই গাড়ির দরজা খুলে বাহিরে বের হয়ে যায় ফারহানা। হা করে তাকিয়ে আছে শুভ। এ যে এক সুস্থ, স্বাভাবিক ফারহানা। রাগে রীতিমত ফুসছে সে। গাড়ি থেকে বের হয়ে আসে শুভ।
— How Funny! ফারহানা তুমি ভালো হয়ে গেছ?
— হ্যাঁ, ভালো হয়ে গেছি।
— সিনেমায় দেখতাম স্মৃতিহারা মানুষের গাড়ি কোন কিছুর সাথে ধাক্কা খেলে মানুষটা স্মৃতি ফিরে পায়।
এখন তো দেখছি পা হারা মানুষও তাদের পা ফিরে…
— বন্ধ করো তোমার জোকস বলা।
— ইটস ওকে! এই দ্যাখো! একদম চুপ হয়ে গেছি। এখন চলো তো…
— আমি ভিতরে যাবো না।
শুভ কাছে যাওয়ার আগেই রাস্তা বরাবর দৌঁড় দেয় ফারহানা। একটা গাড়ি বিকট শব্দে ফারহানার পাশে এসে থামে। ভয়ে থমকে দাঁড়ায় ফারহানা। কানে হাত দিয়ে রাস্তার মধ্যিখানেই দাঁড়িয়ে আছে। এদিকে বাসের ড্রাইভার ফারহানাকে যাচ্ছে তাই বকে যাচ্ছে। একটা শয়তানি হাসি দিয়ে শুভ ফারহানাকে রাস্তার পাশে নিয়ে আসে। ফারহানা তখনো দু’হাত দিয়ে কান ঢেকে রেখেছে।
— ভয় পাওয়ার কিছু নেই আর। চলো…
— না, আমি যাবো না।
কোন কথা ছাড়া’ই শুভ ফারহানাকে টানতে টানতে ভেতরে নিয়ে যায়। পরিচিত লোকগুলোর সামনে গিয়ে হাজির হয়। পূর্বেই শুভ- ফারহানার ডিভোর্সের প্রয়োজনীয় সকল কাগজপত্র প্রস্তুত ছিল। বাধ্য ফারহানা একসময় নিজের হার মেনে নেয়। তারপর সবার উপস্থিতিতে ডিভোর্সের সমস্ত কার্যক্রম সম্পূর্ণ হয়। আলাদা হয়ে যায় শুভ-ফারহানার পথ চলা।
কোর্টের সমস্ত কার্যক্রম শেষ করে ফারহানাকে বাসার সামনে পৌঁছে দিয়ে অফিসের দিকে চলে যায় শুভ। যাওয়ার আগে অবশ্য ফারহানাকে বলে গেছে- “আজ রাতটাই! তারপর সকালে যাতে কোন কথা ছাড়া’ই এ বাসা খালি পাই…”
চলবে…