ফুলশয্যা_সিজন(০৩)
পর্ব- ১৫
লেখা- অনামিকা ইসলাম।
রুমে ঢুকে নুহা। খাটের একপাশে হিয়া আন্টিকে বসে থাকতে দেখে চমকে যায় সে। কিছুটা তোতলাতে তোতলাতে প্রশ্ন করে- ‘আআআনটি আপনি? ককখন আসলেন?
স্বাভাবিক গলায় হিয়ার জ্ববাব, অনেকক্ষণ’ই হলো। দেখলাম শুভর সাথে কথা বলছিস। তাই ডাকিনি। ভাবলাম রুমে এসে বসি….
আমতাআমতা করতে থাকে নুহা। “শুভভাইয়াহ্যাঁআসলেইয়েমানেআমি।”
– সমস্যা কি তোর? এভাবে ঘামছিছ কেন?
— ইয়ে, না মানে….
– আমার পাশে বসতো।
— …………
– এবার বল কি হয়েছে তোর?
— আন্টি। আমি এমনি। কিছু হয়নি।
– কিছু হয়নি তবে হোস্টেলে কেন থাকবি?
— ওহ, বাবা তোমাকে বলেছে?
– হ্যাঁ! আমাকে ফোন করে জানিয়েছেন…
— আসলে আন্টি হোস্টেলে থাকলে…(….)….???
– হ্যাঁ, বল। আমিও শুনতে চাচ্ছি।
— আসলে আন্টি ঐখানে থাকলে ঠিকঠাক মতো পড়াশুনা করতে পারব আর আমার রেজাল্টও ভালো হবে।
– এখানে করতে মানা করছে কে?
— কেউ না।
– তবে? তোকে আমরা রান্নাবান্নার সকল দায়িত্ব দিয়ে দিয়েছি, তাইতো?
— এসব কি বলছেন আন্টি?
– এসব আমি নয়, তুই বলছিস। আমাকে দিয়ে বলাচ্ছিস।
— আন্টি রেগে কেন যাচ্ছেন?
– রাগিনি। রাগবোও না। তুই শুধু একটা কথা সত্যি করে বল, আমার অবর্তমানে এ বাড়ির কেউ তোকে কষ্ট দিয়েছে কি?
— না, আন্টি। এরকম কিছু হয়নি।
– তবে?
— হয়েছে একটা জিনিস…
– কি হয়েছে সেটাই তো জানতে চাচ্ছি।
— না, না! বলা যাবে না সে কথা…
– তুই কি আমার সাথে রসিকতা করছিস?
— ছি, ছি! এসব কি বলছেন?
– মনে তো হচ্ছে সেটাই।
— আসলে আন্টি কথাটা আপনাকে বলা যাবে না।
– কি এমন কথা যা আমাকে বলা যাবে না?
— বাদ দেন না।
– তোর কি শারীরিক কোনো সমস্যা হয়েছে?
— না, না আন্টি। সেরকম কোন সমস্যা নেই।
– তবে?
— সমস্যাটা মানসিক।
– আমাকে বলবি? নাকি আঁখিকে পাঠাবো?
— না আন্টি।
– তাহলে বর্ণিতা না করে বলে ফেল…
— আমার কিচ্ছু ভালো লাগে না আন্টি। ওরা আদনানকে আমার কাছে দেয় না।
– ওহ, গড! এই কথা?
— রাত্রে ঘুম হয় না। খুব কষ্ট হয়।
– আর তাই সেই কষ্ট নিরসনের জন্য হোস্টেলে চলে যেতে চাচ্ছিস, তাই তো?
— কষ্ট নিরসনের জন্য নয় আন্টি। আমার এমনিতেও ভালো লাগছে না। পড়াশুনায় মন টিকছে না। মনে হচ্ছে হোস্টেলে গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে। সবার দেখাদেখি আমিও কিছু পড়তে পারবো।
– ঠিক আছে। আর মাত্র পনেরো দিন আছে। তারপরেই তো রোজা শুরু। তুই বরং ঈদের পর যা…
— না, আন্টি। আমার আর একমিনিট সময়ও নষ্ট করতে ইচ্ছে হচ্ছে না। আমি কালকেই যেতে চাচ্ছি।
– ঠিক আছে। আমি তবে হোস্টেল সুপারকে ফোন দিয়ে জেনে নেই খরচের ব্যাপারে।
— আচ্ছা।
– ঘুমা তাহলে। সকালে উঠে জিনিসপত্র গুছিয়ে নিস। আসি…
— আল্লাহ হাফেজ।
হিয়া চলে যায়। বালিশ কোলে নিয়ে, খাটে হেলান দিয়ে বসে আছে নুহা। বড্ড কান্না পাচ্ছে ওর। এ বাড়ি থেকে চলে যাবে ভাবতেই চোখ জলে ভরে গেছে। কিন্তু ফারহানা এ বাড়ি থেকে যাচ্ছে না। শুভও হাত পা গুটিয়ে বসে আছে। আদনানকে আগের মতো আপন করে কাছে পাবে না। এ ব্যাপারটা’য় নুহাকে বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার ইন্দ্রন জুগিয়েছে।
অনেক রাত হয়েছে। ভোরে উঠতে হবে আবার। কালবিলম্ব না করে তাই বিছানায় গা এলিয়ে দেয় নুহা।
চোখটা প্রায় লেগে এসেছিল। তখনি দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হয়। বিছানায় উঠে বসে নুহা। এতরাত্রে কে এসেছে? ভাবতেই আবারো কড়া নাড়ার আওয়াজ পায়।
নুহা নেমে যায় বিছানা থেকে। ওড়নাটা সুন্দর করে নববধূদের ন্যায় মাথায় এবং শরীরে জড়িয়ে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে যায় দরজার দিকে।
দরজার একদম কাছে গিয়ে কাঁপা গলায় প্রশ্ন করে, কে?
বাহির থেকে ভেসে আসে, ‘আমি…’
শুভর কন্ঠ শুনে চমকে যায় নুহা। ভাবতে থাকে- এত রাতে ওনি আবার কি মনে করে? দরজায় আবারো কড়া নাড়ার শব্দ হয়। ভাবনা জগত থেকে ফিরে আসে নুহা। দরজাটা খুলে দেয়।
– ডিস্টার্ব করলাম মনে হয়। স্যরি…
— না, না। ইটস ওকে।
– এটা কি তোমার? (হাতে একটা কানের দুল)
— হ্যাঁ, কোথায় থেকে পেয়েছেন এটা?(কানে হাত দিয়ে অবাক হয়ে)
– আমার শার্টের বোতামের মধ্যে আটকে ছিল।
— ওহ…(লজ্জায় নিচু হয়ে যায়)
নুহার লজ্জানত মুখের দিকে তাকিয়ে আছে শুভ। লজ্জায় মুখমন্ডল কিরকম লাল হয়ে গেছে। বোধ হয় তখনকার কথা ভেবে লজ্জা পাচ্ছে।
‘ওহ, হ্যাঁলো! শুনতে পাচ্ছেন?’
ডাক দেয় নুহাকে। নড়ে উঠে নুহা। শুভর দিকে না তাকিয়েই হাত বাড়িয়ে দেয় সামনের দিকে।
কিচ্ছু বলেনি শুভ। নুহার হাতে দুলটা রেখে নিঃশব্দে নিজ রুমে চলে যায়।
দরজা বন্ধ করে বিছানায় গিয়ে ধপাস করে বসে পড়ে নুহা। এই মানুষটাকে ছেড়ে চলে যেতে হবে, ভাবতেই নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে ওর। চোখজোড়া বোজে ঘন ঘন নিশ্বাস নিচ্ছে নুহা। একটা অচেনা কষ্ট ওর ভিতরটা কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে।
‘ওনার জন্য আমার এরকম লাগছে কেন? ওনি আমার কে? ভালোবাসা? কখনো তো মুখে বলেনি! আচ্ছা, ওনি তো বলেছেন আমাকে নাকি বিশ্বাস করেন। তবে কি ওনি আমাকে ভালোবাসেন? ধূর! কিসব ভাবছি। বিশ্বাস আর ভালোবাসা তো এক জিনিস হতে পারে না…’
এরকম হাজারো প্রশ্ন আনমনে নুহা নিজে নিজেকে করে। কোন প্রশ্নের সঠিক কূল কিনারা সে পায়নি। ভাবতে ভাবতে একসময় ক্লান্ত নুহা তলিয়ে যায় গভীর ঘুমে।
সকালে দরজায় কড়াঘাতের আওয়াজে ঘুম ভাঙ্গে। বাহির থেকে হৃদয় আঙ্কেল ডাকছেন। ‘কই নুহা মা! আজান দিয়েছে। নামাজ পড়বে না? উঠো…’
চটজলদি বিছানায় উঠে বসে নুহা। জ্বি, আঙ্কেল। উঠছি। আপনিও এখন যান। নামাজ পড়ে আসেন।
হৃদয় চলে যায়। যাওয়ার আগে বলে যায়, আঁখি এবং হিয়াকেও ডেকে উঠানোর জন্য।
দরজা খুলে নুহা। শরীর টানা দিতে দিতে আঁখির রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। দরজায় নক করবে তখনি পাশের অই কিচেন থেকে ভেসে আসে কারো গলা।
“আরো বেশি কষ্ট দিচ্ছো না কেনো
তবেই না নষ্ট হওয়াতে আনন্দ…”
আঁখি আপু না? থমকে দাঁড়ায় নুহা। ভিতরটা শিউরে উঠে ওর। তবে কি আমার ধারনায় ঠিক? আঁখি আপু সত্যিই কোন মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে আছে। কিন্তু কে দিচ্ছে এই যন্ত্রণা? আর কাকেই বা বলছে এ কথা? নিষিদ্ধ কোন সম্পর্কে জড়িয়ে গেলো না’তো?
কিচেন থেকে চাপা কান্নার আওয়াজ ভেসে আসে। ভাবনাচ্ছেদ ঘটে নুহার। দ্রুত কিচেনের দিকে এগিয়ে যায়। ফোন হাতে গাল গড়িয়ে পরা জলটুকু মুছছে আর ডায়েরী থেকে একটা একটা পাতা ছিড়ে আগুনে জ্বালিয়ে দিচ্ছে।
কাছে গিয়ে কাঁধে হাত রাখে নুহা। চোখের কোণে জমে থাকা জলটুকু দ্রুত মুছে নিয়ে পিছু ফিরে তাকায় আঁখি।
– ওহ, নুহা…!
— হু, আমি। কাঁদছো কেন?
– কই কাঁদছি না তো।
— আমি স্পষ্ট দেখছি তুমি কাঁদছ আর…
– রুমে যা নুহা। ভালো লাগছে না আমার।
— ভালো লাগানোর জন্যই তো এলাম।
– মানে?
— নামাজ পড়বে, আসো…
– তুই যা। আমি একটু পর….(…..)….???
— একটু পর না। এখন আসো।
– উফফ! একটু শান্তিতে থাকতে দে।
— নামাজ মানুষের মনে শান্তি আনয়ন করে, জানো কি?
– ঠিক আছে, চল…
হিয়া আন্টিকে জাগিয়ে নামাজে দাঁড়িয়ে পড়ে নুহা। পাশেই দাঁড়ায় আঁখি। নুহার নামাজ শেষ সাথে সাথেই। কিন্তু আঁখি সেই কখন থেকে মোনাজাতের ভঙ্গিতে বসে আছে। মোনাজাত শেষ হওয়ার নাম নেই।
নুহা গভীর দৃষ্টিতে আঁখির দিকে তাকায়। আঁখির চোখের জলে গাল ভিঁজে একাকার হয়ে গেছে। চোখ মুখ ফুলে গেছে। ভিষণ অদ্ভত রকম দেখাচ্ছে তাকে। না জানি মানুষটার ভিতর দিয়ে কতবড় ঝড় বয়ে যাচ্ছে।
‘ কিরে? এভাবে কি দেখছিস?’ ভাবনাচ্ছেদ ঘটে নুহার। ফিরে তাকায় আঁখির দিকে। ওহ, আপু। তোমার হলো?
– হু…
— মনটা কি খুব খারাপ?
– না।
— খুব বেশী খারাপ থাকলে কোরআন তেলওয়াত করো কিছুক্ষণ যেহেতু অজুটা আছে…
– না, এখন অনেকটাই ভালো লাগছে।
— আরো ভালো লাগবে, এক দুই পাতা কুরআন তেলওয়াত করে নাও।
– আমার ভালো লাগছে নুহা।
— এটা আমি তোমার খারাপের জন্য বলছি না আপু। পড়লে তোমার’ই উপকার।
– আসলে নুহা আজ আমি কুরআন তেলওয়াত করতে পারবো না।
— ঠিক আছে। তুমি তাহলে আমার পাশে বসো। আমি কুরআন তেলওয়াত করবো, তুমি সেটা শুনো।
– আচ্ছা…
নুহা কুরআন তেলওয়াত করছে আর আঁখি গভীর মনোযোগের সহীত সেটা শুনছে। মিনিট দশেক পর রুমে ঢুকে আদনান। দৌঁড়ে এসে দু’জনের মাঝখানে বসে।
কুরআনটা বন্ধ করে নুহা ফিরে তাকায় আদনানের দিকে। আদনান বিনীত ভঙ্গিতে নুহাকে সালাম দেয়-
” আসসালামু আলাইকুম, আম্মু…”
চমকে যায় আঁখি। ফিরে তাকায় নুহার দিকে। নুহাও যে অবাক হয়নি, তাও কিন্তু নয়।
” ওয়ালাইকুম আসসালাম, বাবা…”
কুরআন মাজিদে চুমু খেয়ে যথাস্থানে রেখে দিয়ে ছোট্ট আদনানকে কোলে তুলে নেয় নুহা। তারপর আদনানের কপালে একটা চুমু খায়।
পাশ থেকে আঁখির প্রশ্ন-
” আদনান বাবা! তোমাকে আসসালামু আলাইকুম বলা কে শিখিয়েছে?”
আদনানের ছোট্ট জবাব, আম্মু…
আঁখি ফিরে তাকায় নুহার দিকে। স্মিতহাস্য নুহার জবাব, আসলে সেদিন সকালে হিয়া আন্টিকে যখন সালাম দিয়েছিলাম তখন ও সাথেই ছিল। তারপর যা বললো- “আম্মু তুমি আসসালাম কও ক্যা?”
– কি?
— ইতটু আগে নানুরে কি কইছ? আব্বুরেও একদিন কইছিলা…
– কইছিলা নয় বলছিলা, বাবা…
— তুমি আসসালাম কও ক্যা?
– ওহ, আচ্ছা! এটাকে সালাম বলে বাবা। সালাম দিলে আল্লাহ খুশি হয়।
— আমিও আসসালাম বলবো আম্মু।
– ঠিক আছে বাবা। আগে শিখে নাও। তারপর…
আঁখি একটা বড়সড় নিশ্বাস ফেলে। নুহা জানায়-
” তারপর থেকে ওকে সালামটা শিখাতে থাকি। ঠিকঠাক উচ্চারণ করতে পারতো না কখনো। কিন্তু আজ এ কেমন কারিশমা দেখালো…?”
চলবে…