ফুলশয্যা_সিজন(০৩)
পর্ব-১৪
লেখা- অনামিকা ইসলাম।
কাঁদতে থাকে আদনান। ওকে যে করেই হোক বিষ দিতেই হবে। সবার শত নিষেধ, শত কথার পরও ও কিছুতেই কারো বুঝ মানছে না।
চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল নুহা। কাছে আসে আদনানের। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে দু’গাল স্পর্শ করে। ‘বাবা! এসব খেতে নেই। এইসব পঁচা খাবার। খেলে অসুখ হয়…।’
– আব্বু কেন বলল তখন?
— কি বলছে?
– বিষ খেতে।
— তোমার আব্বুর ভুল হয়ে গেছে।
– খিদে লাগছে। ভাত খাবো।
— আসো। চেয়ারে আসো….
বাড়ি ভর্তি মানুষের কারো কথা শুনেনি। অথচ নুহার দু’কথায় শান্ত হয়ে যায় ছোট্ট আদনান। তারপর আর কোন কথা বলতে হয়নি। কোন কথা ছাড়াই চুপচাপ খাবার খেয়ে উপরে রুমে চলে যায়।
একে একে সবাই টেবিল ছেড়ে চলে যায় শুভ নুহা ছাড়া। শুভও উঠছিল। পাশ থেকে ধীর গলায় বলে উঠে নুহা। ‘কাজটা আপনি ঠিক করেননি।’
থমকে দাঁড়ায় শুভ। নিচু গলায় জবাব দেয়।
– আসলে মন মেজাজ ভালো ছিল না।
— হুটহাট রাগ করা ভালো না। রাগটা আসার সময় হয়তো টের পাওয়া যায় না। কিন্তু যাওয়ার সময় টের পাওয়া যায় কতটা ক্ষতি হয়েছে।
– জানি।
— জানেন বলেই তো আজ এতবড় একটা ভুল করে ফেলেছেন।
– বিষটা আসলে ওকে নয় ঐ ফাজিল মহিলাকে খাওয়ানো উচিৎ।
— জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে সবই আল্লাহর হাতে। বিধির বিধান লঙ্ঘন করার চেষ্টাও করবেন না কখনো। তওবা করে দ্রুত আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে নেন।
– কিসের ক্ষমা? ঐ মহিলা তো একটা কীট। যে সংসারে যাবে অশান্তি বয়ে যাবে। ওকে মেরে ফেললে আমার সওয়াব হবে।
— হে আল্লাহ রহম করেন আপনার এই বান্দাটার উপর। সদয় হোন আপনি তার প্রতি।
– ভুল কিছু বললাম কি?
— মহাভুল। সংসারের শান্তি আনয়নের জন্য কোথাও মানবহত্যার বিধান নেই। তার জন্য আল্লাহ আছেন। আপনি তার কাছে সাহায্য চান। নিরাশ হবেন না।
– কিন্তু আমার তো একে সহ্য হচ্ছে না একদম।
— একটা কথা বলব?
– জ্বি, বলো…
— ওনি কি সত্যিই ব্যাংক ম্যানেজারের হাত ধরে চলে গিয়েছিলেন?
– কেন? সন্দেহ আছে?
— সেটা নয়। প্রশ্নটা হলো আপনি কিভাবে জানলেন ওনি অন্যের হাত ধরে বাড়ি ছেড়েছে?
– আমার বন্ধু বলেছে।
— আপনি অন্যের কথায়…(…..)….???
– আমার বন্ধুই ওর বর্তমান হাজবেন্ড।
–হায় আল্লাহ! এসব কি বলছেন?
.
– হ্যাঁ। আমরা প্রেম করে বিয়ে করেছিলাম। খুব ভালো আন্ডারস্ট্যান্ডিং ছিল আমাদের মধ্যে। শত ব্যস্ততার মাঝেও সময় বের করে আমি ওকে নিয়ে এখানে ওখানে ঘুরতে যেতাম। এভাবেই কাটছিল আমাদের দিন। হঠাৎ ও অসুস্থ হয়ে পড়ে। ওকে আমি আমার থেকেও বেশী ভালোবাসতাম। অফিস কামাই করে আমি ওর সেবাযত্ন শুরু করি। একসপ্তাহ পর যখন আমি অফিসে যাই তখন বস আমাকে কাজ থেকে বের করে দেয়।
–মানে কি? আপনি সাতদিনে একবারও ওদের সাথে কথা বলেননি? মানে ফোনে যোগাযোগ করেননি?
– নাহ! এতবেশী চিন্তিত ছিলাম যে ভুলে গেছিলাম আমি ইহজাগতিক সবকিছু।
–তারপর?
– একবছর পর আদনান আসে পৃথিবীতে। তখনো আমার চাকরী হয়নি। চেষ্টা যে করিনি তাও কিন্তু নয়।
–কলেজে জয়েন করলেন কখন?
– তখনি। বন্ধু রুহুলের অনুরোধে গেস্ট টিচার হিসেবে জয়েন করি ওর কলেজে। ফাঁকে ফাঁকে চাকরীর ইন্টারভিউও দিতে থাকি।
— তখন সংসার কিভাবে চলতো?
– আমার বন্ধু যে ব্যাংকে জব করত সে হুট করে হাতেমতাই হয়ে যায়।
— মানে?
– মানে ও আমার দুর্দিনে সুপারম্যানের মতই আমার পাশে এসে দাঁড়ায়। আমাকে টাকা দিয়ে হেল্প করে।
— ওরা পালিয়েছে কখন?
– তিনমাস পর।
— ওদের পরিচয়টা কি তিনমাসেরই ছিল?
– জানি না।
— আপনি কিছুই টের পাননি?
– শেষের দিকে কিছুটা টের পেয়েছিলাম।
— কিভাবে?
– ফারহানার ফোনে কথা বলার মাত্রাটা বেড়েই চলছিল।
— মায়ের সাথেও তো কথা বলতে পারে।
– গভীর রাতে? কি এমন দরকার?
— ঘুম থেকে উঠে গিয়ে কথা বলত?
– হু।
— কি সমস্যা জিজ্ঞেস করেননি ওনাকে?
– করেছিলাম। ভুলভাল জবাব দিত।
— যেমনঃ
– ও আমাকে বলে, বিশ্বাস করো। চাকরী সংক্রান্ত বিষয়ে আপনজনদের সাথে কথা বলছি। বলেছিলাম আমি, এ বিশ্বাসের অমর্যাদা করো না। ও আমার গা ছুঁয়ে তারউপর বিশ্বাস রাখতে বলল।
— সত্যিই কি রেখেছিলেন বিশ্বাস?
– ওর উপর বিশ্বাস আমি রেখেছিলাম। কিন্তু যখন দেখলাম মোবাইলে কথা বলার সময় সে হাসিখুশি থাকত। কথা বলার শেষ হলে সে বিরক্ত হতো। সময়ে অসময়ে ছোট্ট অবুঝ শিশুকে বিছানায় ছুঁড়ে মারত। তখন থেকে তার প্রতি বিশ্বাস আমার কমতে লাগলো।
— তারপর?
– ধৈর্য্যের বাধ ভেঙে গেলে মানুষের হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। আমারও একসময় ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটল। ক্ষুব্ধ
হয়ে তার কাছে জিজ্ঞাসা করলাম, কার সঙ্গে কথা বলো, কি কথা বলো? এতে সে বিরক্ত হলো। এমন ভাব দেখাল, যেন আমাকে বিয়ে করে সে মস্ত বড় ভুল করেছে। বিষয়টা আমার পৌরুষে আঘাত করল। নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললাম। তাকে আঘাত করলাম।
— ভালো কোন পরিবর্তন এসেছিল কি?
– না। বরং দিনদিন তার মোবাইল ব্যবহার অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেল। সেই সঙ্গে বাড়তে থাকল আমার প্রতি অবহেলা।
— তারপর?
– একদিন গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেল। দেখলাম, বিছানায় ফারহানা নেই। বাথরুমেও লাইট জ্বলছিল না। বারান্দায় গিয়ে দেখলাম সে মোবাইলে কথা বলছে। মাথায় খুন চেপে গেল। হাত থেকে মোবাইলটা কেড়ে নিয়ে তাকে চড়-থাপ্পড় মারতে লাগলাম। ঘটনার আকস্মিকতায় সে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেল।
— এরপর কি হলো?
– এর পরের ঘটনা সংক্ষিপ্ত। ফারহানা আমাকে আর আদনানকে ছেড়ে চলে গেল।
বড়সড় নিশ্বাস ফেলল নুহা। প্রশ্ন করল শুভকে। “এবার আপনার জায়গায় দাঁড়িয়ে আমি কি কিছু বলতে পারি?”
– অবশ্যই…(শুভ)
— ফারহানা চলে যাওয়ার পর ঘরের মতো মনটাও ফাঁকা হয়ে গেল। সেই ফাঁকা মনে আর কেউ বিশ্বাসের ছোঁয়া ফেলতে পারেনি।(নুহা)
– জীবন কোন গল্প নয় মিসেস নুহা।
— জীবন দিয়েই তো গল্প রচিত হয়।
– তা হয়। কিন্তু আমার অবস্থানে দাঁড়িয়ে বিশ্বাস সংক্রান্ত তুমি যে ডায়লগটা দিলে, সেটা ভুল।
— মানে বিশ্বাসের ছোঁয়া ফেলতে পেরেছে কেউ?
– হ্যাঁ, পেরেছে।
— কে সেই ললনা? নামটা জানতে পারি?
– হায়, আল্লাহ! তোমার ওড়নায় এটা কি? সাপ নাকি বিচ্ছু? কিরকম ঘাপটি মেরে বসে আছে।
শুভর কথায় ভয়ে লাফিয়ে উঠে নুহা। ‘ও মাগো, ও বাবাগো’ বলে ছুঁড়ে ফেলে দিল পরনের ওড়না। জাপটে ধরলো শুভকে। কান্নাজড়িত গলায় বার বার বলতে লাগল- ” পিপিপ্লিজ, ফেলে দিন। পিপিপ্লিজ, ফেলে দিন। আমি ভিষণ ভয় পাই বিচ্ছুকে। পিপিপ্লিজ…”
ঐভাবেই জড়িয়ে রাখে শুভ নুহাকে। তারপর অনেকটা আদুরে গলায় সুর তুলে বলতে শুরু করে
‘তুমি, তুমি, তুমি… তুমি, তুমি, তুমি….’
ভয়টা তখনো রয়েই গেছে নুহার। মাথা তুলে শুভর মুখের দিকে তাকায় সে। তারপর অনেকটা কাঁপা গলায় প্রশ্ন করে, কিসের তুমি?
স্মিতহাস্যে শুভর জবাব। ‘প্রশ্নটা ছিল- ফারহানা চলে যাওয়ার পর কোন ললনা আমার মনে বিশ্বাসের ছোঁয়া ফেলতে পেরেছে? তারই উত্তর বললাম হলো- ‘তুমি’……
শুভর থেকে সরে দাঁড়ায় নুহা। লজ্জায়, সুখে ওর মুখটা অদ্ভুতরকম সুন্দর দেখাচ্ছে। গাল দুটো একদম লাল হয়ে গেছে। শুভর বড্ড ইচ্ছে হচ্ছিল গাল দুটো একবার ছুঁয়ে দিতে। এগুচ্ছিলও সামনে। তারআগেই উপরতলা থেকে ডাক পড়ে হিয়া আন্টির। ‘ কইরে শুভ! কই গেলি….’
‘আসছি ফুপ্পি’ বলেই দুরে পরে থাকা ওড়নাটা যতনে হাতে তুলে নেয় শুভ। এগিয়ে যায় নুহার দিকে। নুহা তখনো নিচের দিকেই তাকিয়ে আছে। কিচ্ছু বলেনি শুভ। শুধু ওড়নাটা সুন্দর করে নুহার মাথায় দিয়ে দেয়। যাওয়ার সময় ছোট্ট করে বলে যায়- ” স্যরি! জানতাম না তুমি বিচ্ছুকে ভয় পাও। জানলে এটা নিয়ে ফান করতাম না….”
দেখতে দেখতে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে যায় শুভ। সম্ভিত ফিরে নুহার। ডাক দেয় শুভকে। ‘দাঁড়ান….’
থমকে দাঁড়ায় শুভ। সিড়ি বেয়ে দ্রুত উপরে উঠে নুহা। সামনে গিয়ে দাঁড়ায় শুভর। তারপর অনেকটা ধীর গলায় বলে- ” আল্লাহ মিথ্যেবাদীকে পছন্দ করেন না। মিথ্যে বলা মহাপাপ। আশা করি, এরপর থেকে মিথ্যে বলবেন না। কৌতূক করেও না….”
কথাটা বলেই দ্রুত সেখান থেকে প্রস্থান করে নুহা।
দীর্ঘশ্বাসের সাথে ঠোঁটের কোণে একটা হাসি ফুটে উঠে শুভর।
চলবে….