ফুলশয্যা_সিজন(০৩)
পর্ব- ১৩
লেখা- অনামিকা ইসলাম।
মিনিট তিনেক অতিবাহিত হওয়া মাত্রই নুহা ওর হাতটা দ্রুত ছাড়িয়ে নেয়। কিছুটা অবাক হয়ে শুভ নুহার দিকে তাকায়। জবাবে কিচ্ছু বলেনি নুহা। ব্যাগ থেকে সেফ্টিপিন বের করে চলন্ত রিক্সায়’ই মুখটা ঢেকে নেয়।
হাত ছাড়িয়ে নেয়ার কারণটা এতক্ষণে বুঝতে পারে শুভ। প্রতিদিনকার মতই সেদিনও নুহা বাসা থেকে বের হওয়ার আগেই বোরকাটা পরে নেয়। কিন্তু এভাবে ফারহানার অপ্রত্যাশিত আগমন, আদনানকে কেড়ে নিয়ে যাওয়া, ফারহানা শুভর কাছে আসা এসব নানাবিধ কারণে নুহা বেশ উদাসীন ছিল। যার দরুন মুখ ঢাকতেই ভুলে গেছে।
ভিষণ অনুতপ্ত হয় নুহা। একটু উদাসীনতার জন্য আজ রাস্তার শত, শত মানুষ দেখেছে। হে আল্লাহ! মাফ করো আমায়। আর কখনো এমন হবে না।
আনমনে নুহা নিজেই নিজের সাথে কথা বলছিল। সেটা দেখে পাশ থেকে বলে উঠে শুভ, মানুষ মাত্রই ভুল হয়। আর কাজটা তোমার সম্পূর্ণ ইচ্ছের বিরুদ্ধেই হয়েছে। এত অনুশোচনায় ভুগার কি আছে? সব ঠিক হয়ে যাবে।
জবাবে শুধু ফিরে তাকিয়েছিল নুহা। এর বেশী কিছু করেনি।
দেখতে দেখতে অতিবাহিত হয়ে যায় মিনিট বিশেক। নুহা পৌঁছে যায় কাঙ্খিত গন্তব্য তথা কলেজ গেইটে। নেমে পড়ে রিক্সা থেকে। ভাড়া দিতে গেলে বাঁধা দেয় শুভ। ‘ মামা! ভাড়া আমি দেবো। চলেন সামনে….’
নুহা কিছু বলতে যাবে তার আগেই রিক্সা চলতে শুরু করে। একটা বড়সড় নিশ্বাস ফেলে নুহা। তারপর হাঁটতে শুরু করে…
কোর্টে যায় শুভ। পুরু ব্যাপারটা খুলে বলে পরিচিত আংকেল তথা উঁকিল শহিদুল ইসলাম আকাশকে। পরের কথোপকথনঃ-
শুভঃ- আমি তাহলে গ্রামে যাই…!
উঁকিলঃ- হ্যাঁ, তুই গ্রামে যা। ঐ ডিভোর্স লেটার যেটা ফারহানা তোর কাছে পাঠিয়েছিল সেটা নিয়ে আয়।
তারপর ডিভোর্স বলিস আর যায় বলিস, সবই হবে। আপাতত যা বলছি সেটা কর।
শুভঃ- Tnq you, Uncle.
উঁকিলঃ- You are most welcome…
উঁকিলের থেকে বিদায় নিয়ে শুভ রওয়ানা দেয় কুমিল্লার উদ্দেশ্যে। কুমিল্লার চান্দিনা শুভর গ্রামের বাড়ি। শুভকে এখন সেখান থেকে প্রয়োজনীয় সকল কাগজপত্র নিয়ে আসতে হবে। ‘কেন যে সেদিন কাজটা ঝুলিয়ে রেখেছিলাম। আপনমনে নিজে নিজেকেই গালি দিচ্ছে শুভ।
বিকেল ৩টা বেজে ৪৫মিনিট। কলেজ থেকে বাসায় ফেরে নুহা। দাদীমা খাবার খাওয়ার জন্য ডাকতেছে। কিন্তু ওর সেদিকে খেয়াল নেই। ওর দু’চোখ খুঁজছে কেবল আঁখিকে। হ্যাঁ, আঁখিকেই। হিয়া আন্টির একমাত্র মেয়ে আঁখি। যাকে বেশ ক’মাস ধরে নুহা বড্ড উদাসীন দেখেছে।পড়াশোনা, খাওয়া-দাওয়া, নামাজ-রোজা কোনো কিছুই ঠিকমতো করছে না। ক’দিন ধরে তো ভার্সিটিতেও যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে।
মোটকথা, ইহজাগতিক সমস্ত কার্যক্রম থেকে আঁখি নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছে।
কেন এই নিরবতা? কি হয়েছে তোমার? প্রশ্নটা করেছিল নুহা।
জবাবে কিচ্ছু বলেনি আঁখি। এড়িয়ে যাওয়া ছাড়া…
যায় হোক। অনেক খুঁজার পর নুহা আঁখিকে স্টোররুমে ফ্লোরে বসে কিছু একটা পুড়তে দেখতে পায়। আগুন দেখে ভয় পেয়ে যায় নুহা। দৌঁড়ে যায় আঁখির কাছেঃ-
– আঁখি আপু! কি করছো তুমি এসব?
— ওহ তুই?
– হু, আমি। তোমায় খুঁজতে খুঁজতেই তো হয়রান প্রায়।
— কেন?
– এসব কি?
— আগুন।
– আগুনের ভিতর কি দিয়েছ সেটাই জানতে চাচ্ছি।
— কলিজা।
– কিসব উল্টাপাল্টা কথা বলছো?
— ভুল তো কিছু বলিনি।
– তাই বলে কলিজা?
— হ্যাঁ, কলিজা। অহর্নিশী পুড়ে। ভাগ্যিস সে পুড়ার গন্ধটা কেউ পায় না। তাইতো জানতেও পারে না কেউ ভেতরের খবর।
– আমি কিছুটা টের পাচ্ছি?
— কি?
– অন্তঃদহন…
— যা। ড্রেস চেঞ্জ করে খেয়ে নে।
– সেইজন্যই তো তোমাকে নিতে এসেছি। চলো তো…
নুহার অনেক জোড়াজুড়ির পর আঁখি খাবার খেতে রাজি হয়। নেমে যায় নিচে। খেয়ে নেয় দুপুরের খাবার।
আসরের নামাজ শেষে নুহা আবারো আঁখির রুমে গিয়ে হাজির।
– আপু আসবো?
— হ্যাঁ, আয়।
– কি করছিলে?
— গেইমস খেলছিলাম…
– গেইমসই যদি হয় ফোনটা কেন লুকালে?
— গোয়েন্দাগিরি শুরু করেছিস কবে থেকে?
– গোয়েন্দাগিরি না।
— তবে পিছনে কেন লেগেছিস?
– মনের খবর নেয়ার জন্য।
— কিহ? কিসের খবর???
– বর্ণিতা করো না আপু। মনটা যে তোমার ভালো নেই, এটা আমি অনেক আগেই টের পেয়েছি।
— ………….
– প্লিজ আপু! চুপ করে থেকো না। আমায় বলো। কি হয়েছে তোমার? কেন এই নিরবতা?
— যা, রুমে যা নুহা।
– আপু আমায় বেয়াদব হতে বাধ্য করো না।
— মানে কি?
– আমি আজকে আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে এখান থেকে যাবো না।
— নুহা। রাগ উঠাবি না আমার। খুউব খারাপ হয়ে যাবে।
– আপু, সংযত করো নিজেকে। রাগকে প্রশ্রয় দিও না। রাগ আসে শয়তানের থেকে। যায় হোক। আমি আর বিরক্ত করতে চাচ্ছি না। চলে যাচ্ছি।
নুহা রুমে যায়। রাত্রি সাড়ে নয়টার দিকে শুভ আসে। সাথে একজন উঁকিল এবং এলাকার কিছু গন্যমান্য লোক। সবার সম্মুখে শুভ ঘোষনা দেয়,
‘আজ আমার আর ফারহানার সম্পর্কের চির সমাপ্তি ঘটতে যাচ্ছে।’
এ ঘোষনায় নড়ে উঠে ফারহানার মা। ‘চির সমাপ্তি মানে? বাবা, তুমি কি বলছ এসব?
ক্ষাণিক হাসে শুভ। জানান দেয়, অবাক হওয়ার তো কিছু বলিনি আমি। আর খুব কঠিন কথা যে বলেছি, তাও কিন্তু নয়। তবুও আপনার বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে?
পাশ থেকে ফারহানার জবাব, শুভ তুমি কি শুরু করছ এসব?
এবারো হাসে শুভ। ‘শুরু তো করেছ তুমি, তোমরা। যার শেষটা করব আমি।’
– মানে কিকিকিকি করবা?
— মন থেকে আমি তোমায় সেদিনই বের করে দিয়েছি, যেদিন শুনেছি তুমি ব্যাংক ম্যানেজারের টাকার প্রলোভনে আমাদের ছেড়ে গেছো। আজ আমি তোমাকে সর্বসম্মুখে এ বাড়ি থেকে বের করব।
নদর্মার বিষাক্ত কোন কীটকে আমি এ বাড়িতে স্থান দেবো না। কিছুতেই না।
শুভর দৃঢ় মনোবল দেখে ভয় পেয়ে যায় ফারহানা। জুড়ে দেয় মায়া কান্না। কাজ হচ্ছে না দেখে হুইল চেয়ার থেকে ইচ্ছে করে পড়ে যায়। জাপটে ধরে শুভর পা। একে একে হিয়া, ওর হাজবেন্ড এবং সবশেষে এলাকাবাসীর পা জাপটে ধরে। এ ঘটনায় মুরুব্বীরা বিব্রতকর অবস্থায় পরে যায়। বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় সবাই। ফারহানা তখনো ফ্লোরে বসে অবিরত কান্না করছে আর তাকে এ বাড়ি থেকে না তাড়ানোর মিনতি জানাচ্ছে।
কিছু একটা বলতে চাচ্ছিল মুরুব্বীরা। কিন্তু সেটাও পারেনি। তার আগেই জ্ঞান হারায় ফারহানা।
ফারহানার মা এবং হিয়া দু’জনই ফারহানাকে ধরাধরি করে রুমে নিয়ে যায়। মুরুব্বীদের একজন জানায়- “জানি! মেয়েটা অন্যায় করেছে। কিন্তু ও যেহেতু আবারো ফিরে এসেছে এবং এমনভাবে ক্ষমা চাচ্ছে আমার মনে হয় ওকে একটা সুযোগ দেয়ায় যায়। কি বলেন উঁকিল সাহেব?”
উঁকিলঃ- হ্যাঁ, আমারও সেটাই মনে হচ্ছে। ওকে সংশোধনের একটা সুযোগ দেয়ায় যায়।
হৃদয়ঃ- কিন্তু মেয়েটি তো ওকে ডিভোর্স দিয়েছে।
মুরুব্বী-১ঃ- এরকম হয়। মানুষ এরকম ভুল করে।
মুরুব্বী-২ঃ- আবার এর সুন্দর সমাধা আছে।
হৃদয়ঃ- কি সেই সমাধা?
মুরুব্বী-৩ঃ- পুনরায় বিয়ে….
শুভঃ- অনেকক্ষণ চুপ করে বসে ছিলাম। আর পারছি না। মাফ করবেন। আমার পক্ষে সেকেন্ড টাইম এই মেয়েকে বিয়ে করা অসম্ভব।
উঁকিলঃ- কিন্তু মেয়েটি তো পাগল…
শুভঃ- আংকেল আপনিও…..(….)….???
উঁকিলঃ- আরে বাবা! উত্তেজিত কেন হচ্ছিস তুই?
শুভঃ- যত যায় হোক। আপনার থেকে এটা আমি প্রত্যাশা করিনি আংকেল।
উঁকিলঃ- শান্ত হো। আজ মেয়েটি অসুস্থ হয়ে পরেছে। সুস্থ হোক। তারপর কালকে যা করার করা যাবে। আমি উঠি এখন।
মুরুব্বীরাঃ- আমরাও উঠি…
সবাই চলে যায়। উত্তেজিত শুভ ডান হাতটা মুঠো করে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পিছন থেকে কাঁধে হাত রাখে হৃদয়। ‘শান্ত হও। যা করার কালই হবে।’
রাত্রি ১১টা বেজে ৩৫মিনিট_
খাটে আধশোয়া অবস্থায় হেলান দিয়ে বসে আছে ফারহানা। তার পাশেই ওর মায়ের অবস্থান। দু’জনের চোখে মুখেই অদৃশ্য আলোর রেখা খেলা করছে…
এ বাসার সবাই নিচে ড্রয়িংরুমে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে বিষণ্ন মনে। শুভ বসেছে সোফার ঠিক মাঝখানে। ছোট ছোট পায়ে উপরতলা থেকে ছুটে আসে আদনান। জাপটে ধরে শুভকে।
” বাবা! খিদে পেয়েছে।
আজকে আমি কি দিয়ে খাবো?”
মুহূর্তেই ঠাস করে শব্দ হয়। গালে থাপ্পর মারে শুভ আদনানকে। ‘যা এখান থেকে! বিষ খা গিয়ে…’
কান্না করতে করতে উপরে নুহার রুমের দরজায় গিয়ে দাঁড়ায় আদনান। শক্ত করে মুখটা চেপে ধরে কান্না করছিল নুহা। দরজার সামনে বাচ্চার কান্না আওয়াজ শুনে নিজেকে সংযত করে নেয়।
‘কে ওখানে?’
ভেতরে প্রবেশ করে আদনান। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করছে তখনো। সেটা দেখে নিজেকে আর সামলে রাখতে পারেনি নুহা। জাপটে ধরে আদনানকে। গালে, মুখে, নাকে চুমু দিতে দিতে দিতে বলে- ‘ কি হয়েছে বাবা? আব্বু আজো মেরেছে? বকে দেবো ওনাকে। আচ্ছা করে বকে দেবো।’
কান্না থেমে যায় আদনানের। ততক্ষণে নিচ থেকে খাবারের জন্য ডাক পড়ে। ছোট্ট আদনানকে কোলে নিয়ে ধীর পায়ে সিড়ি বেয়ে নিচে নামে নুহা। মা মেয়ের খাবারটা উপরে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে যেহেতু ওনারা না করেছে খাবেনা। ঐ মুহূর্তে টেবিলে উপস্থিত ছিল- আঁখি, হিয়া, হৃদয়, শুভ, নুহা এবং আদনান।
নিত্যকার নিয়মে সেদিনও নুহা নিজের প্লেট থেকে একমুঠো ভাত নিয়ে আদনানের মুখে এগিয়ে দেয়। আদনান মুখ ফিরিয়ে নেয়। নুহা আবারো আদনানের মুখের দিকে ওর হাতটা নিয়ে যায়। আদনান এবার বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। নুহাও উঠে দাঁড়ায়-
” কি হলো? উঠলে কেন? খাবে না?”
আদনান রাগান্বিত স্বরে জবাব দেয়, আমি এগুলো খাবো না। আমি নতুন মজা খাবো।
আদুরে স্বরে নুহার প্রশ্ন, নতুন মজা? সেটা আবার কি?
” আমি বিষ খাবো…..”
চমকে উঠে সবাই। ফিরে তাকায় আদনানের দিকে। একটু সময়ের ব্যবধানে আদনান কাঁদার সাথে সাথে রাগে লাফাতে থাকে।
“আমার খিদে পেয়েছে। আমায় বিষ দাও। ভাতের সাথে বিষ মাখিয়ে দাও। আমি খাবো…!”
(বিঃদ্রঃ- রহস্য থাকবে এবং তার উন্মোচন হবে। শুধু ফারহানা নয়, পুরো গল্পটায় রহস্যে আবৃত। সকল রহস্যেরই উন্মোচন হবে, একটু একটু করে, ধীরে ধীরে। সেই পর্যন্ত সাথেই থাকুন ধৈর্য্য নিয়ে। ওহ, হ্যাঁ!একটা কথা না বললেই নয়। ৪বছরের ছোট্ট আদনান বিষ খাওয়ার জেদ ধরেছে কারণ, ও ওর জীবনের প্রথম নামটা শুনেছে ওর বাবার মুখ থেকে। তাই ভাবছে এটা না জানি কত মজার জিনিস….]