ফুলশয্যা_সিজন(০৩)
পর্ব- ১২
লেখা- অনামিকা ইসলাম।
ভারাক্রান্ত মন নিয়ে রুমে চলে যায় নুহা। বন্ধ করে দেয় দরজা। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে ওর। কিন্তু পারছে না। দাঁতে দাঁত চেপে কান্নার শব্দটাকে ভিতরেই আটকে রাখার অদম্য চেষ্টা চলছে। চোখ দুটো বোজে রেখেছে নুহা। অজস্র জলরাশি গাল গড়িয়ে নিচে পরছে। ঠোঁটগুলো ছোট বাচ্চাদের ন্যায় মৃদু কাঁপছে।
দরজা খুলে বাহিরে যায় নুহা। পূর্বের ন্যায় আবারো জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। শুভর বুকে ফারহানা গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছে। বাহির থেকে ওদের ভারী হয়ে যাওয়া নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছে। ওদের প্রতিটি নিঃশ্বাস নুহাকে ধারালো ছুরির ন্যায় ক্ষত-বিক্ষত করে দিচ্ছে। কান্না আটকাতে মুখ চেপে দ্রুত সে স্থান পরিত্যাগ করে নুহা।
নুহার কাছে মন খারাপের কারণ অজানা থাকলেও মন ভালো করার কারণটা বেশ ভালো করে জানা আছে। নুহা ওর জীবনে কারো কাছে সাহায্যের জন্য হাত পাতেনি কেবলমাত্র আল্লাহ ছাড়া। মহান আল্লাহ তায়ালা জাগতিক সকল সমস্যার সমাধানদাতা। তাই যেকোনো প্রতিকূল অবস্থায় নুহা পরম সৃষ্টিকর্তার কাছেই সাহায্যের আবেদন জানান। সেদিনও তার ব্যতিক্রম হয়নি। মন ভালোর মহৌষধ হিসেবে নুহা নামাজকেই বেছে নেয়। তাইতো অজু করে দ্রুত নামাজ পড়ে নেয়।
সকালে আদনানকে সাথে নিয়ে পড়তে বসছিল নুহা। দুজনেই নিজ নিজ পড়াশুনায় ব্যস্ত ছিল ভিষন। রুমে ঢুকে ফারহানার মা। কিছু না বলেই আদনানকে কোলে তুলে নেন। ‘ছাড়ো, ছাড়ো’ বলে কান্না শুরু করে দেয় আদনান। ফিরে তাকায় নুহা। মহিলাটিকে দেখে ইতস্তত নুহা ওর বই বন্ধ করে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায়।
” কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আদনানকে?”
– রুমে।
— ও’তো পড়বে এখন।
– সেই জন্য’ই নিয়ে যাচ্ছি।
— ………
– আগে ওর মা ছিল না। তাই তোমাকে পড়াতে হয়েছে। এখন ওর মা চলে আসছে। আশা করি, তোমাকে আর কষ্ট করতে হবে না।
— ……….
– আসো। লক্ষ্মী ভাই আমার। আসো, আসো। মায়ের কাছে পড়বে।
প্রচন্ড কান্না করছিল আদনান। তবুও কোল থেকে নামায়নি ওর নানী। নুহার চোখের সামনে দিয়ে আদনানকে নিয়ে যাওয়া হয় অন্য রুমে। চেয়ারে বসে পড়ে নুহা। শব্দ করে কেঁদে দেয়।
রুমের সামনে দিয়ে যাচ্ছিল শুভ। চাপা গলায় কারো কান্নার আওয়াজ শুনে থমকে দাঁড়ায় সে। ফিরে তাকায় নুহার রুমের দিকে। ‘হ্যাঁ, এ রুম থেকেই তো শব্দটা আসছে। কিন্তু এ রুমে এরকম করুণ স্বরে কে কাঁদছে? নুহা নয়তো?’
কৌতূহল মেটাতে নুহার রুমের দিকে পা বাড়ায় শুভ। দরজার সামনে থেকেই প্রশ্ন করে। ‘কে? কে কাঁদছে?’ রুমে অপ্রত্যাশিত মানুষের আগমনে চুপ হয়ে যায় নুহা। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আবারো প্রশ্ন করে শুভ। ‘কে কাঁদছে?’
চুপ হয়ে আছে নুহা। কান্নারা সব গলায় দলার মতো কুন্ডলি পাকিয়ে আছে।
আরো কাছে চলে আসে শুভ। জোর গলায় প্রশ্ন করে আবারো, ‘কি হলো? কথা বলছো না কেন? শুনতে কি পাচ্ছো আমার কথা?’
‘ আল্লাহ! ওনি তো দেখছি আমার পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন। আমি এখন কি করব? সত্যিটা যে বলা যাবে না। মিথ্যেও যে বলা মানা। আল্লাহ! সাহায্য করো আমাকে….’
নুহার আকুল আবেদন বোধ হয় উপরওয়ালার কাছে সাথে সাথেই পৌঁছে গিয়েছিল। হয়তো সেজন্যই নুহার মাথা থেকে খসে পড়ে ওড়নাটা। আলগা হয়ে যায় খোপার বাধন। শুভর দৃষ্টি চলে যায় টেবিল থেকে সরাসরি মেঘকন্যার দীঘল কালো কেশের দিকে। এলোমেলো অবিন্যস্ত চুলে মেঘকন্যার পুরো মুখ ঢেকে গেছে। তৈরি হয় একটা অদৃশ্য পর্দা। সেই পর্দার আড়ালে গিয়ে মেঘের দেশের মেঘকন্যা দ্রুত তার চোখের জলটুকু মুছে নেয়। শক্ত করে মনকে। স্বাভাবিক হয়ে যায় অনেকটা।
এদিকে শুভ ওর পকেট থেকে ফোনটা বের করে দ্রুত। ভয়ে ভয়ে পিছন থেকে একটা ছবি তুলে নেয়।
ফোনের আলোটা নুহার চোখ এড়াতে পারেনি।পিছু ফিরে তাকায় চটজলদি।
হাবা মার্কা হাসি দিয়ে শুভ ওর হাতের ফোনটা উপরে তুলে নাড়াতে থাকে। জিজ্ঞাসো দৃষ্টি নিয়ে নুহা তখনো শুভর দিকে তাকিয়ে। আড়চোখে সেটা খেয়াল করে শুভ। নুহার প্রশ্ন করতে হয়নি। তার আগেই বোকা শুভর জবাব, ‘ইয়ে! নেট পাওয়া যাচ্ছিল না। তাই দেখলাম ছবি উঠানো যায় কি না…’
– নেটের জন্য মানুষ ছবি নয় কল দেয়।
— হ্যাঁ, হ্যাঁ, সেটাই।
– কি সেটাই?
— কল, কল…
– কিসের কল?
— নেট আনার জন্য।
– নেট আনার জন্য কল দেয় না মানুষ। যে জায়গায় নেট পাওয়া যায়, সেখানে যায়।।
— হ্যাঁ, হ্যাঁ….
– কিসের হ্যাঁ, হ্যাঁ?
— দেখছিলাম এখানে নেট পাওয়া যায় কি না…
– নেটের জন্য কোন জায়গা লাগে না। আপনার ফোন নষ্ট হয়ে গেছে।
— হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমার সেটাই মনে হচ্ছে।
– আমার কি মনে হচ্ছে জানুন?
— কি?
– ফোন নয় আপনার ভিতরে যান্ত্রিক কারিগরির কোন সমস্যা হয়েছে।
— Sorry….?
– আপনি অফিসে যাওয়ার আগে একবার হিয়া আন্টির চেম্বার থেকে ঘুরে আসুন, ধন্যবাদ।
লজ্জায় মাথা নিচু করে রুম থেকে বেরিয়ে যায় শুভ।
শুভ রুম থেকে বেরিয়ে যেতেই দাদীমার(বুয়া) ডাক পরে। ‘কইরে নুহা-আঁখি! টেবিলে খাবার দিয়েছি। সবাইরে নিয়ে আয়….’
দাদীমার ডাকে সাড়া দিতে নিচে নেমে আসে নুহা। কারো কোন কথা ছাড়াই চুপচাপ টেবিলে বসে খেতে শুরু করে।
এদিকে আঁখির ডাকে বাকি সবাই খাবার টেবিলে উপস্থিত হয়। খেতে বসে। ছোট্ট আদনান এসে বসলো নুহার পাশেই। প্রতিদিনকার মতো সেদিনও নুহা নিজের প্লেট থেকে একমুঠু ভাত আদনানের মুখে পুরে দেয়। আরেকমুঠু ভাত মুখে পুরে দেয়ার আগেই আদনানকে টান দিয়ে নিজের কাছে নিয়ে যায় ফারহানা। ‘ ও যথেষ্ট বড় হয়েছে! তাই এখন থেকে প্লেটেই খাবে ও। ওর খাওয়া দাওয়া নিয়ে আর কারো টেনশন করতে হবে না…’
ফারহানার কথার জবাবে কিচ্ছু বলেনি নুহা। চুপচাপ মাথা নিচু করে খেয়ে সে স্থান পরিত্যাগ করে।
ওয়াশরুমের দরজা বন্ধ করে হু,হু করে কেঁদে উঠে নুহা। ওর চোখের সামনে দিয়েই একটু একটু করে সব প্রিয়জনরা দুরে সরে যাচ্ছে। অচেনা হয়ে যাচ্ছে চেনামুখ। বড্ড অচেনা। এতকিছু দেখেও সে কিচ্ছুটি করতে পারছে না, নিরবে সয়ে যাওয়া ছাড়া।
দরজায় কে যেন ধাক্কা দিচ্ছে। কান্না থামিয়ে প্রশ্ন করে নুহা, কে? বাহির থেকে শুভর গলা ভেসে আসে। ‘বাসায় এত ওয়াশরুম থাকতে, পুরুষদের ওয়াশরুমেই ঢুকতে হলো?’
নুহার চোখ চলে যায় ওয়াশরুমের চারিদিকে। বুঝতে পারে বড়সড় একটা ভুল করে ফেলেছে। চোখের জলটুকু মুছে দরজা খুলে নুহা। অতঃপর মাথা নিচু করে নিজ রুমে চলে যায়।
‘অদ্ভুত মানুষ’তো! একটা স্যরিও বললো না…’ নুহার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে শুভ।
এদিকে রুমে এসে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে নুহা। যত দ্রুত সম্ভব হোস্টেলে উঠবে সে। কলেজ হোস্টেলে থেকে পড়াশুনা করবে। আঁখির থেকে ফোনটা নিয়ে নুহা কল করে ওর বাবাকে।
ওর বাবা ফোন রিসিভ করে। ও জানায়- ‘পড়াশুনার সুবিধার্থে ওকে কলেজ হোস্টেলে থাকতে হবে।’ প্রতিউত্তরে ওর বাবা জানায়- ‘ ঠিক আছে, মা! আমি এক্ষুনি হিয়ার সাথে এ ব্যাপারে কথা বলছি। ও আজকে আসার সময় সব ব্যবস্থা করে আসবে।’
তারপর আরো কিছুক্ষণ কথা বলে তখনকার জন্য বিদায় নেয় বাবার থেকে।
কল কেটে একটা বড়সড় নিশ্বাস ফেলে নুহা। রেডি হয়ে নেয় কলেজে যাওয়ার জন্য। দরজার সামনে এসে দাঁড়ায় শুভ।
” কই! হলো..?”
– আআআআপনি?
— বিশেষ দরকারে কোর্টে যাবো। তোমাদের কলেজের পাশ দিয়েই যেতে হবে। চলো। একসাথেই যাওয়া যাক…
– না, আপনি যান। আমি যেতে পারব।
— তুমিও চলো না।
– আমি যেতে পারবো।
— সেটা আমিও জানি। যাবে না। এটা বলে দিলেই হয়….
রাগ দেখিয়ে চলে যায় শুভ। কান্না লুকিয়ে বাসা থেকে বের হয় নুহা। বাসার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে শূন্য রিক্সার জন্য। মিনিট দুয়েকের মধ্যে একটা শূন্য রিক্সা আসে। নুহা উঠে বসে। হুট করে কোথায় থেকে যেন শুভ চলে আসে। লাফিয়ে উঠে রিক্সায়। রিক্সা চলা শুরু করে। বিস্মিত নুহা চোখ বড় বড় করে শুভর দিকে ফিরে তাকায়।
” আপনি…?”
– হ্যাঁ, আমি। শুভ আমার নাম। কেন? কোন সন্দেহ আছে?
— সেটা না…
– তো?
— আপনার তো গা….(….)….???
– গাড়ি আছে। তবে রিক্সায় চড়তে আমার বেশী ভালো লাগে। আর তখন তো কোন কথায় নেই যখন পাশে…..
— কি?
– কিছু না।
— ওহ….
তারপর নিরবতা। ঘোর নিরবতা বিরাজ করে দুজনের মাঝে। হঠাৎ রিক্সার প্রচন্ড ঝাঁকুনিতে নুহা শুভর একটা হাত চেপে ধরে। শুভ ফিরে তাকায় নুহার দিকে। চোখাচোখি হয়। ইতস্তত নুহা হাতটা সরিয়ে নিতে চাইল। কিন্তু পারল না।
মিনিট পাঁচেক পর ওদের হাত দুটির ওপর নুহার আরেকটি হাত এসে ভর করল। শুভ ফিরে তাকায় নুহার দিকে।
লক্ষ্য করল, নুহার নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। শুভ আরো খেয়াল করল, ওর হাতের মধ্যে রাখা নুহার হাত দুটো মৃদু কাঁপছে।
চলবে….