ফুলশয্যা_সিজন(০৩)
পর্ব- ০৮
লেখা- অনামিকা ইসলাম।
টেস্ট পরীক্ষা শেষ হলো।
রেজাল্ট দিলো। 4.83 পেয়ে উত্তীর্ণ হলো নুহা। বিদায়ের মুহূর্ত ঘনিয়ে এলো। সেদিন ছিল স্কুলে বিদায় অনুষ্ঠান। বিদান অনুষ্ঠানে শুধুমাত্র নুহাকে খাওয়ানোর জন্য মামুন ষাট জন ছাত্র ছাত্রীকে চকোলেট খাইয়েছিল। কিন্তু নুহা চকোলেট নেয়নি।
পরীক্ষা শুরু হলো। দেড় বছরের ছোট্ট আদনানের বয়স তখন চার বছরে দাঁড়ায়। এসএসসি পরীক্ষার প্রাক্কালে নুহার রুটিন করা কিছু কাজ ছিল।
সেগুলো হলো- তিনবেলা নিয়ম করে খাওয়া, গোসল, পড়াশুনা আর নিয়ম করে ঘুমানো। এর ছাড়া নুহার বেশি কোন কাজ ছিল না। নুহা যখন পড়ত, আদনান তখন চুপ করে নুহার কোলে এসে বসে থাকত। কখনো বা নিজেও স্বরবর্ণ, ব্যঞ্জনবর্ণ বই নিয়ে এসে নুহার পাশে বসে পড়তো। শুভ দুর থেকে নুহার গতিবিধি লক্ষ্য রাখতো। লক্ষ্য রাখতো আদনান নুহাকে ডিস্টার্ব করছে কি না…!
পরীক্ষা শুরু হলো। পরীক্ষার আগমুহূর্ত শুভ নুহাকে পড়াশুনার জন্য এক নতুন রুটিন করে দেয়। যেখানে পড়াশুনার চেয়ে নুহার দৈহিক সুস্থতাকেই বেশি প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। রুটিনে স্পষ্ট লিখাঃ-
” ভালো ভাবে পরীক্ষা সম্পূর্ণ হওয়ার পূর্বশর্ত তোমার দৈহিক সুস্থতা। আর সেই দৈহিক সুস্থতার জন্য প্রয়োজন নিয়ম মেনে চলা। এক্ষেত্রে ঠিক মতো খাওয়া, গোসল আর ঘুমের কোন বিকল্প নেই। তুমি একজন বুদ্ধিমতি এবং মেধাবী ছাত্রী। আশা করি, পরীক্ষার আগমুহূর্তে বই নিয়ে কোমর বেধে লেগে পরে, নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিবে না। মস্তিষ্ককে বিরাম দাও। সফল হয়ে ফিরে এসো….”
হ্যাঁ, নুহা সফল হয়েই ফিরে এসেছে।
বইয়ের সাথে পূর্বসংযোগ থাকায় নুহাকে পরীক্ষার দিনগুলোতে কোমর বেধে লাগতে হয়নি। অন্যান্য দিনের মতই স্বাভাবিক নিয়মেই নুহা ভোরে ঘুম থেকে উঠে নামাজ আদায় করে, খানেকক্ষণ কুরআন তেলওয়াত করেছে। অতঃপর পুরো বইয়ে একবার চোখ বুলিয়ে, সকলের থেকে দোয়া নিয়ে, আল্লাহর নাম নিয়ে বেরিয়ে যেতো রুম থেকে। এভাবেই নুহা ওর পরীক্ষাগুলো দেয়।
দু’মাস পর রেজাল্ট দেয়া হয়। নুহা জি.পি.এ-০৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয় এসএসসিতে। নুহার সাফল্যে সবাই খুব খুশি। শুভও খুশি। অফিসে বসে নেট থেকে রেজাল্ট জেনে নেয় সবার আগে। অতঃপর দ্রুত অফিস থেকে বের হয়ে মিষ্টির দোকানে চলে যায়। মিষ্টি শুভ আগেই অর্ডার দিয়ে রেখেছিল। শুভ যাওয়ার পর মিষ্টি বিক্রেতা প্যাকগুলো শুধু গাড়ির মধ্যে উঠিয়ে দেয়। নুহার সাফল্য উপলক্ষ্যে পুরো মহল্লায় মিষ্টি বিতরণ করা হয়।
মিষ্টি এবং হিয়া আন্টিকে সাথে করে নুহা দাদীমা এবং ছোট ভাইকে দেখতে যায়। ওখানে গিয়ে দেখতে পায় আরো বড় সড় উৎসব করে মিষ্টি বিতরণ করা হচ্ছে পুরো গ্রামে। নুহার ছোট ভাই নীলয় সেও এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিল। এটা তারই মিষ্টি। পরীক্ষার ব্যস্ততার জন্য অনেকগুলো মাস নুহা কিংবা নীলয় একে অপরের সাথে দেখা করতে পারে নি। মিষ্টি হাতে নুহাকে দেখতে পেয়ে কি যে খুশি হয় নীলয়, তা বলে বুঝানো যাবে না।
নীলয় ভিষণ মিষ্টি প্রিয়। প্রচুর মিষ্টি খায় ও। এই জন্য দাদীমার বকাও খায় অনেক। নুহাকে মিষ্টি হাতে দেখে হাত থেকে একটা কার্টুন নিয়ে নেয় সে। দেখতে দেখতে, চোখের পলকে কার্টুনের অর্ধেক মিষ্টি সাবাড় করে ফেলে নীলয়।
হেসে দেয় হিয়া। কাছে গিয়ে মুখটা মুছে দিয়ে প্রাণের বান্ধবী নীলিমার ছেলে নীলয়কে জড়িয়ে ধরে হিয়া। চুমু খায় কপালে।
হাসি মুখে নীলয় জানায়, আন্টি! আমি না পাস করেছি। ট্রিপল-4 পেয়েছি।
শব্দ করে হেসে দেয় নুহা। ট্রিপল-4? সেটা আবার কেমন রেজাল্টরে?
গর্বিত ভঙ্গিতে নীলয়ের জবাব, আরে তুই বুঝবি না। এটা আমার নতুন আবিষ্কার। ট্রিপল- 4 মানে 4.44………..
নুহা এবং হিয়া দু’জনেই হা, হা করে হেসে দেয়।
কলেজে ভর্তি উপলক্ষ্যে স্কুল থেকে প্রয়োজনীয় কিছু কাগজপত্র নিয়ে শুভদের বাসায় ফিরছিল নুহা। পথ আগলে দাঁড়ায় মামুন। থমকে যায় নুহার পথ চলা। ফিরে তাকায় মামুনের দিকে। বিনীত ভঙ্গিতে মামুন নুহার হাতে একটা খামবিহীন ভাঁজ করা চিঠি তুলে দেয়। নুহা চিঠিটা গ্রহন করলে মামুন দ্রুত সে স্থান প্রস্থান করে।
নুহা পড়ার টেবিলে বসে বসে হাদিস বইয়ের পাতা নাড়ছিল। পড়া আর হলো না। শুধু সময় অতিবাহিত হতে লাগল। নুহার মন পড়ায় নয়, ওড়নার আড়ালে লুকিয়ে রাখা হাতের ঐ চিঠিটার দিকে আছে। মামুন কি লিখেছে তাতে, এটা দেখার জন্য ওর যত ব্যাকুলতা। কিন্তু পাছে কেউ দেখে ফেলে সেই ভয়ে চিঠিটা খুলতেও পারছে না। সন্ধ্যার দিকে নুহা একা টেবিলে বসে ছিল। রুমেও কেউ ছিল না। নুহা ভাবলো এটাই সুযোগ। এই সুযোগকে হেলায় নষ্ট করতে নারাজ সে। আবারো নুহা চারিদিকটা ভালো করে পরখ করে নিল। না, কোথায় ও কেউ নেই। নুহা দ্রুত ওড়নার আড়াল থেকে হাতটা বের করলো। মেলে ধরলো চিঠিটা চোখের সামনে। নুহা মনোযোগ সহকারে পড়তে লাগল মামুনের না বলা কথাগুলোঃ-
নুহা,
প্রথমেই আমার শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা গ্রহন করিও। তুমি যে খুব ভালো আছো তা তোমার চোখেই প্রকাশ পায়। কিন্তু আমি ততটা ভালো নেই। যতটা ভালো থাকলে মন খুলে দুটি কথা বলা যায়। তোমার ঐ হৃদয়হরণকারী আঁখিদ্বয় আমার হৃদয়ে বার বার হানা দেয় তোমায় কিছু বলার জন্য। হয়ত তাই কাগজের বুকে কিছু না বলা কথা এঁকে দিলাম।
জানি আমার ভালো থাকা আর না থাকা নিয়ে তোমার কোন ভাবনা নেই। আর থাকবেই বা কেন? আমি তোমার কে? আর তুমিই বা আমার কে? হয়ত এই প্রশ্বদ্বয় তোমার মনের ঘরে কড়া নাড়তে পারে। কিন্তু তোমাকে ছাড়া যে আমার চলবে না। বল আমি এখন কি করব? কি করণীয় আমার?
একজোড়া চোখ দেখেই তোমাকে আমার ভালো লেগেছিল। আর প্রতিনিয়ত দেখতে দেখতে একসময় নিজের অজান্তে মনের ঘরে তোমায় ঠাঁই দিয়ে ফেলি। তাই তোমার ভালোবাসা পাবার জন্যই আজ আমি তোমার শরণাপন্ন হলাম।
বিশ্বাস করো নুহা, আমি তোমায় ভুলে যেতে চেয়েছি বার বার। দিবানিশি সারাক্ষণ চেষ্টা করেছি তোমায় ভুলে থাকতে। কিন্তু পারলাম না। তোমার কাছে ফিরে আসতেই হলো। এবার তুমিই বলে দাও-
কি করতে পারি আমি? এমন পরিস্থিতিতে কি করা যায়? নুহা, আমি তোমায় বলবো না যে, আমায় ভালোবাসতেই হবে। কারণ আমি জানি জোর করে ভালোবাসা হয় না। তবে শুধু এইটুকু জেনো, আমি তোমায় ভীষণ, ভীষণ ভালোবাসি। তাই বলছি, যদি পারো আমায় সামান্যতম ভালোবাসা দিও। তোমার ভালোবাসা দিয়ে আমার অশান্ত মনকে শান্ত করে দিও।
ইতি,
মামুন।
চিঠি পড়ে মেজাজ পুরো গরম হয়ে গেছে নুহার। রাগ উঠে যায় নুহার। সেই মুহূর্তেই রুমে আসে আদনান। চিকন এবং টানা টানা স্বরে বলে উঠে,
“আম…..মু… কি ক……রো……”
ডাক শুনে কলিজা জড়িয়ে যায় নুহার। সমস্ত রাগ নিমিষেই পানি হয়ে যায়। নিজের কাছে টেনে নেয় আদনানকে। জড়িয়ে ধরে কপালে, গালে চুমু খায়।
অতঃপর চিঠির জবাবসরূপ কাগজের বুকে এঁকে দেয়-
” আমি বিবাহিতা, মামুন।”
পরদিন কলেজ থেকে ভর্তির কাজ সেরে ফিরছিল নুহা। আগের দিনের মতই পথ আগলে দাঁড়ায় মামুন। ভয় পেয়ে আশেপাশে তাকাতে থাকে নুহা। কারণ, এই মুহূর্তে নুহা ঐ বাসায় সামনেই দাঁড়িয়ে, যে বাসায় ও বিগত কয়েক বছর ধরে আছে।
হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন। নুহার পথ আগলে দাঁড় করানো হয় শুভদের বাসার সামনেই। শুভর নিজস্ব বাসা এটা। শুভর বাবা নেই, মা নিজের সুখের জন্য অন্যত্র বিয়ে করে নিয়েছেন। মায়ের বিয়ের পর শুভ হয়ে গিয়েছিল একা। হিয়া তাই একমাত্র ভাইয়ার ছেলে শুভর সুষ্ঠুভাবে বেড়ে উঠা ও ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে স্বামী সন্তান নিয়ে ভাইয়ার বাসায় উঠেছে। নুহও সেই বাসায়’ই থাকে।
ভয়ে যখন নুহার কলিজা শুকানোর উপক্রম, পাশ থেকে তখনই মামুনের তাড়াঃ-
” আমার চিঠির জবাব চাই….
ভালোবাসো কি না সেটা বলো?”
নুহা ব্যাগ থেকে চিরকুট’টা বের করে কাঁপা হাতে সেটা এগিয়ে দেয় মামুনের দিকে। যাতে লিখাঃ-
” আমি বিবাহিতা, মামুন।”
চিঠি পড়ে স্তব্ধ হয়ে যায় মামুন। যেন সে কথা বলার ভাষা হারিয়েছে। বহুকষ্টে মামুন ফিরে তাকায় নুহার চোখের দিকে। মনে মনে বলেঃ-
” না। এ চোখ তো মিথ্যে বলছে না। তবে সত্যটাকে মেনে নিতে আমার কেন এত কষ্ট হচ্ছে? তবে কি আমার বুঝার ভুল হচ্ছে কোথায় ও? ও কি আমায় মিথ্যে বলছে? কিন্তু ও তো নামাজী এবং পর্দানশীন মেয়ে। আমায় কি ও মিথ্যে বলবে? যাক। জিজ্ঞেস করেই দেখি….”
মামুন ফিরে তাকায় নুহার দিকে।
” নুহা, তুমি কি আমার সাথে মজা করতেছ? তুমি তো নামাজ পড়ো। তুমি কিভা…”
পুরো কথা বলতে পারেনি মামুন। গেইটের ভেতরের বাগান থেকে দৌঁড়ে আসে আদনান। জাপটে ধরে নুহাকে। নাকের পানি, মুখের পানি নুহার বোরকায় মুছতে থাকে আর কান্না করতে থাকে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠে-
” আম্মু, আব্বু আমায় মেরেছে।”
ঘটনার আকস্মিকতায় চমকে যায় মামুন।
“নুহা তোমার বা বা…..”
কোলে তুলে নেয় নুহা আদনানকে। আদনানের গালের সাথে গাল মিশিয়ে স্মিতহাস্যে বলে উঠে-
” জ্বি, আমার বাচ্চাও আছে…….”
চলবে…..