ফুলশয্যা_সিজন(০৩) পর্ব- ০৭

0
2706

ফুলশয্যা_সিজন(০৩)
পর্ব- ০৭
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

‘থ’ হয়ে যায় শুভ। চোখ দুটো গোল মার্বেলের ন্যায় হয়ে যায় ওর।

” ইঁদুর মারার যন্ত্রগুলো বিছানায় রাখা। আর তার পাশেই বসে ভিতর থেকে কলা বের করে চপচপ করে কলা খাচ্ছে নুহা…..”

খোলা জানালা দিয়ে ভিতর পানে অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিল শুভ। একে একে তিনটা মেশিন থেকেই কলা বের করে খেয়ে নিয়েছে নুহা। খাওয়া শেষে অত্যন্ত সংগোপনে নুহা ইঁদুর মারার যন্ত্রগুলো পূর্বের স্থানে রেখে দেয়। তারপর চুপ করে লাইটটা অফ করে ড্রিম লাইটের আলোয় আদনানের পাশে শুয়ে পরে। শুভও ভিষণ সাবধানে সে স্থান পরিত্যাগ করে।

সকালে স্টাডি রুমে পড়তে বসছিল নুহা। তখনি ড্রয়িংরুমে ডাক পড়ে ওর। ডাক দিয়েছে শুভ। ছুটে যায় নুহা। ইঁদুর মারার তিনটা যন্ত্র’ই সামনে নিয়ে বসে আছে শুভ। তার পাশে বসেছে হিয়া আন্টি।
বিনীত ভঙ্গিতে মাথা নীচু করে নুহা গিয়ে দাঁড়ায় হিয়া আন্টির পাশেই।
প্রশ্ন করে শুভ, তিন তিনটে কলা দিয়ে আসছিলাম যন্ত্রের ভিতর। একটা যন্ত্রেও কলা অবশিষ্ট নেই। তো ইঁদুর কোথায় যন্ত্রের?
প্রশ্ন শুনে নুহার পুরো মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। আসলে কি বলবে সেটাই বুঝতে পারছে না ও।
পাশ থেকে শুভর তাড়া, তাড়াতাড়ি বলো। ইঁদুর কোথায়?
ঢোক গিলে নুহা। আঙ্গুল দিয়ে নিজের দিকেই নির্দেশ করে। চমকে যায় হিয়া। প্রশ্ন করে নুহাকে, নুহা! তোকে জিজ্ঞেস করছে ইঁদুরের কথা, তোর কথা নয়।
নিচের দিকে তাকিয়ে ধীর গলায় নুহার জবাব, আমি মিছে কথা বলি না আন্টি।
কিচ্ছু বলেনি শুভ। নুহাকে শুধু ভেতরে যেতে বলল। নুহা চলে গেলে শুভ ওর ফুপ্পির সাথে রাতের ঘটনাটা শেয়ার করল।
হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে গেছে হিয়ার। ‘Oh, my god!’ একি শুনালি তুই? এটাও শুনার ছিল?
হাসছিল শুভও। হাসি থামিয়ে জবাব দেয়, বড় ইঁদুর বিছানায়’ই বসে ছিল। আমি সেটা জানতাম না। উৎ পেতে ছিল কখন রাত্রি গভীর হবে।
হাত ইশারায় হিয়ার জবাব, আর বলিস না বাপ। আমি আর পারছি না…..

সকালে স্কুলে যাচ্ছিল নুহা, পথ আগলে দাঁড়ালো আদনান। “আমু যাম, আমু যাম, আমু যাম….”
শুভ, আঁখি, হিয়া কিংবা ওর হাজবেন্ড কেউ পারেনি আদনানকে শান্ত করতে। কান্নাজড়িত কন্ঠে ওর একটাই জবাব, “আমু যাম, আমু যাম….!”
বাধ্য নুহা কোলে তুলে নেয় আদনানকে। কোলে উঠে কান্না করতে করতেই নুহার বোরকার মুখোশ ধরে টানতে থাকে আদনান। নুহা একটা সেফ্টিপিন খুলে আদনানকে ওর মুখ দেখায়। মিটে যায় আদনানের কৌতূহল, থেমে যায় কান্না। পাশ থেকে সেফ্টিপিনটা যথা স্থানে লাগিয়ে দেয় আঁখি। আদনানকে কোলে নিয়ে নিচে যেতেই দেখতে পায় রিক্সাওয়ালা দাঁড়িয়ে। বিলম্ব না করে নুহা রিক্সায় গিয়ে বসে।

মিনিট দশেক পর কাঙ্খিত স্থানে গিয়ে পৌঁছে নুহা। কোল থেকে আদনানকে নামিয়ে রেখে ভাড়া মিটিয়ে আদনানের ছোট আঙুল ধরে স্কুলের গেইট দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে।
বাচ্চা কোলে নিয়ে কমন রুমের কর্ণারের একটা ছোট্ট বেঞ্চিতে বসে ছিল নুহা। আলাপ জমে উঠেছিল দুজনের মধ্যে। পাশে এসে দাঁড়ায় কিছু মেয়েরা। পরিচিত হয় নতুন ক্লাসমেট নুহার সাথে। দৃষ্টি যায় আদনানের দিকে। আদনানের নিষ্পাপ চাহনি আর আধো আধো বুলি বিমোহিত করল ওদের। কোলে নেয়ার টানাটানি করতে থাকে মেয়েরা। কেউ কেউ তো আদনানের মাংসালু গোল গাল দুটো ধরে টানতে থাকে।
” আমু মারে, বলে চিৎকার দিয়ে উঠে আদনান।”
চমকে যায় মেয়েরা। প্রশ্ন করে নুহাকে,
– নুহা তুমি বিবাহিতা?
সম্মতি সূচক জবাবসরূপ মাথা ঝাকায় নুহা।
” ওয়াও! আমরা খালামনি হয়ে গেছি। ওলে বাবাটা আসো…..”
আবারো মেয়েরা টানাটানি করতে থাকে আদনানকে নিয়ে।

এভাবেই নুহা নতুন স্কুলের নতুন সহপাঠীদের সকলের কাছে প্রিয় হয়ে উঠেছিল। জুটিয়ে ফেলেছিল অনেকগুলো বান্ধবী।

নুহাদের ব্যাচে চল্লিশজন মেয়ে আর বিশজন ছেলে ছিল। বেশির ভাগ মেয়ে বোরকা পরত।

নবম শ্রেণীর ফার্স্ট বয় ছিল ‘মামুন’। একদিন মামুনকে ওর সহপাঠী মিনহাজ বলল, দোস্ত, ক্লাসে কয়েকজন সুন্দর মেয়ে আছে, লক্ষ্য করেছিস?
মামুন বলল, না।
পরদিন মিনহাজ মামুনকে তাদের দেখালো। তাদের মধ্যে একজনের চোখে মামুনের চোখ স্থির হয়ে গেল। পর্দা করার কারণে তার চেহারা দেখার উপায় ছিল না। চোখ দুটো ছিল অসাধারণ। সেই চোখ মামুনকে খুন করল। যেন নীরব ঘাতক। অনেকটা ইজিপটের রানি ক্লিওপাট্রার মতো। যার চাহনির কাছে হার মেনেছেন রোম সম্রাট সিজার ও পরে অ্যান্টনি। এমনকি অক্টোভিয়া যখন ক্লিওপাট্রার সঙ্গে কথা বলতেন তখন মেঝের দিকে চোখ রেখে কথা বলতেন। তার ধারণা ছিল, তিনি যদি ক্লিওপাট্রার চোখের দিকে তাকান, তবে সঙ্গে সঙ্গে তার সব শক্তি নিঃশেষ হয়ে যাবে।

কিছুদিন যাওয়ার পর মামুনের মনে হলো সে যেন কিছু হারিয়ে ফেলেছে। হৃদয়ের প্রতিটি কোণে বোরকা পরা সেই মেয়েটির উপস্থিতি টের পাচ্ছিলো। মামুন বুঝলো, এরই নাম প্রেম। অনেক চেষ্টা করেও মামুন মেয়েটিকে তার ভালোবাসার কথা বুঝাতে পারেনি। চিঠি লিখে কাজিনের মাধ্যমে পাঠালো।
চিঠিতে লিখলোঃ-
“তোমাকে দেখার পর থেকে কিরকম পাল্টে গেল আমার আকাশ। সেখানে এখন শুধু চাঁদের বদলে তুমি উঠো, আর একটাই উঠে সন্ধ্যা তারা, সেও তুমি। বইগুলো খুলে দেখি সব গ্রন্থ জুড়ে শুধু এই একটাই শব্দ তাতে লেখা- তোমাকে দেখার পর অসম্ভব বদলে গেছে আমার ভুবন, বদলে গেছে জলবায়ু, দিন রাত্রি, ঋতু।”

চিঠিটা পৌঁছে দেয়া হলো নুহার হাতে। হ্যাঁ, নুহাই সেই মেয়ে, যার এক জোড়া চোখের কাছে হার মেনেছে একটি হৃদয়। চিঠি পড়ে নুহা খুব রাগ করল। মামুন ভয়ে ছিল, যদি প্রধান শিক্ষকের কাছে বলে দেয়। কিন্তু নুহা বলেনি। স্রস্টার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানালো মামুন, প্রথমবারের মতো বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্য।
ক্লাসে কিছুতেই মনোযোগ দিতে পারছিল না মামুন।

কয়েকদিন পর আবার কবিতা লিখে পাঠালোঃ-
” রাগ করে একটি কথাও যদি বলো
ফেনিল সাগরে আমি ঝাপ দেবো,
ঘৃণা করে একটি কথাও যদি বলো
সহস্র ঘুমের বড়ি একসঙ্গে খাবো।
আমি শুধু ভালোবাসা চাই মেয়ে
অন্য কিছু নয়।”

অনেক আশা করেছিল মামুন, নুহা পজিটিভ উত্তর দেবে। কিন্তু নুহা কোনো উত্তর দিলো না। খুব কষ্ট পেলো মামুন স্বপ্ন ভঙ্গ হতে দেখে।
এক প্যাকেট সিগারেট কিনে তখনি সাবাড় করল।
নুহার ক্ষতির কোনো চেষ্টা করল না। কেননা সে শুনেছে, যাকে ভালোবাসা যায়, তার ক্ষতি করা যায় না। কারণ, প্রিয়ার দেয়া কষ্টগুলো প্রিয়ার মতোই প্রিয়।

সামনে বার্ষিক পরীক্ষা। তাই পুরোদমে পড়াশুনা শুরু করলো মামুন। এমনও রাত গেছে, পড়তে পড়তে সকাল হয়ে যেত। একটুও ঘুমাতো না। যখন রাতে বিদ্যুৎ থাকতো না, তখন রাস্তায় ল্যাম্পপোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে পড়ত।

ডিসেম্বরের ৩১তারিখ রেজাল্ট বের হলো। চার নাম্বারের জন্য প্রথম হতে পারলো না মামুন। ১ম স্থান অধিকার করেছে নুহা।

দেখতে দেখতে অনেকগুলো দিন দিন অতিবাহিত হয়ে যায়। ঘনিয়ে আসে নুহার টেস্ট পরীক্ষার সময়। পূর্বেকার মতই বোরকা পরে, মুখ ঢেকে হলে উপস্থিত হয় নুহা। পরীক্ষা আরম্ভ হলো। স্কুলে নতুন যে শিক্ষকটি এসেছেন, ওনার গার্ড পরলো নুহাদের রুমে। খাতা সাক্ষরের সময় এডমিট কার্ডের সাথে নুহার মুখটা মিলিয়ে দেখতে চাইলে বাঁধ সাধে নুহা। ও কিছুতেই ওর এডমিট কার্ডের ছবি এবং ওর মুখ কোনো পর পুরুষকে দেখাতে রাজি নয়। রাগান্বিত শিক্ষক একসময় একটা জ্বালাময়ী মন্তব্য ছুড়ে দেয় নুহার দিকে। প্রশ্ন করে নুহাকে-
” তোমার ছবি কি তোমার জামাইরে দিয়ে উঠাইছো?”
স্তব্ধ হয়ে যায় নুহা। সেই সাথে নিস্তব্ধ হয়ে যায় পুরো রুম। সবার দৃষ্টি নুহার দিকে। নুহার চোখ দুটো ছলছল করে উঠে। তবুও অনেকটা স্বাভাবিক কন্ঠে শিক্ষককে জানায়, স্যার! আপনি মেডামকে বলেন। আমি ওনাকে মুখ দেখাচ্ছি। রাগে খাতা ছুড়ে দিয়ে পিছনে চলে যায় শিক্ষকটা। পিছনে গিয়ে অপর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মেডামকে জানায়, মেডাম, আপনি ঐ মেয়েটাকে একটু চেক করে আসুন।
মেডাম সামনে এসে দাঁড়ালে নুহা মেডামকে ওর কাছে ডেকে আনে। মুখটা আংশিক ফাঁক করে মেডাম বলে, “এই যে মেডাম! আমার এডমিট কার্ড আর আমি। মিলিয়ে দেখুন।”
স্মিতহাস্য মেডামের জবাব, ইটস ওকে। ঢাকতে পারো মুখ। কষ্ট পেয়ো না তুমি। আসলে এটা নিয়ম।
বিনীত ভঙ্গিতে নুহার জবাব, জ্বি, ম্যাডাম। বুঝতে পারছি আমি।

পাশ থেকে মামুনের জবাব, মেডামের ঐ স্যার কি হিন্দু? জিহ্বায় কামড় দেয় ম্যাডামটা। ধীর গলায় বলে, ‘আরে না! ওনি মুসলমান। ‘
দাঁতে দাঁত চেপে মামুনের জবাব, একজন মুসলমান হয়ে আরেকজন মুসলমানকে কিভাবে ওনি এমনভাবে আঘাত করতে পারলেন? মামুনের সাথে তাল মিলিয়ে অন্যান্য স্টুডেন্টসরাও একই কথা বলা শুরু করে।
কথা বাড়াননি মেডাম। কোনো মতে, দ্রুত সে স্থান পরিত্যাগ করেন।

(বিঃদ্রঃ- বাচ্চা মানুষ, বকা ঝকা দিও না বন্ধুরা। কেঁদে দেবো তাহলে। পরীক্ষা শেষ। পরের দুই পরীক্ষা একমাস পর হবে। তাই আশা করা যায়, আপনারা আপনাদের গল্প এখন থেকে নিয়মিত’ই পাবেন, ইনশআল্লাহ।)

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে