ফুলশয্যা_সিজন(০৩)
পর্ব- ০৫
লেখা- অনামিকা ইসলাম।
ছোট্ট আদনানকে কোলে নিয়ে স্বয়ং নুহা দাঁড়িয়ে। সেই নুহা যার সাথে শুভর পিকনিকে দেখা হয়েছিল।
চমকিত নয়নে শুভ তাকিয়ে আছে নুহার মুখপানে। আদনানকে বুকে চেপে ধরে নুহাও পরম বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে শুভর মুখপানে।
নিরবতা। ঘোর নিরবতা বিরাজ করছে। কারো মুখেই কোন কথা নেই। অথচ দুজনের মনেই ভিড় করে আছে অব্যক্ত সব কথারা।
ঘটনার আকস্মিকতায় রুমে প্রবেশ করে নীলিমার বান্ধবী ডাঃ হিয়া।
ওহ, তুই এখানে? আমি তো তোকে খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে গেছি।
ঘোর কাটে নুহার। দৃষ্টি নিয়ে যায় দরজার দিকে। পিছু ফিরে তাকায় শুভও।
‘একি! তুই গায়ে তোয়ালে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে কেন? যা, ফ্রেশ হয়ে আয়। আমি তো এসেই গেছি। আজ না হয় আমিই আদনানকে খাওয়াবো। আদিরা যা তুইও ফ্রেশ হয়ে আয়।’
চমকিত নয়নে শুভ ফিরে তাকায় ফুপ্পির পানে। কিছুটা টান টান কন্ঠে প্রশ্ন করে, আ…দিরা???
ক্ষাণিক হাসে হিয়া। ওহ, তোকে তো পরিচয় করানোই হয়নি। এ আমার একমাত্র বান্ধবী ডাক্তার নীলিমার মেয়ে আদিরা। যার আসার কথা কালকে রাত্রে তোদের বলেছিলাম।
বিস্ময়টা কাটেনি। তবুও স্বাভাবিক ভাবে শুভ ওর একটা হাত নুহার দিকে বাড়িয়ে দেয়। Hlw! I am Shuvo. Nice too meet you.
আদনানের পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে নুহার জবাব, আসসালামু আলাইকুম। আমি আদিরা মাহমুদ নুহা।
হাতটা ফিরিয়ে নেয় শুভ। অতঃপর সালামের জবাব দিয়ে ফের ওয়াশরুমের দিকে প্রস্থান করে।
নুহার দিকে এগিয়ে আসে হিয়া। দে, আদনানকে আমার কোলে দে। ওকে খাইয়ে দেই তাড়াতাড়ি। ততক্ষণে তুই ফ্রেশ হয়ে নে। তোদের খাইয়ে দিয়ে আমার আবার চেম্বারের দিকে যেতে হবে।
আদনানকে হিয়ার কোলে দিয়ে নুহা চলে যায়।
মিনিট দশেক পর ফিরে আসে নুহা। বিছানায় বসিয়ে আহ্লাদী স্বরে কথা বলতে বলতে হিয়া আদনানের মুখে খাবার তুলে দেয়ার বৃথা চেষ্টা করছে।
বৃথা চেষ্টা বললাম কারণ এখন অবধি হিয়া পারেনি আদনানের মুখে খাবারের এতটুকু অংশ তুলে দিতে। পাশে এসে বসে নুহা। প্রশ্ন করে হিয়াকে, আন্টি বাবুর মা কোথায়?
নুহার দিকে একবার তাকিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয় হিয়া। আদনানকে খাওয়ানোর বৃথা চেষ্টা করতে করতে বলে, যা বলছিস তো বলছিস’ই! সাবধান এ কথা যেন শুভর সামনে না বলা হয়।
চোখ বড় বড় করে হিয়ার মুখপানে তাকায় নুহা। প্রশ্ন করে আবারো, কেন আন্টি? বললে কি হবে?
আশপাশটা একবার ভালো ভাবে দেখে চাপা গলায় হিয়ার জবাব, আদিরা! আস্তে। তোকে বলেছিলাম না আমার এক ভাইপুর কথা। যার বউ ২মাসের ছোট্ট বাচ্চাকে রেখে ব্যাংক ম্যানেজারের সাথে পালিয়ে গেছে? এ সেই বাচ্চা। ওর এখনকার বয়স ১বছর ৬মাস।
মায়াবী চাহনীতে নুহা আদনানকে দেখছে। তারপর অনেকটা ভেঁজা গলায় বলে উঠে, আহারে! এমন দুধের শিশুদের রেখে মানুষ কিভাবে এসব করতে পারে? এদেরকে কি দিয়ে গড়েছে আল্লাহ? এমন একটা বাচ্চাকে রেখে চলে যাওয়ার সময় একটুও বুক কাঁপেনি ঐ মহিলার? আচ্ছা, আন্টি আপনার ভাইপু আশিক কোথায়? আসার পর থেকে দাদীমা আর শুভ ভাইকে ছাড়া তো আর কাউকে দেখলাম না।
প্রশ্নোত্তরে হিয়ার জবাব, শুভ’ই আশিক। আশিক আহমেদ শুভ।
স্তব্ধ হয়ে যায় নুহা। চমকিত নয়নে ফিরে তাকায় খাটে বসে থাকা আদনানের মুখপানে। প্রশ্ন করে হিয়াকে, মামমমমমমানে? আদনানের বাবা শুভ?
নির্লিপ্ত গলায় হিয়ার জবাব, হ্যা! আশিকের(শুভ) ছেলে আদনান।
বসা থেকে উঠে পড়ে নুহা। নিঃশব্দে প্রস্থান করে রুম থেকে।
দুপুরে টেবিলে খেতে বসেছিল শুভ। রুমে ঢুকে আঁখি। কাঁধ থেকে কলেজ ব্যাগটা খুলে ছুঁড়ে মারে ড্রয়িংরুমের সোফায়। প্রশ্ন করে শুভকে, ভাইয়া! আমাদের বাসায় আজ না নতুন অতিথি আসবে?
শুভ ফিরে তাকায় ফুপাতো বোন আঁখির দিকে। ভ্রু- কুচকে প্রশ্ন করে, তো?!
রেগে যায় আঁখি। তো মানে? কি বলেছিলাম রাত্রে? নতুন অতিথি আসলে সবাই মিলে একসাথে লাঞ্চ করব। তুমি আগে আগে খেয়ে উঠছ যে?
পানি খেয়ে গ্লাসটা যথা স্থানে রেখে শুভর জবাব, এসেছে। নতুন অতিথি এসে গেছে। কিন্তু অতিথি এখন খাবে না জানালো। আমাকে খাবার দিয়ে ফুপ্পিও তাই চলে গেছে চেম্বারে। যা। ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নে।
ওহ, আচ্ছা বলে মন খারাপ করে রুমে চলে যায় আঁখি।
রাত্রের খাবারের পর চুপিচুপি শুভ নুহার দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। নক করে দরজায়। দরজা খুলে আঁখি। ঘাবড়ে যায় শুভ।
“কি, কিছু বলবা?”
ইতস্তত শুভ ঘুরে দাঁড়ায়। ইয়ে, না মানে আদনানকে পাচ্ছি না তো। তাই দেখতে এলাম তুই এনেছিস কি না…..!
চলে যাচ্ছিল শুভ, পিছন থেকে আঁখির জবাব- ভাইয়া! আদনান মনে হয় ছাদে নুহার সাথে গল্প করছে।
শুভ নিঃশব্দে হেঁটে হেঁটে ছাদে গিয়ে হাজির হয়। দেখতে পায় নুহাকে। নুহা ওর গায়ের ওড়না দ্বারা আদনানের পুরো শরীর ঢেকে ছাদের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে হাঁটাহাঁটি করছে। হালকা ঝাকুনির সাথে আদনানের পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর ছড়া বলছে। ছড়া শুনতে শুনতেই একসময় ঘুমিয়ে যায় আদনান।
“ঢাকা শহরে প্রচন্ড শীত পরেছে। শীতে রীতিমত জমে যাচ্ছে মানুষজন। কারো কারো তো ঠান্ডায় গলা জমেও গেছে। আর তুমি কি না সেই শীতের মধ্যে এ ছোট্ট বাচ্চাকে নিয়ে এখানে হাঁটাহাঁটি করছ?”
থমকে দাঁড়ায় নুহা। ভয়ে ভয়ে পিছনে ফিরে তাকায়। ‘ইয়ে! আমার তো একটুও শীত করছে না।’
কিছুটা ধমকের স্বরে শুভর জবাব, কোথায় তুমি আর কোথায় ও? কিসের সাথে কিসের তুলনা দিচ্ছ? দাও। ওকে আমার কোলে দাও।
ভয়ে ভয়ে নুহা আদনানকে শুভর কোলে তোলে দেয়।
কিছুটা রাগান্বিত কন্ঠে শুভর প্রশ্ন, কি হলো? ওড়নাও কি দিয়ে দিবে নাকি?
ওড়নাটা টেনে এনে, গায়ে জড়িয়ে নেয় নুহা। অতঃপর মাথা নিচু করে ছাদ থেকে নেমে যায়।
সপ্তাহখানেক পরের ঘটনা_
শুভ আপ্রাণ চেষ্টা করছে আদনানকে খাওয়ানোর জন্য কিন্তু পারছে না। যতবার মুখে খাবার তুলে দিচ্ছে ততবার আদনান মুখ থেকে খাবার বের করে ফেলে দিচ্ছে। রেগে যায় শুভ। ধমক দেয় আদনানকে। ঠোঁট ভেঙ্গে কাঁদতে থাকে আদনান।
ছুটে আসে আঁখি। কোলে তুলে নেয় আদনানকে। ভাইয়া মারছ কেন?
– মারছি না, ধমক দিয়েছি।
— সেটাই বা দিবা কেন?
– কখন থেকে বলছি খা, খা! খাচ্ছে না। যা মুখে দিচ্ছি, ফেলে দিচ্ছে সব। এদিকে আমার আবার একটা কোম্পানিতে চাকরীর ইন্টারভিউয়ের জন্য যেতে হবে।
— মানে? কোম্পানিতে জব মানে? তুমি না কলেজে জব করতা?
– করতাম। তবে সেটা গেস্ট টিচার হিসেবে।
— ওহ, আচ্ছা! তুমি যাও তাহলে। তোমার তো মনে হয় লেট হয়ে যাচ্ছে।
– কিন্তু ও যে খাচ্ছে না। ওকে না খাইয়ে আমি যাই কি করে? দে, আরেকবার ট্রাই করে দেখি।
শুভ আঁখির কোল থেকে আদনানকে নিয়ে ছোট্ট চেয়ারে বসায়। তারপর পিঠে হাত বুলিয়ে খাবার মুখের সামনে নিয়ে অত্যন্ত আদুরে গলায় বলে- আমার লক্ষ্মী বাবা, আমার সোনা বাবা। খাও। খেলেই তোমায় আমি ফোনে গান দেখাবো।
আরো জোরে জোরে কেঁদে দেয় আদনান। পূর্বের ন্যায় লালার সাথে মুখ থেকে খাবারগুলো বের হয়ে দেয়।
অধৈর্য্য হয়ে যায় আঁখিও। ভাইয়া! এ তো আজকে গানের কথা শুনেও শান্ত হচ্ছে না। এদিকে আম্মুর হাতেও খায়নি। কি চাচ্ছেটা কি তোমার ছেলে?
দরজার সামনে এসে দাঁড়ায় নুহা। নুহাকে দেখে কান্না থামিয়ে দেয় আদনান। চেয়ার থেকে নেমে পিলপিল করে হেঁটে আদনান পৌঁছে যায় নুহার কাছে। আমু টাত খাম, আমু টাত খাম বলে নুহার আঙ্গুল ধরে টানতে থাকে আদনান।
টানতে টানতে চেয়ারের কাছে নিয়ে যায়। তারপর নিজে নিজেই চেয়ারে উঠে বসে। নুহা দাঁড়িয়ে আছে চেয়ারের পাশেই।
ছোট্ট আদনান ফিরে তাকায় নুহার মুখপানে। আদো আদো বুলিতে আবারো বলতে থাকে, আমু টাত খাম। আমু টাত খাম।
বিলম্ব না করে হাতটা ধুয়ে ভাত মেখে নুহা বসে পরে আদনানের চেয়ারের পাশে। এগিয়ে দেয় ভাত আদনানের মুখের দিকে। পরম তৃপ্তি সহকারে আদনান প্লেটের সবগুলো ভাত খেয়ে নেয়। হাত মুখ ধুতে যাবে তখনি আদো আদো বুলিতে আবারো বলে উঠে, টাত খাম। আমু টাত খাম।
নুহা অল্প কিছু ভাত নিয়ে মাছ দিয়ে মেখে এগিয়ে দেয় আদনানের দিকে। এবার আদনান কোন কথা ছাড়া’য় নিজ হাতে ভাতগুলো খেয়ে নেয়।
শুভ এবং আঁখি ২ভাই বোন এ হেন ঘটনায় একে অপরের দিকে বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
নুহা…. মেয়েটাই এরকম। অতি সহজে মানুষকে নিজের মায়ায় ফেলে দেয়ার ক্ষমতা রাখে। অদ্ভুত সে মায়া। যে মায়া থেকে বেরিয়ে আসার সাধ্য কারো নেই। ছোট্ট আদনানেরও তাই হয়েছে। মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে আদনান নুহা ভক্ত হয়ে যায়। জড়িয়ে যায় নুহার মায়ায়। আজকাল শুভ নয় নুহার সাথেই সময়
কাটাতে পছন্দ করে আদনান। বিষয়টা শুভকে ভাবিয়ে তুলে। সেদিন আর বাহিরে কোথাও যায়নি শুভ। ইজি চেয়ারে গা এলিয়ো দিয়ে বসে আছে শুভ। নিশ্চুপ শুভ ভাবছে গত হয়ে যাওয়ার দিনগুলোর কথা। ফারহানা চলে যাওয়ার পর ভেঙ্গে পড়েছিল একদম। দীর্ঘ ছ’মাস লেগেছে নিজেকে গুছাতে। নিজের স্বপ্নগুলোকে নতুন করে সাজাতে।
হ্যা, নতুন স্বপ্ন। শুভ চেয়েছিল একমাত্র ছেলে আদনানকে বুকে জড়িয়ে বাকি সময়টা কাটিয়ে দিতে। শুভ চেয়েছিল একজন আদর্শ বাবা হতে।
আজ কেন জানি মনে হচ্ছে ওর স্বপ্নগুলো একটু একটু করে সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এরকম মনে হওয়ার কোন যুক্তিসংগত কারণ শুভ খুঁজে পাচ্ছে না।
এক দুপুরবেলার ঘটনা বলছি_
শুভ খাবার টেবিলে খেতে বসেছিল আদনানকে নিয়ে। কিন্তু কিছুতেই শুভ আদনানকে খাওয়াতে পারছে না। ওর এক কথা। ও নুহার সাথে খাবে। না হয় কিছুতেই খাবে না। রাগে একটা থাপ্পর মারে শুভ আদনানকে। ভ্যাঁ, ভ্যাঁ করে কাঁদতে কাঁদতে আদনান নুহার রুমের দিকে চলে যায়।
আদনান চলে যাওয়ার পর ভাতের প্লেটটা ধাক্কা দিয়ে ফ্লোরে ফেলে দিয়ে শুভ রুমে চলে যায়। রুমে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠে শুভ। ‘নুহা, নুহা, নুহা। খাইতে, বসতে, ঘুমুতে সব জায়গায় ও। কি পেয়েছেটা কি ঐ মেয়ে? কি চায় ও? কেন আমার ছেলেকে এভাবে দখলে নিয়ে যাচ্ছে? না, আর বসে থাকলে চলবে না। আমার জানতে হবে।’
শুভ নুহার রুমের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। বন্ধ দরজা ধাক্কা দিতেই মেলে যায়। উত্তেজিত শুভ কিছু একটা বলতে যাবে তখনি ‘থ’ হয়ে যায়। ফ্লোরে জায়নামাজে বসে নুহা যোহরের নামাজ শেষে মোনাজাত করছে। আর ঠিক সেরকমভাবেই ২বছরের ছোট্ট আদনান জায়নামাজের সামনে বসে মোনাজাতের ভঙ্গিতে হাত দুটো উঁচু করে রেখেছে।
চলবে….